Wednesday, January 25, 2017

কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা - তিন



   উমাইয়ারাও ইসলামকে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু মুহাম্মদ তাদের বিশ্বাস করতেন না


৩য় খলিফা ওসমান গণির খেলাফতকাল (৬৪৪-৬৫৬ খৃঃ) ছিলো খুবই ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ হয়েছিলো এবং তিনি বিদ্রোহিদের হাতেই নিজ বাসভবনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। যে যে কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিলো বলে বলা হয় (অন্ততঃ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেমনটি বলেছেন) তা মোটেই বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী নয়। বিদ্রোহের প্রধান ও আসল কারণটি চতুরতার সঙ্গে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ চেপে গেছেন। সে বিষয়ে অতি সংক্ষেপেই আলোচনা করবো কারণ এ লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করার পরিসর ও অবসর নেই। কী সেই প্রধান কারণটি সে আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, কারবালা যুদ্ধের সঙ্গে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমেই দেখে নেবো মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিদ্রোহের পেছনে কোন কোন কারণগুলিকে দায়ী করেছেন। তাঁরা যে কারণগুলিত কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলি হলো – এক). ওসমান গণির কোরান পুড়ানো, দুই). ইসলামি ভূমিনীতি কৃষিনীতির  পরিবর্তন, তিন). রাজস্বনীতির পরিবর্তন, চার). দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণ, পাঁচ). উমাইয়া বংশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভুমিকা ইত্যাদি। কোরান গ্রন্থাকারে প্রথম সংকলিত করেন খলিফা ওসমান গণিই। শুধু এই কাজটির জন্যেই তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন তিনি অন্য কোনো কাজ না করলেও। কারণ তিনি এ কাজটি না করলে কোরানের  কথাগুলি হয় তো কালের গর্ভে বিলীন হয়েই যেতো চিরতরে। কোরানের কথাগুলি সংকলিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্যে তাঁকে জামেউল কোরান বলা হয়। তবুও কোরান সংকলন করার কাজ সম্পন্ন করার জন্যে তাঁকে কম মাশুল দিতে হয় নি। এ কাজটি করার জন্যে বিভিন্ন প্রান্তে বহুজনের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোরানের বাণিগুলি একত্রিত করে তারমধ্যে যেগুলি জাল বা বিকৃত সেগুলি বাদ দিয়ে একটি আসল কোরান সংকলিত করার জন্যে তিনি একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির বিবেচনায় যেগুলি জাল ও বিকৃত সেগুলি চিহ্নিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারজন্যে মুসলিম জাহানে মুসলিমদের একাংশের মধ্যে এরূপ ধারণা তৈরী হয়েছিলো যে খলিফা তাঁর নিজের স্বার্থে আল্লাহর বাণী পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে প্রচণ্ড গর্হিত ও অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।  মুসলিমদের একাংশের মধ্যে তৈরী হওয়া এরূপ ধারণাকে সাহাবিদের কয়েকজন উস্কেও দিয়েছিলেন তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে কোরান পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যে ও অভিসন্ধিমূলক, তাঁরা সেই কোরানের প্রতিই সম্পূর্ণ আস্থা ও  ভরসা রেখেছেন। খলিফা ওসমানকে সেই সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিজনিত কারণে এমন কিছু পদক্ষেপ করতে হয়েছিলো যেগুলি মুসলিম জনতার মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি, সংশয় ও সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলো। একটি স্বার্থাণেষী গোষ্ঠী মানুষের মধ্যেকার সেই সংশয় ও সন্দেহকে খলিফার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করতে ব্যবহার করেছিলো।  খলিফা ওসমানের সময়কালে ছোট্ট ইসলামি রাষ্ট্রটি তখন সাম্রাজ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা এবং উট ও ঘোড়ার সংখ্যা বিপুলকায় আকার ধারণ করেছে। ফলে আবশ্যক হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয়চারনভূমি। পরিস্থিতির এই দাবি অনুযায়ী খলিফাকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছিলো যার ফলশ্রুতিতে কিছু কৃষককে অনিবার্য কারণেই উচ্ছেদও করতে হয়েছিলো। অন্যদিকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জিহাদ ভীষণ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছিলো। জিহাদে অংশগ্রহণকারীগণ সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের (টাকা-পয়সা, ঘোড়া-উট, বন্দি নারী-পুরুষ প্রভৃতি) বখরা (ভাগ)  পেতো।  ইসলামের পরিভাষায় লুণ্ঠিত দ্রব্যগুলি গণিমতের মাল। গণিমতের মাল হিসেবে বন্দি নারীদের ভোগ করাকে ইসলাম আল্লাহর নামে বৈধতা দিয়েছিলো। পুরুষ-বন্দিরা ক্রীতদাস এবং নারী-বন্দিরা ক্রীতদাসী – এই ছিলো আল্লাহর নামে মুহাম্মদের বিধান। এসব কারণে রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্যে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে  মদিনায় এসে ভিড় করতো যাদের মধ্যে এমনকি বিধর্মীরাও অনেকেই থাকতো।   অপরদিকে ২য় খলিফা ওমর ফারুক ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই  আইন প্রণয়ন করায় জমি কেনাবেচার সুযোগ অনেকতাই কমে গিয়েছিলো। ফলে গ্রামাঞ্চলে বসবাসের আগ্রহ মানুষের মধ্যে ভীষণভাবেই হ্রাস পেয়েছিলো। এর ফলশ্রুতিতে মদিনায় জনসংখ্যার চাপ এতো বৃদ্ধি পায় যা একটা গভীর সংকটের সৃষ্টি করে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে ওসমান জমিদারী প্রথার প্রবর্তন করেন। এই নতুন ভূমিনীতি স্বভাবতই ছিলো খলিফা ওমরের ভূমিনীতির পরিপন্থী। কৃষকদের উচ্ছেদ-সহ এই নতুন ভূমিনীতি গ্রহণ করায় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে  আওয়াজ উঠেছিল যে তিনি ইসলামি নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। খলিফা এসব সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়।  তৎসত্ত্বেও যাঁরা খলিফার বিরোধী ছিলেন তাঁরা এই ইস্যুগুলিতে মুসলমানদের ভুল বুঝিয়েছিলেন। তার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনায় ছোটখাটো যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো সেগুলিকেও অস্ত্র হিসেবে খলিফার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো মক্কার মানুষের মধ্যে বহুকাল থেকে চলে আসা স্পর্শকাতর  বংশ-গোত্রের বিরোধটিকেও।  মুহাম্মদ ছিলেন হাসিম বংশের  লোক আর ওসমান ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক। এই দু’ই বংশের মধ্যে কলহ-বিবাদ ছিলো খুবই তীব্র ও পুরানো। মুহাম্মদ মক্কা বিজয় করার পর তাঁর একচ্ছত্র শাসনের কারণে তাঁর জীবদ্দশায়  সেই কলহ-বিবাদ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছিলো যা ওসমান খলিফা হওয়ায় আবার মাথা চাড়া দিয়েছিলো। খলিফা ওসমানের পূর্বে মুহাম্মদ এবং আবুবকর ও ওমর ফারুকের খেলাফত কালে প্রশাসনে সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছিলো হাসিম বংশ, অপরিদিকে বঞ্চিত থেকে ছে উমাইয়া বংশ। উমাইয়া বংশের লোক ওসমানের আমলে উমাইয়া বংশ সেই বঞ্চনা থেকে কিছুটা মুক্তি পায় এবং প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিছুটা বৃদ্ধি পায়।  এটা মুহাম্মদের বংশধর হাসিম বংশের একটা বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়ায়ফলে মদিনার মাটিতে ওসমানের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং খলিফার পায়ের তলার মাটি ক্রমশঃ আলগা হতে থাকে। সেই সুযোগটা নিয়েছিলো বিদ্রোহিরা যারা কুফা, বসরা, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এসে মদিনায় জড়ো হয়েছিলো। তারা এক সময় একেবারে বিনা বাধায় খলিফার প্রাসাদ অবরোধ করে তাঁকে প্রাসাদে বন্দি রাখতে সমর্থ হয়। সেই অবরোধ ছিলো টানা ৪০ দিন। সে সময় মদিনার মানুষ কেউ খলিফার পাশে দাঁড়ায় নি। তখনও আলি, তালহা, জুবায়ের প্রমুখ সাহাবিগণ (যাঁরা মুহাম্মদের সঙ্গে অসংখ্য জিহাদে বীরের ভুমিকা পালন করেছিলেন) জীবিত ছিলেন, কিন্তু সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। একজন খলিফার কিছু দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক নয়, তাই বলে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে একদল মুসলমান, ৪০ দিন ধরে তাঁকে  বন্দি করে রেখেছে তাঁর বাসভবনে,  বাহির থেকে কোনো খাবার, এমনকি পানীয় জল ঢুকতে পর্যন্ত দিচ্ছে না খলিফার প্রাসাদে, এমন অবস্থা চোখের সামনে দেখেও সাহাবিদের নীরব বসে রয়েছেন ৪০ দিন ধরে – এমন ঘটনা ইতিহাসে সম্পূর্ণ বিরল। খলিফার দোষ-ত্রুটির অন্ত ছিলো না  বলেই সাহাবিগণ তাঁকে রক্ষা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন – এটা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাঁদের অবিশ্বাসযোগ্য ও চরম বিষ্ময়কর এই নীরবতার  পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো যেটা মুসলিম ঐতিহাসিকগণ চতুরতার সাথে আড়াল করে গেছেন।      
খলিফা ওসমানের জীবনী ও তাঁর খেলাফতকালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিক ও আলেম সমাজকে কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কারণ তাঁর জীবনী ও খেলাফতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন মুহাম্মদের জামাই আলি যাঁর স্থান মুসলিমদের কাছে মুহাম্মদের ঠিক পরেইওসমানের খলিফা হওয়ার সময় একমাত্র আলীই ছিলেন ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দী। তাঁর খলিফা হওয়াটা আলী এবং তাঁর অনুগামীরা একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। ওসমানের খেলাফতকালে ইসলামি খেলাফত (সাম্রাজ্য) যখন সংকটে পড়েছে, কিংবা স্ব্যং খলিফা যখন কোনো সংকটে পড়েছেন তখন একবারের জন্যেও আলী তাঁর পাশে দাঁড়ান নি, তাঁকে কোনো প্রকার সহায়তা দেন নি। ২য় খলিফা ওমর ফারুকের মৃত্যুর পর ইসলামি খেলাফত কঠিন সংকটে পড়েছিলো। সে সংকট ছিলো প্রধানতঃ বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট। কারণ ওসমান ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির মানুষ এবং সেটা ছিলো সর্বজন সুবুদিত। ফলে ওসমান খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ইসলামের শত্রুরা ইসলামি রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ শুরু করে দেয়, এবং অপরদিকে একই সাথে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এ রকম এক গভীর সংকটকালে আলির ভূমিকা ছিলো রহস্যময়, সংকট মোকাবিলায় তাঁকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় নি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ওসমান সাফল্যের সাথে সমস্ত বিদ্রোহ এবং বহিঃশত্রুদের আক্রমণ মোকাবিলা করে ইসলামি রাষ্ট্রকে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের বিপুল বিস্তারও ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওসমান আলির ভূমিকায় ভীষণ অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কোনো সময় খারাপ আচরণ করেন নি। এমনকি আলিকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনে কখনো কার্পণ্য পর্যন্ত করেন নি। এতদসত্ত্বেও আলি কিন্তু সর্বদা খলিফার থেকে দুরত্ব বজায় রেখেই চলতেন। তবুও খেলাফতের যে কোনো সমস্যা বা সংকটে খলিফা উদার মন নিয়ে আলির পরামর্শ ও সহযগিতা চেয়ে গেছেন। খেলাফতের শেষদিকে তাঁর বিরুদ্ধে সাহাবিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের বিষয়টি যখন তাঁর গোচরে আসে তখনও তিনি আলিকে সেটা অবগত করান এবং তাঁর পরামর্শ ও সহযগিতা চান।     অসন্তুষ্ট সাহাবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তাঁর বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ বা ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে তা দূর করার জন্যে তিনি আলিকে ভূমিকা নিতে অনুরোধ করেছিলেন। আলি কিন্তু সে অনুরোধ নানা অজুহাতে উপেক্ষা করেছিলেন এবং কঠিন সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে রেখেছিলেন।  আলি একই রকমভাবে নির্বিকার ছিলেন যখন ৪০ দিন ধরে খলিফা তাঁর প্রাসাদে বিদ্রোহিদের দ্বারা অবরুদ্ধ ও বন্দি ছিলেন। এই ঘটনাগুলি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে মুসলিম ঐতিহাসিকদের সমস্যা হওয়ার কথা, হয়েছিলোও, এবং এখনো হয়। কারণ, মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে তাঁরা প্রথমে মুসলিম তারপর ঐতিহাসিক। যদিও আলি ও ওসমান দু’জনেই মুহাম্মদের জামাই ও দু’জনেই বিশ্বস্ত সাহাবি, তথাপি তাঁরা দু’জন মুহাম্মদের চোখে এক সমান ছিলেন না। ওসমানের তুলনায় মুহাম্মদ আলিকে অনেক বেশী স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। কারণ, আলি ছিলেন তাঁর আপন চাচাতো ভাই, বংশধর এবং ওসমানের চেয়ে অনেক বড়ো যোদ্ধা। অপরদিকে ওসমান জামাই ও সাহাবি হলেও তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি যে বংশকে মুহাম্মদ ও তাঁর পূর্বসূরীরা কোনোদিন বিশ্বাস করতেন না। এই পার্থক্যগুলো মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ক্ষত্রে সর্বদা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পরিবর্তে আলিকে সমস্ত দোষ-ত্রুটির ঊর্ধে স্থাপন করাকে তাঁরা তাঁদের প্রাথমিক কর্তব্য জ্ঞান করেন। সে কারণে আলির  দোষ-ত্রুটি ও এবং নেতিবাচক ভূমিকার  ঘটনা ও তথ্যগুলি তাঁদের লেখায় পাওয়া যায় না। অপরদিকে ওসমানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা যতোটুকু করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশী খলিফা ওসমানের সমালোচনা তাঁরা করেছেন। ওসমানের খেলাফতকালের শাসনপ্রণালির দোষ-ত্রুটি এবং ইসলামি নীত-আদর্শ থেকে বিচ্যুতিকেই বিদ্রোহের জন্যে দায়ী করেছেন। খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে মূলতঃ খলিফার কাঁধেই দায় চাপিয়েছেন। ফলে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পশ্চাতে নিহিত থাকা প্রকৃত কারণগুলি এবং বিদ্রোহের পেছনে নেপথ্য ভূমিকায় কে বা কারা ছিলেন তা ইতিহাসের আড়ালে চলে গেছে বা মিথ্যা ইতিহাসের নীচে চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়ে গিয়েছে বোধ হয় চিরিতরেই।
ওসমানের বিরুদ্ধে ইসলামের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতির যে অভিযোগগুলি উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলি প্রকৃত বিচারে বিচ্যুতিই নয়, সেগুলি ছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতির সংস্কার মাত্র। একজন খলিফা হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের স্বার্থেই বাস্তব পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারেই সেই সংস্কারগুলি তাঁকে করতে হয়েছিলো। উপরে সংশ্লিষ্ট স্থানে সেগুলি কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আর এরূপ সংস্কার তিনি প্রথম করেছিলেন এমন নয়। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময়েই সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিলো। যেমন ওমরই প্রধানতঃ তালাক নীতিতে একটা বিরাট সংস্কার নিয়ে আসেনকোরান প্রদত্ত তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার আইনের সংস্কার করে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াকে বৈধ তালাক বলে নতুন আইন প্রণয়ন করেন। তিনি যে ভুমিনীতি (লাঙ্গল যার জমি তার) প্রণয়ন করেছিলেন তা ছিলো কোরান বহির্ভূত নীতি। আরব ও অনারবদের মধ্যে বিয়ে দেওয়ার রীতিকে তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন যা মুহাম্মদ করে যান নি। বায়তুল মাল (সরকারী কোষাগার) থেকে মুহাম্মদের নিকটাত্মীয়দের বেশী পরিমাণে অর্থ দেওয়া তিনি প্রচলন করেছিলেন যা মুহাম্মদ ও আবুবকর করেন নি। এর কুফল পড়েছিলো আরবের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। একদল ধনী লোকের উদ্ভব হয়েছিলো যা মালিক-শ্রমিক দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এই দ্বন্দ খলিফা ওসমানের সময় ধীরে ধীরে প্রকট হতে শুরু করেছিলো।
মুহাম্মদ যা করেন নি তা করার অর্থ হলে মুহাম্মদের নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া। খলিফা ওমর ফারুকের সময় মুহাম্মদের নিকটাত্মীয়দের জন্যে বায়তুল মাল থেকে বেশী অর্থ দেওয়া শুরু করার ফলে সমাজে একদল ধনী লোকের উদ্ভব হয়েছিলো যা মালিক-শ্রমিক দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল পরে তা বাড়তে বাড়তে খলিফা ওসমানের সময় প্রকট হতে ও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে   ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেরেও  খলিফা ওমর  অনেক সংস্কার করেছিলেন তারাবির নামায (রমজান মাসে এসার নামাযের পরে অতিরিক্ত নামায) জামাতে পড়ার নিয়ম চালু করেন অর্থাৎ একজন ইমামের পেছনে একসাথে নামায পড়া চালু করেন প্রথমে ৮ (আট) রাকাত তারাবির নামায পড়া হতো, সেটা বাড়িয়ে তিনি ২০ রাকাত করেছিলেন  এ সব সংস্কার ওমর যা করেছিলেন তা সবই ছিলো মুহাম্মদের প্রদর্শিত পথের বাইরে ওমরের এ সব সংস্কার নিয়ে সাহাবী ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন ও অসন্তোষ ছিলো না এমনটা নয় অনেকের মধ্যেই নানা প্রশ্ন ও অসন্তোষ থাকলেও কেউ ওমরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা ভাবেন নি। অথচ সেই একই প্রশ্নে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়ে গেলো।  এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা স্মরণ করা প্রয়োজন যা হলো, ওসমান যে সব সংস্কার করেছিলেন সেগুলি মোটেই মুহাম্মদ প্রদর্শিত ও প্রবর্তিত পথের বিপরীত ছিলো না। কারণ এটা দেখা গেছে যে, যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন তার পূর্ব নজির ছিলো না। ফলে কোরানে সেই সমস্যাগুলি সমাধান করার পথনির্দেশ বা দিকনির্দেশ না ছিলো কোরানে, না মুহাম্মদ প্রদর্শিত পথে। জমিদারী প্রথা প্রবর্তন করে তিনি ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ করা হয় সেটাকে সঠিক ও বাস্তবসম্মত বলা যায় না।  কারণ জমিনীতি, কৃষিনীতি এবং উৎপাদন ও বণ্টননীতি নিয়ে মুহাম্মদ কোনো স্পষ্ট বিধান দিয়ে যান নি কিংবা দিয়ে যেতে পারেন নি।  তারজন্যেই  ২য় খলিফা ওমরকে ভূমিনীতি প্রণয়ন করতে হয়েছিলো তাঁর সেই ভূমিনীতির (লাঙল যার জমি তার) জন্যে আরবে তখন জমি কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো যা পরে খলিফা ওসমানের সময়ে গভীর সংকট  রূপে প্রকটিত হয়েছিলো  সেই সংকট নিরসনের জন্যে ওসমান ওমরের ভূমিনীতি বাতিল করে পুনরায় জমি কেনাবেচার পুরানো ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছিলেন এর জন্যে তিনি ইসলামের আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয় না  সুতরাং এ দাবীই জোরালো হয় যে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পশ্চাতে অন্য কারণ নিহিত রয়েছে সেই কারণগুলি এতোই স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হয় যে কয়েক শ’ বছর ধরে সেগুলিকে আড়াল করে রাখার বা চেপে যাওয়ার মরীয়া চেষ্টা করেও মুছে দেওয়া বা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। প্রকৃত সেই কারণগুলি অনুসন্ধান করে সামনে নিয়ে আসার নৈতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে যেতে বা অস্বীকার করতে পারি না। সেই কারণগুলি অনুসন্ধান করার আগে একটা কথা বলা আবশ্যক। তা না হলে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য আড়ালে থেকে যাবে। কথাটি হলো – খলিফা ওসমান গণি একটি খেলাফতি শাসনে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছিলেন যাতে স্পষ্টতই কোরানের নির্দেশের উল্লঙ্ঘন। বলা বাহুল্য যে এই সংস্কারের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সাহাবি ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিলো। সেই সংস্কারটির উপর আলোকপাত করা হবে একটু পরে। এখন খলিফার বিরুদ্ধে  বিদ্রোহের আসল কারণগুলি কী কী সেই সেই দিকে দৃষ্টি ফেরানো করা যাক। মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুগণ ওসমানের সমালোচনা করলেও তাঁর ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্যে তাঁকেই সম্পূর্ণ দায়ী করতে চান নি। সুন্নি মুসলিমদের বিচারে ইসলামের ইতিহাসে মাত্র যে চার জন খলিফাকে ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’ (সৎপথে পরিচালিত খলিফা) এর মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ওসমান অন্যতম। সুতরাং তাঁকে তো ইসলাম থেকে বিচ্যুত বলা যায় না। তাই তাঁর উপর  আরোপিত ও উত্থাপিত সকল দোষ-ত্রুটির দায় চাপানো হয়েছে তাঁর দু’জন অধস্তন প্রশাসকের উপর। তাঁরা হলে তাঁর প্রধান মন্ত্রী (সচিব) মারওয়ান এবং সিরিয়ার গভর্ণর আমির মাবিয়া (মুয়াবিয়া)। মারোয়ান সম্পর্কে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ কী বলেছেন তা শোনা যাক। ড. ওসমান গণি লিখেছেন, হযরত ওসমানের চরম দুর্ভাগ্য যে তাঁর নিকটতম সহযোগী বা প্রধান সচিব বা উপদেষ্টার স্থান লাভ করলো তার চাচাতো ভাই ও জামাতা মারওয়ান। মারওয়ান ছিলেন দুর্নীতি পরায়ণ কুচক্রী মানুষ এবং খলিফা ওসমান ছিলেন ন্যায়পরায়ণ সরল মানুষ।  সুতরাং খলিফা সহজেই মারওয়ানের শিকার হলেন। (দ্রঃ- হযরত ওসমান গণী (রাঃ), পৃ-১৮৩) ভারতীয় মুসলিম সমাজের একজন বিশিষ্ট বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি আমির আলিও ওই একইভাবে মারওয়ানের বিরুদ্ধে দোষারোপ করে লিখেছেন – তিনি (খলিফা) অজ্ঞাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর পরিবারের প্রভাবাধীন ছিলেন। মহানবী কর্তৃক একবার বিশ্বাসভঙ্গের অভিযগে বহিষ্কৃত এবং উমাইয়াদের মধ্যে অন্যতম নীতিজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তি সচিব মারওয়ান কর্তৃক পরিচালিত হলেন। (সূত্র – ঐ) অবশ্য মারওয়ান অপেক্ষা অনেক বেশী সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয়েছে মাবিয়াকে। সে আলোচনা করা হবে পরে।  
ওসমান গণির সঙ্গে মুহাম্মদ তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং  তিনি (ওসমান গণি) আলীর থেকে অধিক যোগ্য বিবেচনায় আলীর বাদ দিয়ে তাঁকেই ৩য় খলিফার জন্য নির্বাচিত করা হয়। এই দুটি ঘটনা প্রমাণ করে যে ওসমান একজন সাধারণ মাপের সাহাবী ছিলেন না। তিনি নিশ্চয়   মুহাম্মদের বিশ্বস্ত সাহাবী এবং প্রাজ্ঞ ও ব্যক্তিত্বশালী মানুষ ছিলেন। এমন একজন খলিফা কলের পুতুলের মতো অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইসলাম প্রদর্শিত পথ পরিত্যাগ করেছিলেন এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। আর তা ছাড়া তিনি ইসলামি নীতি বর্জন করে খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন – এ অভিযোগও যে ভিত্তিহীন সে কথা একটু আগেই আলোচনা করা হয়েছে। আর ইতিহাস থেকে এ প্রমাণও পাওয়া যায় যে মারওয়ান ও মাবিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগও বহুলাংশেই মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আসলে তাঁদের প্রধান দোষ (!) ছিলো দুটি – এক). তাঁরা দুজনেই ছিলেন উমাইয়া বংশের মানুষ, এবং দুই). তাঁরা খলিফার প্রতিটি সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন ও সেগুলি আন্তরিকতার সাথে কার্যকর করেছিলেন এবং অন্যান্য সাহাবিদের সমালোচনা ও বিরুদ্ধ প্রচারে সামিল হয়ে খলিফাকে বিব্রত করেন নি। এখন প্রশ্ন হলো উমাইয়া বংশের প্রতি সাহাবিদের কেনো এতো রাগ, ক্ষোভ ও অবিশ্বাস? উমাইয়া বংশের উপর সাহাবিদের প্রবল অবিশ্বাস, সন্দেহ, অসন্তোষ, ক্ষোভ ও ক্রোধের পেছনে প্রধান কারণটি এই যে, মক্কার মাটিতে মুহাম্মদের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড়ো এবং প্রায় দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো উমাইয়া বংশের লোকজন। মক্কার অধিবাসীদের আদি বংশ ছিলো কোরেশ বা কোরায়েশ বংশ যারজন্যে তাদের কোরেশ বলে ডাকা হতো। সেই বংশের দু’টো গোত্র বা গোষ্ঠী ছিলো যাদের একটা হাসেমি এবং অপরটি ছিলো উমাইয়া গোষ্ঠী। হাসেমি গোষ্ঠীর লোকজন হাসেমি বংশের লোক এবং উমাইয়া গোষ্ঠীর লোকেরা উমাইয়া বংশের লোক নামে ইতিহাসে অভিহিত। এই দু’ই বংশের মধ্যে মতান্তর ও বিরোধ ছিলো অতিশয় তীব্র, সাপে-নেউলে সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় ঠিক সে রকম। মুহাম্মদ ইসলামের পক্ষে মক্কায় খুব কম লোকের কাছ থেকে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছিলেন। বরং মুহাম্মদ যখন ইসলামের পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে কোরেশদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করতেন তখন তারা তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন, এমনকি মুহাম্মদ তাদের ধর্মকে অপমান করার মাত্রা বাড়িয়ে দিলে তারা শেষ দিকে মুহাম্মদকে নানাভাবে উত্যক্তও করতেন। এক সময় তো কোরেশরা মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের বয়কটও করেছিলেন।  এ সব কারণে মুহাম্মদ এক সময় মক্কা ছেড়ে মদিনা চলে যান। সে সময় যে কতিপয় কোরেশ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলামকে কবুল করেছিলেন তাঁরা ছিলো সকলেই হাসেমি বংশের লোক। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ওসমান গণি যিনি উমাইয়া বংশের লোক ছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিলেন এবং বংশ, আত্মীয়-স্বজন এবং নিজ বাসভুমি পরিত্যাগ করে মুহাম্মদের সঙ্গে মদিনা চলে গিয়েছিলেন। এ জন্যেই মুহাম্মদ গোটা উমাইয়া বংশকেই তাঁর শত্রু মনে করতেন। মক্কায় বিজয় হাসিল করার পর কোরেশরা সকলেই প্রাণ রক্ষার্থে স্বধর্ম ত্যাগ করে মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও তিনি উমাইয়া বংশের লোকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন নি।       





(বিঃদ্রঃ- এর আগের অংশটির লিঙ্ক হলো -  
http://giasuddinonline.blogspot.in/2016/05/blog-post_22.html  , এবং পরের অংশের লিংকটি হলো -

http://giasuddinonline.blogspot.in/2016/10/blog-post_6.html )
  


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...