Sunday, January 28, 2018

মুসলিম নারীর মেহরাম ছাড়া হজযাত্রার অধিকার মুক্তিযাত্রার সামিল

সবেই (২৯.১২.১৭) তাৎক্ষণাৎ তিন তালাকের খাঁড়া থেকে মুসলিম নারীদের বাঁচাতে লোকসভায় একটি বিল পাস করিয়ে নিয়েছেন। রাজ্যসভায় এখনো পেশ করা বাকি (পেস করার কথা আগামী মঙ্গলবার, ০২.০১.২০১৮)। এর মধ্যেই  আবার গতকাল (১লা জানুয়ারী) তিনি মুসলিম নারীদের জন্যে আর একটি মস্ত বড়ো পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেনতিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পদক্ষেপটি হলো  হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের প্রতি  বহু যুগ ধরে চলে আসা বৈষম্যের অবসান ঘটানো নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে হজে যাওয়া বাধ্যতামূলক সকল সামর্থবান (আর্থিক ও শারিরীক দিক থেকে) মুসলমানদের জন্যে।  হজে যাওয়া বাধ্যতামূলক হলেও   মুসলিম নারীদের একাকী হজে যাওয়ার অনুমতি নেই। হজে যেতে পারবে যদি সঙ্গে তাদের বর কিংবা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন পুরুষ অভিভাবক থাকে। বর (স্বামী) ছাড়া যে পুরুষ মুসলিম নারী হজযাত্রীর সঙ্গী হতে পারবে তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘মেহরাম’ বলে। হজের বিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ‘মেহরাম’ ছাড়া মুসলিম নারী হজে যেতে পারবে না।         
হজে যেতে প্রবল ইচ্ছুক কোনো অবিবাহিত মুসলিম নারী, কিংবা কোনো বিধবা নারীর যদি মেহরাম  হওয়ার উপযুক্ত কোনো পুরুষ না থাকে  তাহলে তিনি কী করবেন?  কিংবা কোনো সধবা নারীর বর যদি পঙ্গু হয় এবং তার যদি মেহরাম হবার উপযুক্ত অন্য কোনো পুরুষ অভিভাবক না থাকে, কিংবা থাকলেও তাকে সঙ্গে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ যদি তার না থাকে তবে সেই নারী কী করবেন?  এর উত্তর একটাই, এ রকম মুসলিম নারী হজ করা থেকে বঞ্চিত হবেন। হজ করা থেকে বঞ্চিত মানে, হজ করার নেকী (পূণ্য) থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। এটা যে নারীর প্রতি একটা  বড়ো বৈষম্য তা বলা বাহুল্য। প্রধানমন্ত্রী বৈষম্যমূলক এই নিয়মটির অবসান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তারজন্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীকে  প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশও প্রদান করেছেন। 
সৌদি আরবের বেঁধে দেওয়া কোটা অনুযায়ী ভারত থেকে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সর্বাধিক এক লক্ষ সত্তর হাজার মুসলমান হজে যেতে পারেনকিন্তু যেহেতু হজে যাওয়ার জন্যে মুসলমানদের ব্যাকুলতার অন্তহীন, তাই হজযাত্রার জন্যে আবেদন পত্র জমা পড়ে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার আবেদনকারীদের মধ্যে লটারী করে হজযাত্রীদের তালিকা তৈরী করে থাকে।  প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এবার যে ১৩০০ জন নারী ‘মেহরাম’ ছাড়া একাকীই হজে যাওয়ার আবেদন করেছেন তাঁদের সকলকে লটারীর নিয়মের বাইরে রেখে বিশেষ শ্রেণীর মর্যাদা দিয়ে হজে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
মক্কা ও মদীনা মুহাম্মদের জন্মভূমি ও কর্মভূমি জিহাদেরও পবিত্র(!) ভূমি। স্বভাবতই মুসলমান মাত্রই সকলের মনের মধ্যেই হজ করতে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ ও আকাঙ্খা থাকেথাকে প্রবল বাসনাও। বাসনা থাকে তাদের প্রিয় নবী এবং তাঁর সাহাবী সহযোদ্ধাদের সমাধিগুলো এবং তাঁদের  স্মৃতিবিজড়িত দ্রষ্টব্য স্থানগুলি স্বচক্ষে ঘুরে ঘুরে দেখার ও স্পর্শ করার। সেই আকাঙ্খা ও বাসনা বহুগুণ তীব্রতা লাভ করে বেহেস্তের মহালোভ ও দোযখের (নরকের) মহাভয়ের কারণেকারণ, তাদের মহানবী বলে গিয়েছেন যে হজ করলে সব পাপ মুছে যাবে এবং বেহেস্তবাসী হবে, আর সামর্থবানরা যদি হজ না করে তবে মৃত্যুর পর তাদের দোযখের আগুনে অনন্তকাল পুড়ে মরতে হবে। তাই অসামর্থবানরাও যাদের হজ করতে যাওয়া ফরজ (বাধ্যতামূলক) নয়  - অবশ্য হজে  যেতে তাদের মানাও নেই - বিপুল সংখ্যায় হজ করতে যেতে চায়যায়ও তাই নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানই জীবনে অন্ততঃ একবার হজ করতে যাওয়ার বাসনা যাতে পূরণ হয় তার জন্যে তারা আল্লাহ্‌র কাছে জীবনভোর প্রার্থনা করে। যারা একবার হজ করে আসে তারা আর একবার, বারবার, হজে  যেতে চায়। হজে যাওয়ার এই তীব্র বাসনা পূরণ করার অধিকার আছে চোর, ডাকাত, দস্যু, বাটপার, লম্পট, সুদখোর, চাঁদাবাজ, ধোঁকাবাজ, জুলুমবাজ, ইত্যাদি সকল শ্রেণীর পুরুষ মুসলমানেরই। অধিকার আছে  সকল মুনাফেক পুরুষ মুসলমানেরও, কিংবা যারা মক্কা ও মদীনাকে স্রেফ ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থান বলে মনে করে সেই শুধু নামধারী মুসলিম পুরুষদেরও। এমনকি আল্লাহ্‌র শত্রু ইহুদি, খৃস্টান ও মুশরিকদেরও (অংশীবাদীদেরও) কর্মসূত্রে মক্কা ও মদীনা যাওয়ার অনুমতি ও অধিকার আছে। কিন্তু  মুসলিম নারীদের একাকী হজ করতে যাওয়ার অধিকার নেইএ যে মুসলিম নারীর প্রতি কতো বড়ো বঞ্চনা, বৈষম্য ও অবিচার তা ভাষায় প্রকাশ  মানুষের সাধ্যের অতীত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এই  পদক্ষেপটিকে নারীর প্রতি বৈষম্য ঘটানোর শুধু একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে শুধু দেখলে ভুল হবে। এটা তার চেয়ে অনেক বড়ো বিষয় এর মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতের মুসলিম নারীর একটি মস্ত বড়ো অধিকারওএই ন্যায্য অধিকার থেকে তারা এতদিন বঞ্চিত ছিলো। সৌদি আরব তিন বছর আগেই এই বৈষম্যটির অবসান করেছে। সৌদি আরবের পথ ধরে অনেক মুসলিম দেশও তাই করেছে। কিন্তু ভারতে মুসলিম নারীদের প্রতি সেই বৈষম্যমূলক নীতি বহালই ছিলো। ভারতের বুকে কেউ এটা তুলে দেওয়ার দাবি জানায় নি। প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব উদ্যোগেই হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বৈষম্যমূলক আইনটির অবসান ঘটালেন। হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদেরকে এই যে পুরুষদের সমান  অধিকার প্রদান করা হলো, মুসলিম সমাজে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। এর ফলে মুসলিম নারীদের হাত অনেক শক্ত হবে, তাদের  মনোবল আরো দৃঢ় হবে, তারা তাদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও সমানাধিকার অর্জন করার লড়াইকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করতে পারবে 
মুসলিম সমাজের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো যে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকার মুসলিম সমাজের পক্ষে কল্যাণকর কোনো কাজ করতে পারে। অনুরূপ  ধারণা বদ্ধমূল ছিলো এবং এখনও বিদ্যমান রয়েছে অমুসলিমদের মধ্যেওএতে কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, আরএসএস ও বিজেপির যা দর্শন তাতে এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিককিন্তু তিন তালাক আইন বাতিল করতে চেয়ে লোকসভায় বিল পাশ করার ঠিক পরপরই মেহরাম ছাড়াই মুসলিম নারীগণ হজে যেতে পারবেন এমন আইন প্রণয়ন করায় নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে সেই ‘অসম্ভব ব্যাপার’টিতে কিছুটা পরিবর্তনের আভাষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মুসলিমদের মধ্যে একটা অংশ, বিশেষ করে নারী সমাজ, ইতিমধ্যেই মনে করতে শুরু করেছে যে, নরেন্দ্র মোদি সত্যি সত্যিই মুসলিম মহিলাদের দুঃখ-কষ্ট ও নিরাপত্তাহীনতা লাঘব করতে, তাদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে এবং তাদের কিছুটা হলেও ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করতে আগ্রহী। মুসলিম মহিলাদের দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা লাঘব করতে চান বলে তিনি যা প্রায়শঃই বলেন তা নেহাতই কথার কথা নয়। মুসলিম নারী সমাজ যে সত্যিই এরূপ ধারণা পোষণ করেন তা কারো কোনো কষ্ট-কল্পনা নয়। তাঁরা (মুসলিম মহিলারা) রাস্তায় নেমে প্রকাশ্যেই তাদের মতামত এখন ব্যক্ত করছেন। তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করার আইনই হোক, কিংবা ‘মেহরাম’ বাতিলের আইনই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে মুসলিম নারীরা শয়ে শয়ে রাস্তায় নেমে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানিয়েছেন,  তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।  এই নারীদের মধ্যে যেমন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার নির্ভিক প্রতিবাদী নারীরা রয়েছেন, তেমনি সাধারণ নারীরাও রয়েছেন। খোলা মনে এবং শোনার আগ্রহ নিয়ে বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় মুসলিম নারীদের মনে আজ কী খুশীর লহর বইছে।  দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বজবজের সন্তোষপুরের ষাটোর্ধ মুসলিম রমণী সামশুন্নেহার  মহানন্দে হজযাত্রার প্রস্তুতি সারছেন। যারা তাঁর একা যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “বয়স ছাড়া তাদের আর কী আছে যা আমার নেই? বিপদ যদি ঘটে তারা থাকলেও আটকাবে না।” একা যেতে সত্যি ভয় করছে না? তিনি বলেছেন, “ একদমই না। আমি যে পারি সেটা প্রমাণ করার সুযোগই পাইনি এতদিন।”  সামসুন্নেহারের মতো একই আনন্দঘন অনুভূতি নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার আর এক মহিলা হজযাত্রী, খাদিজা বেওয়া। তাঁর বয়সও এখন ৬৫, স্বামী মারা গেছে এক যুগ আগে ২০০৫ সালে।  তিনি একই সঙ্গে খেদ ও খুশী প্রকাশ করেছেন এভাবে,  “এর আগে মেয়েদের দলে দিল্লি ও আজমের গিয়েছি ধর্মের টানে। কিন্তু দেশের বাইরে? ভাবতেই পারতাম না। এবারও হজে যাচ্ছি ধর্মের টানেই, কিন্তু বাড়ির বাইরে সব দায়িত্ব আমার  নিজের, এটা কম বড় কথা? একটাই আফশোস, বয়স এখন ৬৫, সুযোগটা আরো আগে পেলে ভাল হতো।”  নিজের মতো করে ভাববো এটা ভেবে ভীষণ উত্তেজিত আর এক হজযাত্রী মরজিনা বিবিও। মুর্শিদাবাদ জেলার রাধাকান্তপুরের এই রমণীর কণ্ঠেও আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি ঝরে পড়তে দেখা যায় প্রচণ্ড খেদ ও ক্ষোভও তিনি জানান,  “মনে পড়ে যাচ্ছে মেহরাম পাওয়া যায়নি বলে কত মহিলার যে হজে যাওয়ার ইচ্ছাটা পুরণ হয়নি। মারাও গিয়েছেন অনেকেই।”
মোল্লা-মুফতি ও মুসলিম সমাজের মাতব্বররা মোদিজির এই সিদ্ধান্তে যে বেজায় ক্ষুব্ধ তা বলা বাহুল্যমোল্লা-মুফতিগণ তৎক্ষণাৎ হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, আল্লাহর আইনে হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবো না। পরক্ষণেই অবশ্য একটু গলা নামিয়ে বলেছেন যে এটা অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত এবং এর বিরুদ্ধে তাঁরা আদালতে যাবেন। অন্যদিকে মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী ও মাতব্বরগণ নানা অপযুক্তি খাড়া করে মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। বলছেন যে নরেন্দ্র মোদি মুসলিম নারীদের বিপাকে ফেলার জন্যে একটি ভালো আইনে পরিবর্তন এনেছেন। কী রকম বিপাক? যেমন এ কে এম ফারহাদ, রাজ্য হজ কমিটির সদস্য, বলেছেন, “ধরুন, আমার মা কিংবা স্ত্রী একা হজে যাবেনসব ঠিকঠাক থাকলে অসুবিধা নাই। কিন্তু যদি তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন তা হলে কী হবে?” এটা যে স্রেফ অজুহাত  তা মুখের উপরেই বলে দিয়ে তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন মুসলিম নারীরাইমুর্শিদাবাদ জেলার গোকর্ণের নাজমা বিবি কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মেটিয়াবুরুজের ফতেমা বিবির পাল্টা প্রশ্ন, “মেহরাম কি অসুস্থ হতে পারে না?” নাজমা ও ফতেমারা একা যাচ্ছেন না। পাড়া বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে থেকে তাঁরা তিন/চার জন মহিলাকে সঙ্গী করে নিয়ে দল বেঁধে হজে যাচ্ছেন। সেটা আইনের গ্যাঁড়াকল মানার জন্যে, ভয়ে মোটেই নয়। এই মহিলারাই প্রশ্ন তুলেছেন, ৪৫ বছরের কম বয়সী মহিলারা কেন এ সুযোগ পাবে না। মহিলাদের এই উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস দেখে রহিমা খাতুন, যিনি  মুসলিম নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন, বলেছেন, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার প্রশ্নে আমরা আর এক ধাপ এগোলাম।   
উপরের নারী চরিত্রগুলি কাল্পনিক চরিত্র একদমই নয়, এবং তাঁদের সংলাপগুলিও এই লেখকের মনগড়া নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই বাস্তব ও জীবন্ত চরিত্রমেহরাম ছাড়াই কবে হজের উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে পা রাখবেন সেদিনটির জন্যে প্রহর গুণছেন। হঠাৎই পুরুষের লেজুড় না হয়ে একাকী হজে যাওয়ার সুযোগ উপলব্ধ হওয়ায় মুসলিম নারীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার সন্ধান করতে বেরিয়ে পড়েছিলো কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যম। বাংলার সে রকম একটি বহুল প্রচারিত সংবাদ পত্র মুসলিম নারীদের এই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও অভিব্যক্তিগুলি তুলে ধরেছে সংক্ষেপে। (সূত্রঃ    http://www.anandabazar.com/state/they-found-proper-freedom-in-travelling-alone-for-hajj-pilgrimage-1.740363?ref=hm-ft-stry-4) সামশুনেহার, খাদিজা, মরজিনা, নাজমা, ফতেমা,  রহিমা খাতুন প্রমুখ নারীগণ কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন চরিত্র নয়। এঁরাই মুসলিম নারীসমাজের আসল প্রতিনিধি যাঁদের কাছে শরিয়া আইন কী বলছে সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো তাঁদের কাছে তাঁদের নিজস্ব অধিকার ও স্বাধীনতা। এই নারীগণই যে মুসলিম সমাজের আসল মুখপত্র তার প্রমাণ মেলে এই দুটি তথ্য থেকেএক). মেহরাম ছাড়া হজে যাওয়ার বিধান ছিলো না জেনেও ১৩০০ জন মুসলিম নারী হজে যাওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। এই আবেদনের মাধ্যমেই তাঁরা দুটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন). হজ্জ্বে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যে বঞ্চনা ও অবিচার রয়েছে তার অবসান তাঁরা চান। খ).  শরিয়তি বিধানের অনুশাসন ও নারী স্বাধীনতার মধ্যে দ্বিতীয়টাই তাঁদের পছন্দ। দুই). মেহরাম ছাড়াই মহিলারা হজে যেতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই কলকাতা-সহ সারা রাজ্য থেকে মুসলিম নারীদের হজে যাওয়ার বহু আবেদন জমা পড়েছে। রাজ্য হজ কমিটির একজন মুখপত্র জানিয়েছেন যে মুসলিম নারীদের কাছ থেকে এতো সাড়া আসবে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি(সূত্রঃ ঐ) যা কল্পনাতীত ছিলো তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে এ জন্যে যে, মুসলিম নারী মেহরাম ছাড়া হজযাত্রার অধিকারকে তাঁদের মুক্তিযাত্রা বলে মনে করছেন। যারা মানুষের মনের কথা সোচ্চারে বলতে পারে তারাই তো মানুষের প্রতিনিধি। সুতরাং যে নারীরা প্রথম হজ্জ্বে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন এবং যাঁরা সর্বপ্রথম হজ্জ্বে যাচ্ছেন তারাই তো মুসলিম নারীদের আসল প্রতিনিধি।   
মুসলিম নারীদের এই আনন্দ ও উচ্ছ্বাসকে কটাক্ষ করছেন মুসলিম সমাজের অনেকেই। তারা বলছেন যে, এরা মুর্খ নারী, নারীদের মেহরাম ছাড়াই হজে পাঠাবার অনুমতি দেওয়ার পেছনে মোদির যে নিশ্চয়ই কোনো গভীর দূরভিসন্ধি আছে তা বোঝার ক্ষমতা এদের নেই। এই মহাপণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মেহরাম’ ছাড়াই মুসলিম নারীদের হজ ও উমরা (ছোট হজ) করার অধিকার দেওয়ার আগে ও পরে যথাক্রমে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান’কে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ বলে চিহ্নিত করে বিল প্রণয়ন করেছেন ও সংসদে পাশ করিয়েছেন এবং হজে ভর্তুকি তুলে দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী জানিয়েছেন যে মাদ্রাসা বোর্ড তুলে দেওয়া হবে এবং মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ করা হবে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলের দুই নেতা মোদি ও যোগী কর্তৃক গৃহীত এই পদক্ষেপগুলির প্রত্যেকটিই যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিকতাঁদের এই কাজগুলি যে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের পক্ষে প্রভূত মঙ্গলময় ও কল্যাণকর হবে  তা নিয়ে তর্ক করার কোনো অবকাশ নেই। এটা ঠিক যে নরেন্দ্র মোদি ও আদিত্যনাথ যোগি সরকারে আসার পর এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে যেগুলি মুসলিমদের নিরাপত্তার কাছে হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। বিপদের এই দিকটাকে খেয়ালে রেখেও  একথা বলতে চাই যে, তাঁদের শাসনকালে মুসলিম সমাজের যতোটা অমঙ্গল ও ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা তৈরী হয়েছিলো পরিস্থিতি ততোটা খারাপ হয়নি। বরং বলা যায় যে, তাঁদের ক্ষমতার যুগলবন্দি মুসলমানদের পক্ষে শাপে বরই হয়েছে।   
আর দু’টি বিষয় উল্লেখ করে নিবন্ধটির যবনিকা টানবো।
এক). তথাকথিত ডান বা বাম ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সরকার ক্ষমতায় থাকলে কি মুসলিম নারীগণ একাকী ও স্বাধীনভাবে হজে যাওয়ার অধিকার পেত? ডান অর্থে কংগ্রেস, আরজেডি, সপা, বহুজন সমাজ পার্টি এবং বাম অর্থে মূলতঃ সিপিআই(এম)  ও সিপিআই এই দুটি  কম্যুনিস্ট পার্টকে বোঝানো হয়েছে। এই দলগুলিই বরাবর নিজেদের ভারতের সংখ্যালঘুদের (মুসলমানদের) একমাত্র স্বার্থরক্ষাকারী স্বঘোষিত ঠিকাদার বলে দাবী করে আসছে। কিন্তু এরা ক্ষমতায় থাকলে মুসলিম নারী যে সে অধিকার পেতো না তা দুধের শিশুও জানে। দুই). মুসলিম সমাজ যারপরনাই বিভ্রান্ত এই প্রশ্নে যে মুসলিম নারীদের হজে যাওয়ার কোন বিধানটা (আগেরটা না পরেরটা) ইসলাম সম্মত? ইসলামের পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিধানগুলিকে মোল্লা-মুফতিদের মনগড়া বিধান বলে প্রচার করার একটা সংস্কৃতি চালু আছে মডারেট মুসলিম সমাজে। এটা নিঃসন্দেহে একটা কুৎসিৎ সংস্কৃতি কারণ, মোল্লা-মুফতিরা কখনোই জ্ঞানতঃ মনগড়া ফতোয়া বা বিধি তৈরী করেন নাযারা মডারেট মুসলিম সমাজের কলমেই আস্থাশীল এবং ইসলাম হলো শ্রেষ্ঠ ও চির আধুনিক ধর্ম বলে অহংকার বোধ করেন তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলতে চাই যে, ‘মেহরাম’ ছাড়া নারী হজে যেতে পারবে না এই নারীবিরোধী বিধানটি সম্পূর্ণ কোরান সম্মত বিধানকোরানের আহযাব সুরার তেত্রিশ নম্বর (৩৩/৩৩) আয়াতে স্পষ্ট বিধান হলো  মুসলিম নারীদের ঘরের কোণেই আবদ্ধ থাকতে হবে। সেই আয়াতটি হলো –
·         তোমরা সকলে আপন আপন গৃহকোণে স্থিতি করিতে থাক ও পূর্বতন মূর্খতার বেশ-বিন্যাসের ন্যায় বেশ-বিন্যাস করিও না।’
এই আয়াতের ভিত্তিতেই শরিয়তি বিশেষজ্ঞদের প্রণয়ন করা বিধিটি হলো,
·         “মুসলিম নারী একাকী একদিক্রমে তিন দিনের বেশী বাড়ির বাইরে থাকতে, কিংবা ৭৮ কিমির বেশী পথ যেতে পারবে না, এমনকি তা হজের জন্যে হলেও।   
      (বিঃদ্রঃ- নিবন্ধটি প্রথমে ০২/০১/২০১৮ তারিখে লেখা হয় বিতর্ক ডট কম ওয়েব ম্যাগাজিন (www.bitarka.com) - এর জন্যে।  তখন শিরোনাম ছিল - ‘মেহরাম’ ছাড়াই নারীকে হজযাত্রার অনুমতি প্রদান একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ              
২৬/০১/২০১৮ তারিখে নিবন্ধটি সম্পাদনা ও হালনাগাদ (update) করা হয়েছে।) 
 গিয়াসুদ্দিন



    


Sunday, January 14, 2018

জেরুজালেমের ওপর ফিলিস্তিনি আরবদের দাবি অতিশয় দুর্বল



৬ই ডিসেম্বর জেরুজালেম নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচমকা দু’টি ঘোষণা ইসরায়েল-আরব সংঘাত যা আপাত শান্ত ছিলো তাকে উস্কে দিয়েছে। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, জেরুজালেম হলো ইসরাইলের রাজধানী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমেই স্থানান্তরিত করা হবে। প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনের একটি সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ শহর হলো জেরুজালেম। জেরুজালেম আবার বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও খ্যাত। এই শহরটি ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইহুদিরা বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত রয়েছে যে এই জেরুজালেমেই তাদের ঈশ্বর ‘ইয়াওয়ে’ (হিব্রু ভাষায় ঈশ্বরকে ইয়াওয়ে বলে) বাস করে। ফিলিস্তিনি আরবরা কিন্তু জেরুজালেমের উপর তাদের অধিকার ছাড়তে নারাজ। তাদের পেছনে রয়েছে এবং আরবের অধিকাংশ দেশ এবং বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ। এ শহরটি যে বিশ্বের মুসলিমদের কাছে অতি পবিত্র এক তীর্থভূমি যার স্থান মক্কা ও মদিনার ঠিক পরেই। এই জেরুজালেমই ছিলো তাদের প্রথম কিবলা যে দিকে মুখ করে তারা নামায পড়তো। তাই জেরুজালেমের উপর থেকে দাবি ছাড়তে তারা নারাজ। স্বভাবতই ট্রাম্পের ঘোষণায় তৎক্ষণাৎ পরষ্পরবিরোধী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ইসরাইল প্রবল সোল্লাসে স্বাগত জানায়, আর আরবরা  প্রবল ক্ষোভে তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানায়। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্রোধে ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
এ বছরটি আর পাঁচটা বছরের মতো একটা সাধারণ বছর নয়, এটা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর। বছরটি বিশ্বজুড়ে উদযাপন করছে একদিকে কম্যুনিস্ট ও বামপন্থীরা আর একদিকে ইহুদিরা। এ বছর নভেম্বর মাসে রুশ বিপ্লবের শত বছর পূর্ণ হয়েছে আবার ‘বেলফোর ঘোষণা’রও শত বছর পূর্ণ  হয়েছে  এ বছর নভেম্বর মাসেই ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে চিঠি লিখে জানান যে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনে তাঁদের পূর্ণ সহায়তা দেবে। এটা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে খ্যাত। এ বছরটি আবার ইহুদিদের কাছে আর একটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ, এ বছরটি জাতিসংঘে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইল রাষ্ট্র স্থাপনের প্রস্তাব পাশ হওয়ার ৭০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি রাষ্ট্রসঙ্ঘের ১৮১ নং প্রস্তাব (United Nations Resolution 181, resolution passed by the United Nations (UN) General Assembly in 1947 that called for the partition of Palestine into Arab and Jewish states, with the city of Jerusalem as a corpus separatum (Latin: “separate entity”) to be governed by a special international regime. The resolution—which was considered by the Jewish community in Palestine to be a legal basis for the establishment of Israel, and which was rejected by the Arab community—was succeeded almost immediately by violence.) নামে খ্যাত। 


জেরুজালেম ইহুদি, খৃস্টান ও মুসলমানদের তীর্থভূমি। জেরুজালেম ছিলো একদা ইহুদিদের বাসভূমি খৃস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে ইহুদি রাজা ডেভিড ও তাঁর পুত্র সালমান এখানেই স্থাপন করেছিলেন জিহোভার মন্দির জিহোভা হলো ইহুদিদের ঈশ্বর যেমন আল্লাহ্‌ মুসলমানদের। একেশ্বরবাদী ইহুদিরা মোজেসকে ঈশ্বরের সর্বশেষ দূত বলে বিশ্বাস করে যে বিশ্বাসে যীশু নিজেকে ঈশ্বরের দূত ও পুত্র বলে দাবি করেতার পরিণতি কী চরম ভয়াবহ হয়েছিলো তা সর্বজন বিদিত। মোজেস ঈশ্বরের সর্বশেষ দূত – এ বিশ্বাস ও দাবিকে অগ্রাহ্য ও চ্যালেঞ্জ করার চরম মাশুল দিতে হয়েছিলো যীশুকে।  ত্রিশ খৃস্টাব্দের মাঝামাঝি  রাজা হেরড তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে চরম যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করেছিলেন। তার আগে হত্যা করেছিলেন তাঁর ভাই জনকে কারাগারে বন্দি করে। খৃস্টানরা এর চরম প্রতিশোধ নিতে দ্বিধা করেনিযীশুকে হত্যা করার মাত্র চার দশক পর সত্তর খৃস্টাব্দে রোমান  রাজপুত্র টাইটাস ক্ষুধার্ত হিংস্র শ্বাপদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জেরুজালেমের ওপর। ইহুদিদের চরম বিশ্বাস ও অহংকারের প্রতীক জিহোভার মন্দিরটি ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রশক্তির দম্ভেশুধু মন্দির ধ্বংস করেই তাঁর প্রতিহিংসার আগুন নেভে নি। পাশবিক হিংস্রতায় ঝাঁপিয়েছিলেন নিরীহ ইহুদিদের উপর এবং তাদের হত্যা করেছিলেন  লাখে লাখে। বাকি ইহুদিরা প্রাণ বাঁচাতে দেশ ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর পথে পথে।  তারপর থেকে ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি রাষ্ট্র তৈরী হওয়ার আগে পর্যন্ত  প্রায় দু’হাজার ধরে তারা উদ্বাস্তু হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে যাযাবরের মতো ছুটে বেড়িয়েছে। রাজা ডেভিডের তৈরী মন্দিরটি অবশ্য প্রথম ভেঙে দিয়েছিলেন ব্যবিলিন সম্রাট নেবুচাদনেজার  খৃস্টের জন্মের ৬০০ বছর পূর্বে। কিন্তু পারসিক সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট সেই শতকেই জেরুজালেম জয়ের পর মন্দিরটির পুনর্নিমাণ করেন। রোমান রাজপুত্র টাইটাস ধ্বংস করেছিলেন পুনর্নির্মিত সেই ২য় মন্দিরটিকেই কিন্তু ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস, টাইটাসের উত্তরসূরী রোমান সম্রাটরা টাইটাসের ঐ ধ্বংসলীলায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন জিহোভার মন্দির ভাঙার জন্যে ঈশ্বরের অভিশাপে তাঁদের অকল্যাণ হবে। তাই তাঁরা পুনরায় ঐ একই স্থানে ঐ মন্দিরের পুনর্নিমাণ করে  টাইটাসের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন।    
জেরুজালেমের উপর আক্রমণ এসেছিল মুসলমান খলিফাদের দিক থেকেও। ৬৩৭ খৃস্টাব্দে ২য় খলিফা ওমর ফারুকের সেনাবাহিনী খৃস্টান সম্রাট সাফ্রোনিয়াসকে পরাস্ত করে জেরুজালেমের দখল নিয়েছিলো। তারপর খলিফা ওমরের নির্দেশে ইহুদি ও খৃস্টানদের পবিত্র তীর্থভূমি জেরুজালেমের মাটিতেই তৈরী করা হয় মুসলমানদের একটি উপাসনালয় যেটা আল-আকসা মসজিদ নামে খ্যাত। ইহুদি ও খৃস্টানদের পবিত্র তীর্থভূমিতে মুসলমানদের শাসন ও আধিপত্য বজায় ছিলো ১০৯৯ সাল পর্যন্ত। সেই বছর ১ম ক্রুসেডের সময় খৃস্টানরা জেরুজালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করে। নিজেদের পবিত্র তীর্থভূমির দখল নেওয়ার পর তারা শুরু করে প্রতিহিংসার রাজনীতি। আল-আকসা মসজিদটিকে  সালমানের মন্দির নাম দেয় এবং মসজিদের জায়গায় এক স্থানে একটি গীর্জা স্থাপন করে। খৃস্টানরা কিন্তু খুব বেশী দিন জেরুজালেমের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে নি। ১১৮৭ খৃস্টাব্দেই সুলতান সালাহউদ্দিন আয়ুবী জেরুজালেম পুনরায় দখল করে নিয়ে ক্রুসেডের বদলা নেয়। সর্বশেষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও জেরুজালেম ছিলো উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে তথা মুসলমানদের দখলে।    




 
বাইতুল মুকাদ্দাস
শুধু প্রাচীন ও মধ্য যুগের আদিম বর্বতার শিকার নয় ইহুদিরা। আধুনিক যুগেও পৈশাচিক হিংস্রতার শিকার হয়েছে তারা। হিটলার নানা অপবাদ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইহুদিদের ওপরতিনি যেন পণ করেছিলেন যে পৃথিবীর বুকে ইহুদিদের নাম ও নিশানা রাখবেন না। তাঁর নাৎসীবাহিনী ৬০ লক্ষ ইহুদিকে কচু কাটা করে কেটেছিলো। টাইটাসের পরে ও হিটলারের আগে মুসলমানদের রোষানলে পড়তে হয়েছিলো আরবে বসবাসকারী সকল ইহুদিদেরতাদের অপরাধ ছিলো তারা মোজেস  (মুসা) ঈশ্বরের শেষ নবী/দূত এই বিশ্বাস থেকে টলে নি এবং মুহাম্মদকে ঈশ্বরের দূত বলে মান্যতা দেয় নি। ইসলামকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য (?) মুসলমানদের সহ্য হয় নি।  লাগামহীন নৃশংস অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে ইহুদিদের আরব ছাড়া করেছিলো। সে সময় হাজার হাজার ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যাও করেছিলো আরবের মুসলমানরা।      
বস্তুতঃ জেরুজালেম ও ইহুদিদের ইতিহাস খুবই করুণ। জেরুজালেমের মাটি শুধু খৃস্টান, পারসিক ও মুসলমানদের হাতেই লাঞ্ছিত, নিগৃহীত ও পদদলিতই হয় নি। আরো অনেক জাতি ও গোষ্ঠীই  জেরুজালেমের উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছে। জেরুজালেমের ভূমিপুত্র ইহুদিরাও বোধ হয় যত লাঞ্ছিত, উৎপীড়িত ও নির্যাতিত হয়েছে পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ তত হয় নি অথচ তাদের জন্যে আমাদের (ভারতীয়দের) কোনো সমবেদনা নেই। নেই একটু সহানুভূতিও। উল্টে তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের মাটিতে নিজেদের একটি রাষ্ট্র তৈরী করেছে, এবং সেটা রক্ষা করতে চাইছে বলে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই।
জাতিসংঘ ট্রাম্পের ঘোষণা ধ্বনি ভোটে প্রত্যাখান করেছে। আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক মঞ্চ ইসলামি সহযোগী সংস্থা ওআইসি (Organization of Islamic Co-operation) তার শীর্ষ সম্মেলনে জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে জেরুজালেমকে ইসরাইলের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্যে আরব দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছে। ওআইসিভুক্ত দেশগুলি যদি ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন প্রশ্নে যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিলো সেটাকে স্বাগত ও সমর্থন জানাতো তবে  তখনই ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম নিয়ে সব বিতর্ক এবং ইসরাইল ও আরবের মধ্যেকার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয়ে যেতো। তাতে ইহুদিরা যেমন তাদের নিজেদের হারানো স্বদেশের খানিকটা ফিরে পেতো তেমনি  ফিলিস্তিনি আরবদেরও তাদের প্রিয় জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হতে হতো না।
১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪ - ১৯১৮) ফিলিস্তিন ছিলো উসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে। সেই যুদ্ধে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের পরাজয় ও পতন হয় এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে চলে যায় বৃটিশদের হাতে। ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত  সময়কালে বৃটিশ সরকারের সহায়তা ও মদতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্বাস্তু ইহুদিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ঢুকে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে বাড়িতে থাকে ফিলিস্তিনি ভূমে ইহুদি জনসংখ্যা এবং একই সঙ্গে ইহুদি ও আরব সংঘাতও। ২য় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় ঘটলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার জন্যে বৃটিশদের উপর চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে ১৯৪৭ সালে এপ্রিল মাসে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিন ইস্যুটি মীমাংসার জন্যে জাতিসংঘের কাছে  প্রেরণ করে। জাতিসংঘ তখন ১১টি দেশ নিয়ে তৈরী করে একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি UNSCOP (UN Special Committee on Palestine) কমিটি দুটি প্রস্তাব দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব ছিলো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা এবং সংখ্যালঘিষ্ঠের মত ছিলো ফিলিস্তিনে একটি রাষ্ট্রের অধীনে ইহুদি ও আরবদের জন্যে পৃথক  স্বাশাসিত অঞ্চল গঠন করা। কমিটি জেরুজালেম সম্পর্কে খুবই সাবধানী প্রস্তাব দিয়েছিল, বলেছিলো, জেরুজালেম থাকবে আন্তর্জাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে।  ইহুদিরা ১ম প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানায়, কিন্তু আরবরা পুরো প্রস্তাবটাই প্রত্যাখান করে। ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর জাতিসংঘে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। জাতিসংঘ  ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৫৭% অংশ ইসরাইল রাষ্ট্রকে এবং ৪৩% অংশ  ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের  জন্যে সুপারিশ করে।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দুটি পৃথক রাষ্ট্র স্থাপন করার প্রস্তাব জাতিসংঘে গৃহীত হবার কিছুদিন পর (১৯৪৮ সালের ১২ই মে) ইহুদিরা স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় এবং তার পর স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্ধভাবে কোরানের আজ্ঞা পালনকারী পাঁচটি আরব দেশ মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডান সম্মিলিত সেনাবাহিনী গঠন করে ১৯৪৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার বাসনা ও সংকল্প নিয়ে। কিন্তু সেই যুদ্ধে ইসরাইলই বিজয়ী হয় এবং রাষ্ট্রসংঘ  ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের জন্যে যতোটা জায়গা দিয়েছিলো তার চেয়ে বেশী এলাকা দখল করে নেয় ইহুদি সেনারা। এই যুদ্ধ থেকে আরবরা শিক্ষা নেয় নি। বারবার তারা ইসরাইলের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, ফলে ১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৮২ সালে আরব ও ইসরাইলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। কিন্তু আক্রমণকারী আরবরা প্রত্যেকটা যুদ্ধেই পরাজিত হয় এবং অপরদিকে ইসরাইল তার সীমানা বাড়িয়ে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে  যুদ্ধে  সিনাই মরুভূমির পাশাপাশি সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাজা উপতক্যা এবং জেরুজালেমের পূর্ব অংশ-সহ অবশিষ্ট সকল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরাইল দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে  ফিলিস্তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপনের সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিলো সেটা একেবারেই বিলীন হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়ে মিশর ও জর্দান ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। ১৯৭৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তি (ক্যাম্প-ডিভিড চুক্তি) হয় এবং মিশর ইসরাইলকে ইহুদি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। সৌদি আরব ২০১৬ সালে মিশর-ইসরাইল শান্তিচুক্তি মেনে নেয় তখন থেকেই সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যেকার বৈরীমূলক সম্পর্কের  অবসান হয় এখন তো সৌদি আরব ও ইসরাইল দু’ দেশই পারষ্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সৌদি আরব তার সেনাবাহিনীর একদল অফিসারকে পাঠিয়েছে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া এবং সৌদি আরব ও ইসরাইলের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যে সৌদি আরব ইসরাইলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নতিকরণের লক্ষ্যে একদল ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদকেও ইসরাইল পাঠিয়েছিলো। সৌদি আরব ইতিমধ্যেই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঠ্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে ইসলামিস্টদের সরিয়ে দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ওআইসি যে শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চে ইসরাইলকে ফের হুঙ্কার দিয়েছে সেই সম্মেলনে  অংশ গ্রহণ করেন নি সৌদি রাজা সালমান ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মহম্মদ বিন সালমান। অংশ নেয় নি মিশর, আরব আমিরাত ও বাহরিনের রাষ্ট্রপ্রধানরাও। ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনের অনুপস্থিত থেকে এই দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা ইসরাইলের সঙ্গে আরবদের আর সংঘাত ও যুদ্ধ চাই না, তার পরিবর্তে আলচনার মাধ্যমে সমস্ত রকম বৈরীতা ও সংঘাতের অবসান চান। ইসরাইলও আরবদের সঙ্গে সংঘাতের স্থলে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী। সেই উদ্দেশ্যে ইসরাইলের পক্ষ থেকে সৌদি আরবের রাজপুত্রকে মধ্যস্থতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু একই উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাবেন স্থির করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। সৌদি আরবও মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স  ইতিমধ্যেই পিএলও-র রাষ্ট্রপ্রধান মাহমুদ আব্বাসকে জেরুজালেমের দাবি থেকে সরে এসে ‘আবু দিস’ নামক একটি শহরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে খবর এবং সেখানে রাজধানী গড়ে তোলার জন্যে অর্থ সিয়ে সাহায্য আশ্বাসও দিয়েছেন।
মিশর, আরব আমিরাত, বাহরিন, সৌদি আরব ইত্যাদি আরব দেশগুলির মতো বাকি দেশগুলিরও  উচিৎ ধর্মান্ধতা পরিত্যাগ করে ইতিহাস ও বাস্তবকে স্বীকার করে নেওয়। তারা যদি ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব পরিত্যাগ করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম সমস্যার সমাধানের পথ সন্ধান করতে সম্মত হয় তবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যেকার চির বৈরী সম্পর্কের অবসান অধরা থাকবে না। আর তার ফলে লাভবান হবে দু’পক্ষই, তবে ফিলিস্তিনিরাই  লাভবান হবে সবচেয়ে বেশী

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...