Thursday, August 31, 2017

৩ তালাক বাতিল: চাই সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকাররের ভিত্তিতে অভিন্ন আইন

ঘটনা ১. বর ও বৌয়ের মধ্যে কিছুদিন ধরে বনিবনা নেই। দু’জনে একসঙ্গে বেরিয়েছেন এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্য। বাড়ির অশান্তি রাস্তাতে নেমে আসে। বৌ রাগের বশেই একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করে, বর কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। বর কয়েক বার বৌকে আস্তে হাঁটতে বলেবৌ তাতে কান দেয়  নি। রাস্তার মাঝে বৌয়ের এমন আচরণে বরের আঁতে ঘা লাগে। বর ঠিক করে অবাধ্য বৌকে চরম শাস্তি দিতে হবে। ব্যাস! বরের বজ্র নির্ঘোষ – তালাক। তালাক। তালাক। না, এটা সিনেমার কোনো স্ক্রীপ্ট নয়। বাস্তব জীবনের ঘটনা। সৌদি আরবের রিয়াধের একটি ঘটনা। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। রোজ অন্তত ১২৭টি ডিভোর্সের মামলা হয় সৌদি আরবে। (http://www.sangbadpratidin.in/saudi-man-divorces-wife-for-walking-ahead/)  ঘটনা ২. দু’ই ভাইরা ভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি। ওদের মধ্যে অশান্তি হয়েছে। একদিন এক ভাইরা ভাই আর এক ভাইরা ভাইয়ের বাড়ি চরে তার মায়ের গায়ে হাত দিয়ে বসে। যার মায়ের গায়ে হাত পড়েছে সে তখন বাড়ি থকে প্রায় এক হাজার কিমি দূরে ওড়িশায় কাজ করছে। মোবাইলের যুগ, খবরটা দ্রুতই তার কানে পৌঁছে যায়। অমনি মোবাইলে তার বৌকে ধরে বলে, তোর বহনু (ভগ্নীপতি) আমার মাকে মেরেছে, তাই তোকে তালাক। তালাক। তালাক। হ্যাঁ, এটাও একটি জীবনের ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে আমার বাড়ির পাশে ২০০৬/২০০৭ সালে। এমন কোনো মুসলিম গ্রাম নেই যে গ্রামে কারণে, অকারণে বা তুচ্ছ কারণে তালাকের ঘটনা ঘটেনি। এ রাজ্যে তালাকপ্রাপ্ত ও বর-পরিত্যাক্ত নারীর সংখ্যা লক্ষাধিক।   
হ্যাঁ, শরিয়তি আইনে বৌকে তালাক দেওয়া এমনই সহজ। চিঠি পাঠিয়ে, মোবাইলে টেক্সট মেসেজ দিয়ে, ফেসবুকে চ্যাট করে, হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে বৌকে তালাক দেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটছে এখন। বৌকে তালাক দেবার এ রকম প্রত্যেকটি পদ্ধতিই শরিয়তি তালাক আইনে বৈধ যে আইনটি তৈরী হয় কোরান-হাদিসের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালেএর থেকেও সহজ পদ্ধতি রয়েছে কোরানে যেখানে মুখে ‘তিন বার তালাক’ না বলে কিংবা চিঠি বা মোবাইল/ইমেল/হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ না পাঠিয়েও বৌকে তালাক দেওয়া যায়  মনে মনে বৌকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত করে তার সঙ্গে চার মাস যৌন মিলন না করলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে কোরানের পরিভাষায় যাকে ইলা তালাক (কোরানের ২/২২৬, ২২৭ আয়াতের উপর ভিত্তিতে রচিত শরিয়তি আইনের ৩৭০ নং ধারা) বলে। শরিয়তি তালাক আইন এমনই অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও অসভ্য আইন! মদিনায় ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর নামে এই আইনটি তৈরী হলেও মুসলিম বিশ্বের ২০/২২টি দেশ বর্বর এই আইনটিকে বাতিল করে দিয়েছে যে দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশও রয়েছে। আমরা আমাদেরকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক বলে  বড়াই করি, অথচ এতোদিন আমরা কুৎসিত এই আইনটিকেই যকের ধনের মতো বুকে আগলে রেখেছিলাম। ছিঃ! ভাবতেই লজ্জা লাগে।              
অবশেষে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই ২২ শে আগস্ট বাতিল হলো সর্বকালের সবচেয়ে কালা এই কানুনটি। যতো রকমের তালাক আইন আছে, তালাক আইনের যতো রকম পদ্ধতি আছে তার সবগুলোই আদালত তার রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষা বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। কোরান ও হাদিসে তালাক আইনের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। কোরানের তালাক আইনটি জটিল, তাতে বিভিন্ন ধারা রয়েছে, সে সব ধারায় নানা বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। ফলে তালাকেরও নানা রকম ও নানা নাম আছে। সকল প্রকার তালাক আইন প্রধানতঃ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত। তার একটির বৈশিষ্ট হচ্ছে অপ্রত্যাহারযোগ্য তালাক এবং আর একটি প্রত্যাহারযোগ্য তালাক। অপ্রত্যাহারযোগ্য তালাককে ইসলামের পরিভাষায় তালাক–ই–বিদাত এবং প্রত্যাহারযোগ্য তালাকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাসান তালাক ও এহসান বা আহসান তালাক সর্বোচ্চ আদালতের যেগুলির উল্লেখ রয়েছে। কোরানের সমগ্র তালাক আইনটিকেকে অক্ষত ও সুরক্ষিত রেখেই সেগুলির সঙ্গে হাদিসে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে কেবল।  সেই ধারাটি হলো, বর একসঙ্গে ইচ্ছা করলে, তা ন্যায়সঙ্গত হোক বা  না হোক, তিন তালাক দিতে পারবে এবং সে তালাক প্রত্যাহার করা যাবে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কোরান তিন মাসে তিন তালাক দেবার কথা বলেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে,  ১৯৩৭ সালে যে শরিয়তি আইন তৈরী হয় তার প্রধান দু’টি উৎস বা স্তম্ভ হলো কোরান ও হাদিস। সুন্নী সমাজের ধর্মগুরুরা ১৯৩৭ সালের তৈরী এই শরিয়তি আইনটিকেই  যথার্থ আল্লাহর আইন বলে বিশ্বাস করে এবং যে কোনো মূল্যে এটিকে রক্ষা করতে চায়। অপরদিকে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন যে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াটা অনৈসলামিক। আসলে তাঁরা মিথ্যাচার করেন। কারণ, হাদিসকে বাদ দিলে ইসলাম আর ইসলামই থাকে না। 
একটা প্রচার করা হয় যে, কোরানের তালাক আইনটি বেশ ভালো। সুতরাং একসঙ্গে তিন তালাক বাদ দিয়ে সেটাই চালু করা হোক। এটা একেবারে ভুল ধারণা। বৌকে এক তালাক দিলে তাকে তার বরের মন জয় করার জন্যে তার বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে – এই হলো কোরানের বিধি। এটা অবাস্তব বিধি। কারণ, এক). বর যে যদি তাকে থাকতে, পরতে ও খেতে না দেয় তবে কী হবে সে বিষয়ে কোরান নীরব। দুই). বর যদি তার বৌকে তালাক দেবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ থাকে তবে তার বাড়িতে সেই বৌয়ের তিন মাস কেন তিন ঘণ্টা অবস্থান করারও পরিবেশ থাকা সম্ভব নয়। বরের বাড়ির অন্য সদস্যরা তার সঙ্গে সহানুভূতিশীল এবং সম্মানজনক আচরণ করবে এমনটা কল্পনাতীত ব্যাপার। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে, তিন বারে তিন তালাক দেওয়ার কোরানীয় বিধিটিও নারীর পক্ষে ভীষণ অসম্মানজক এবং বাস্তবায়িত করার অনুপযুক্ত।
যারা কোরানের তালাক বিধির খুব প্রসংশা করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি যে, কোরানের বিধি অনুসারে তিন তালাক তিন বারে দেওয়া (যা নারীর পক্ষে যথেষ্ট অসম্মানজনক ও অবাস্তবও) ছাড়াও আরো বহু বিধি আছে যেগুলির কোনোটাই নারীর পক্ষে শুভ ও সম্মানজনক নয়। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ইলা তালাক যার কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে একটি ভয়ংকর নারীবিরোধী তালাক বিধি যেটা কোরানের ৪/২০ নং আয়াতের ভিত্তিতে প্রণীত। সেখানে বলা হয়েছে কোনো বিবাহিত পুরুষের অন্য একজন নারীকে পছন্দ হলে তাকে বিয়ে করার জন্যে তার বৌকে সে তালাক দিতে পারবে। কোরানের তালাক বিধিতে আর একটি ধারা আছে যা নারীর পক্ষে সবচেয়ে অসম্মানজনক ও অবমাননাকর। সেই বিধিটি রয়েছে ভারতীয় শরিয়তি আইনের ৩৫১ নং ধারায় যে ধারাটি কোরানের ২/২৩০ নং আয়াতের ভিত্তিতে রচিত। সেখানে বলা হয়েছে বর তিন তালাক দেওয়ার পর যদি অনুতপ্ত হলেও তালাক প্রত্যাহার করতে পারবে না। এমনকি পুনরায় সে তার সেই বৌকে সরাসরি বিয়ে করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্ত সেই নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করতে হবে। তারপর সেই পুরুষটি মারা গেলে কিংবা তালাক দিলে তবে সেই নারীটি তার প্রাক্তন বরের উপযুক্ত হবে। আর অন্য পুরুষের সঙ্গে শুধু নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে করলে হবে না, তাকে (দ্বিতীয় বরকে) তার শরীরটাও সঁপে দিতে হবে তার ভোগের জন্যে। কোরানের তালাক বিধির আর একটি দিক আছে সেটাও সম্পূর্ণ নারীবিরোধী ও ভীষণ অগণতান্ত্রিক। তা হলো, কোরান নারীকে তালাক দেবার অধিকার শুধু পুরুষকেই দিয়েছে, নারীর তালাক দেবার অধিকার নেই এবং যতো অন্যায়ভাবেই বর তার বৌকে তালাক দিক না কেন, তা প্রতিহত করার কোনো রক্ষা কবচ কোরান নারীকে দেয়নি।  এই হচ্ছে কোরানীয় তালাক আইনের কুৎসিত রূপ।
মূল কথা হল কী কোরান, কী হাদিস, দু’টি ধর্মগ্রন্থেই যে তালাক আইন রয়েছে তা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বর্বর ও অমানবিক এবং সম্পূর্ণ একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক আইন। তাই সমগ্র শরিয়তি তালাক আইনটিকেই বাতিল করে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছে যা ভারতের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই সর্বোচ্চ আদালতের যে তিন জন বিজ্ঞ বিচারপতি এই রায় দিয়েছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই যে মুসলিম মহিলারা মুসলিম পুরুষ এবং মোল্লা-মুফতিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিন তালাক-সহ সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিলের দাবীতে লড়াই করেছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদেরও। এবং সব শেষে ধন্যবাদ জানাই বিজেপির সরকারকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
১৫ই আগষ্ট ও ২৬শে জানুয়ারী আমরা পালন করি মহাসমারোহে আমাদের স্বাধিনতা ও নিজস্ব সংবিধান প্রাপ্তির জন্যে। কিন্তু ভারতের মুসলিম নারীর কাছে এই দুটো দিনের কোনো অর্থই ছিলো না। তারা স্বাধীনতার ৭০ বছর পর এতদিনে একটা দিন, ২২ শে আগষ্ট, পেলো উদযাপন করার জন্যে। এই দিনেই তারা তিন তালাক-সহ সমস্ত তালাকের খড়্গ থেকে মুক্তি পেলো, বিনা কারণে আল্লাহর দোহাই দিয়ে পুরুষেরা যখন তখন তালাক দিয়ে তাদের জীবনের সব নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে আর তাদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিতে পারবে না।           
সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে কেন্দ্রিয় সরকার লোকসভায় আইন পাশ করে বাতিল করে দিতে পারে জেনেও বলছি যে, মুসলিম মেয়েরা এবার নিশ্চিতভাবেই শরিয়তি তালাক আইনের হাত থেকে মুক্তি পেলো। কারণ যারা মুসলিম ভোটের লোভে মাওলানা-মুফতিদের সারা জীবন গোলামী করেছে এবং মুসলিম নারীদের বুকে ছুরি চালিয়েছে তারা এখন ক্ষমতায় নেই। সুতরাং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আই ভরসাটুকু রাখাই যায় যে, সর্বোচ্চ আদালত যেমন বলেছে সেই মতো কেন্দ্রিয় সরকার নিশ্চয় ছ’মাসের মধ্যে একটি তালাক আইন প্রণয়ন করবে যে আইনে মুসলিম নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা হবে।
শুধু তালাক আইনটিই নয়, সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিই নারীবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক। যে আইন পুরুষের জন্যে জঘন্য বহুবিবাহকে অনুমোদন করেছে, তালাকের পর নারীকে খোষপোষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, তালাকের পর নারীর উপর কুৎসিত ইদ্দত আইন আরোপিত রয়েছে, দত্তকবিরোধী অমানবিক আইন রয়েছে এবং মজনুবিলাস আইন-সহ বৈষম্যমূলক ফারাজ আইন (উত্তরাধিকার আইন) রয়েছে। তাই সমগ্র সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিরই অবসান ঘটানো জরুরী। ভারতের মুসলিম নারীদের প্রায় ৯২% নারীই চাই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অক্টোপাশ থেকে মুক্তি। এটা নিয়ে এই কাগজেই আমি নিবন্ধ লিখেছি গত বছর। সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল না করলে শুধু তালাক আইন বাতিলের মধ্যে দিয়ে মুসলিম নারীর মুক্তি আসবে না। নারীর প্রতি সমস্ত বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচার দূর করে নারীকে স্বাধীনতা ও সমানাধিকার দিতে হলে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিকে বাতিল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। চাই তার একমাত্র বিকল্প আইন - সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকাররের ভিত্তিতে অভিন্ন আইন২২শে আগষ্টের রায়ের বজ্র নির্ঘোষ সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি বড়ো পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়এই কাগজেই গত  বছরে বোধ হয় সেপ্টেম্বর মাসে আমি লিখেছিলাম যে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তিম দশা আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় এবার সবাই দেখতে পাচ্ছেন।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...