Wednesday, October 26, 2016

মুসলিম বিয়েঃ চুক্তি বিয়ে – (তিন)

                     কন্যাশিশু ও দত্তক-পুত্রের একদা জীবনসঙ্গিনীকে বিয়ে করা জায়েজ 

ইসলাম বাল্যবিবাহে  বৈধতা দিয়েছে


                                                

বাল্যবিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের পশ্চাদপদ সমাজের নিকৃষ্ট ব্যাধিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ব্যাধি। এ ব্যাধিটি মানবসমাজের যতোটা ক্ষতিসাধন করে ততোটা ক্ষতি বোধ হয় আর অন্য কোনো সামাজিক ব্যাধির দ্বারা সম্ভব হয় না।  যে সব ছেলেমেয়েদের বাল্যাবস্থায় বিয়ে হয় তাদের কাঁধে অপরিণত বয়সেই  সংসারের বোঝা চেপে বসে। ফলতঃ অচিরেই তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে, জীবনে তাদের নেমে আসে অকালবার্ধক্য, খুব তাড়াতাড়িই তারা সমাজের বোঝা হয়ে ওঠে এবং নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে অকালেই নিভে যায় তাদের জীবনদীপগুলোও বাল্যাবস্থায় বিয়ের কুফল শুধু সংশ্লিষ্ট বালক-বালিকাদেরই ভোগ করতে হয় এমন নয়, এর কুফল ভোগ করতে হয় তাদের গোটা পরিবারকেই এবং পরিশেষে গোটা সমাজ ও গোটা দেশকেই। বাল্যাবস্থায় বিয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো অধিক সন্তান, দারিদ্রতা,অপুষ্টি, অপরিচ্ছন্নতা, অসচেতনতা, রোগ-ব্যাধি, অকালমৃত্যু, কুসংস্কার ইত্যাদি। স্বভাবতই বাল্যবিয়ে যে মানব সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথে একটি  বিরাট বড়ো প্রতিবন্ধক তা বলা বাহুল্য। এই প্রতিবন্ধকতা তথা বাল্যবিয়ে মানব  সমাজ থেকে দূর ও নির্মূল করার জোর অভিযান চলছে বিশ্বজুড়ে।
ভুবন জুড়ে যে ছবিটি আমরা দেখি তা হলো সেই জাতি ও সেই দেশ ততো বেশী উন্নতি করেছে যারা যতো বেশী বাল্যবিয়ের অভিশাপকে মানব সমাজের দেহ থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, এবং অপরদিকে যে জাতি ও যে দেশের সমাজদেহে যতো বেশী বাল্যবিয়ের ব্যধি রয়েছে সে জাতি ও সে দেশ  ততো বেশী পশ্চাদপদ রয়ে গেছে।  অর্থাৎ মানব সমাজের উন্নয়ন বা অনুন্নোয়ন, অগ্রগতি বা পশ্চাদপদতা, বিকাশ বা বদ্ধদশার সঙ্গে বাল্যবিয়ের একটি গভীর বন্ধন রয়েছে। সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও বিকাশ এবং বাল্যবিয়ে দু’টো হাত একসঙ্গে হাত ধরাধরি চলতে পারে না। মানব সমাজের পশ্চাদপদতা এবং বিকাশের বদ্ধদশা বা রুদ্ধদশা কাটাতে হলে বাল্যবিয়ের সঙ্গে বন্ধন বা গাঁটছড়া ছিন্ন করতেই হবে।    
ভুবন জুড়ে আর একটি ছবিটি আমরা দেখতে পাই, তা হলো, মুসলিম সমাজের দেহে বাল্যবিয়ের ব্যাধিটা সবচেয়ে বেশী প্রকট এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম দেশগুলিতেই দারিদ্রতা, অনুন্নোয়ন, অশিক্ষা, অচেতনতা, অস্বাস্থ্য, অস্থিরতা, হিংসা ও কুসংস্কার সব চেয়ে বেশী। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাল্যবিয়ের ব্যাধি ও অভিশাপ মুসলিমদের পশ্চাদপদতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এখন প্রশ্ন হলো এতো খারাপ একটি সামাজিক ব্যাধির প্রকোপ মুসলিম সমাজেই কেনো সব চেয়ে অধিক? এ প্রশ্নের উত্তরে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যে কৈফিয়ত দেন তা হলো, মুসলিমদের মধ্যে দারিদ্রতা ও শিক্ষা কম থাকাই প্রধান কারণ এর বাইরে অন্য কোনো কারণ তাঁরা দেখতে বিশেষ পান না। আসলে তাঁরা দেখতে চান না। শুধু  দারিদ্রতা ও শিক্ষায় পশ্চাদপদতার জন্যেই মুসলিম সমাজে বাল্যবিয়ের চল সর্বাধিক এটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। এই দু’টি কারণ ছাড়াও রয়েছে আর একটি মস্ত বড়ো কারণ, তা হলো ধর্মীয় কারণ। অন্য সকল ধর্মেও বাল্যবিয়ে বৈধ ঠিকই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলাম বাল্যবিয়েতে শুধু বৈধতার সীলমোহরই মারে নি, তাতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।  এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে বাল্যাবস্থায়  সন্তানদের, বিশেষতঃ মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা সুন্নত। সুন্নত হলো এক ধরণের ঈমানী কর্তব্য যা পালন না করলে দোষ বা পাপ হয় না, কিন্তু পালন করলে সওয়াব (পূণ্য) পাওয়া যায়। তাদের এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে স্বয়ং মুহাম্মদ। তিনি ছ’ বছর বয়সী একটি শিশু কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন যখন তাঁর বয়স
ছিলো পঞ্চাশ। খাদিজার মৃত্যুর সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই প্রথমে বিয়ে করেন সওদাকে, এবং তার অল্প কিছুদিন পরেই বিয়ে করেন তাঁর প্রধান ও প্রথম সাহাবি আবুবকরের মেয়ে আয়েশাকে যাঁর বয়স ছিলো মাত্র ছ’বছর। আর বিয়ের মাত্র তিন বছর পরেই আয়েশার সঙ্গে সহবাস করেছিলেন। মুহাম্মদ যখন আবুবকরকে আয়েশার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন আবুবকর আঁতকে উঠেছিলেন এবং সে প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন নি। মুহাম্মদ তখন আল্লাহর দোহায় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মুহাম্মদের সঙ্গে আয়েশার বিয়ে হোক এটা আল্লাহর ইচ্ছা, আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নের মাধ্যমে সে ইচ্ছার কথা জানিয়েছে। এ কথা শোনার পর আবুবকর আর না করতে পারে নি, কারণ আল্লাহর ইচ্ছার পূরণ না করলে তো আর মুসলমান থাকা যায় না এবং ইসলাম ও মুহাম্মদকে ত্যাগ করে গেলে তো মক্কার কোরেশদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যায়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আবুবকর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েতে সম্মতি দেন। মুসলমানরা আজো বিশ্বাস করে যে আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশেই আয়েশার সঙ্গে  মুহাম্মদের বিয়ে হয়েছিলো। সে কারণেই তারা মনে করে যে নাবালক মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা তাদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তব্য বা সুন্নত, আর সেই বার্তাটা দিতেই আল্লাহ  মুহাম্মদ ও আয়েশার মধ্যে বিয়েটা সম্পাদন করেছিলেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন তাঁর একজন অন্যতম প্রধান বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ২য় খলিফা ওমর ফারুক। তিনি ৪র্থ খলিফা ও মুহাম্মদের জামাই আলির নাবালক কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন যিনি ছিলেন তাঁর নাতনির বয়সি। মুহাম্মদের পর যে সাহাবিরা মুসলমানদের নিকট রোল মডেল হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত ও সম্মানিত তাঁরা হলেন এই তিনজন (আবুবকর, ওমর ফারুক ও আলি)।  সুতরাং এ কথাটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, ইসলাম বাল্যবিয়েতে শুধু বৈধতাই দেয় নি, মুহাম্মদ (যাঁকে মুসলমানরা আল্লাহর নবি বলে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে) এবং তাঁরই সর্বাধিক বিশ্বস্ত ও প্রিয় সাহাবিগণ নিজেরা হয়  নাবালক কন্যাকে বিয়ে করে কিংবা নাবালক কন্যার বিয়ে দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দিয়ে গেছেন। এর প্রভাব আজো ব্যাপকভাবেই রয়ে গেছে যা মুসলিম সমাজ কাটিয়ে উঠতে পারছেনা।
                       দত্তক-পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা পত্নী দত্তক-পিতার জন্যে বৈধ  
কোন কোন নারী পুরুষদের (বিয়ের) জন্যে বৈধ এবং কোন কোন নারী অবৈধ এই তালিকা যখন ইসলাম প্রণয়ন করে বা প্রকাশ করে কোরানের বিভিন্ন আয়াতে (যেমন ৪/২২,২৩,২৪, ৩৩/৫০) তখন দত্তকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা পত্নী সে তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। ইসলাম পুরুষদের জন্যে এই নারীদের বৈধ করেছে বা সংযোজন করেছে অনেক পরে কেনো এ সংযোজনটি করা হয়েছিলো? এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিলো?  পালিত পুত্র তো আপন সন্তান তুল্যই, এবং বলা বাহুল্য যে পালিত পুত্রবধু আপন পুত্রবধুসমইআর সর্বকালের সামাজিক সংস্কৃতি অনুযায়ী পুত্রবধূ তো আপন কন্যাসমই। কারো দত্তক পুত্র যদি তার বধূকে পরিত্যাগ করে তবে তাকে বিয়ে করা কি সে লোকটির পক্ষে শোভা পায়? কোনো সভ্য সমাজে কি এরূপ আইন বা প্রথার কথা কল্পনাও করা সম্ভব? এমন কুৎসিত ও অসভ্য আইন বা প্রথা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাতে ঠাঁই না পেলেও ইসলাম এই প্রথাটিকে ঠাঁই দিয়েছে বা সংযোজিত করেছে তার বিয়ের বিধানে।  এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কেনো এরূপ কুৎসিত বিধান সংযোজন করা হয়েছে?  এর উত্তরটা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হবে, এবং শ্রুতিকটূও লাগতে পারে, তথাপি এটাই সত্যি যে  মুহাম্মদের স্বার্থ পূরণের জন্যে এই সংযোজনটা করা হয়েছিলোহ্যাঁ, কোনো সন্দেহ ও সংশয় নেই যে শুধু তাঁর স্বার্থ পূরণের জন্যেই কুৎসিত এ বিধিটি সংযোজন করা হয়েছিলো। কে সংযোজন করেছিলেন জানার জন্যে কথাটি প্রত্যক্ষ্য ভাষ্যে (active voice)  বলা যাক। তা হলো এই যে,  মুহাম্মদই একেবারেই তাঁর নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে তিনি নিজে এটা সংযোজন করেছিলেন, করে তা  প্রচার করেছিলেন আল্লাহর নামেএটা তিনি সংযোজন করেছিলেন তিনি যখন নিজে তাঁর দত্তক সন্তানের তালাকপ্রাপ্তা সুন্দরী ও যুবতী নারীকে বিয়ে করবো বলে স্থির করেন। এর জন্যে তিনি  কয়েকটি অধ্যাদেশ (তথাকথিত ওহি বা প্রত্যাদেশ) জারি করেছিলেন।   না,  মুহাম্মদ বা ইসলামকে কালিমালিপ্ত করার জন্যে কারো মনগড়া বা কষ্টকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কুৎসা এটা নয়। এটা যে নির্ভেজাল ও নিরেট সত্যি কথা তার  অকাট্য সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোরান। কোরানের ৩৩/৪ ও ৩৩/৩৭ নং আয়াত দু’টি তার সব চেয়ে বড়ো সাক্ষী। এ বিষয়টি বিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে ‘মুহাম্মদের হারেম সংবাদ’ অধ্যায়ে ‘জয়নাবের সঙ্গে মুহাম্মদের বিয়ে’ প্রসঙ্গে আলোচনায়।   তাই এখানে প্রাসঙ্গিকতাহেতু ঘটনাটি সংক্ষেপে বলা হলোঘটনাটি হলো এ রকমঃ খাদিজা (মুহাম্মদের প্রথম বধূ) মুহাম্মদকে বিয়ের পর একজন ক্রীতদাসকে (জায়েদ বিন হারিসকে) উপহার দেন। মুহাম্মদ জায়েদকে কিছুদিন পরে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তথাপি জায়েদ নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে না গিয়ে মুহাম্মদের কাছেই থেকে যান। মুহাম্মদ কিছুদিন পরে তাঁকে দত্তক নেন এবং নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাঁর নিজের আত্মীয় জয়নাব নামের একটি মেয়ের সঙ্গে যায়েদের বিয়ে দেন। জয়নাব ছিলেন ভরপুর যৌবনা এবং অপার সুন্দরী ও মনোহরিণী একজন নারী। একদিন হঠাৎ  জায়েদের গৃহে প্রবেশ করে জয়নাবকে  দেখে মুহাম্মদ চমকিত হয়ে পড়েন। মুহাম্মদ যখন জায়েদের গৃহে যান তখন জায়েদ ঘরে ছিলেন না। স্বভাবতই গৃহের অভ্যন্তরে একাকী থাকা জয়নাবের  সারা শরীর পোশাকে ঢাকা ছিলো না, এবং    অর্ধনগ্ন শরীর থেকে তাঁর রূপ ও যৌবন যেনো ছিটকে বেরুচ্ছিলো  সেই অপরূপ দেহসৌষ্ঠব ও উদ্দাম যৌবন  দেখে মুহাম্মদের বিমোহিত ও বিমুগ্ধ হয়ে যান। জয়নাবকে ঐ অবস্থায় তিনি দরজাতেই থমকে দাঁড়িয়ে যান এবং কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জয়নাবকে কিছু না বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যান।    বেরুনোর আগে দরজায় দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তির মতো তিনি বিড়বিড় করে তাঁর রূপের প্রশংসা এবং আল্লাহর তারিফ করেন।  কথাগুলি কিন্তু স্বল্প দুরত্বে থাকা জয়নাবের কানে প্রবেশ করে মুহাম্মদের (তাঁর আল্লাহর নবীর) মুখ নিঃসৃত তাঁর রূপের প্রশংসা শুনে তাঁর বুক গর্বে ও আনন্দে ভরে ওঠে। জায়েদ গৃহে ফিরলে মুহাম্মদ কী বলে তাঁর রূপের প্রশিংসা করে গেলেন তা তাঁর সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে ব্যক্ত করে বসেন। জায়েদ এ কথা শুনে বিষণ্ণ না হয়ে আঁতকে ওঠেন। নিজের বধূ কাছে  পরপুরুষের  উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে কারো ভালো লাগে না ঠিকই, কিন্তু তা শুনে কারো আঁতকে ওঠার কথা নয় যেমনটা জায়েদের ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। জায়েদ আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর নিজের জীবনের কথা ভেবে। জয়নাবের চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে গিয়ে মুহাম্মদ নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠবেন তাঁকে (জয়নাবকে) পাওয়ার জন্যে - এ বিষয়ে তিনি (জায়েদ) সুনিশ্চিত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা  থেকে এ বিষয়েও সংশয়হীন ছিলেন যে তাঁর (মুহাম্মদের) কামনার সামনে যতো শক্ত প্রতিবন্ধকতাই থাক না তা তিনি যেকোনো মূল্যে উৎপাটন করবেনই।  আর জায়েদের দুশ্চিনার কারণ হলো তিনিই সেই প্রধান বাধা, কারণ জয়নাব যে তাঁরই বধূ। জায়েদ তাই কালবিলম্ব না করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে জয়নাবকে তালাক দিয়ে মুহাম্মদের পথের প্রধান কাঁটাটা সরিয়ে দেন। কিন্তু তারপরেও আর একটা বড়ো কাঁটা ছিলো। সেটা তৎকালীন সমাজের একটি চলমান সংস্কৃতি ও প্রথা। প্রথাটা ছিলো এই যে, দত্তক পুত্র তার বধূকে তালাক দিলে পালক পিতার জন্যে সেই বধূটি অবৈধ। কাঁটাটা ছিলো কোরানের পূর্ব ঘোষিত আয়াতেও যেখানে বলা হয়েছে পুত্রবধূকে বিয়ে করা অবৈধ। এই বাধাটি অপসারিত করার জন্যে আল্লাহকে দিয়ে ঐ দু’টি আয়াত বা ওহি বলিয়ে নেন। ৩৩/৪ নং আয়াতে আল্লাহকে দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে দত্তক সন্তান আসল সন্তান নয় এবং সন্তান নেওয়া অবৈধ কাজ। আর ৩৩/৩৭ নং আয়াতে আল্লাহকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়েছে যে আল্লাহর আদেশ পালন করতেই মুহাম্মদ জয়নাবকে বিয়ে করেছিলেন, কারণ আল্লাহ অনেক পূর্বেই বেহেস্তে (স্বর্গে) মুহাম্মদ ও যয়নাবের বিয়েটা পড়িয়ে দিয়েছিলো এবার আয়াতদুটির ভাষ্য  উদ্ধৃত করা যাক। “আল্লাহ কোনো মানুষের জন্য তার ধড়ের মধ্যে দু’টো হৃদয় বানান নি; আর তোমাদের স্ত্রীদেরও যাদের থেকে তোমরা যিহার করে ফিরে গেছ তাদের তিনি তোমাদের মা বানান নি, আর তোমাদের পোষ্য-সন্তানদেরর তোমাদের সন্তান বানান নি। এসব হচ্ছে তোমাদের মুখ দিয়ে তোমাদের কথা। আর আল্লাহই সত্য কথা বলেন, আর তিনিই পথে পরিচালিত করেন।” (কোরান,  ৩৩/৪, অনুবাদ – ডাঃ জহরুল হক) অন্য আয়াতটি হলো - .. জায়েদ যখন জয়নবের সহিত বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সহিত বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে-সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহ্‌র আদেশ কার্যকর হতে বাধ্য।” (কোরান- ৩৩:৩৭)
মুহাম্মদ এভাবে তাঁর নিজের যৌন-কামনা পূরণ করার জন্যে সন্তান দত্তক নেওয়া ও তাকে উত্তরাধিকার দেওয়ার মতো সুন্দর ও সুস্থ সামাজিক প্রথা এবং একটি উচ্চ মূল্যবোধকে হত্যা করেন এবং সন্তান তূল্য দত্তক-পুত্রের বধূকে বিয়ে করার বৈধতা প্রদান করে পৃথিবীতে একটি অতি নিকৃষ্ট প্রথার প্রচলন শুরু করেন।  
ইসলামি বিয়ে-বিধি প্রসঙ্গে আলোচনায় এ পর্যন্ত যে ছবি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ইসলামের চোখে নারী পুরষের জন্যে একটি ভোগ্যপণ্য ছাড়া কিছু নয়  অবিশ্বাসী নারী সধবা হোক বিধবা হোক মায়ের তূল্য হক মেয়ের তূল্য হোক সবাই ভোগ্যবস্তু। বিশ্বাসী নারীও যে তার ব্যতিক্রম তা নয়। কন্যাশিশু যদি ছ’বছর/ন’বছরের হয় সেও ভোগ্য, নারী যদি দত্তক-পুত্রের বধূ হয় সেও। কন্যাশিশুদের শুধুই স্নেহ ও ভালোবাসা দাও, তাদের প্রতি কামদৃষ্টিতে তাকিও না - এমন কথা ইসলাম বলে নি। এবং এ কথাও বলে নি যে,  দত্তক-পুত্র-বধূদের আপন মেয়ের মতো স্নেহ ও মর্যাদা দেবে, তাদের প্রতি কামাতুর হয়ে উঠবে না।  বরং কন্যাশিশু ও দত্তক-পুত্রের বধূদের দেখে পুরুষদের যৌনপ্রেমের উদ্রেক যদি হয় তবে ইসলাম তাদের ভোগ করার ঢালাও লাইসেন্স প্রদান করেছে, বলেছে তারাও তোমাদের জন্যে বৈধ, তাদের বিয়ে করো এবং ভোগ করো।
বিয়ে সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত যে সব আয়াত কোরানে আছে সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সর্বক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভুমিকায় রাখা হয়েছে পুরুষকে। বিয়ে ব্যবস্থার সমগ্র প্রক্রিয়ায় পুরুষের ভূমিকাই প্রধান এবং নারীর ভূমিকা সম্পূর্ণরূপেই গৌণ। আয়াতগুলিতে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে পুরুষের বিয়ের জন্যে নারীর মধ্যে কারা বৈধ এবং কারা অবৈধের। এর বিপরীতে একটি আয়াতও নেই যেখানে   উল্লেখ করা হয়েছে নারীর জন্যে কোন কোন পুরুষ বৈধ আর কারা অবৈধ। এর দ্বারা বোঝা যে ইসলামের চোখে নারী কতো গুরুত্বহীন। অথচ ইসলামের মুরুব্বীরা দাবি করেন যে একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে অধিকার দিয়েছে বিয়েতে তাদের মতামত দেবার, স্বাধীনতা দিয়েছে তাদের পছন্দ অপছন্দ অবাধে ব্যক্ত করার, এবং ইসলাম বলেছে নারীর সম্মতি ব্যতিত কোন বিয়েই বৈধ নয়। এটা হাস্যকর দাবি বৈ নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বিয়ে পড়ানোর সময় পুরুষ ও নারী উভয়ের মত নেওয়া হয়। নারীকে পিতৃগৃহের অন্দরে বসিয়ে রেখে তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয় যে অমুকের ছেলে অমুককে এতো টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে সে কবুল করছে কীনা। সে হ্যাঁ বলে এবং তারপর একই কায়দায় পুরুষকেও প্রায় একই কথা তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়।  বলা বাহুল্য যে পুরুষটিও তিনবারই হ্যাঁ বলে, এবং তারপর বিয়েটা পড়ানো হয়। এভাবেই বিয়ের প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হয় এবং ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই পুরুষটি সেই নারীর কর্তা হয়ে যায়। না, এটা কথার কথা নয়। এটা আক্ষরিক ও মর্মগত অর্থেই একেবারে সত্যি কথা তার স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াতে। এ কথা থাক। বিয়েতে নারীর মতামত প্রদান, অনিচ্ছা-অনিচ্ছা অবাধে ব্যক্ত করার স্বাধীনতা ও অধিকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিয়ে পড়ানোর প্রাক্কালে নারীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে সে বিয়েটা কবুল করছে কীনা ঠিকই, এবং এটাও ঠিক যে সে যদি কবুল না করে অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ না বলে তবে বিয়েটা ভেস্তে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো নারীর যদি সেই বিয়েতে অমত থাকে তবে তার কি সেই মুহূর্তে ‘না’ বলার পরিস্থিতি ও পরিবেশ থাকে? বলা বাহুল্য যে থাকে না, তার ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।  এটা সর্বজন সুবিদিত যে বিয়ের প্রাক্কালে নারকে ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নেওয়া হয়, তাকে না বলার স্বাধীনতা বা অধিকার কোনোটাই দেওয়া হয় না। যার ফলে এখন দেখা যাচ্ছে মুসলিম মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করছে। এমন ঘটনা এখন ব্যাপক সংখ্যায় ঘটছে এবং এর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছেইসলামি বিয়ের বিধানে নারীর বর বা পাত্র পছন্দ করার স্বাধীনতা ও অধিকার থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না, ঘটার প্রয়োজন হতো না তাছাড়া যেখানে বাল্যবিয়ে অনুমোদিত সেখানে নারীর বর পছন্দ করার অধিকার বা স্বাধীনতার প্রশ্নই আসে না। পাত্রী বা বধূর বাবার পাত্র পছন্দ এবং সম্মতিতেই বিয়ে হয়। এটা সাবালিকা নারীর ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। বাবা বা বাড়ির পুরুষ অভিভাবকরাই পাত্র পছন্দ করে, যার বিয়ে সেই নারী বা পাত্রীর কোনো মতামত নেওয়া হয় না, সে  থাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে, বিয়ে পড়ানোর সময় তাকে দিয়ে ‘‘হ্যাঁ” দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়। মোদ্দা কথা হলো এই যে,  আলেম সমাজ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুক না কেনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যান্য ধর্মীয় বিয়ে-ব্যবস্থার মতো ইসলামি বিয়ের কর্মকাণ্ডেও  পুরুষই সর্বেসর্বা; পুরুষ বিয়ে করে আর নারীর বিয়ে হয়; বিয়ের আইন-কানুন ও অনুষ্ঠান সবকিছুই একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক;  বিয়ের সমগ্র কর্মকাণ্ডে প্রতিটি ধাপে পুরুষকে বসানো হয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে, আর নারীর স্থান পুরুষের পদতলে; বিয়ের সমগ্র প্রক্রিয়া জুড়ে পুরুষই থাকে শুধু সক্রিয়, নারী থাকে কার্যতঃ অক্রিয়; পুরুষের ইচ্ছাই সব, নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম নেই; এবং  পুরুষের ভূমিকাই প্রধান,নারীর ভূমিকা একেবারেই গৌণ।       

চুক্তিবিয়ের আর একটা বিধি আছে যেটা উল্লেখ করা হয় নি। এ বিধিটাও প্রমাণ করে যে ইসলামি বিয়ের বিধান নারীর প্রতি ন্যায়বিচার তো করেই নি, বরং নারীকে করেছে চরম অপমান। এই বিধিটি হলো  একজন নারীকে বিয়ে করতে হলে তার বিনিময়ে তাকে মোহর প্রদান করতে হবে। মুসলিমরা বলেন ‘মোহর’ হলো নারীর জন্যে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। মোহর প্রদানের মাধ্যমে নারীকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয় এবং এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসানো হয়। এটা একটি হাস্যকর দাবি।  আসলে ‘মোহর’ প্রদান মানে পাত্রীকে নগদ কিছু টাকা (অর্থমূল্য) প্রদান করা। নগদ টাকার পরিবর্তে সোনাদানা ও আসবাবপত্র বা জমিজায়গা দিয়েও ‘মোহর’ প্রদান করা যাবে, কিংবা নগদ টাকা এবং গয়নাগাটি ও জিনিষপত্র দুটোই দেওয়া যাবে। ‘মোহর’ কতো হবে তা দরদাম করে ঠিক করা হয় বিয়ের আগেই। দরদাম করার সময় বরপক্ষ কনের নানান দিক খতিয়ে দেখে। যেমন দেখে কনের পিতার  সামাজিক অবস্থান, পিতার আর্থিক অবস্থা,  রঙ-ঢঙ কেমন অর্থাৎ কনে ফর্সা না কালো না বাদামী, তার শিক্ষাদীক্ষা কতোটা আছে, কনে রান্নাবান্না ও ঘরের কাজকর্ম করতে জানে কী না, ইত্যাদি ইত্যাদি।  বরপক্ষের বিচারে যে মেয়ের গুণাগুণ যেমন তার তেমন ‘মোহর’ বা দাম ঠিক হয়। মোহর আসলে হলো পাত্রীর বিক্রয়মূল্য। একজন পুরুষ সেই দাম বা মূল্য মিটিয়ে দিয়ে পাত্রীটিকে কিনে নেয়। সুতরাং  চুক্তিবিয়ের মূল কথা হলো কিছু অর্থের বিনিময়ে একজন নারীর একজন পুরুষের কাছে বিক্রি হওয়া। এই বিক্রি হওয়াটা জন্মের জন্যে, কারণ ইসলামি বিয়ের বিধানে বিয়ের পর বধূ তার বরকে কোনো কারণেই ত্যাগ করতে বা তালাক দিতে পারবে না। পুরুষ পারবে, ইচ্ছা হলেই পারবে, কারণে অকারণে পারবে, জামাকাপড় ফেলে দেওয়ার মতো যখন তখন তার বধূকে তালাক দিয়ে চির তরে তাড়িয়ে দিতে পারবে,  কিন্তু বধূ শত অত্যাচারেও তার বরকে তালাক দিতে পারবে না। সে যে তার বরের কেনা ক্রীতদাসী, কিছু টাকা ও গয়না তথা ‘মোহর’-এর বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া এক নারী। ‘মোহর’-এর এমনই মাহাত্ম্য!          
   


মুসলিম বিয়েঃ চুক্তি বিয়ে - (দুই)




চারটির বেশী বিয়ে করায় কোনো বাধা নেই


এবার উলামা এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের দ্বিতীয় দাবিটির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক। এক্ষেত্রে তাঁদের দাবি হলো, বিশেষ পরিস্থিতিতে ইসলাম বহুবিয়েকে বৈধতা দিলেও তার সংখ্যা সীমায়িত করেছে মাত্র চারের ঊর্ধ সংখ্যায়, এবং একত্রে চারজনের অধিক পত্নী রাখা না নাজায়েজ (অবৈধ) ঘোষণা করেছে। সমগ্র মুসলিম সমাজই এ দাবিটিকে সংশয়াতীত সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং মানে।  শুধু মুসলিম সমাজই নয়, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সমগ্র বিশ্বই এটাকে সত্যি বলে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। সর্বস্তরের মানুষের এরূপ নিঃসংশয় বিশ্বাসের পেছনে রয়েছে বিশেষ কয়েকটি কারণ। কারণগুলি হলো, এক). মুসলিম দুনিয়ায়  মুসলমানরা সাধারণতঃ  একসাথে চারটির বেশী পত্নীকে একত্রিত করার সীমারেখা লঙ্ঘন করে না।  দুই). মুহাম্মদের সাহাবিরাও এই নীতি  অনুসরণ করে গেছেন এবং যাঁদের চারজনের অধিক পত্নী ছিলো তাঁরা পছন্দের চারজন পত্নী রেখে  বাকিদের তালাক দিয়েছিলেন।  (ইতিহাসের এই তথ্যটি যে সংশয়াতীতভাবে সত্য তা বলা যায় না। কেনো সংশয়াতীত নয় তা পরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যাবে)  তিন). কোরানের নিসা সুরার  তিন নং  (৪/৩ আয়াত)  আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘তোমাদের যেরূপ অভিরুচি তদনুসারে দুই, তিন ও চারিজনের পাণিগ্রহণ করিতে পার’।       
সারা বিশ্বের লোক বিশ্বাস করে যে ইসলামে চারটির বেশী বিয়ে করা  নিষিদ্ধ  বলেই এটাই সত্যি - এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। বিজ্ঞান ও যুক্তির দর্শন দাবি করে তথ্য-প্রমাণ।  বিজ্ঞান ও যুক্তির বিচারে তথ্য ও প্রমাণ ছাড়া কোনো ঘটনা, অভিমত বা তত্ত্বকে সত্য বলে মানা যায় না একদা সারা বিশ্বের মানুষ বিশ্বাস করতো যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এবং পৃথিবী স্থির।  এ কথাটা ভারতের অধিকাংশ মানুষ আজো বিশ্বাস করে। কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে –  এটা ডাহা ভুল এবং পৌরাণিক গল্পের মতো মিথ ও মিথ্যে ‘ইসলাম পুরুষের চারটির বেশী বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে’ – এটাও তদ্রুপই একটি ডাহা ভুল এবং পৌরাণিক গল্পের মতো মিথ ও মিথ্যে হ্যাঁ, এটা যে একটা ডাহা মিথ ও মিথ্যা তার প্রমাণ কিন্তু কোরান ও হাদিসেও পাওয়া যায়।  এবার সেই আলোচনাতেই  ঢোকা যাক।  প্রথমে ৪/৩ নং আয়াতটি ভালো করে বিশ্লেষণ করা যাক।  আরবি ও কোরান বিশেষজ্ঞদের তর্জমা আয়াতটির মূল কথাগুলি হলো,  “এতিমের প্রতি সুবিচার করিতে পারিবে না এ প্রকার আশংকা তোমাদের হইলে বিবাহ করিবে নারীদের হইতে যাকে ভাল লাগে দুই-তিন কিংবা চার’’।  এই কথাগুলির মধ্যে চারটি বিয়েকে ঊর্ধসীমা বলে উল্লেখ করা হয় নি। বলা হয়েছে বিয়ে করতে পারো পছন্দ মতো  ‘দুই-তিন কিংবা চার’।  এ কথাগুলোর অর্থ এটা নয় যে চারের অধিক কখনই না। আসলে ব্যাপারটা হলো এই যে, ‘দুই-তিন কিংবা চার’ – এটা নিছকই কথার কথা মাত্র। যদি কথার কথা না হতো তবে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হতো যে চারটির বেশী কখনৈ বিয়ে করা যাবে না। এখানে আর একটি কথা  বিবেচনাযোগ্য, তা হলো, উক্ত আয়াতে চারটির বেশী  বিয়ে করলে কী হবে সে সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। বলা নেই যে চারের অধিক বিয়ে করলে তা হবে নাজায়েজ (অবৈধ) এবং তাতে আল্লাহর সীমালঙ্ঘন করা হবে। কোথাও বলা হয় নি যে, যে চারের অধিক বিয়ে করবে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। সুতরাং এটা জোরের সাথেই বলা যায় যে ৪/৩ নং আয়াতে পুরুষের চারটির বেশী বিয়েতে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় নি। কোনো নিষেধাজ্ঞা যে নেই  তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হচ্ছেন স্বয়ং মুহাম্মদ যাঁর হারেম একসঙ্গে ১৩ জন পত্নী পর্যন্ত একত্রিত ছিলেন এবং মৃত্যুর সময় তিনি ১১ জন পত্নীক রেখে গিয়েছিলেন।  মুসলিম ধর্মগুরুরা অবশ্য হাদিস ও কোরানের তফসিরে দাবি করেছেন যে আল্লাহ মুহাম্মদের জন্যে এটা (চারের অধিক বিয়ে) অনুমোদন করেছে ব্যতিক্রম হিসেবে। এটা কিন্তু অবশ্যই হাস্যকর যুক্তি বৈ নয়, কারণ মুহাম্মদকে তাঁর অনুসারীরা অনুসরণ  করবেন এটাই তো স্বাভাবিক।  তাই প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে  কোরানের ওই আয়াতটি কে সত্য বলে সব মুসলিমরা বিশ্বাস করেন  না। শিয়া সম্প্রদায় তো এই কোরানটিকে আসল কোরান বলে মানেন না, বলেন খেলাফতি কোরান। তাঁরা বলেন যে তৃতীয় খলিফা ওসমান গণীর সময়ে আসল কোরানটিকে পুড়িয়ে ফেলে তাঁর মনের মতো একটি কোরান লেখানো হয়েছিলো যে কোরানে তাঁর মনের মতো কিছু আয়াত ঢুকানো হয়েছিলো, কিছু আয়াতের সংশোধন করা হয়েছিলো এবং মূল কোরানের কিছু আয়াত বাতিল করা হয়েছিলো। তাঁরা বোখারি হাদিস-সহ সুন্নীরা যে হাদিসগুলিকে সহি হাদিস বলে স্বীকৃতি দিয়েছে আএই হাদিসগুলিকেও জাল হাদিস বলে মনে করেন।  কতোগুলি পত্নীকে একত্রিত করা যাবে সে প্রশ্নে শিয়া সম্প্রদায়ের একটা  অংশের দৃঢ় অভিমত হলো মুহাম্মদ যতোগুলি পত্নী একত্রিত করেছিলেন ততোগুলি পত্নী রাখা বৈধ। আর একটি মত হলো, কতোগুলি পত্নী একত্রে রাখা যাবে তার কোনো সংখ্যাই ইসলাম নির্ধিরিত করে নি। শিয়া সমাজের একাংশ যে সত্যি সত্যিই এটা বিশ্বাস করেন তা স্বীকার করেছেন সুন্নি সমাজের ধর্মীয় নেতারাও। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত আলেম ও তফসিরকার ইবনে কাসির লিখেছেন,  তবে কোন কোন শি’আর মতে তা নয়টি পর্যন্ত একত্রিত করা বৈধবরং কোন কোন শি’আর মতে তা নয়টির বেশী একত্রিত করলেও দোষ নেই তাদের মতে কোন সংখ্যাই নির্ধারিত নেইতাদের দলীল হচ্ছে রসূলুল্লাহ (সঃ) – এর কাজযেমন সহীহ হাদীসে রয়েছে, তাঁর নয়জন পত্নী ছিলেন  সহীহ বুখারী শরীফের মুআল্লাক হাদীসের কোন কোন বর্ণনাকারী  এগার জন বলেছেন (সূত্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ৪র্থ-৭ম খন্ড, পৃ- ২৮০)  মুসলিমরা যে কোরান ও হাদিসগুলিকে চরম সত্য বলে বিশ্বাস করেন ও মানেন সেই কোরান ও হাদিস সম্পর্কে শিয়া মুসলিমগণ  তীব্র অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণা পোষণ করেন।  তাঁরা কীরূপ ধারণা পোষণ করেন তার দু’একটি নমুনা দেখা যাক। তাঁরা বলেছেন, “ঈমাম বাকের (আঃ) বলিয়াছেন তিন শতের উপর কোরানের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হইয়াছে যাহা আহলে বাইতের শানে ছিল। ইহাদের মধ্যে ইমাম (?) নেসাই ১৫০টা দেখাইয়া দিয়াছেন। ‘সিরাতুন নবী’ [অর্থাৎ নবীর চারিত্রিক গুণরাজি]  যে সকল বাক্যে উল্লেখিত ছিল তাহাদের মধ্য হইতে ১১৪টি বাক্য বদল করা হয়েছে।”   ... “হাদিস গ্রন্থাদি রচিত হইয়াছে আরও পরে, পরিপূর্ণ রাজত্বের যুগে। সেইজন্য রাসুল চরিত্রের উপর কলঙ্ক রচনার পরিমাণ সেখানে আরো অধিক হইতে পারিয়াছে। এক একটি সত্যকে ঢাকিবার জন্য সত্য হাদিসের পাশাপাশি বহু মিথ্যা হাদিস রচনা করিয়া রাসুলের সুন্নাকে একেবারে কলুষিত ও ঝাপসা করিয়া রাখা হইয়াছে। মিথ্যা হাদিসসমূহ সত্য হাদিস বলিয়া এমনভাবে চিহ্নিত হইয়া রহিয়াছে যে, ইহার শোধন ক্রিয়ার বিষয় নতুন করিয়া ঘোষণা করা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার।” (দ্রঃ ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণ, সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী, ইমামীয়া – নেজামীয়া চিশতী সংঘ, বাংলাদেশ, পৃ – ৩৪-৩৬)
এবার উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবী সমাজের তিন নম্বর দাবি ও যুক্তিটির যথার্থতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা যাক।  বহুবিয়ের কলঙ্ক থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে তাঁরা দাবি করেন যে ইসলামের আগমনের সময় তখনকার বিশেষ পরিস্থিতিতে বহুবিয়েকে ইসলাম বৈধতা দিয়েছিলো বটে তবে বহুবিয়েতে ইসলাম কখনোই উৎসাহ প্রদান করে নি, বরং নিরুৎসাহ প্রদানই করেছে। এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে তাঁরা কোরানের দুটি আয়াতকে তুলে ধরেন।  আয়াত দু’টি হলো সুরা নিসার ৪/৩ ও ৪/১২৯ নং  আয়াত।  তাঁদের দাবি, উপরে বর্ণিত শর্তগুলি ছাড়াও উক্ত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ পুরুষের একাধিক বিয়ে তথা বহুবিয়ের ক্ষেত্রে এমন একটি কঠোর শর্ত আরোপ করেছে যা  পূরণ করা তাদের সাধ্যের অতীত, আর এরূপ শর্ত রাখার উদ্দেশ্য হলো বহুবিয়ে থেকে পুরুষদের  বিরত  রাখা। তাঁদের তর্জমা (অনুবাদ) অনুসারে ৪/৩ নং আয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত শর্তটি হলো, যারা সকল পত্নীর সঙ্গে সমান ন্যায় ব্যবহার করতে পারবে না তারা মাত্র একটিই বিয়ে করবে। হ্যাঁ, এরূপ তর্জমাই তাঁরা করেছেন। তাঁদের করা পুরো তর্জমাটি হলো,  এবং তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে, পিতৃহীনদের (ইয়াতিম) প্রতি তোমরা সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীদের মধ্য হতে তোমাদের পছন্দ মতো দু-দুটো, তিন-তিনটে বা চার-চারটে বিয়ে করো, কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে, (স্ত্রীদের মধ্যে) সমান ব্যবহার  করতে পারবে না, তবে একটি মাত্র বিয়ে করবে; অথবা (তাও যদি না পারো তবে) তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যার অধিকারী অর্থাৎ অধিকারভুক্ত দাসীকে বিয়ে করবে, এতে অবিচার না হওয়াই অধিকতর সম্ভাবনা (দ্রঃ - কোরয়ান শরীফ বঙ্গানুবাদ ও বাখ্যা, ড. ওসমান গণী, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা)  এর পরেই ইসলাম যে বহুবিয়ে করতে পরোক্ষে নিষেধ করেছে তার দ্বিতীয় প্রমাণ হিসেবে তাঁরা  ৪/১২৯ নং আয়াতকে তুলে ধরেন।  এই আয়াতের প্রথামাংশে বলা হয়েছে যে কেউই সকল পত্নীদের প্রতি সমান ব্যবহার  করতে পারবে না।  এ কথাগুলির সূত্র ধরেই তাঁদের জোরাল দাবি হলো, যেহেতু সকল পত্নীর প্রতি সমান ও  ন্যায়সংগত আচরণ করা খুব কঠিন, তাই মুসলমানদের প্রতি ইসলামের বিধান হলো একের বেশী বিয়ে না করা।    
এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে মুহাম্মদ স্বয়ং এবং তাঁরা সাহাবি ও তাবেয়িগণ-সহ (মুহাম্মদের অনুগামী ও সহকর্মীদের সাহাবী এবং  সাহাবিদের সহকর্মীদের তায়েবী বলে) সকল খলিফা ও আলেমগণ প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বহুবিয়েকে তাঁদের জীবনসংস্কৃতির অঙ্গ করে  নিয়েছিলেন কেনো এবং এখনো কেনো মুসলিম সমাজে এর প্রচলন জারি রয়েছে?  উলামা এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যা বলছেন এবং যে বাখ্যা দিচ্ছেন তা যদি সঠিক হয় তবে মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবি ও তায়েবিগণ যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বহুবিয়ে করেছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই ভুল করেছিলেন এবং ইসলামি  বিয়ে-বিধিরও স্পষ্ট  উল্লঙ্ঘন করেছিলেন এবং এখনো যে সব আলেম বহুবিয়ে করেন তাঁরাও ইসলামবিরোধী কাজ  করছেন, নচেৎ উলামা এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যা দাবি করছেন ও বাখ্যা দিচ্ছেন তা  মোটেই ইসলামসম্মত নয়।  মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবিগণ যা করেছেন তা ভুল ও অনৈস্লামিক, আর এখনকার উলামাদের একাংশ ও মুসলিম বুদ্ধজীবীরা যা বলেছেন এবং ইসলামের যে বাখ্যা দিচ্ছেন তাই-ই সঠিক ও নির্ভুল এ কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাসযোগ্য ও বিবেচনাযোগ্য নয়। তাহলে রহস্যটা কোথায়? এর রহস্যটি লুকিয়ে রয়েছে উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রতারণা ও মিথ্যাচারের মধ্যে। একটু আগেই আমি উল্লেখ করেছি যে যেহেতু সভ্য সমাজে বহুবিয়ে প্রথা ও আইনটি প্রবলভাবে নিন্দিত ও ঘৃণিত, তাই সেই নিন্দা ও কলঙ্কের  ছোঁওয়া থেকে ইসলামকে বাঁচাতে  এবং ইসলামি বিয়ে-বিধানকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দিতে উলামা ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা স্থূল মাপের চতুরতা, প্রতারণা ও মিথ্যচারের আশ্রয় নেন।  রহস্যটা  লুকিয়ে ঠিক এখানেই। কথাটা হলো তাঁরা কোরানের  যে তর্জমা ও বাখ্যা  দিয়েছেন তার  মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যটা। ৪/১২৯ নং আয়াতের তর্জমা যথাযথ করলেও  ৪/৩ নং আয়াতের তর্জমাকে তাঁরা বিকৃত করেছেন। বিকৃত করেছেন সম্পূর্ণ জ্ঞাতসারে ও সচেতনভাবেই। এ  আয়াতটির যে বাখ্যা দিয়ে তাঁরা দাবি করেন যে ইসলাম বহুবিয়েতে উৎসাহ দেয় নি সেই বাখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতিপূর্ণ করেই তর্জমা তাঁরা করেছেন আয়াতটির। ফলে তাঁদের তর্জমাটিকে বিকৃত করতেই হয়েছে। কোথায় বিকৃতি ঘটানো হয়েছে দেখা যাক। ড.ওসমান গণি কর্তৃক অনুদিত রঙিন নিম্নরেখাংশটির প্রতি লক্ষ্য করুন।   সেখানে লেখা আছে -  কিন্তু যদি আশঙ্কা করো যে, (স্ত্রীদের মধ্যে) সমান ব্যবহার করতে পারবে না, তবে একটি মাত্র বিয়ে করবে;  প্রথম বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘স্ত্রীদের মধ্যে’ শব্দবন্ধটি কিন্তু মূল আরবি আয়াতে নেই, এটি ড.ওসমান গণি আরোপ করেছেন। অন্য তর্জমাগুলিতে এই শব্দবন্ধটি নেই। এ লেখাটির সব উপরে চোখ রাখুন যেখানে এ কে এম ফজলুর রহমান মুন্সীর আরবি উচ্চারণ-সহ  বাংলা তর্জমা দেওয়া আছে। সেখানে ‘স্ত্রীদের মধ্যে’ শব্দদ্বয় নেই।  ‘স্ত্রীদের মধ্যে’ শব্দদ্বয়  ড.ওসমান গণি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আরোপ করেছেন তা একেবারেই সংশয়াতীত। পাঠকের সংশয় নিরসনের জন্যে এখানে আরো চারটি তর্জমা উদ্ধৃতি করা হলো। দেখুন সেই তর্জমাগুলি।  গিরিশচন্দ্র সেন তর্জমা করেছেন – “এবং যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, অনাথদিগের প্রতি ন্যায় ব্যবহার  করিতে পারিবে না, তবে তোমাদের যেরূপ অভিরুচি তদনুসার দুই, তিন ও চার নারীর পাণি গ্রহণ করিতে পার, পরন্তু যদি আশঙ্কা কর যে ন্যায় ব্যবহার করিতে পারিবে না তবে এক নারীকে [বিবাহ করিবে,] অথবা তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাহার উপর অধিকার লাভ করিয়াছে, তাহাকে [পত্নী স্থলে গ্রহণ করিবে,] ইহা অন্যায় না করার নিকটবর্তী(দ্রঃ- কুরআন শারীফ, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা)  বাংলাদেশের মাওলানা মোহাম্মদ শাজাহান ও মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান তর্জমা করেছেন – “যদি ভয় হয় যে, ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার করিতে পারিবে না; তবে পছন্দ মত দুই, তিন বা চারিজন করিয়া স্ত্রী বিবাহ কর ; যদি সুবিচারের ভয় হয় তবে একজন অথবা অধিকার ভুক্ত দাসীকে; ইহাতে অন্যায় না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী (দ্রঃ রহমানিয়া লাইব্রেরী, ৪২/৪৩, নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা )  ইবনে কাসির তর্জমা করেছেন, “আর যদি তোমরা আশংকা কর যে পিতৃহীনগণের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে নারীগণের মধ্য হতে তোমাদের মন মতো দু’টি, ও তিনটি ও চারটিকে বিয়ে করো;কিন্তু যদি তোমরা আশংকা করো যে, ন্যায় বিচার করতে পারবে না, তবে মাত্র একটি অথবা তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যার অধিকারী (ক্রীতদাসী), এটা অবিচার না করার নিকটবর্তী ।” (http://IslamiBoi.wordpress.com)  বাংলাদেশের আর একজন ইসলামি পণ্ডিত ডাঃ জহরুল হকের তর্জমা হলো – “আর যদি তোমরা আশংকা করো যে তোমরা এতিমদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হতে পারছ না, তবে স্ত্রীলোকদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে তাকে বিয়ে করতে পার - দুই বা তিন বা চারকিন্তু তোমরা যদি আশংকা করো যে তোমরা সমব্যবহার করতে পারবে না তাহলে একজনকেই; অথবা তোমাদের দান হাত যাদের ধরে রেখেছেএইটিই বেশী  সঙ্গত যেন তোমরা সরে না যাও(http://www.QuranToday.com/)   ৪/৩ আয়াতটিতে স্ত্রীদের মধ্যে’ বা স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহারের কথা বলা হয় নি তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে হাদিসেও যে হাদিসটি মুহাম্মদের প্রিয় পত্নী আয়েষা বর্ণনা করেছেন। আয়েষা বর্ণিত হাদিস দু’টি হলো -  হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘একটি পিতৃহীনা বালিকা ছিলতার মাল-ধনও ছিল এবং একটি বাগানও ছিলযে লোকটি তাকে লালন পালন করছিল সে শুধুমাত্র তার মাল-ধনের লালসায় পূর্ণ মোহর ইত্যাদি নির্ধারণ না করেই তাকে বিয়ে করে নেয়। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়আমার ধারণা এই যে, ঐ বাগানে ও মালে ঐ বালিকাটির অংশ ছিল’ সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, হযরত ইবনে শিহাব (রঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)- কে এই আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞাসা করলে বলেনঃ ‘হে ভাগ্নে! এটা পিতৃহীনা বালিকার বর্ণনা, যে তার অভিভাবকের অধিকারে রয়েছে এবং তার মালে তার অংশ রয়েছেআর সে বালিকার মাল ও সৌন্দর্য তার চোখে লেগেছে। সুতরাং সে তাকে বিয়ে করতে চায়কিন্তু অন্য জায়গায় বালিকাটি যতটা মোহর ইত্যাদি পেত সে ততোটা দেয় না। সুতরাং সে অভিভাবককে নিষেধ করা হয়েছে যে, সে যেন সে বাসনা পরিত্যাগ করে এবং অন্য স্ত্রীলোকদেরকে পছন্দমত বিয়ে করে নেয় (দ্রঃ- ঐ, পৃঃ ২৭৮-২৭৯) বিখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাসির এ আয়াতটির তফসিরেও বলেছেন যে পত্নীদের প্রতি নয়, অনাথদের প্রতি সমান ও ন্যায় বিচার করার কথা বলা হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, “অতঃপর আল্লাহ  তা’আলা বলেন, কোন পিতৃহীনা বালিকার লালন পালনের দায়িত্ব যদি তোমাদের উপর ন্যাস্ত থাকে এবং তোমরা তাকে যদি বিয়ে করতে ইচ্ছা কর, কিন্তু যেহেতু তার অন্য কেউ নেই, কাজেই তোমরা এরূপ করো না যে, তাকে মোহর কম দিয়ে স্ত্রীরূপে ব্যবহার করবে, বরং আরও বহু স্ত্রীলোক রয়েছে তাদের মধ্যে তোমাদের পছন্দমত দুটি, তিনটি এবং চারটিকে বিয়ে কর   (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ৪-৭ খণ্ড, পৃ – ২৭৮)
সত্যকে ঢাকতে এবং তার উপর মিথ্যাকে বসাতে হলে যেরূপ নগ্ন ও কুৎসিত  মিথ্যাচার ও প্রতারণা করা দরকার হয় ৪/৩ নং আয়াতটির ক্ষেত্রে ঠিক তদ্রুপই করা হয়েছে। এবার ৪/১২৯ নং আয়াতের উপর আলোকপাত করা যাক। এই আয়াতটিকে আলেম সমাজ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবিগণ একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন এটা প্রমাণ করার জন্যে ইসলাম বহুবিয়েতে উৎসাহ দেয় নি, বরং নিরুৎসাহ করেছে। এ আয়াতটির অনুবাদ উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে - কারো পক্ষে সকল পত্নীদের সঙ্গে সমান ও ন্যায় ব্যবহার করা সম্ভব নয়। উক্ত আয়াতের এই কথাগুলিই শুধু তাঁরা উদ্ধৃত করে থাকেন এবং এই কথাগুলির সূত্র ধরে তাঁদের দাবি - যেহেতু সকল পত্নীদের প্রতি সমান ব্যবহার করা সম্ভব নয় আল্লাহ পুরুষদের একটির বেশী বিয়ে না করার বার্তা দিয়েছে এই আয়াতটির মাধ্যমে। এ দাবিটিও একটি জঘন্য প্রতারণা ও মিথ্যাচারের প্রকট দৃষ্টান্ত। কারণ  পুরো আয়াতটি  এবং  আয়াতটির প্রেক্ষাপট বলছে  সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত কথা। অর্ধ বা আংশিক সত্য কখনো কখনো বিকৃত সত্য ও মিথ্যার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর হয়। ৪/৩ নং আয়াতকে তাঁরা বিকৃত করেছেন মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্যে, এক্ষেত্রেও একটা অর্ধ সত্যকে (সেটাও আবার আপাতদৃষ্টিতে) ফলাও করে প্রচার করেন মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্যেইশুধু প্রতারণাই নয়, এর মধ্যে রয়েছে আবার জঘন্য মিথ্যাচারও। কারণ, ৪/১২৯ নং আয়াতটি আদৌ মুসলিম পুরুষদের বহুবিয়ে না করার কোনো পরামর্শ বা বার্তা দেবার  উদ্দেশ্যে রচনা করা হয় নি। আয়াতটির শেষাংশে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে   সেখানে একটির বেশী বিয়ে না করার বিষয়ে কোনো শব্দই নেই। পুরো আয়াতটি দেখা যাক - "তোমরা কখনও  স্ত্রীদের মধ্যে সমান ব্যবহার করতে পারবে না যদিও তোমরা কামনা করো, সুতরাং তোমরা কোন একজনের প্রতি  সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকেও পড়ো না অপরজনকে ঝুলান অবস্থায় রেখো না এবং যদি তোমরা সম্মিলিত ও সংযমী হও তবে নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল, ও করুণাময় (অনুবাদ – ইবনে কাসির)  আয়াতের শেষাংশে  স্পষ্টতঃই  পুরুষদের  বহুবিয়ে  করতে  নিষেধ  করা হয় নি কিংবা নিরুৎসাহিত করা হয় নিবরং বলা যায় যে তাদের বহুবিয়ে করতেই বলা হয়েছেসেক্ষেত্রে তাদের কেবল পরামর্শ  প্রদান করা হয়েছে  একজন পত্নীর প্রতি সম্পূর্ণরূপে ঝুকে না পড়ার এবং অপরজনকে দোদ্যুল্যমান অবস্থায় ফেলে না রাখার।  আয়াতটি সত্যিই কী বলেছে এবং কোন  প্রেক্ষাপটে বলেছে তার স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় তফসিরে ও হাদিসেএখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আয়াতটি রচনা করা হয়েছে বহুপত্নীক পুরুষদের  উদ্দেশ্যে, কিন্তু মোটেই তা নয়, এটা রচনা করা হয়েছে মূলতঃ নারীদের উপদেশ দেবার জন্যে। কথাটা সম্পূর্ণ  অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যি এবং চরম বাস্তব। দেখুন আয়াতের তফসির কী বলছে,  এখানে আল্লাহ তা’আলা স্ত্রীদের অবস্থাসমূহ এবং তাদের নির্দেশাবলীর নির্দেশ দিচ্ছেন। স্বামীরা কখনও কখনও তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে। তারা কখনও স্ত্রীদেরকে চায়, আবার কখনও পৃথক করে দেয়। সুতরাং যখন স্ত্রী তার স্বামীর অসন্তুষ্টির মনোভাব বুঝতে পারবে তখন যদি সে তাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তার সমস্ত প্রাপ্য বা আংশিক প্রাপ্য ছেড়ে দেয় তবে তা সে করতে পারে। যেমন সে তার খাদ্য ও বস্ত্র ছেড়ে দেয় বা রাত্রি যাপনের হক ছেড়ে দেয় তবে উভয়ের জন্য এটা বৈধ। অতঃপর ওরই প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন যে, সন্ধিই উত্তম।” ( দ্রঃ-  ইবনে কাসির, ৪র্থ-৭ম খণ্ড, পৃ – ৫৮৫) তফসিরকার ইবনে কাসির তার বক্তব্যের সমর্থনে একটি বোখারী হাদিসকেও উদ্ধৃত করেছেন। সেই হাদিসটি হলো, -  “সহীহ বুখারী শরিফে রয়েছেঃ এর ভাবার্থ এই যে, কোন বৃদ্ধা স্ত্রী তার স্বামীকে দেখে যে, সে হয়তো তাকে ভালবাসে না বরং পৃথক করে দিতে চায়, তখন সে তাকে বলেঃ ‘আমি আমার অধিকার ছেড়ে দিচ্ছি, সুতরাং তুমি আমাকে পৃথক করো না।’’  (সূত্রঃ ঐ, পৃ – ৫৮৬)  এই হাদিসটির পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান পুরুষদের কী করা উচিত সে প্রসঙ্গে  ইবনে কাসির বলেছেন, “এ আয়াতটি দু’জনকেই এ কাজের অনুমতি দিচ্ছে। ঐ সময়েও এ অবস্থা যখন কারো দু’টি স্ত্রী থাকবে এবং একটিকে তার বার্ধক্যের কারণে বা সে বিশ্রী হওয়ার কারণে তার সাথে ভালবাসা রাখবে না এবং ফলে তাকে তালাক দিয়ে দেয়ার ইচ্ছে করবে, কিন্তু ঐ স্ত্রী যে কোন কারণেই তার ঐ স্বামীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে এবং পৃথক হওয়াকে অপছন্দ করবে তখন তার এ অধিকার থাকবে যে, তার সমস্ত প্রাপ্য বা আংশিক প্রাপ্য ছেড়ে এবং স্বামী তাতে সম্মত হয়ে তালাক দেয়া থেকে বিরত থাকবে। (সূত্রঃ- ঐ) তফসিরকার আয়াতটির যে প্রেক্ষাপট বাখ্যা করেছেন সেটা যে সংশয়াতীতভাবেই সম্পূর্ণ নির্ভুল তার প্রমাণ হিসেবে মুহাম্মদের জীবনের একটি ঘটনার কথাও বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, - “হযরত সাওদা বিনতে যামআ’ (রাঃ) যখন খুবই বৃদ্ধা হয়ে যান এবং বুঝতে পারেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে পৃথক করে দেয়ার ইচ্ছা রাখেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ) – কে বলেনঃ “আমি আমার পালার হক হযরত আয়েশা (রাঃ) – কে দিলাম।”  রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটা স্বীকার করে নেন এবং এর উপরেই সন্ধি হয়ে যায়  ( সূত্রঃ- ঐ, পৃ – ৫৮৫) 
ইসলাম বহুবিয়েতে উৎসাহ নয় নিরুৎসাহ প্রদান করেছে এবং সকল পত্নীর সাথে ন্যায় ও সমান ব্যবহার করতে পারবে না বলে পুরুষদের একটাই বিয়ে করতে বলেছে – এটা যে সম্পূর্ণ অবাস্তব দাবি এবং এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার তার অনেক প্রমাণ রয়েছে কোরানের অন্যান্য আরো অনেক আয়াতে এবং মুহাম্মদের সমগ্র জীবনচর্চায়। এ লেখার শুরুতেই ৩৩/৫০ ও ৪/২৪ নং আয়াত দু’টির প্রতি লক্ষ্য করা যাক। ৩৩/৫০ নং আয়াতে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় মুহাম্মদ যতগুলি বিয়ে (কমপক্ষে ১৫টি) করেছিলেন, যতগুলি দাসী ও উপপত্নী তাঁর অধিকারে ছিলো, এবং তারপরেও যারা তাঁকে বিয়ে করতে চাইবে তাদের সকলকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে বৈধতা প্রদানের ঘোষণা করা হয়েছে। যিনি সারা জাহানের (বিশ্বের) পথপ্রদর্শক তাকে  আল্লাহ যতো খুশী বিয়ে করার ঢালাও অনুমতি প্রদান করেছে আর সেই  আল্লাহই বাকি মানব সমাজকে একটির বেশী বিয়ে করতে নিষেধ করেছে – এর চেয়ে হাস্যকর ও শিশুসুলভ দাবি আর হয় না।  একজন ধর্মপ্রবর্তকের  এতো বিয়ে করা এবং দাসী ও উপপত্নী রাখাটা নিঃসন্দেহে যেমন শ্রুতিকটূ, তেমনি দৃষ্টিকটূ  এবং তেমনি লজ্জাকরও বটে। সেই লজ্জা ঢাকার জন্যে তাই উক্ত আয়াতেই আল্লাহকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়েছে যে, এমন ঢালাও অনুমতি আল্লাহ দিয়েছে ব্যতিক্রম হিসেবে কেবল মুহাম্মদকেই। আর বাকিদের ক্ষেত্রে চারের অধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।  আল্লাহকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?  অমুসলিমদের কথা বাদই দিলাম, সব মুসলমানই যে এটা বিশ্বাস করে না সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তথাপি তর্কের খাতিরে ধরা যাক যে আল্লাহ শুধু মুহাম্মদকেই অনুমতি দিয়েছিলো,  অন্যদের ঢালাও নয় সর্বাধিক চারটি পত্নী রাখার অনুমতি দিয়েছে। এটাকেই যদি সত্যি বলে ধরা হয় তাহলেও প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ পুরুষদের বহুবিয়েতে নিরুৎসাহ নয়,  উৎসাহই দিয়েছে। এবার ৪/২৪ নং আয়াত কী বলেছে দেখা যাক। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এ আয়াতটি সকল মুসলিমদের উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছে। এই আয়াতে রয়েছে দু’টি  প্রধান কথা – এক. তোমাদের (পুরুষদের) অধিকারে যতো দাসী আছে তারা সবই তোমাদের জন্যে বৈধ।  এবং দুই. অধিকারভুক্ত দাসীদের ছাড়াও সধবা মুসলিম নারী বাদে সমস্ত বিধবা ও অবিবাহিত নারীদের মোহর দিয়ে বিয়ে করলে তারাও বৈধ। ৩৩/৫০ নং আয়াতে মুহাম্মদকে যেমন বহুবিয়ে করার এবং বহু পত্নী রাখার ঢালাও অনুমতি প্রদান করা হয়েছে তেমনি প্রায় তদ্রুপভাবেই সমস্ত মুসলমান পুরুষদের ঢালাও অনুমতি দেওয়া হয়েছে বহুবিয়ে করার এবং বহু পত্নী রাখার। এখানে একসঙ্গে চারজন পত্নী রাখার ঊর্ধসীমাটুকুও রাখা হয় নি। তাই এই আয়াত থেকে শিয়া মুসলমানদের সেই দাবিটিই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে একজন পুরুষ একত্রে কতোজন পত্নী রাখবে তার ঊর্ধসীমা ইসলামি বিয়ের বিধানে নেই। ৪/২৪ নং আয়াতের এই বাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমার একান্ত ব্যক্তিগত বলে  কারো যদি মনে হয় তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি তফসিরে চোখ রাখতে। দেখুন তফসির কী বলছে, - অর্থাৎ যে সব নারীর স্বামী রয়েছে তারাও তোমাদের জন্য হারাম। তবে হ্যাঁ, কাফেরদের যে সব স্ত্রী যুদ্ধেক্ষেত্রে বন্দি হয়ে তোমাদের অধিকারে আসবে, এক ঋতুকাল অতিক্রান্ত হবার পর তারা তোমাদের জন্য বৈধ হবে। মুসনাদ-ই-আহমাদে কযরত আবূ সাঈদ খুদরী(রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আওতাসের যুদ্ধে কতগুলো সধবা স্ত্রীলোক বন্দিনী হয়ে আসে। আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তাদের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং তাদের সাথে মিলিত হওয়াকে বৈধ করা হয়’। জামেউত তিরমিযী তিরমিযি, সুনান-ই-ইবনে মাজা, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থেও এ হাদিসটি রয়েছে। তাবরানীর হাদিসে বর্ণিত আছে যে, এটা খাইবার যুদ্ধের ঘটনা।  (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, ৪র্থ-৭ম খণ্ড, পৃ - ৩৪৩)
আলেম সমাজ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন যে এ যুগে  অমুসলিম নারীদের অপহরণ করে যতখুশী সংখ্যায় দাসী করে রাখা, বা বিক্রী করা, বা উপপত্নী করে রাখা বা বিয়ে করে পত্নীর মর্যাদা প্রদান করা  এখন আর ইসলামে বৈধ নয়, এগুলো সব এখন অনৈসলামিক কাজ।  ইসলামি বিয়ে-বিধি থেকে এই নীতিটিকে আধুনিক যুগে বর্জন করা হয়েছে। এটাও একটা নির্লজ্জ মিথ্যাচার। কারণ, এই আলেম সমাজই দাবি করেন যে ইসলাম হচ্ছে সর্বকালের জন্যে একটি পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা। আল্লাহ তৈরী সংবিধান কোনো একটি সময় বা যুগের জন্যে রচনা করা হয় নি,  এটা রচনা করা হয়েছে এমনভাবে  যে পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এটা সমান প্রাসঙ্গিক ও কার্যকরী থাকবে। আলেম সমাজ এ কথাটা তাঁদের মনগড়া কথা বলেন তা মোটেই নয়। কোরানেও এই ঘোষণা রয়েছে। সুতরাং ৪/৩, ৪/২৪, ৩৩/৫০ নং প্রভৃতি আয়াতগুলিও পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও কার্যকরী রয়েছে। বিধর্মী নারীদের অপহরণ করে ধর্ষণ করা যে সর্বকালেই বৈধ তা হাতেনাতে করে দেখাচ্ছে নাইজিরিয়ায় বোকো হারাম এবং ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস জঙ্গীগোষ্ঠী। মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবিরা বিধর্মী নারীদের  অপহরণ করে মুসলিম জিহাদিদের বণ্টন করে দিতেন। সে সময় এই নারীদের ভোগ করতে গিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিলো কী না তার খবর জানা যায় না। কিন্তু এখন আইএস জঙ্গীদের মধ্যে বিধর্মী বন্দি নারীদের ধর্ষণ করতে গিয়ে রীতিমতো বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এই বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা পেতে ২০১৫ সালে ‘আইএস’  জঙ্গীদের উদ্দেশ্যে একটি ফতোয়া জারি করেএটা তাদের ৬৪ নং ফতোয়া।  ইসলামিক স্টেটের কমিটি অব রিসার্চ অ্যান্ড ফতোয়াজ’ - এর পক্ষ থেকে জারি করা  ফতোয়ায় ১৫টি বিধির উল্লেখ রয়েছে যাতে বলা হয়েছে কোন নিয়ম মেনে ধর্ষণ করলে শরিয়ত মতে আর কোনটা অবৈধ।  ঐ ফতোয়ায় যেমন বলা হয়েছে বাবা-ছেলে একই যৌনদাসীকে শয্যাসঙ্গী করতে পারবে না। একই ভাবে, কোনও এক জন  জঙ্গির অধীনে যৌনদাসী হিসেবে কোনও মা-মেয়ে থাকলে তাদের এক জনকে বেছে নেবে মালিক। এই ধর্ষণ-ফতোয়া দেওয়া হয়েছে কোরানের ৪/২৩ নং আয়াতের আলোকে। এই ফতোয়াটি যে ইসলামসম্মত তার প্রমাণ রয়েছে ৪/২৩ নং আয়াতের তফসিরে।  তফসিরের বয়ানটি হলো, “অনুরূপভাবে মুসলমানদেওর ইজমা রয়েছে এ, এ আয়াতে মাতা, কন্যা, বোন ইত্যাদিকে হারাম করা হয়েছে। এদের সাথে যেমন বিয়ে হারাম, তদ্রুপ যদি তারা দাসী হয়ে অধীন হয়ে যায় তবে তাদের সাথেও মিলন হারাম ।
মোট কথা বিয়ের ও দাসীদের উপর অধিকার লাভের পরে, এ দু’ অবস্থাতেই এরা সবাই সমান । না তাদেরকে বিয়ে করে তাদের সাথে মিলন বৈধ, না তাদের উপর অধিকার লাভের পর তাদের সাথে মিলন বৈধ।
...                                    ...                                  ...
মোটকথা একই সাথে দু’  বোনকে বিয়েতে একত্রিত করাও হারাম এবং দু’ বোনকে দাসীরূপে রেখে তাদের সাথে মিলিত হওয়াও হারাম।” (দ্রঃ ৪/২৩ আয়াতের তফসির, ইবনে কাথিরের তফসির, ৪র্থ-৭ম খণ্ড, পৃ-৩৪২)  আইএস –এর উক্ত ফতোয়াটির খবর প্রকাশ্যে চলে আসে সংবাদ মাধ্যমে। সংবাদ সূত্রটি হলো -   (http://www.anandabazar.com/international/islamic-state-issues-fatwa-on-how-to-rape-a-woman-slave-1.273529)


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...