Friday, September 9, 2016

ভারতের মাটিতে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটির অন্তিম দশা দেখতে পাচ্ছি যেনো



সপরিবারে পিকনিক থেকে ফেরার পর পত্নী তাঁর সন্তানদের নিয়ে গাড়ী থেকে নেমে বাড়িতে প্রায় ঢুকেই গিয়েছিলেন। এমন সময় পতি পত্নীকে বললেন, গাড়ীর দরজাটা বন্ধ করে যাও।  পত্নী বললেন, তুমি তো গাড়ীর কাছেই আছো, তুমি বন্ধ করে এসো  এতে পতি রেগে গিয়ে পত্নীকে  তালাক দিয়ে বসেন।  পত্নীকে বলেন, তুমি আমার কাছে পরিত্যাজ্য। তোমাকে ‘এক তালাক’, ‘ দু’ তালাক’, ‘তিন তালাক’ বাইন তালাকতুমি এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, আমার বাড়িতে আর কখনো ঢুকবে না এটা একদম সত্যি ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে ২৮  সেপ্টেম্বর ২০১৪ সৌদি আরবে এবং খবরটা করে একটি অনলাইন আরব পোর্টালআমরা সেটা জানতে পারি বাংলাদেশের ‘মানব জমিন’ খবরের কাগজ থেকে তার পরের দিনএর সংবাদ সূত্রটি দেওয়া আছে প্রবন্ধের একদম নীচে। বলা বাহুল্য যে,শুধু সৌদি আরবে নয়, এ আইন ভারতেও চালু আছে।   

হ্যাঁ, এটাই শরিয়া আইন। এই আইনে পত্নিকে তালাক দেওয়াটা এ রকমই সহজ ও সরল।  হ্যাঁ, শরিয়া তালাক আইন এমনই বর্বর ও আমানবিক। ইন্টারনেটের যুগে  এটাকে আরো সহজ করে তোলা  হয়েছেপত্নীকে আর সামনাসামনি তালাক দেওয়া জরুরী নয়। পত্নীকে ফোনে তিন বার তালাক বললেই তালাক হয়ে যাবে। হচ্ছেও। এমনকি মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে কিংবা ইমেল, মেসেঞ্জার ও হোয়াটস আ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েও পত্নীকে তালাক দিলেও তা বৈধ। পৃথিবী যতো আধুনিক ও সভ্য হচ্ছে শরিয়া আইন ততৈ পশ্চাদপদ ও অসভ্য হচ্ছে। এই অসভ্য আইনের মাথায় বসে আছে ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড” (AIMPLB)এ কথার অর্থ হলো যুগেরপরিবর্তনের সঙ্গে শরিয়া আইনকে কোরানে আলোকে হালনাগাদ বা আপডেট করার দায়িত্ব ঐ বোর্ডের উপর। হালনাগাদ করার নামে বোর্ডের দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ধর্মগুরুগণ তালাক আইনকে ক্রমাগত আরো অসভ্য, অমানবিক ও বর্বর করে তুলছেন।    
রাগের মাথায় বা ঠাণ্ডা মাথায়  পত্নীদের তালাক দেওয়ার যে সব ঘটনা ঘটছে সে গুলো মোটেই বিচ্ছিন্ন  ঘটনা নয়।  বিশ্বজুড়ে তালাকের ঘটনা কী হারে ঘটছে তার পরিসংখ্যান থেকেই এটা বোঝা যায়।    দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে  মুসলিম গ্রামগুলিতে তালাকপ্রাপ্তা পত্নীদের সংখ্যা গড়ে এখন ১০/১২ জনএ তথ্য দিয়েছে  মুর্শিদাবাদ জেলার ‘রোকেয়া উন্নয়ন সমিতি’।  সমিতির সম্পাদক খাদিজা বানু বলেছেন যে, শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই তালাকপ্রাপ্তা বা পতিপরিত্যক্তা নারীর সংখ্যা এক লাখেরও বেশী। সৌদি আরবে অবস্থাটা আরো খারাপ। সৌদি আরবের একটি সংবাদপত্র আলেকতেসাদিয়ার এক জরিপে দেখা গেছে,  প্রতিদিন গড়ে ৮২টির হিসাবে ২০১২ সালে ৩০,০০০ তালাকের ঘটনা ঘটেছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে সৌদি আরবের জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি।
ভারতে এই আইনটি নির্বিবাদে চালু আছে ভাবলে অবশ্য ভুল হবে।  এই আইন নিয়ে মুসলিম সমাজে তীব্র দ্বন্দ রয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের মতে তিন তালাকের আইন অবৈধ  এই আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা  ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড” (AIMPLB)  থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৃথক একটি বোর্ড গঠন করেছেএকই কারণে  AIMPLB  থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি পৃথক বোর্ড (অল ইণ্ডিয়া মুসলিম মহিলা পার্সোনাল ল’ বোর্ড, AIMMPLB ) তৈরী করেছেন সুন্নি মুসলিম নারীরাও। তারপর তাঁরা  AIMMPLB ‘শরিয়া নিকাহনামা’ নামে একটি পৃথক শরিয়া আইনও প্রণয়ন করেছেন যে আইনটি  পুরুষের বহুবিবাহ ও তিন তালাককে অবৈধ ঘোষণা করেছে  
‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড”  – এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন সুন্নি  মুসলিম সমাজের সাধারণ নারীরারও।  তাঁদের মধ্যে ৯২.১% এবং ৯১.৭% মুসলিম নারী বলেছেন যে তাঁরা যথাক্রমে তিন তালাক এবং  পুরুষের বহুবিবাহের অবসান চান।   এই তথ্য পাওয়া  গেছে  ভারতীয় মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ (BMMA) - এর একটি সমীক্ষা থেকে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও তথ্য। এই সমীক্ষাটির বিস্তারিত তথ্য-সহ একটি এর উপর লেখা একটি প্রবন্ধ রয়েছে আমার ব্লগে। তার লিংক এটা -   http://giasuddinonline.blogspot.in/2015/08/blog-post_29.html । BMMA এর নেত্রী জাকিয়া সোনাম আরো জানিয়েছেন যে,  এই দু’টি আইনের বিলুপ্তি চেয়ে ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি দাবিপত্র ইতিমধ্যেই  প্রধানমন্ত্রীর  হাতে তাঁরা তুলে  দিয়েছেন। শুধু তাইই নয়,  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন রদ করার দাবি জানিয়ে সুপ্রীম কোর্টে তাঁরা একটি পিটিশনও দাখিল করেছেন।  সেই পিটিশনের প্রেক্ষিতে  সুপ্রীম কোর্ট  AIMPLBকে বলেছিলো  কেনো আইনটি রদ করা হবে না তা হলফনামা  (affidavit) দিয়ে  জানাতে। AIMPLB-এর নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যেই বহুবিবাহ ও তিন তালাকের পক্ষে সুপ্রীম কোর্টে তাঁদের হলফনামা (affidavit) পেশ করেছেন।  বলা বাহুল্য যে  সে  হলফনামাট একেবারে অন্তঃসারশূন্য। তার পরতে পরতে রয়েছে অপযুক্তি, অবাস্তব যুক্তি  এবং শিশুসুলভ ও হাস্যকর আব্দার।    
পুরুষের বহুবিবাহের পক্ষে AIMPLB-এর  পেশ করা প্রধান যুক্তিটি  হলো   - যদি নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশী হয় এবং পুরুষের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ থাকে, তবে বহু নারীই অবিবাহিত জীবন কাটাতে বাধ্য হবে সুতরাং নারীর পক্ষে সতীনের সঙ্গে  জীবনযাপন মেনে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গতনচেৎ পত্নীর প্রাপ্য অধিকারগুলি ছাড়াই নারীকে পুরুষের উপপত্নী হয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হতে হবে। যুক্তির নামে এটা যে অপযুক্তি তা বলা বাহুল্য।  তাছাড়া AIMPLB –র প্রতিনিধিরা এই অপযুক্তিটিতে  কার্যতঃ তাঁরা  স্বীকার করে নিয়েছেন যে পুরুষের বহুবিবাহের প্রয়োজনীয়তা ও  প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে গেছে।  কারণ ভারতে নারীর অনুপাতে পুরুষের সংখ্যাই অধিক।  এ প্রসঙ্গে AIMPLBকে আর একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া  আবশ্যক। তা হলো, নারী কীরূপ জীবনযাপন করবে - সতীনের সঙ্গে ঘর,  নাকি  কুমারীত্বের  জীবন,নাকি উপপত্নীর জীবন  - তা ঠিক করবে নারীই, নারীর ভাবনায় ও জীবনে নাক গলানোর অধিকার পুরুষের বিন্দুমাত্র নেই। পুরুষের বহুবিবাহকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে গিয়ে আরো যে দু’টি কথা তাঁরা বলেছেন তাকে হাস্যকর বললেও কম বলা হয়  তাঁরা দাবি করেছেন যে,  পুরুষের বহুবিবাহ   সামাজিক ও নৈতিক চাহিদা পূরণ করছে এবং  নারীর জন্যে উদ্বেগ থেকে এবং নারীর  মঙ্গলার্থেই   পুরুষের বহুবিবাহের  প্রচলন করা হয়েছিলো  
তিন তালাকের পক্ষে AIMPLB  যে যুক্তিগুলি  উপস্থাপিত করেছে সেগুলির  প্রতি এবার দৃষ্টিপাত করা যাক। শরিয়তি তিন তালাক আইনটি যে অমানবিক, অসভ্য ও কুৎসিত  আইন তা দৃষ্টান্ত সহকারে  উপরে  আলচনা করা হয়েছে। এ রকম একটা আইনকে যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও  অপরিহার্য প্রমাণ  করতে গিয়ে হলফনামায় তাঁরা যে যুক্তিগুলি সাজিয়েছেন  তার মধ্যে প্রধান দুটি যুক্তিতে বলা হয়েছে -     পুরুষকে  মৌখিক তালাকের অধিকার দেওয়া হয়েছে  কারণ,  ১). পুরুষের  আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বেশী ২). পুরুষরা সিদ্ধান্ত নেয় ভেবেচিন্তে,  ক্রোধশতঃ কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না।  হায় রে!  অপযুক্তি আর কাকে বলে!  এ যুক্তি বা দাবি যে শুধু হাস্যকর ও বমি উদ্রেককারী  তার সবচেয়ে বড়ো সাক্ষী হলো ইসলামের আঁতুড় ঘর সৌদি আরব যেখানে মুড়িমুরকির মতো তালাকের ঘটনা ঘটে।   
AIMPLB হলফনামায় আরো দাবি করেছে যে, মৌখিক তালাক আইন নারীর পক্ষেই উত্তম, কারণ তালাক নিয়ে আদালতে যখন শুনানি হয় তাতে নারীর সম্মানের হানি হয় বেশী। এ যুক্তিটি শুধু হাস্যকরই নয়, এটা পুরুষজাতির পক্ষে অবমাননাকরও বটে। কারণ এই যুক্তি দেখিয়ে AIMPLB গোটা পুরুষজাতিকে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিজেদেরকে নীচে নামিয়েছেন। কারণ এ যুক্তির মানে দাঁড়ায় যে মানসম্মানের বালাই যতো নারীর, ওটা পুরুষের নেই।  
AIMPLB অন্য এক জায়গায় দাবি করেছে যে, এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা যে পুরুষরাই কেবল একপেশে ও অপ্রত্যাহারযোগ্য মৌখিক তালাকের অধিকারটি ভোগ করে। এটা সংশয়াতীতভাবেই সম্পূর্ণ মিথ্যে দাবি। কারণ, শরিয়ত আইন পত্নীকে তালাক দেওয়ার বিন্দুমাত্র অধিকার দেয় নিAIMPLB পরোক্ষভাবে সেটা স্বীকারও করেছে। যেমন হলফনামায় তাঁরা লিখেছেন যে, A Muslim man can delegate his power of pronouncing talaq to his wife. অর্থাৎ পতি পত্নীকে  তালাক দেওয়ার অধিকার  দিলে  তবেই সে  তালাক দিতে পারবে, নচেৎ নয়।  
হলফনামায় AIMPLB এর উত্থাপন করা আরো দু’টি হাস্যকর ও শিশুসুলভ যুক্তির কথা উল্লেখ করে    আলচনা শেষ করবো।  AIMPLB বলেছে যে, যেহেতু মুসলিম ব্যক্তিগত আইন স্বয়ং  আল্লাহর আইন এবং আল্লাহর ধর্ম পালন করার অধিকার যেহেতু মুসলিমদের মৌলিক অধিকার,  সেহেতু  সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানাতে চাই যে, ইরাক, ইরান, মিশর, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ ২২টি মুসলিম দেশ এই আইনটি হয় বর্জন করেছে, না হয় এর সংস্কার করেছে।  তাই এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, অর্ধেক মুসলিম বিশ্বই যেখানে আল্লাহর (!) আইন মানছে না সেখানে ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে সেই আইনটা মানতেই হবে এমন দাবি যারা করে তারা নিশ্চিতভাবে হয় নাবালক না হয় আহাম্মক  আর ধর্ম পালন করার অজুহাতে সর্বোচ্চ আদালতের  কাছে নারীদের মানবাধিকার  লঙ্ঘন করার অধিকার  দাবি  করাও বোধ হয় কেবল  মূর্খ ও আহাম্মকদের  কণ্ঠেই  শোভা পায়।      
উপসংহারে আর একটা কথা বলতে চাই। তা হলো, মানবতাবিরোধী ও  কুৎসিত এই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি যাদুঘরে পাঠাতে মুসলিম নারীরা যে সংকল্পবদ্ধ লড়াই  চালাচ্ছেন তার মধ্যে আমি ভারতের মাটিতে আল্লাহর(!) এই আইনটির  মৃত্যুঘণ্টা শুনতে পাচ্ছি।  এবং তারজন্যে আন্দোলনরত বীর নারীদের  কুর্ণিশও জানাচ্ছি।     ০৭.০৯.১৬  
 (সৌদি আরবের সংবাদটি পড়তে http://mzamin.com/details.php?mzamin=NDM3MDY=&s=OA== এখানে ক্লিক করুন    )
  
    





KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...