Saturday, October 29, 2016

ইচ্ছাপত্র (Will)



 ইচ্ছাপত্র

২৫.৬.০৫

বৈকাল – ৩টা ২৫মি.

স্নেহের বহ্নি,

* স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি।  আমার মৃত্যুর জন্য কোনো ব্যক্তি দায়ী নহে।

* আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এই সমাজ। সমাজের তথাকথিত নিয়ম-শৃংখলা ও মূল্যবোধে বহুদিন থেকেই আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যারা সমস্ত রকম সংস্কার ভাঙতে চাই বা অস্বীকার করতে চাই এই সমাজ তাদের কাছে একটা ভয়ঙ্কর কারাগার। এখানে স্বাধীনভাবে শ্বাস নেওয়া যায় না। দীর্ঘকাল এই কারাগারে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত, অবসন্ন। তাই এই সমাজকে চির বিদায় জানিয়ে মুক্তি নিলাম।
* না, (দলীয়) রাজনীতি ছেড়ে আমি হতাশ হই নি। দীর্ঘকাল রাজনীতি করেছি। কিন্তু শেষের দিকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ আর মিথ্যার সঙ্গে সঙ্গে আপোষ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পার্টি শৃংখলা মেনে সব সহ্য করতে হচ্ছিল। স্বেচ্ছারোপিত শৃঙ্খলা আক্ষরিক (বাস্তবে) হাতে-পায়ে-মুখে শৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। পার্টি ছেড়ে অবশ্যই নিজেকে শৃঙ্খল মুক্ত করেছিলাম। তারজন্য আপশোষ তো ছিলই না, ছিল বরং স্বস্তি।

  •      * আমার মৃত্যুর পর যেন কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না হয়।
  •      * আমার লাশ নিয়ে যেন জানাযা না হয়।

  •      * আমার লাশ যদি ‘Medical Science’ নেয় তবে কলকাতায় যে কোনো Medical College – এ পৌঁছে দিস, যদি পারিস।
  •      * যদি না পারিস তবে আমাদের যেটুকু জায়গা আছে সেখানে সমাধিস্থ করবি এক কোণে যাতে জায়গা কম নষ্ট হয়।


* জঙ্গীপুর গৌড় গ্রামীণ ব্যাংকে দুটো সার্টিফিকেট (NSC) বন্ধক দিয়ে ১০০০ টাকা ঋণ নেওয়া আছে।

* LIC অফিস থেকে দুটো পলিসির বিপরীতে ৫০০০০ টাকার কিছু কম ঋণ নেওয়া আছে।


ঃ-একান্ত ইচ্ছাঃ-

ক) কতকগুলি নিবন্ধ আমার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু চিঠি প্রকাশিত হয়েছে ‘আজকাল’ পত্রিকায়। কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দুটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। পারলে সেগুলো সংরক্ষণ করিস। আমার দৃষ্টিভিঙ্গী খুঁজে পাবি সে সব লেখায়।

খ) বিভিন্ন খাতে তোরা যে টাকা পাবি তাতে জানি না তোদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণের অসুবিধা হবে কি না। যদি মনে করিস ভীষণ রকমের অসুবিধা হবে না, তবে প্রাপ্ত টাকা থেকে ৫০০০০ টাকা [পঞ্চাশ হাজার] MIS  না কি একটা স্কীম আছে সেখানে জমা রাখিস। সেখান থেকে যে টাকাটা মাসে মাসে বা বৎসর শেষে পাবি সে টাকা দিয়ে গরীব ছেলে মেয়েদের বই কিনে দিস।



* ধর্ম তৈরী হয়েছে অজ্ঞানতা ও আতঙ্ক থেকে। যারা ধর্ম বিশ্বাস ও পালন করে তারা নিজেরা জানে না ধর্ম আসলে কী এবং এর ভিতর কী আছে। দরিদ্র মানুষকে ধর্ম শেখায় আল্লাহ তোমার ঈমান পরীক্ষা করছে। তুমি অনাহারে আছো, তোমার সন্তান বিনা ঔষধে বিনা চিকিৎসায় মরছে, তোমার সন্তান খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা পায় না, দুর্ঘটনায় তোমার স্বজন মরেছে - এসবই তারই ইচ্ছা।  তুমি এ সবের জন্য ক্ষোভ করো না, অসন্তুষ্ট হবে না, আল্লাহ/ভগবান রুষ্ট হবে।  তাহলে তোমার নরকবাস হবে। এভাবে ধর্ম মানুষকে শেখায় প্রতিবাদ না করতে। ধর্ম এ যুগে শোষক শ্রেণীর শক্তিশালি হাতিয়ার। মানুষ মানুষকে শোষণ করে তাই একদল লোক বিত্তবান হয় আর বিশাল সংখ্যক মানুষ বিত্তহীন হয় – ধর্ম অর্থনীতির এই রহস্যকে আড়াল করে শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করেধর্ম এ ভাবেই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে।

নারীর প্রতি সবচেয়ে অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন হয় ধর্মের কারণে। নারীকে বলেছে ধর্ম, স্বামী তোমার দেবতা, স্বামীর পূজা ও সেবা করা তোমার ধর্ম, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখো আল্লাহ/ভগবান সন্তুষ্ট হবে, শত অত্যাচারেও স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করবে না, করলে স্বামী যদি অসন্তুষ্ট হয় তবে ওপরওয়ালাও অসন্তুষ্ট হবে, তাহলে তোমার নরকবাস হবে। নরকের ভয় দেখিয়ে ধর্ম নারীকে পুরুষের পদানত করে রেখেছে। হাতে শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় আঁচল বা বোরখা পরে নারীকে বোঝাতে হয় যে তার একজন মালিক আছে, মালিকটি হলো তার স্বামী-দেবতা। স্বামীর মৃত্যুর পরও স্ত্রীকে শাঁখা-সিঁদুর ভেঙে-মুছে, থান-কাপড় পরে, কৃচ্ছ্বসাধন করে বোঝাতে হয় যে তার একজন মালিক ছিল সে এখন আর নাই। নারীর নিজস্বতা বলতে কিছু নেই, স্বাধীনতা তো অনেক বড় বিষয়। নারীর নিজস্ব পরিচয় থাকতে নেই, হয় পিতার নামে না হয় স্বামীর নামে তাকে চেনাতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও স্বামীর চিহ্ন বহন করতে হয় তার নামের সঙ্গে। কী হিন্দু কী মুসলমান বিয়ের পর নারীকে সর্বদা স্বামীর পদবী ধারণ করতে হয়। নারী যদি অন্য ধর্মাবলম্বী পুরুষকে বিয়ে করে তবে তাকে পুরুষ স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে হয়। নারী ধর্ষিতা হলে পুরুষ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে দূর দূর করে তেড়ে দেয় অথচ ধর্ষক পুরুষ বুক ফুলিয়ে সমাজে বাস করে, সমাজ তাকে আদর করে বরণ করে, বিধায়ক করে, মন্ত্রী করে। পুরুষতন্ত্র এ সব নিয়ম চালু করেছে, আর ধর্মের থেকে জল-আলো-বাতাস নিয়ে পুরুষতন্ত্র ক্রমশঃ যেন অপরাজেয় হয়ে উঠছে। নারীর ওপর সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারী কার্যতঃ চুপ, কারণ নারী মনে করে এসব বিধান আল্লাহ/ভগবন প্রদত্ত। ধর্ম এভাবেই নারীকে চুপ করিয়ে রেখেছে পরকালের নরকবাসের ভয় দেখিয়ে। এসবই মিথ্যে, মনুষ্য সৃষ্টি, মানুষ যদি বেশী শিক্ষিত হতো এবং সব ধর্মকে নিজের মাতৃভাষায় ভালো করে পড়ে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করতে পারত তবে ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস বহগুণে দূর হোত। তাহলে সমাজের চেহারাটাই বদলে যেত।

বহ্নি, তোকে এসব কথাগুলো লিখলাম এজন্য যে, তুইও অন্ধভাবে আল্লাহ-কোরান এসবে বিশ্বাস করিস। তোর প্রতি পরামর্শ – কোনো কিছুই অন্ধভাবে বিশ্বাস ও মেনে চলবি না। ধর্ম মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। আমার কথাগুলোও অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে না। আমার আলমারিতে বহু বই আছে, তাতে ধর্মপুস্তক আছে, ধর্মের পক্ষে লেখা বই আছে, আছে কিছু বই যাতে ধর্মের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা আছে। সেগুলো পড়ে নিজস্ব স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবি।

আর একটা কারণে এসব কথা লিখলাম – আমি চেয়েছিলাম এইসব বিষয়ে লেখালেখি করে মানুষকে সমাজ সচেতন করার কাজে একটু অবদান রেখে যেতে। সমাজের সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। কিন্তু সেটা আর হলো না। এই একমাত্র আক্ষেপ নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। আর কোনো আক্ষেপ আমার নেই।

* যতদূর স্মরণে আছে, আমার ঋণ যা ছিল সব শোধ করে দিয়েছি।

* আমার এই ‘উইল’টি (ইচ্ছাপত্র) ‘জংগীপুর চিঠি’-র দপ্তরে জেরক্স করে পৌঁছে দিস, যদি সম্পাদক মনে করে তবে ছাপাবে। ছাপালে যেন পুরোটাই ছাপায়। জানি, অনেক গুজব বা জল্পনা-কল্পনা হবে আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর পর।  কাগজে যদি এটা ছাপে তবে সেই কল্পনা-জল্পনার কিয়দংশে অবসান হতে পারে।  ইতি তোর বাবা – গিয়াসুদ্দিন

২৫/৬/০৫, বিকাল – ৫টা।


 (বিঃদ্রঃ- ইচ্ছাপত্রটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। কথাগুলি হলোঃ- প্রথমতঃ  এটা লিখেছি ১১ বছর আগে যখন মাত্র কয়েক ঘন্টা পর পৃথিবী থেকে নিশ্চিতভাবেই বিদায় নিতে যাচ্ছি ঠিক তখন। তখন মস্তিষ্কের কোষগুলি আমার কী মাত্রায় চঞ্চল ও অস্থির ছিলো তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া এই ১১ বছরে আমার চিন্তাধারা ও অভিজ্ঞতায় আরো স্বচ্ছতা এসেছে। স্বভাবতই ইচ্ছাপত্রটি সম্পাদনা ও হালনাগাদ (update) করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু করিনি। কারণ সে সময়ের ‘আমি’ (অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হলেও) কী ভেবেছিলাম, কী চেয়েছিলাম তা সংরক্ষণ করতে চাই।  দ্বিতীয়তঃ  তখনো আমার কলম থেকে আল্লাহ, মুহাম্মদ ও কোরানকে সরাসরি অস্বীকার ও আক্রমণ করে কোনো লেখা বের হয় নি। স্বভাবতই ‘মোরতাদ’ ও ‘মুণ্ডুচ্ছেদ’ এর ফতোয়া তখনো আমার উপর জারি হয় নি। অর্থাৎ তখনো মুসলিম সমাজে আমি একজন বিশিষ্ট সম্মানিত মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তৃতীয়তঃ ‘বহ্নি’ হলো আমার পুত্র যাকে উদ্দেশ্য করে ইচ্ছাপত্রটি লিখেছিলাম।  সে কিন্তু এখন আর আস্তিক নেই, তবে আমার মতো অনুশীলনকারী নাস্তিকও (practicing atheist) সে নয়।    তাং - ২৯.১০.২০১৬)        



KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...