Thursday, August 31, 2017

৩ তালাক বাতিল: চাই সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকাররের ভিত্তিতে অভিন্ন আইন

ঘটনা ১. বর ও বৌয়ের মধ্যে কিছুদিন ধরে বনিবনা নেই। দু’জনে একসঙ্গে বেরিয়েছেন এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্য। বাড়ির অশান্তি রাস্তাতে নেমে আসে। বৌ রাগের বশেই একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করে, বর কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। বর কয়েক বার বৌকে আস্তে হাঁটতে বলেবৌ তাতে কান দেয়  নি। রাস্তার মাঝে বৌয়ের এমন আচরণে বরের আঁতে ঘা লাগে। বর ঠিক করে অবাধ্য বৌকে চরম শাস্তি দিতে হবে। ব্যাস! বরের বজ্র নির্ঘোষ – তালাক। তালাক। তালাক। না, এটা সিনেমার কোনো স্ক্রীপ্ট নয়। বাস্তব জীবনের ঘটনা। সৌদি আরবের রিয়াধের একটি ঘটনা। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। রোজ অন্তত ১২৭টি ডিভোর্সের মামলা হয় সৌদি আরবে। (http://www.sangbadpratidin.in/saudi-man-divorces-wife-for-walking-ahead/)  ঘটনা ২. দু’ই ভাইরা ভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি। ওদের মধ্যে অশান্তি হয়েছে। একদিন এক ভাইরা ভাই আর এক ভাইরা ভাইয়ের বাড়ি চরে তার মায়ের গায়ে হাত দিয়ে বসে। যার মায়ের গায়ে হাত পড়েছে সে তখন বাড়ি থকে প্রায় এক হাজার কিমি দূরে ওড়িশায় কাজ করছে। মোবাইলের যুগ, খবরটা দ্রুতই তার কানে পৌঁছে যায়। অমনি মোবাইলে তার বৌকে ধরে বলে, তোর বহনু (ভগ্নীপতি) আমার মাকে মেরেছে, তাই তোকে তালাক। তালাক। তালাক। হ্যাঁ, এটাও একটি জীবনের ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে আমার বাড়ির পাশে ২০০৬/২০০৭ সালে। এমন কোনো মুসলিম গ্রাম নেই যে গ্রামে কারণে, অকারণে বা তুচ্ছ কারণে তালাকের ঘটনা ঘটেনি। এ রাজ্যে তালাকপ্রাপ্ত ও বর-পরিত্যাক্ত নারীর সংখ্যা লক্ষাধিক।   
হ্যাঁ, শরিয়তি আইনে বৌকে তালাক দেওয়া এমনই সহজ। চিঠি পাঠিয়ে, মোবাইলে টেক্সট মেসেজ দিয়ে, ফেসবুকে চ্যাট করে, হোয়াটস অ্যাপে ভিডিও কল করে বা মেসেজ পাঠিয়ে বৌকে তালাক দেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটছে এখন। বৌকে তালাক দেবার এ রকম প্রত্যেকটি পদ্ধতিই শরিয়তি তালাক আইনে বৈধ যে আইনটি তৈরী হয় কোরান-হাদিসের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালেএর থেকেও সহজ পদ্ধতি রয়েছে কোরানে যেখানে মুখে ‘তিন বার তালাক’ না বলে কিংবা চিঠি বা মোবাইল/ইমেল/হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ না পাঠিয়েও বৌকে তালাক দেওয়া যায়  মনে মনে বৌকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত করে তার সঙ্গে চার মাস যৌন মিলন না করলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে কোরানের পরিভাষায় যাকে ইলা তালাক (কোরানের ২/২২৬, ২২৭ আয়াতের উপর ভিত্তিতে রচিত শরিয়তি আইনের ৩৭০ নং ধারা) বলে। শরিয়তি তালাক আইন এমনই অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও অসভ্য আইন! মদিনায় ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর নামে এই আইনটি তৈরী হলেও মুসলিম বিশ্বের ২০/২২টি দেশ বর্বর এই আইনটিকে বাতিল করে দিয়েছে যে দেশগুলির মধ্যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশও রয়েছে। আমরা আমাদেরকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক বলে  বড়াই করি, অথচ এতোদিন আমরা কুৎসিত এই আইনটিকেই যকের ধনের মতো বুকে আগলে রেখেছিলাম। ছিঃ! ভাবতেই লজ্জা লাগে।              
অবশেষে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই ২২ শে আগস্ট বাতিল হলো সর্বকালের সবচেয়ে কালা এই কানুনটি। যতো রকমের তালাক আইন আছে, তালাক আইনের যতো রকম পদ্ধতি আছে তার সবগুলোই আদালত তার রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষা বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। কোরান ও হাদিসে তালাক আইনের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। কোরানের তালাক আইনটি জটিল, তাতে বিভিন্ন ধারা রয়েছে, সে সব ধারায় নানা বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। ফলে তালাকেরও নানা রকম ও নানা নাম আছে। সকল প্রকার তালাক আইন প্রধানতঃ দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত। তার একটির বৈশিষ্ট হচ্ছে অপ্রত্যাহারযোগ্য তালাক এবং আর একটি প্রত্যাহারযোগ্য তালাক। অপ্রত্যাহারযোগ্য তালাককে ইসলামের পরিভাষায় তালাক–ই–বিদাত এবং প্রত্যাহারযোগ্য তালাকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাসান তালাক ও এহসান বা আহসান তালাক সর্বোচ্চ আদালতের যেগুলির উল্লেখ রয়েছে। কোরানের সমগ্র তালাক আইনটিকেকে অক্ষত ও সুরক্ষিত রেখেই সেগুলির সঙ্গে হাদিসে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে কেবল।  সেই ধারাটি হলো, বর একসঙ্গে ইচ্ছা করলে, তা ন্যায়সঙ্গত হোক বা  না হোক, তিন তালাক দিতে পারবে এবং সে তালাক প্রত্যাহার করা যাবে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কোরান তিন মাসে তিন তালাক দেবার কথা বলেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে,  ১৯৩৭ সালে যে শরিয়তি আইন তৈরী হয় তার প্রধান দু’টি উৎস বা স্তম্ভ হলো কোরান ও হাদিস। সুন্নী সমাজের ধর্মগুরুরা ১৯৩৭ সালের তৈরী এই শরিয়তি আইনটিকেই  যথার্থ আল্লাহর আইন বলে বিশ্বাস করে এবং যে কোনো মূল্যে এটিকে রক্ষা করতে চায়। অপরদিকে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন যে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াটা অনৈসলামিক। আসলে তাঁরা মিথ্যাচার করেন। কারণ, হাদিসকে বাদ দিলে ইসলাম আর ইসলামই থাকে না। 
একটা প্রচার করা হয় যে, কোরানের তালাক আইনটি বেশ ভালো। সুতরাং একসঙ্গে তিন তালাক বাদ দিয়ে সেটাই চালু করা হোক। এটা একেবারে ভুল ধারণা। বৌকে এক তালাক দিলে তাকে তার বরের মন জয় করার জন্যে তার বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে – এই হলো কোরানের বিধি। এটা অবাস্তব বিধি। কারণ, এক). বর যে যদি তাকে থাকতে, পরতে ও খেতে না দেয় তবে কী হবে সে বিষয়ে কোরান নীরব। দুই). বর যদি তার বৌকে তালাক দেবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ থাকে তবে তার বাড়িতে সেই বৌয়ের তিন মাস কেন তিন ঘণ্টা অবস্থান করারও পরিবেশ থাকা সম্ভব নয়। বরের বাড়ির অন্য সদস্যরা তার সঙ্গে সহানুভূতিশীল এবং সম্মানজনক আচরণ করবে এমনটা কল্পনাতীত ব্যাপার। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে, তিন বারে তিন তালাক দেওয়ার কোরানীয় বিধিটিও নারীর পক্ষে ভীষণ অসম্মানজক এবং বাস্তবায়িত করার অনুপযুক্ত।
যারা কোরানের তালাক বিধির খুব প্রসংশা করেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি যে, কোরানের বিধি অনুসারে তিন তালাক তিন বারে দেওয়া (যা নারীর পক্ষে যথেষ্ট অসম্মানজনক ও অবাস্তবও) ছাড়াও আরো বহু বিধি আছে যেগুলির কোনোটাই নারীর পক্ষে শুভ ও সম্মানজনক নয়। সেগুলির মধ্যে রয়েছে ইলা তালাক যার কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে একটি ভয়ংকর নারীবিরোধী তালাক বিধি যেটা কোরানের ৪/২০ নং আয়াতের ভিত্তিতে প্রণীত। সেখানে বলা হয়েছে কোনো বিবাহিত পুরুষের অন্য একজন নারীকে পছন্দ হলে তাকে বিয়ে করার জন্যে তার বৌকে সে তালাক দিতে পারবে। কোরানের তালাক বিধিতে আর একটি ধারা আছে যা নারীর পক্ষে সবচেয়ে অসম্মানজনক ও অবমাননাকর। সেই বিধিটি রয়েছে ভারতীয় শরিয়তি আইনের ৩৫১ নং ধারায় যে ধারাটি কোরানের ২/২৩০ নং আয়াতের ভিত্তিতে রচিত। সেখানে বলা হয়েছে বর তিন তালাক দেওয়ার পর যদি অনুতপ্ত হলেও তালাক প্রত্যাহার করতে পারবে না। এমনকি পুনরায় সে তার সেই বৌকে সরাসরি বিয়ে করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্ত সেই নারীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করতে হবে। তারপর সেই পুরুষটি মারা গেলে কিংবা তালাক দিলে তবে সেই নারীটি তার প্রাক্তন বরের উপযুক্ত হবে। আর অন্য পুরুষের সঙ্গে শুধু নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে করলে হবে না, তাকে (দ্বিতীয় বরকে) তার শরীরটাও সঁপে দিতে হবে তার ভোগের জন্যে। কোরানের তালাক বিধির আর একটি দিক আছে সেটাও সম্পূর্ণ নারীবিরোধী ও ভীষণ অগণতান্ত্রিক। তা হলো, কোরান নারীকে তালাক দেবার অধিকার শুধু পুরুষকেই দিয়েছে, নারীর তালাক দেবার অধিকার নেই এবং যতো অন্যায়ভাবেই বর তার বৌকে তালাক দিক না কেন, তা প্রতিহত করার কোনো রক্ষা কবচ কোরান নারীকে দেয়নি।  এই হচ্ছে কোরানীয় তালাক আইনের কুৎসিত রূপ।
মূল কথা হল কী কোরান, কী হাদিস, দু’টি ধর্মগ্রন্থেই যে তালাক আইন রয়েছে তা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বর্বর ও অমানবিক এবং সম্পূর্ণ একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক আইন। তাই সমগ্র শরিয়তি তালাক আইনটিকেই বাতিল করে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছে যা ভারতের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই সর্বোচ্চ আদালতের যে তিন জন বিজ্ঞ বিচারপতি এই রায় দিয়েছেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই যে মুসলিম মহিলারা মুসলিম পুরুষ এবং মোল্লা-মুফতিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিন তালাক-সহ সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিলের দাবীতে লড়াই করেছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদেরও। এবং সব শেষে ধন্যবাদ জানাই বিজেপির সরকারকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
১৫ই আগষ্ট ও ২৬শে জানুয়ারী আমরা পালন করি মহাসমারোহে আমাদের স্বাধিনতা ও নিজস্ব সংবিধান প্রাপ্তির জন্যে। কিন্তু ভারতের মুসলিম নারীর কাছে এই দুটো দিনের কোনো অর্থই ছিলো না। তারা স্বাধীনতার ৭০ বছর পর এতদিনে একটা দিন, ২২ শে আগষ্ট, পেলো উদযাপন করার জন্যে। এই দিনেই তারা তিন তালাক-সহ সমস্ত তালাকের খড়্গ থেকে মুক্তি পেলো, বিনা কারণে আল্লাহর দোহাই দিয়ে পুরুষেরা যখন তখন তালাক দিয়ে তাদের জীবনের সব নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে আর তাদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিতে পারবে না।           
সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে কেন্দ্রিয় সরকার লোকসভায় আইন পাশ করে বাতিল করে দিতে পারে জেনেও বলছি যে, মুসলিম মেয়েরা এবার নিশ্চিতভাবেই শরিয়তি তালাক আইনের হাত থেকে মুক্তি পেলো। কারণ যারা মুসলিম ভোটের লোভে মাওলানা-মুফতিদের সারা জীবন গোলামী করেছে এবং মুসলিম নারীদের বুকে ছুরি চালিয়েছে তারা এখন ক্ষমতায় নেই। সুতরাং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আই ভরসাটুকু রাখাই যায় যে, সর্বোচ্চ আদালত যেমন বলেছে সেই মতো কেন্দ্রিয় সরকার নিশ্চয় ছ’মাসের মধ্যে একটি তালাক আইন প্রণয়ন করবে যে আইনে মুসলিম নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত করা হবে।
শুধু তালাক আইনটিই নয়, সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিই নারীবিরোধী, অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক। যে আইন পুরুষের জন্যে জঘন্য বহুবিবাহকে অনুমোদন করেছে, তালাকের পর নারীকে খোষপোষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, তালাকের পর নারীর উপর কুৎসিত ইদ্দত আইন আরোপিত রয়েছে, দত্তকবিরোধী অমানবিক আইন রয়েছে এবং মজনুবিলাস আইন-সহ বৈষম্যমূলক ফারাজ আইন (উত্তরাধিকার আইন) রয়েছে। তাই সমগ্র সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিরই অবসান ঘটানো জরুরী। ভারতের মুসলিম নারীদের প্রায় ৯২% নারীই চাই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অক্টোপাশ থেকে মুক্তি। এটা নিয়ে এই কাগজেই আমি নিবন্ধ লিখেছি গত বছর। সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল না করলে শুধু তালাক আইন বাতিলের মধ্যে দিয়ে মুসলিম নারীর মুক্তি আসবে না। নারীর প্রতি সমস্ত বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচার দূর করে নারীকে স্বাধীনতা ও সমানাধিকার দিতে হলে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটিকে বাতিল করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। চাই তার একমাত্র বিকল্প আইন - সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকাররের ভিত্তিতে অভিন্ন আইন২২শে আগষ্টের রায়ের বজ্র নির্ঘোষ সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি বড়ো পদক্ষেপ বলে আমার মনে হয়এই কাগজেই গত  বছরে বোধ হয় সেপ্টেম্বর মাসে আমি লিখেছিলাম যে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তিম দশা আমি দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে হয় এবার সবাই দেখতে পাচ্ছেন।

Monday, August 21, 2017

শরীয়া তালাক আইন নিয়ে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দটি সমাধান অযোগ্য



এখন একজন মুসলিম পুরুষ তার বৌকে তালাক (divorce) দিতে পারে নানা পন্থায়। ইসলাম কিন্তু শুরুতে তালাক দেওয়ার যে বিধান প্রচলন করেছিলো তাতে পদ্ধতি ছিলো মুলতঃ একটিই। বরকে তার বৌ-এর মুখের সামনে ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করে তালাক দিতে হতো। বলতে হতো, তোমাকে ‘তালাক’ দিলাম। তবে অন্য শব্দ বা কথা বলেও তালাক দেওয়া বৈধ বলে গণ্য হতো। যেমন মুহাম্মদ স্বয়ং তাঁর ২য় বৌ সওদাকে ‘তোমার ইদ্দত গণনা করো’ বলে প্রথম তালাক প্রদান করেছিলেন।  প্রথম দিকে এক মাস অন্তর দু’বার তালাক দেওয়ার পর তিন তালাক দিয়ে ‘বাইন’ তালাক বললে তালাক কার্যকর হতো। পরে সেটায় একটি সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধনিতে ঠিক হয় যে, এক সঙ্গে পরপর তিনবার তালাক দিয়ে বাইন তালাক বললেও তালাক কার্কর হবে। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তালাক দেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নেওয়াকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।  ফলে তালাক দেওয়ার পদ্ধতিতে একটা বৈপ্লবিক  পরিবর্তন এসেছে। এখন তাই তালাক দেওয়ার নানা পন্থা বেরিয়েছে এবং বৌকে তালাক দেওয়া অনেক সহজ হয়েছে। এখন একজন মুসলিম পুরুষ তার  বৌকে তালাক দিতে পারে ডাক যোগে বা ক্যুরিয়ার মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে, মোবাইলে বা হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে, ইমেল পাঠিয়ে অথবা মোবাইলে ফোন করে কিংবা ভিডিও কলিং করেইন্টারনেটের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার এই অভিনব ও সহজ পন্থাগুলি ইসলাম-সম্মত কী না তা নিয়ে অবশ্য উলামা বা আলেম সমাজের মধ্যে মতবিরোধ আছে। এই বিরোধ যে খুব প্রবল  তা বলা যায় না। তবে প্রবল মতবিরোধ রয়েছে মূল তালাক আইন (বিবাহ-বিচ্ছেদ আইন/Divorce law) নিয়েই  এই মতবিরোধের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ ভাগ রয়েছে দেখা যায় যার একটি হলো ইসলামি তত্ত্বভিত্তিক, আর অন্যটি লিঙ্গভিত্তিক। প্রথম বিরোধটি সীমাবদ্ধ মূলতঃ আলেম সমাজের মধ্যে। দ্বিতীয় বিরোধটি মুসলমান সমাজের সঙ্গে আলেম সমাজেরএই বিরোধটি খুবই তীক্ষ্ণ ও  বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত।  প্রথম বিরোধটি তথা আলেম সমাজের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধটির  বীজ নিহিত রয়েছে মুসলমানদের দু’টি ধর্মগ্রন্থ  কোরান ও  হাদিসের মধ্যে। কোরানে তালাক সংক্রান্ত যে বিধি-নিষেধ রয়েছে, হাদিসে রয়েছে তার থেকে অনেকটাই আলাদা বিধি-নিষেধএকদল (শিয়া মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুগণ) কোরানের বিধানকেই একমাত্র ইসলাম-সম্মত বিধান বলে মানেন। তাঁদের মতে যারা (সুন্নি মুসলমানরা) যে হাদিসের কথা বলে তা মনুষ্যরচিত তথা খলিফাদের মনোনীত ধর্মগুরুদের রচিত মনগড়া   যা জাল এবং সেই হাদিসের বিধানগুলি ইসলামবিরোধী অপর দল (সুন্নি সমাজের আলেমগণ) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস  করেন যে  কোরান এবং হাদিস দু’টো ধর্মগ্রন্থই সমান সত্য, সংশয়াতীত ও নির্ভুল  তাঁদের অভিমত  হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিবার্য কারণে কোরানের বিধি আল্লাহ স্বয়ং পরিবর্তন করেছেন যে পরিবর্তনগুলির কিছু এসেছে আল্লাহর প্রেরিত দূত মুহাম্মদের মাধ্যমে, কিছু পরিবর্তন আল্লাহ  সরাসরি  জিব্রাইলের মাধ্যমে পাঠিয়েছেনতাঁদের মতে হাদিস ও কোরান পরষ্পরের পরিপুরক এবং কোরানের প্রত্যেকটি কথা যেমন সত্যি তেমনি প্রত্যেকটি হাদিসও সমান সত্যি কারণ,  মুহাম্মদ আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছা ব্যতীত কিছু বলেন নি ও করেন নি  নিজ নিজ বিশ্বাসের জায়গায় অনড় থাকার পরিণতিটা হলো এই যে  শিয়া মুসলিম সমাজ শুধু কোরানে বর্ণিত তালাক আইন মেনে চলে এবং সুন্নি মুসলিম সমাজ মেনে চলে কোরান ও  হাদিস উওভয় ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিতে প্রণয়ন করা তালাক আইন যা শরিয়তি আইন (Sharia Law) নামে খ্যাত ভারতের সুন্নি সমাজের আলেমগণ ১৯৩৭ সালে কোরান ও হাদিসের সমন্বয়ে শরিয়তি তালাক প্রণয়ন করেন যা বাংলা সংস্করণে ‘বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন’ বলে খ্যাত। তত্ত্বগত এবং বিধিগত প্রবল মতবিরোধের জন্যে শিয়া মুসলিম এবং সুন্নি মুসলিম সমাজের আলেমদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এই দ্বন্দ ভারতের মাটিতে এক সময় চূড়ান্তরূপে প্রকটিত হয়ে পড়ে এবং শিয়া সমাজের প্রতিনিধিরা ‘নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Personal Law Board) থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি পৃথক  নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Personal Law Board) গঠন করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এই দ্বন্দ শুধু শিয়া ও সুন্নি সমাজের পুরুষ আলেমদের  মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। দ্বন্দ প্রসারিত হয়ে পড়েছিলো সুন্নি সমাজের পুরুষ ও নারী ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও। ফলে ‘নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ – এর নারী সদস্য এবং পুরুষ সদস্যদের মধ্যেও সেই দ্বন্দটি সেই সময়ে  চরম আকার ধারণ করে এবং পর্ষদের নারী সদস্যগণ এক সময়  ‘নিখিল ভারত  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন  পর্ষদ’ কর্তৃক প্রণীত বিয়ে ও তালাক আইনকে সম্পূর্ণ পুরুষকেন্দ্রিক ও নারীবিরোধী আখ্যা দিয়ে পুরো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের  দাবী উত্থাপন করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পুরুষ সদস্যগণ তাঁদের দাবি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখান করেন। এর প্রতিবাদে নারী সদস্যগণ ‘নিখিল ভারত  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ থেকে পদত্যাগ করে বেরিয়ে  গিয়ে গঠন করেন মুসলিম মহিলাদের নিজস্ব পৃথক ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ - ‘নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim Women Personal Law Board)  সেটাও ২০০৫ সালের ঘটনা। মুসলিম নারীদের এই পর্ষদ পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ পৃথক একটি ‘নিকাহ নামা’ অর্থাৎ ‘নিকাহ আইন’ প্রণয়ন করে যে  ‘নিকাহ নামা’য় তাঁরা নারীদের পুরুষদের সমান অধিকার প্রদান করেন।  ‘নিখিল ভারত মুসলিম মহিলা ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ’ (All India Muslim  Women Personal Law Board) - তাদের প্রণয়ন করা নতুন ‘নিকাহ নামা’টি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পেশ করে আইনটিকে অনুমোদন ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে।       
তালাক আইন নিয়ে দ্বিতীয় যে বিরোধটি রয়েছে সেটা হলো মূলতঃ মুসলিম  জনতার সঙ্গে মুসলিম সমাজের আলেমদের বিরোধ এই বিরোধটি কোনো একটি দেশের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই, এটা যে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত সে কথা এর আগেই বল হয়েছেলিঙ্গগত বৈষম্য হলো এই বিরোধটির উৎপত্তির মূল কারণ গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজ এই বিরোধকে কেন্দ্র করে সরাসরি দু’টি শিবিরে বিভক্ত  আলেম সমাজ এবং সাধারণ মুসলিম জনতার মধ্যেকার দ্বন্দে এক পক্ষে যে শুধু আলেম সমাজ     এবং অপর পক্ষে সাধারণ মুসলিম জনতা  রয়েছে তা নয়।  ভারতে যে ছবিটা আমরা দেখি তাতে দেখা যায় যে মুসলিম জনতার একটা বিপুল অংশও রয়েছে আলেমদের সঙ্গে এবং তারা ঐক্যবদ্ধভাবে   তালাক মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর অপরদিকে বাকি  অংশের মুসলমানরা চায় যে এই আইনটি সংশোধন বা বাতিল হোক তাদের দৃঢ় অভিমত হলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষিত হয় নি এবং আধুনিক সমাজে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা আর নেই এই বিরোধটি ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে। যারা  মুসলিম ব্যক্তিগত  তালাক আইনের  পরিবর্তে নারীর স্বার্থবাহী নতুন তালাক আইন প্রণয়নের পক্ষে তাদের পাল্লা দিনকে দিন ভারী হচ্ছে। এমনকি মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুদের মধ্য থেকেও একটা অংশ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি হালনাগাদ (update) করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। তাঁরাও খোলামেলা এটা বলছেন যে পরিবর্তিত পরিস্থিতে নতুন মুসলিম ব্যক্তিগত আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। আলেম সমাজের সঙ্গে মুসলিম সমাজের তীব্র বিরোধে  আলেম সমাজের একটা অংশ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারের দাবিকে সমর্থন জানানোর ফলে মুসলিম বিশ্বে ২২/২৩টি তালাক আইন-সহ সমগ্র মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি হয় সম্পূর্ণই বাতিল হয়ে গিয়েছে, না হয় ব্যাপক মাত্রায় সংশোধিত হয়েছে। এ সব দেশ বহুবিয়ে হয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে, নতুবা দ্বিতীয় বিয়ের আগে আদালতের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে। আর শরিয়া  তালাক আইনটি তো সবগুলি দেশই  সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেছে।  এই দেশগুলি  আদালতের বাইরে তালাক প্রদান সম্পূর্ণ নিষদ্ধ করেছে। যে দেশগুলি  শরিয়া বিয়ে ও তালাক আইন সংশোধন বা বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে  তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশ হলো ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া,   মালয়েশিয়া, তাজকিস্তান, কাজাখাস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইত্যাদি। ভারত একটি হিন্দু অধ্যুষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তথাপি এ দেশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তথা ইসলামি বিয়ে ও তালাক আইন চালু রয়েছে। সেটা এ জন্যে নয় যে এ দেশের সমগ্র মুসলিম সমাজ মুসলিম ব্যক্তিগত আইন আঁকড়ে থাকতে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান দেখা যায় কেবল উলামা তথা আলেম সমাজের মধ্যেই দেশের ভোটভিখারি রাজনৈতিক দলগুলি সাধারণ মুসলিমদের স্বার্থের কথা মোটেই ভাবে না, তারা আলেম সমাজকেই কেবল  তুষ্ট রাখতে সদা তৎপরএই রাজনৈতিক দলগুলো চায় না মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি সংস্কার হোক। তাই এ দেশে আজো মুসলিম ব্যক্তিগত আইন তথা শরিয়া বিয়ে ও তালাক আইন আজও চালু রয়েছে। কিন্তু এই  আইনটির বিরুদ্ধে এ দেশে জনমত ও আন্দোলন ধীরে  ধীরে হলেও ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে।  প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করছেন প্রধানতঃ   এ দেশেরই মুসলিম মহিলারা। ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করছে। বলা বাহুল্য যে এই সংগঠনটি ভারতের মুসলিম মহিলারাই তৈরী করেছেন এবং পরিচালনা করছেন। তাঁরা কয়েকমাস আগে ৭০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন পত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছেন যেখানে বহু বিয়ে এবং তালাক আইন বাতিল করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার দাবি জানানো হয়েছে। তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতেও একই দাবি জানিয়ে একটা রিট পিটিশন দাখিল করেছেনসুপ্রিম কোর্ট সেই পিটিশন গ্রহণ করে আইনি প্রক্রিয়া শুরুও করেছে। এখন ভারতে গোটা দেশ জুড়েই এই মুহূর্তে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে।  
তালাক আইনের কথায় ফিরে আসা যাক। এই আইন নিয়ে দ্বন্দের যে ছবিটি আমরা দেখি তা হলো এই যে, তালাক আইন নিয়ে আলেম সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ এবং আলেম সমাজ ও মুসলিম জনগণের দ্বন্দ ক্রমবর্ধমান। আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট লক্ষ্যণীয় এই দ্বন্দটি নিয়ে তা হলো - উপরে উল্লেখিত দ্বন্দ দু'টি সমগ্র বিশ্বজুড়েই রয়েছে এবং দ্বন্দ দু'টি ক্রমশঃ তীব্র ও প্রকট হচ্ছে, কোথাও হ্রাস পাচ্ছে না বা প্রশমিত হচ্ছে না। দ্বন্দের এই ছবিটি থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে দ্বন্দ দু'টি মীমাংসার অযোগ্য এবং এই দ্বন্দটির অবসান হতে পারে কেবল মুসলিম ব্যক্তগত আইনটির মৃত্যু বা বিলুপ্তি ঘটার মধ্য দিয়ে। পরিস্থিতি সেই দিকেই এগোচ্ছে। তালাক আইন নিয়ে উদ্ভূত দ্বন্দ কেনো ক্রমবর্ধমান এবং কেনো এর বিলোপ অবশ্যম্ভাবী তা জানতে হলে জানতে হবে ভালো করে শরিয়া তালাক আইনটি।    
     

Tuesday, August 15, 2017

নারীর স্বাধীনতা দিবস নেই



সত্তর বছর বাদ -
১৫ই আগস্টের এই ভোরে
পুরুষ, আজ তোমরা আরো বলীয়ান, আর
আমরা আরো শক্তিহীন, আরো অসহায় -  
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন       
সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরাই শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়র, ডাক্তার, ব্যারিষ্টার,  
আর আমরা তোমাদের গিন্নি, কৃপা প্রার্থী –
আজ ১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই  দিন   
সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরা তো ওসি, এসপি, ডিএম, সচিব,   
 দণ্ডমুণ্ডের কর্তা 
 আর আমরা তোমাদের গৃহে বন্দী, নাম দিয়েছো গৃহিণী,  -  
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন      
সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরাই গৃহস্বামী, ভূস্বামী, আর
আমরা তো আজো তোমাদের গৃহদাসী –
 ১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন 
 সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরা বেদ, বাইবেল, কোরান উঁচিয়ে
আমাদের শাসন করো, চাবুক মারো,      
আর আমরা  কেবল তোমাদের যোনি – 
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন 
সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরা আমাদের দেহের মালিক
গর্ভের মালিক, যোনিরও মালিক,
আর আমরা তোমাদের যৌনদাসী –
 ১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন 
 সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো তোমরা আমাদের সিঁথির সিঁদুর,
কপালের টিপ, হাতের শাঁখা,
 আজো আমাদের মঙ্গলসূত্র বাঁধতে হয়  
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন  
সত্তর বছর বাদ -
পুরুষ, আজো আল্লাহ-ভগবান তো
কেবল তোমাদেরই পতাকা বয়,
আর আমাদের বেহেস্ত তো আজো তোমাদের পা'য় -
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন  
সত্তর বছর আগে - 
পুরুষ, তোমরাই পেয়েছিলে স্বাধীনতা,
পেয়েছিলে গদি, পেয়েছিলে ক্ষমতা,
আমরা সেদিন ছিলাম তোমাদের দাসী
আজো তেমনই আছি - 
১৫ই আগস্ট তো তোমাদেরই দিন  
সত্তর বছর আগে - 
পুরুষ, শোনো
আমাদের স্বাধীনতা ছিলো না কোনো,
আমরা আজো পরাধীন
 আমাদের স্বাধীনতা নেই কোনো

    

আজ ২৬শে জানুয়ারি, তোমাদের পতাকা তোলার দিন



সত্তর বছর আগে –
তোমরা ধনী ছিলে, আজ ধনকুবের -   
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
আমার জমিজমা, ভিটেমাটি যেটুকু ছিলো
তার সবই গেছে তোমাদের গ্রাসে - 
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
তোমাদের ছিলো সাততলা অট্টালিকা   
আজ সত্তরতলার রাজপ্রাসাদ  - 
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
আমার একটা কুটীর ছিলো
আজ আমি বস্তিতে, ফুটপাতে -  
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
তোমাদের সম্পদ পাহারা দিতো  
বৃটিশ পুলিশ,  
আজ পাহারা দেয়
তোমাদের নিজেদের পুলিশ –
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
আমার বস্তি উচ্ছেদ করেছে বৃটিশরা
আজো আমার বস্তি উচ্ছেদ হয়
তোমাদের হাতে -
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ
সত্তর বছর আগে –
বৃটিশ পুলিশ আমাকে বলেছে সন্ত্রাসবাদী
আজ তোমাদের কেছে আমি দেশদ্রোহী -
আজ তোমরা পতাকা তোলো
তোমাদের পতাকা তোলার দিন আজ


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...