Wednesday, November 23, 2016

কারবালা যুদ্ধঃ মিথ ও মিথ্যা – (ছয়)


                      ৬ষ্ঠ অধ্যায় 


আলি খুন হয়েছিলেন হয় জিম্মীদের হাতে না হয় খারিজীদের হাতে 



ইমাম হাসেন স্বেচ্ছায় তাঁর নিজের অংশের খেলাফত মাবিয়ার হাতে তুলে দিলে পর মাবিয়া হন সমগ্র ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা, কারণ বাকি ভুখন্ডের মুসলমানরা ইতিপূর্বেই তাঁকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেনমাবিয়ার স্কন্ধে যখন(৬৬১খ্রীঃ) পঞ্চম খলিফা হিসাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের বিশাল গুরু দায়িত্ব অর্পিত হলো তখন সাম্রাজ্যের অবস্থা গভীর সংকট ও অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিমজ্জিত। পাঁচ বছর ধরে চলা এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে সাম্রাজ্যটি তখন একেবারেই বিধ্বস্ত এবং অন্তর্কলহে ভিতর থেকেই মুখ থুবরে ভেঙে পড়ার উপক্রমভিতরের সব শক্তি প্রায় নিঃশেষিত এবং কঙ্কালসার একটি সাম্রাজের কাঠামোটুকুই তার অবশিষ্ট ছিল মাত্র। শুধু অন্তর্কলহ, ভগ্নদশা ও আর্থিক দুরাবস্থাজাত এক কঠিন প্রতিকুল পরিস্থিতিই নয়, ইতিমধ্যেই বহিঃশত্রুরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং যেসব জাতি ও দেশগুলি জয় করে ইসলামি সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল তারাও আবার স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। মূল কথা হলো মাবিয়া যখন ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলেন তখন সাম্রাজ্যটির অবস্থা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এ ভর্তিপ্রাপ্ত এক মৃত্যু পথযাত্রী রুগীর মতো। এ রকম কঠিন দুঃসময়ে ইসলামি সাম্রাজ্যের হাল ধরতে হয়েছিল মাবিয়াকে। খলিফা হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যকে অবধারিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। তিনি অবশ্যই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু রক্ষা করাই নয়, ইসলামি সাম্রাজ্যের আরো ব্যাপক বিস্তারও ঘাটিয়েছিলেন তিনি।

চতুর্থ খলিফা আলির মৃত্যুর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল। ঘাতকবাহিনীর হাতে আলির মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসকে দুরকমভাবে প্রভাবিত করেছিল। একদিকে কারবালা প্রান্তরে মাবিয়ার পুত্র ষষ্ঠ খলিফা এজিদের সৈন্যবাহিনীর সাথে তাঁর পুত্র হোসেনের যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হওয়া, অপরদিকে ইসলাম ও  ইসলামি সাম্রাজ্যের  নিশ্চিত ধ্বংস হওয়া ও ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে মুছে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া। সেইদিক থেকে বিচার করলে আলির ঘাতকবাহিনী আলিকে হত্যা করে ইসলামকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। স্বভাবতঃই আলির সেই ঘাতকবাহিনীর সদস্যদের পরিচয়   জানার গভীর কৌতূহল ও আগ্রহ ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। বলা বাহুল্য যে, ঐ ঘাতকবৃন্দদের পরিচয় ইতিহাসের নানা সূত্র হতে তাঁরা সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাঁরা তাদের পরিচয়ের বিষয়ে একমত হতে পারেন নি, তাঁদের মধ্যে নানা মত আছে। একটা মত হলো এ রকম – আলি যখন ভয়ঙ্কর সেই সিফফিনের যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধ-বিরিতি করলেন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে নিতে সম্মত হলেন তখন তাঁর অনুগামীরা সবাই এটা মেনে নিতে পারেনিএকটা অংশ আলির এই ভুমিকার তীব্র বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহীরা ইতিহাসে খারিজী বলে পরিচিত। তারা আলির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল মীমাংসার পথ থেকে সরে এসে পুনরায় মাবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার জন্য। কিন্তু আলি তাদের কথায় সম্মত হন নি, কারণ  তিনি লাগাতর যুদ্ধ করে করে তখন এতটাই দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর পক্ষে তখনই আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তখন তাঁর যে কোনও মুল্যে প্রয়োজন ছিল একটু নিঃশ্বাস  ফেলার সময়।  তাই তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার পথ থেকে সরে আসার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন নি। এর ফলে যারা আলাপ-আলোচনার বিপক্ষে ছিল তারা আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। একটা মত হলো তারাই আলিকে হত্যা করে। এই মতটি প্রধানত মুসলিম ঐতিহাসিকদের। কিন্তু গুপ্তঘাতকদের পরিচয় সম্পর্কে আরও দুটি ভিন্ন মত শোনা যায়। তার একটা মত হলো এ রকম - বিদ্রোহীদের মধ্যে একটা অংশ ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান যারা প্রাণ রক্ষার্থে অগত্যা স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিল। তাদের পক্ষ থেকেই কেউ উক্ত পরিস্থিতির সুযোগে নিয়ে আলিকে হত্যা করেছিল। তারা আলিকে হত্যা করেছিল এ জন্য নয় যে, আলি মাবিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় সম্মত হয়েছিলেন। আসলে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই তারা আলিকে হত্যা করেছিল । আর একটি মত হলো জিম্মীরা আলিকে হত্যা করেছিল। এদের হত্যা করার পশ্চাতেও ঐ একই কারণ ছিল। সেই ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে। হত্যাকারীরা হয় অগত্যা মুসলমান অথবা জিম্মী এই দুটির মধ্যে কোনো একটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, কারণ ইসলামি শাসনে অবিশ্বাসীদের(জিম্মী) সঙ্গে যে আচরণ করা হতো তা এতই অমর্যাদাকর ও অবমাননাকর ছিলো যা কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভম ছিল নাজিম্মীদের কিভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হত তা ভাষায় প্রকাশ করা  অসাধ্য ব্যাপার । তাঁদের সেই সময়ের জীবন-যাত্রার দুঃসহ ও দুর্বিষহ ছবিগুলি এখনও বিধৃত রয়েছে হাদিস এবং কোরানের তফসিরে । উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোরানের /২৮ ২৯ নং আয়াতদ্বয়ের তফসিরে ইবনে কাথির কী লিখেছেন তা দেখা যাক - ‘আব্দুর রহমান ইবনে গানাম আশআরি বলেন, আমি নিজের হাতে চুক্তি লিখে খলিফা ওমরের (রাঃ) নিকট পাঠিয়েছিলাম যে, সিরিয়াবাসী অমুক অমুক শহরে বসবাসকারী খৃষ্টানদের পক্ষ হতে আল্লাহর বান্দা আমিরুল মুমেনিন হযরত ওমরের(রাঃ) নিকটঃ  যখন আপনারা আমাদের উপর এসে পড়লেন, আমরা আপনাদের নিকট হতে আমাদের জান-মাল ,সন্তান-সন্ততির জন্য নিরাপত্তার প্রার্থনা জানাচ্ছি আমরা নিরাপত্তা চাচ্ছি শর্তাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যে, আমরা শহরগুলোতে আশেপাশের শহরগুলোতে কোন নতুন মন্দির, গীর্জা বা খানকা নির্মাণ করব না এসব ঘরে যদি কোন মুসলিম মুসাফির অবস্থানের ইচ্ছা করেন তবে আমরা তাদেরকে বাধা দেব না, তারা অবস্থান করুক বা দিনে অবস্থান করুক আমরা পথিক মুসাফিরদের জন্য ওগুলোর দরজা সব সময় খোলা রাখব যেসব মুসলিম আগমন করবেন তাদেরকে আমরা তিন দিন পর্যন্ত মেহমানদারি করবো আমরা ঐসব ঘরে বা বাসভূমি প্রভৃতিতে কোন গুপ্তচর লুকিয়ে রাখব না মুসলিমদের সাথে কোনরূপ প্রতারণা করব না নিজেদের সন্তানদের কোরান শিক্ষা করতে দেব না নিজেরা শিরক করব না, বা অন্য কাউকে শিরক করতে দেব না আমাদের মধ্যে কেউ যদি ইসলাম  ধর্ম গ্রহণ করতে চায় আমরা তাকে বাধা দেব না মুসলিমদের আমরা সম্মান করবো যদি তারা আমাদের সঙ্গে বসবাসের ইচ্ছা করেন তবে তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দেব কোন কিছুতেই আমরা নিজেদেরকে মুসলমানদের সমান মনে করব না পোশাক-পরিচ্ছদেও না, তাদের ওপর কোন কথা বলব না আমরা তাদের পিতৃপদবি যুক্ত নামে ডাকব না

জিনবিশিষ্ট ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হব না আমরা তরবারি লটকাব না, আমদের সাথে তরবারি রাখব না অঙ্গুরীর উপর আরবি নকশা অঙ্কন করব না মাথার অগ্রভাগের চুল কাটব না আমরা যেখানেই থাকিনা কেন, পৈতা অবশ্যয় ফেলে রাখব আমাদের গীর্জার ওপর ক্রশ রাখব না, আমাদের ধর্মীয় কেতাবগুলো মুসলিমদের যাতায়াতের স্থানে বাজারে প্রকাশিত হতে দেব না, গীর্জায় উচ্চৈস্বরে শাখ বাজাব না, মুসলিমদের উপস্থিতিতে আমাদের ধর্মীয় পুস্তকগুলি উচ্চৈস্বরে পাঠ করব না, নিজেদের রীতি-নীতি চাল-চলন প্রকাশ করব না নিজেদের মৃতদের জন্য হায় হায় করব না, মুসলিমদের চলার পথে মৃতের সাথে আগুন নিয়ে যাব না যে সব গোলাম মুসলিমদের ভাগে পড়বে তা আমরা গ্রহণ করব না আমরা অবশ্যই মুসলিমদের শুভাকাঙ্খী হয়ে থাকব মুসলিমদের ঘরে উঁকি মারব না যখন চুক্তি ওমরে হাতে দেওয়া হল তখন তিনি আর একটি শর্ত বাড়িয়ে দিলেন, তা হলোআমরা কখনও কোনও মুসলিমকে প্রহার করব না অতঃপর তারা বলল, আমরা এসব শর্ত মেনে নিলাম, (না মেনে তো উপায় নেই) আমাদের ধর্মাবলম্বী সকল লোক এসব শর্তের মাধ্যমে নিরাপত্তা লাভ করল এগুলোর কোন একটি আমরা যদি ভঙ্গ করি তাহলে আমাদেরকে নিরাপত্তা দানের ব্যাপারে আপনাদের কোন দায়িত্ব থাকবে না এবং আপনি আপনাদের শত্রুদের ব্যাপারে যে আচরণ করেন আমাদের সাথেও সেই আচরণের ঊপযুক্ত হয়ে যাব ইসলামি সাম্রাজ্যে জিম্মী তথা মুশরিক তথা অবিশ্বাসী তথা কাফের তথা অমুসলিমদের কীভাবে জীবন-যাপন করতে হতো তার একটি স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে উক্ত তফসিরে। এ জীবন-যাপনকে মানুষের জীবন-যাপন বলা যায় না। এ তো গরু- ছাগল, পশু-পাখির মতো মানবেতর জীবন বৈ নয়। এমন জীবন যে মানুষের পক্ষে দুঃসহ ও দুর্বিসহ তা বলা বাহুল্য। এ রকম মনুষ্যেতর জীবন-যাপনই শেষ কথা নয়, এর পরেও তাদের দিতে হতো চড়া পরিমাণে জিজিয়া কর।  এ রকম জীবন-যাপনই তো মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, করে তোলে প্রতিশোধপরায়পণ ও হিংসাপরায়ণপ্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার পথ যেখানে রুদ্ধ, মানুষ তো সেখানেই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নেয়। সেই পথ ধরে মুক্তির সন্ধান করে মানুষ অথবা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ইসলামের খেলাফত কালে তাই এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। জিম্মীদের অস্ত্র বারবার ঝলসে উঠেছে খলিফাদের ওপর দ্বিতীয় খলিফা ওমরের মৃত্যু হয়েছিল ওই জিম্মী গুপ্তঘাতকদের হাতেই। উমাইয়া বংশের খলিফা দ্বিতীয় ওমরকে হত্যা করা হয়েছিল খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে। এমনকি হযরত মুহাম্মদকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করে। সেই খাবার খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও অল্পের জন্য সেবার প্রাণে বেঁচে যান। সুতরাং আলিকে যারা হত্যা করেছিল তারা জিম্মী সম্প্রদায়ের হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। অবশ্য আলির সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের মধ্যে যারা ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিল তাদের একটা অংশও আলির হত্যাকারী হতে পারে। কারণ অবিশ্বাসীগণ স্বধর্ম পরিত্যাগ করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হলেও সমান মর্যাদা ও বিশ্বাস পেত না, তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমান বলে গণ্য করা হতো এবং কথায় কথায় খোঁটা দেওয়া হতো অগত্যা মুসলমান বলে। তারা কেবল জিজিয়া কর থেকেই রক্ষা পেত, কিন্তু মানুষ হিসাবে তাদের সকল সম্মান, মর্যাদা,স্বাধীনতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিতই থাকতে হতোফলে তাদের মধ্যেকার কিছু মানুষও আলিকে হত্যা করে তাদের মনের  দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জ্বালার নিরসন করে থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে যেটা মূল কথা তা হলো, আলিকে যারা হত্যা করেছিল তারা ইসলামি শাসনে অপমানিত, অত্যাচারিত, নির্যাতীত, নিপীড়িত,ও অতিষ্ঠ একদল মানুষ। কিছু চাওয়া বা পাওয়ার জন্য নয়, তারা আলিকে হত্যা করে ছিল তাদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন, অবমাননা ও  দাসত্ব, পরাধীনতা ও শোষণের ষ্টীম রোলার চালানো হচ্ছিল তারই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আলিকে হত্যা করে তারা অবশ্য তাদের অজান্তেই বাঁচিয়ে দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামি সাম্রাজ্যকেআলি আর কয়েক বছর বেঁচে থাকলে ইসলাম সাম্রাজ্যটির ধ্বংস অনিবার্য ছিল। আর তা যদি হতো তাহলে ইসলাম ধর্মও ধীরে ধীরে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেত।

হ্যাঁ, এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল ছিল। কারণ ইসলামি রাষ্ট্রের বয়স তখন মাত্র ত্রিশ বছর।  ইসলাম ধর্মের প্রসার ও তার রাষ্ট্রের বিস্তার তখন ঘটছে রাষ্ট্র শক্তির জোরেই। সেই রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেলে ইসলামের শক্তি যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তা বলা বাহুল্য মাত্র। এ প্রসঙ্গে যে কথা খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হলো, তখন পর্যন্ত যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা মনেপ্রাণে তাঁদের ছেড়ে আসা (স্ব)ধর্মের প্রতিই বিশ্বাসী ও অনুরাগী ছিলেন, এবং আত্মরক্ষার্থে নিরুপায় হয়েই  মুসলমান সেজে ছিলেন। মক্কার কোরায়েশ তথা কোরেশগণ যে প্রাণের ভয়েই মুসলমান হয়েছিলেন তার ভুরিভুরি প্রমাণ তো  কোরান-হাদিসেই খুঁজলে  পাওয়া যায়। মুহাম্মদ মক্কায় প্রায় তের বছর ধরে ইসলাম প্রচার করেন, কিন্তু মক্কার মানুষ তাঁর ধর্ম প্রত্যাখান করায়  তিনি মদিনা চলে যান।   সে সময় তাঁর  অনুগামী ছিল মাত্র আঙুলে গণা কয়েকজন। মদিনা গিয়ে তিনি ক্রমশঃ  মত ও পথ পাল্টাতে শুরু করেন। শুরু করেন ডাকাতি ও লুটতরাজ। এর পোশাকি নাম দেন জেহাদ (আল্লাহর পথে)। ডাকাতি ও লুটপাট থেকে যা পাওয়া যেত তা ভাগ করে দিতেন সবার মধ্যে। মুহাম্মদ জেহাদের মুখোশের আড়ালে প্রথম সফল ডাকাতি ও লুটতরাজ করেন মক্কার কোরেশদের ওপর। ইতিহাসে সেটা বদর যুদ্ধ নামে খ্যাত। এরপর তাঁর দলে(ধর্মে) সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেমদিনার  ইহুদীদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে তাঁদেরকে মদিনা থেকে নির্বাসিত করেন, কারণ তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি এবং মুহাম্মদের কাজ কর্ম সমর্থন করেন নি। তাঁদের একদলকে (৭০০/৮০০) একসঙ্গে নির্মমভাবে হত্যাও করেন। ফলে মুসলমানরা দ্রুত ধনবান হয়ে ওঠেন এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দ্রুতহারে বাড়তে থাকে। তাই মদিনা যাওয়ার মাত্র আট বছরের মধ্যেই তিনি সশস্ত্র ও সুসংগঠিত দশ হাজার সৈন্য হজের নাম করে নিয়ে গিয়ে মক্কা আক্রমণ করেন। অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত মক্কার কোরেশগণ  মুহাম্মদের কাছে বাধ্য হয়ে  আত্মসমর্পণ করে  আত্মরক্ষা করেন। মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের (৬৩০ খৃঃ) পর শুরু হয় মক্কা-মদিনা ও আরবের বাইরে ইসলামের জয়যাত্রা । একের পর এক দেশে অভিযান (আক্রমণ) চালিয়ে ও দখল করে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা প্রসারের কাজে মত্ত হয়ে ওঠেন মুহাম্মদ ও তাঁর অনুগামী খলিফাগণ। যে দেশ দখলে আসে সে দেশের মানুষের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয় ইসলাম ধর্মকে। যাঁরা প্রাণের ভয় উপেক্ষা করেও স্বধর্ম পরিত্যাগে অসম্মত থাকেন তাঁদের জিম্মী আখ্যা দিয়ে তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত বৈষম্যমুলক ও অমানবিক যত সব জঘন্য  শর্তাবলী। সেই শর্তাবলী আক্ষরিক অর্থেই কত হীন ও জঘন্য তা  ঊপরে বর্ণণা করা হয়েছে। আলির মৃত্যুর পূর্বে এইভাবে ত্রিশ বছরে যারা মুসলমান হয়েছেন তাঁদের মনে ইসলামের প্রতি আস্থা,  আনুগত্য, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সঞ্চার হয় নি, বরং বিরাগ, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ ও ঘৃণাই যে তাঁদের মনের মধ্যে   যথেষ্ট মজুত ছিল তা সহজেই অনুমেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে  ইসলামি সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হলে তার পরিণতি কী হতো তা অনুমান করা নিশ্চয় কঠিন নয়। দলে দলে অগত্যা ধর্মান্তরিত মুসলমানরা আবার ফিরে যেত স্বধর্মে এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে নিশ্চয় ঝাঁপাত। সেই অবস্থার মোকাবিলা করে ইসলাম ধর্ম আপন মহিমা ও ক্ষমতায়  টিকে থাকতে পারতো  এমন বিশ্বাস বোধকরি ধর্মান্ধ মুসলমান ব্যতীত আর কেউ করবেন না।

মাবিয়ার খেলাফত কালটি সবদিক থেকেই ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ । দীর্ঘ কুড়ি বছর (৬৬১-৬৮০) খেলাফত পরিচালনা শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যকে এমন শক্তিশালী একটি ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে  তার এমন একটি সুসংহত রূপ দিয়ে যান যে সাম্রাজ্যটি তখন হয়ে উঠেছে অপরাজেয় ও অপ্রতিদ্বন্দী। পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম তখন দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিসাবে  বিরাজ করছে, এটা সম্ভব হতোনা যদি না আলির খেলাফতকালের অবসান হতো এবং মাবিয়ার উপর খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হতো। ইসলামি সাম্রাজ্যের আব্বাসীয় যুগকে বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ, সেই স্বর্ণযুগের ভিত তৈরী করে দিয়ে যান মাবিয়াই।

এসব বিষয়ে আলোকপাত করার  অবকাশ এখানে নেই। তবুও এটা উল্লেখ করা হলো এই জন্য যে এই মাবিয়ার প্রতি চরম অবিচার করেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকগণ। তাঁরা বল্গাহীনভাবে তাঁর সমালোচনা করেছেন। মাবিয়ার খেলাফত কালকে তাঁরা ইসলামি খেলাফতের অধঃপতনের শুরু বলে চিহ্নিত করেছেন। যে আলি ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচনা দিয়ে তাঁর প্রাণনাশ ঘটিয়ে খেলাফত অর্জন করেছিলেন সেই আলির খেলাফত কালকেই শেষ প্রকৃত ইসলামি খেলাফত বলে বর্ণণা করেছেন তাঁরাইসলামি সাম্রাজ্য ও ইসলামকেই যে তিনি রক্ষা করেছিলেন সে অবদানের কথা  খোলা মনে স্বীকার করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের শিষ্টাচার প্রদর্শনে তাঁরা সর্বদা কুন্ঠিত থেকেছেন। কিন্তু অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি প্রদান করেছেন মাবিয়ার সাফল্যকে। হিট্টি লিখেছেন,  “বিশৃঙ্খলতার মধ্যে মুয়াবিয়া  শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং শক্তিপূর্ণ মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।”  তিনি আরও লিখেছেন, “মুয়াবিয়ার শাসনকালে ইসলামের খেলাফত শুধু সুসংহত হয় নি, বরং বহুগুণে  ইহা সম্প্রসারিতও হয়েছিল।” মুসলিম ঐতিহাসিকরাও কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে আলির সময়েই  ইসলামি সাম্রাজ্যের কিছু অংশ রোম সম্রাট পূর্নদখল করে নিয়েছিল। ড. ওসমান গণি ‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কিন্তু ওসমানের খেলাফতের সময়ে গৃহযুদ্ধ ও ভীষণ গোলযোগের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে রোম সম্রাট পরিত্যাক্ত অঞ্চলগুলো পূনর্দখল করে তথাকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করেন।’ (পৃ-১৯)  এসব স্বীকার করেও ড.ওসমান গণি-সহ অন্যান্য  মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়ার শাসনকাল ও তাঁর চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করতে কোনও দ্বিধা করেন নি, এমনকি তাঁর কঠোর সমালোলচনা করতে গিয়ে একজন ঐতিহাসিক হিসাবে যে  শিষ্টাচার ও শালীনতার প্রদর্শন করা উচিত সে নিয়ম-নীতিকেও তাঁরা অবলীলায় লঙ্ঘন করেছেন। কিভাবে এবং কেন তাঁরা মাবিয়াকে নির্মমভাবে বিদ্ধ করেছেন সে বিষয়ে আরও পরে  যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। মাবিয়ার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এখন সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক।

মাবিয়া ছিলেন অসম্ভব দুরদর্শি মানুষ। তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম সময়টাও চিনতে বা বুঝতে ভুল করেন নি। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র এজিদ তথা ইয়াজিদকে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান। নিজের পূত্রকে খলিফা মনোনীত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাব সমগ্র সাম্রাজ্য ঘুরে ঘুরে মুসলিম জনগণের দরবারে উপস্থিত করেছিলেন এবং তাঁদের মতামত নিয়েছিলেন। খলিফার ক্ষমতাবলে তিনি তাঁর পূত্র এজিদকে সমগ্র মুসলিম জনতার মাথায় খলিফা হিসাবে চাপিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তা করেন নি। সম্ভবত তিনি বুঝে নিতে চেয়েছিলেন এজিদকে খলিফা হিসাবে সমগ্র মুসলিম সমাজ মেনে নিতে সম্মত বা প্রস্তুত আছে কি না। মাবিয়া ছিলেন তীব্র মেধা  ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন এক বিরল প্রতিভাধর মানুষ। তিনি মানুষ চিনতে ও মানুষের মন বুঝতে অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রশাসনে সর্বত্র যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করে নিয়োগ করতেন, এক্ষেত্রে ধর্ম-গোষ্ঠী-জ্ঞাতি নিরপেক্ষ নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতেন। এজিদকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে তিনি সঠিক কাজ করেছিলেন না ভুল করেছিলেন সেটা বুঝে নিতেই সম্ভবত বৃদ্ধ বয়সে গোটা সাম্রাজ্য পরিক্রমা করার কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন। আপন পূত্রকে খলিফা মনোনীত করা নিয়ে নানা মত আছে, তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। ঠিক কি কারণে বা কেন নিজের পূত্রকেই মনোনীত করেছিলেন তা ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়, তবে এই বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ কী বলেছেন এবং তাঁদের সেই বক্তব্য কতটা যথার্থ তা জানার আগ্রহ সকলের মধ্যেই  রয়েছে। তবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে কিছুটা পরে যথাস্থানে।  তার আগে এখন আলোকপাত   করা  যাক সমগ্র মুসলিম জাহানে খলিফা পদে এজিদের মনোনয়নে কী  প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার প্রতি। আগেই বলেছি যে এজিদকে পরবর্তী খলিফা মেনে নিতে সমগ্র মুসলিম দুনিয়া সম্মত ও প্রস্তুত কিনা তা দেখে ও বুঝে নিতে মাবিয়া পুরো সাম্রাজ্য পরিভ্রমণ শুরু করেন, প্রত্যেক প্রদেশের রাজধানি শহরে গিয়ে প্রশাসনের পদাধিকারীদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন, এবং প্রাশাসনের পদস্থ আধিকারিক ছাড়াও অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গেও মত বিনিময় করেন। কেন তিনি তাঁর নিজের পুত্রের উপর বিশাল একটি সাম্রাজ্যের পরবর্তী খলিফা পদের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করতে চান তা সকলের সামনে বাখ্যা করেন এবং তাঁদের অভিমত ও প্রতিক্রিয়া আহবান করেন। তাঁর এই সফর মোটের উপর তাঁর কাছে বেশ সন্তোষজনক ও তৃপ্তিদায়ক ছিল। কারণ, মদিনা প্রদেশ ব্যতীত অন্য সকল প্রদেশ তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি তাঁর পক্ষে যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিলেন তা বোধ হয় তাঁর প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মদিনা শহরে আঙুলে গণা সামান্য কয়েকজন তাঁর প্রস্তাবের সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেনএটা অবশ্য তাঁকে বিষ্মিত করে নি, কারণ তাঁরা যে এজিদকে মানবেন না সেটা তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন। শুধু এজিদ বলে নয়, আসলে অন্য কাউকেই যে তাঁরা মানবেন না সেটা তিনি তিনি জানতেন। তাঁরা তাঁর (মাবিয়ার) শাসন কালে কখনও এবং কোনোভাবেই তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নি, বরং তাঁদের ভূমিকা ছিল সর্বদাই তাঁর (মাবিয়ার) সমালোচনা করা। তাঁরা কখনই মাবিয়ার শুভাকাঙ্খী ছিলনা। মাবিয়ার প্রতি তাঁদের বিরোধিতা ছিল একেবারে অন্ধ বিরোধিতা ও আক্রোশ বশতঃ, খলিফা মাবিয়ার বিরোধিতার অর্থ যে ইসলামি সাম্রাজ্যকেই বিপন্ন করতে পারে সে কথা কোনোদিন তাঁরা ভেবেই দেখেন নি, অন্ধ বিরোধিতা ও অন্ধ আক্রোশের ফলে মানুষের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধির বিনাশ ঘটে সে কথা তো সবার জানা। অর্থ, যশ, খ্যাতি ও ক্ষমতার লোভ এবং প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষকে অন্ধ বিরোধিতা ও অন্ধ আক্রোশের ফাঁদে জড়িয়ে দেয় । কারবালা যুদ্ধের নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল ঐ ক্ষমতা ও খ্যাতির প্রতি দুর্দমনীয় লোভই।

মদিনায় যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এজিদের খলিফা মনোনয়নে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় মাত্র চারজনতাঁরা হলেন আলির পুত্র ইমাম হোসেন, প্রথম খলিফা আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ ও বিশিষ্ট সাহাবী জুবায়েরের পুত্র আব্দুল্লাহ। মাবিয়া মাদিনাবাসীদের সামনে পরবর্তী খলিফা হিসাবে এজিদের নাম প্রস্তাব করার সাথে সাথেই ঐ চারজন উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সভার বাকি উপস্থিত মুসলমান জনসাধারণ মাবিয়ার প্রস্তাবে সমর্থন ও সহমত জ্ঞাপন করেন, তখন তাঁরা  সভাস্থল পরিত্যাগ করে চলে যান। তাঁরা মদিনাবাসীর সমর্থন তাঁদের পক্ষেই আশা করেছিলেন, কারণ তাঁদের ধারণা ছিল মদিনার মুসলমানগণ মুহাম্মদের নাতি এবং আবু বকর ও ওমরের  পুত্রদের পরিবর্তে অন্য কাউকে সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু মদিনার মানুষ তাঁদের ভুল প্রমাণিত করে মাবিয়া ও এজিদের পাশে প্রকাশ্যেই দাঁড়িয় যান। মদিনার মানুষ বোধহয় ওসমানকে যখন বিদ্রোহিরা হত্যা করে তখন ওদের ভুমিকা দেখে যে কষ্ট পেয়েছিলেন তা বোধহয় ভুলতে পারেন নি। মদিনার মানুষের এই ভুমিকায় হোসেন ও তাঁর বাকি তিনজন সঙ্গী  মানসিকভাবে ভীষণ কষ্ট অনুভব করেন এবং হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তাই তাঁরা শুধু সভাস্থলই ত্যাগ করেন নি, অচিরেই মদিনাই ত্যাগ করে মক্কা চলে যান। ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, মানুষের সমর্থন না পেয়ে প্রবল হতাশা নিয়ে ৫৬/৫৭ বছর পূর্বে মুহাম্মদ, আলি, আবু বকর, ওমর এবং আবু যুবাইয়েরদের মক্কা ত্যাগ করে মদিনা এসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, আর আজ তাঁদেরই উত্তরসূরিরা মানুষের সমর্থন হারিয়ে মদিনা ত্যাগ করে মক্কার পথে পাড়ি দিলেন সেদিন হোসেন এবং তাঁর তিনজন সাথী নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন নি, মদিনার মানুষ নীতিভ্রষ্ট হয়ে মাবিয়ার দালাল হয়ে গেছে বলে তাঁদের প্রতি দোষারোপ করেছিলেন, সেই একই ভুল আজও বহন করে চলেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকগণ। হোসেন যেমন মদিনার মানুষকে দালাল বলে অপমান করেছিলেন, মুসলমান ঐতিহাসিকরাও ঐ একই ভাষায় মদিনার মানুষকে সমানে অপমান করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে ড.ওসমান গণি কি বলেছেন তা শোনা যাক, ‘মদীনাবাসীর সম্মুখে তিনি তাঁর প্রস্তাব রাখা মাত্রই সেখানকার প্রধান ব্যক্তিগণ – হযরত আলীর পুত্র হুসাইন, আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ এবং জুবায়েরের পুত্র আব্দুল্লাহ মুয়াবিয়ার প্রতি অবজ্ঞাভরে মক্কা ত্যাগ করে মদিনা চলে মক্কায় চলে গেলেন; তখন বাকি সাধারণ জনগণের পক্ষে কিছু দালাল দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন সকলের আনুগত্য।’(উমাইয়া খেলাফত, পৃ –২২)  ড.গণির দল শুধু মদিনার মানুষকেই দালাল বলে অপমান করে ক্ষান্ত হতে চান না, তাঁরা সেই য়ুগের তামাম মুসলিম জাহানের সকল মুসলমানকেই দালাল বলে অপমান করেছেন তাঁদের কলমে। বিশাল একটি সাম্রাজ্যের তামাম মুসলমান সম্প্রদায়কে দালাল বলে কত কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন গণি সাহেব তা তাঁর ভাষাতেই দেখা যাক– ‘৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি জনগণের সম্মুখে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন, কিন্তু এর পূর্বেই তিনি গোপনে কিছুটা দালাল শ্রেণীর জনমত গড়ে নিয়েছিলেন। তাই আর কোন অসুবিধা হল না। দালালের দ্বারা (ট্রাকে না হলেও) উটের পিঠে ভাড়াটে মানুষ এসে তাঁর প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য জানাল।’ ( দ্রঃ- ঐ)

মাবিয়া তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি মারা যান ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। তারপরেই পরিস্থিতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যায় কারবালা যুদ্ধের দিকে। এজিদের খলিফা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে কারবালার যুদ্ধের ঘটনাটি সংঘটিত হয়। 

 (বিঃদ্রঃ এর পূর্ববর্তী অংশটা পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন -

http://giasuddinonline.blogspot.in/2016/10/blog-post_9.html)



 
 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...