Wednesday, July 6, 2016

ঈদের উৎসবে নেই রমাজানের শুদ্ধাচার, আছে যেন এক অন্য সুর



এবারেও সাড়ম্বরে, মহা ধূমধামের সঙ্গে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হয়ে গেল। ঈদের অন্তর্নিহিত অর্থ যাই থাক না কেন, আমরা বুঝে গেছি ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব। কলকাতার মুসলিম অঞ্চলগুলি –পার্কসার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনিরিচ, চিৎপুর, রাজাবাজার, খিদিরপুর কী সাজে সেজেছিল, কতটা সেজেছিল, এই চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জার পেছনে কত বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে কার সাধ্য তার বর্ণনা দেয়, হিসেব দেয়। তখন এসব অঞ্চলগুলি ঘুরলে মনে হয় না যে এ পোড়ার দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাস্তুহীন লক্ষ লক্ষ মানবেতর জীবনযাপন করে। এই অপরূপ সাজসজ্জা কেবল কলকাতাতেই নয়, শহর, গঞ্জ সর্বত্রই, সবখানেই যে যার সাধ্যমত করেছে। হোর্ডিং, ব্যানার, আলোর বর্ণচ্ছটায় সর্বত্রই ঈদেওর ঘোষণা, ঈদের মেজাজ ও পরিবেশ। বুঝতে অসুবিধা হয় না ঈদ উপলক্ষ্যে এই যে খুশির ফোয়ারা, উৎসবের চেহারা – এসব কোনও কোনও অঞ্চলের কিছু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও খেয়ালের বিষয় নয়।  এর পেছনে আছে অবশ্যই ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কেন্দ্রিয় স্তর থেকে সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং আদেশ। অন্যান্য আর সব ধর্মীয় উৎসবে, বিশেষ করে হিন্দুদের দূর্গা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন হয় থিক তেমনি করেই ঈদ উদযাপন করতে হবে – এমন পরিকল্পনা বা আদেশ উপর থেকেই আসে। আমি কিন্তু আমার সাধারণ বুদ্ধিতে ঈদ উপলক্ষ্যে কেন এত খুশি, কেন এই উৎসব তার অর্থ খুঁজে পাই না।
         ঈদ-উল-ফিতর আসে রমজান মাসান্তে। আর এই রমজান মাসের উপবাস পর্ব শেষ হয় মাত্র দু-রেকাত নামাজের মধ্য দিয়ে। রমজান মাসের দুটো দিক আছে। একটা হলো কঠোর সংযম তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ, আর একটা দিক কৃচ্ছ্সাধন। এর পেছনে না কি বিশেষ তাৎপর্য আছে। এটা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করার অবকাশ নেই এ প্রবন্ধে। তবুও প্রাসঙ্গিকতা – হেতু একটু আলোচনা না করলেই নয়। সংযম মানে বলা হয় চরিতে গঠন করা, অর্থাৎ মানুষের কুপ্রবৃত্তিগুলিকে শাসন করা ও দমন করা। দৃষ্টান্ত স্বরূপ মিথ্যে বলা যাবে না, চুরি-দুর্নীতি করা যাবে না, পরনিন্দা-পরচর্চা করা যাবে না, দুর্বলের উপর অত্যাচার করা যাবে না। লোক ঠকানো যাবে না, শোষণ করা যাবে না, পরনারীর দিকে কুনজরে দৃষ্টিপাত করা যাবে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ সৎভাবে সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হবে। শুধু তাই নয় বছরের পরবর্তী এগারো মাস সেইভাবে জীবন-বোধ রক্ষা করার অঙ্গীকারও গ্রহণ করতে হবে এই রমজান মাসে। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি? কেউ কি দাবি করতে পারেন, যাঁরা রোজা রাখেন কিংবা রাখতে পারেন না কিন্তু রোজা রাখায় বিশ্বাসী তাঁরা ইসলামের নির্দেশগুলি পালন করেন? বা অন্তত পালন করার চেষ্টা করেন? এর উত্তরে বলা যায়, না। যে কঠিন ব্রত পালন করার জন্যে একমাস ধরে উপবাস করে থাকা, প্রতি পদে উপবাস মুখে সেই ব্রতকে লঙ্ঘন করার হাজারো দৃষ্টান্ত দেখা যায় রমজান মাসে। এই যখন অবস্থা তখন ঈদের দিন খুশীতে মেতে ওঠার কী কারণ থাকতে পারে? ব্রত পালনে ব্যর্থতার যন্ত্রণা, কম সে কম অনুতাপ তো থাকা উচিৎ মুসলমানদের চোখে মুখে।
        কৃচ্ছ্বতাসাধন কী কেবল সারাদিনের উপবাস? যারা হয় খেতে পায় না কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান করে তাদের যন্ত্রণা কত তীব্র তা বোঝার জন্য নাকি উপবাসের বিধি। উপবাস থেকে উপবাসক্লিষ্ট গরীব-গুর্বা মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য সকল মুসলমানদের উপর এই এক মাস নাকি উপবাসে থাকার নির্দেশ। কিন্তু রমজানের ত্রিশ দিনের ছবিটা আমরা কী রকম দেখতে পাই? কৃচ্ছ্বতা সাধনের লেশমাত্র কোথাও দেখা যায় না। বরং দেখা যায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত। সূর্য অস্তমিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিগোচর হয় উপবাস ভাঙার বিশাল আয়োজন। হরকিসিমের ফলমূল, উপাদেয় নানারকম তেলের খাবার ও মিষ্টান্ন সহযোগে রোজা ভাঙা হয়, আর রাত্রে থাকে ভুরিভোজের বিপুল ব্যবস্থা। যারা বারোমাস অরধাহারে, অনাহারে থাকে তাদের অনাহারক্লিষ্ট মুখগুলো কি একবারও মনে পড়ে? রোজা এফতারের নামে বড় বড় পার্টি হয়। সেখানে আমন্ত্রিত হয় রোজা রাখা, না রাখা মুসলমান, হিন্দু সব ধর্মের অর্থবান আর ক্ষমতাবানরা। গরীব-গুর্বাগুলো অবাঞ্ছিত থেকে যায়। অসম্মানে, অবহেলায়, অনাদরে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু খাবার যা কেবল তাদের জন্যই, তাদের শ্রেণীর মত করেই তৈরী করা হয়। গরীব-গুর্বাদের কথা ভেবে যে মাসটা আসে তাদের কথা ভাবলে রমজান মাসের শেষে উৎসবের প্রশ্ন আসে কি করে? তবু উৎসব ও আনন্দ হয়।  মহা ধূমধাম করেই হয়। এবার আরো বেশী ধূমধাম হলো। সামনে বছর আরো বেশী হবে তা হলফ করে বলা যায়। ধর্মের রীতি-নীতিগুলো আজ গৌণ। সেগুলো বাতিলের খাতায়।  ধর্ম হয়ে উঠেছে অনুষ্ঠান সর্বস্ব। সব ধর্মই। ইসলামও। কিন্তু কেন? এই কেনর উত্তর হলো – (এক) আর সব ধর্মের মত ইসলাম ধর্মেরও রীতি-নীতি, আইন-কানুন ও নির্দেশিকাগুলো আধুনিক সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। দেড় হাজার বছর  ইসলামী আইন ও রীতি-নীতিগুলো সেই সময়কালেই কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বর্তমান সমাজে তো সেগুলি মানা মোটেই সম্ভব নয়। মানুষ সুদ দেবেনা-নেবেনা, মেয়েরা বোরখা পরিধান করবে, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে না, এই সভ্য যুগেও মানুষ চার-চারটে স্ত্রী রাখবে, কথায় কথায় পদাঘাত করে স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেবে-এসব এ যুগে চলে না। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দাবীতে যখন শোষণের ক্ষেত্রে সুযোগ আরও অবাধ হয়েছে, এবং উদারনীতির প্রভাবে এই পোড়ার দেশেও যখন চুরি ও দুর্নীতির বাজার হাট হয়ে খুলে গেছে, মন্ত্রী-সান্ত্রীরাও যখন বেপরোয়াভাবে চুরি দুর্নীতিতে মগ্ন তখন মুসলমানরা বেহেস্তের লোভে বা দোযখের (নরক) সবাই চরিত্রবান হয়ে উঠবে-এতো অলীক কল্পনা। উপদেশ দিয়ে বা পরলোকের ভয় দেখিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করা যায় না। শোষণের বিরুদ্ধে, দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, গরীব মানুষেওর দাবি দাওয়া নিয়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কেবল সৎ মানুষ তৈরী হতে পারে। ইসলাম ধর্মে সেই কর্মসূচী কোথায়? কোন ধর্মে আছে? তাই সব ধর্মই আজ অনুষ্ঠান সর্বস্ব। দুই) ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ রমজান মাসে রমজানের ইতি-কর্তব্য পালিত হচ্ছে না। তা নিয়ে কিন্তু এমাম, মুফতি, মৌলনা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মাথা-ব্যথা দেখছিনা। বরং আনন্দ ও উৎসবে মেতে ওঠাতেই তাঁদের আগ্রহ বেশী। তাঁরাও এতে আনন্দিত, পুলকিত। এদের অন্তরের ভাবনাতা এরূপঃ ওদের (হিন্দুদের) দেখিয়ে দাও, মুসলমানদেরও বিত্ত আছে, বিত্তের প্রাচুর্য আছে। ধর্মের নামে, ধর্মের জন্য তোমাদের মত মুসলমানরাও পারে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নিজের নিজের অঞ্চলকে সাজিয়ে তুলতে। সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে। তোমরা দেখ ধর্মের আহ্বানে মুসলমানরাও এক হতে পারে, সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, সব দিক দিয়ে তোমাদের টেক্কা দিতে পারে। ঈদের খুশী, ঈদের উৎসব – এসবের পেছনে এই দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কাজ করে, অবশ্যই সুপ্তভাবে, যা উপর থেকে দেখা যায় না সব সময়। সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত বয়ে যায় ঈদোৎসবে। অন্য সব ধর্মীয় উৎসবেও। ঈদের এ খুশী ও উৎসবে মুসলমানদের কোনও মঙ্গল আমি দেখতে পাই না। দেখতে পাই না সমাজের মঙ্গল। ঈদের উৎসব ‘আমরা-ওরা’ বিভেদটাকে আরো প্রকট করে তোলে। বিপদ বাড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ও জাতীয় সংহতির। (তিন) তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ঈদোৎসবের পেছনে আর একটি অন্যতম কারণ। মুসলিম ধর্মের নেতাদের দাবি ইসলাম ধর্মই শ্রেষ্ঠ। শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, একমাত্র সঠিক ধর্ম। আর সবই ভুল, বেঠিক। হজরত মহম্মদ ঈশ্বরের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ দূত, শেষ নবী। সারা বছর ধরে চলে এই সদম্ভ প্রচার এবং প্ররোচনামূলক বাণী বিতরণ। স্ব-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুধু মাত্র বাণী প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা হতে পারে না। তাই দুই ঈদ, মহরম, নবীর জন্মদিন, প্রভৃতি পরবকে ঘিরে চলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার লড়াই। এ এক অশুভ প্রতিযোগীতা ব্যতীত ভালো কিছু বলে মনে হয় না।  
(বিঃদ্রঃ- আজ থেকে তেরো বছর আগে আজকের মতোই  কোনো এক দিনে অনুষ্ঠিত ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এ লেখাটা লিখেছিলাম। লেখাটা ছাপা হয়েছিলো স্থানীয় সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা  ‘জঙ্গীপুরের চিঠি’তে সে বছরের ঈদের পরের ৩রা ডিসেম্বর তারিখে। সেটা ছিলো ২০০৩ সাল। । লেখাটি ঐ পত্রিকায় যে ভাবে ছাপা হয়েছিলো এ লেখাটি অবিকল সেটাই রাখা হয়েছে।   কোথাও কোনোরূপ সংশোধন বা পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করা হয় নি। এমনকি ছাপার ভুলগুলিও কিছু জায়গায় যেমন ছিলো তেমনই  রাখা হয়েছে।  তেরো বছর আগে যখন এ লেখাটি লিখি তখন  ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান ও ধারণা ছিলো তা  অনেক ক্ষেত্রেই  নির্ভুল ছিলো না। ফলে এ লেখাটির মধ্যে  অল্প কিছু জায়গায় তখন যা বলেছিলাম তার সঙ্গে আমি নিজেই এখন একমত নই। তবুও সে সব জায়গায়  কোনোরূপ সংশোধন করি নি এবং কিছু কিছু জায়গায় হাল-নাগাদ (আপডেট) করার প্রয়োজন থাকলেও তা করি নি। সেটা প্রধানতঃ নিজেকে ফিরে দেখার জন্যে।)   

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...