Wednesday, March 16, 2016

‘বিয়ে’ হলো নারীর উপর চাপানো পুরুষদের একটি চরম প্রভুত্ববাদী সামাজিক প্রথা



বিয়ে, তালাক, ইদ্দত এবং উত্তরাধিকার এই চারটি বিষয়ে ইসলামে যে যে আইনগুলি রয়েছে  সেগুলিকে একত্রে   মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বলা হয়বিয়ে, তালাক ও ইদ্দত এই তিনটি বিষয় একই সূত্রে বাঁধা,  এদের প্রত্যকটি একে অপরের পরিপূরক এবং  একটাকে অন্যটার থেকে সম্পূর্ণরূপে  পৃথক বা বিচ্ছিন করা যায় না । কিন্তু এই তিনটি বিষয়ের সঙ্গে উত্তরাধিকারের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ ।  তাই মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তর্ভুক্ত হলেও উত্তরাধিকারের বিষয়টিকে একটি পৃথক বিষয় হিসেবেই দেখা হয় এবং উত্তরাধিকার আইনটি তাই প্রায় স্বয়ং সম্পূর্ণও বটে  সেজন্যে এই অধ্যায়ে উত্তরাধিকার আইনটি বাদ দিয়ে বাকি  তিনটি বিষয় তথা  বিয়ে, তালাক ও ইদ্দত   আলোচনা করা হয়েছে, এবং  উত্তরাধিকার আইনটি আলোচনা করা হয়েছে  অন্য অধ্যায়ে (কোরানের দৃষ্টিতে নারী)  এই অধ্যায়ে প্রথমে শরিয়াভিত্তিক মুসলিম বিয়ে নিয়ে   আলোচনা  করতে চাই । তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে সাধারণভাবে শুধু ‘বিয়ে’ নিয়েই কিছু কথা বলা আবশ্যক ।
বিয়ে হলো নারীর উপর চাপানো পুরুষদের একটি চরম প্রভুত্ববাদী সামাজিক প্রথা    
সাধারণভাবে মানুষ বিশ্বাস করে যে ‘বিয়ে’ ব্যাপারটা একটা ঈশ্বর প্রদত্ত আইন এবং মানব সমাজের আদি থেকেই এটা প্রচলিত ব্যাপারটা আদৌ তা নয় অর্থাৎ  ‘বিয়ে’টা মানব সমাজের আদিতে প্রচলিত ছিলো না । স্বভাবতঃই এটা স্পষ্ট যে এটা ঈশ্বর প্রদত্ত আইন নয় । ঈশ্বর প্রদত্ত হলে  মানব সমাজের আদিতেই এর প্রচলন শুরু হতো    এবং  ঈশ্বর প্রদত্ত  হলে সারা বিশ্ব জুড়ে ‘বিয়ে’র আইন একটাই  হতো, ভিন্ন ভিন্ন আইন হতো না ।  কারণ  দাবি করা হয় যে ঈশ্বর একটাই যদিও কেউ বলে ভগবান, কেউ  আল্লাহ্‌, কেউ  গড, কেউ বলে ঈশ্বর  কিন্তু যেহেতু বিয়ের আইন এক একে  দেশে, এক এক  সমাজে,  এক এক জাতি বা গোষ্ঠীতে একেক  রকম,  তাই এটা  স্পষ্টতঃই বোঝা যায়  যে ‘বিয়ে’টা ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো আইন  নয় । আসলে প্রকৃত ঘটনা হলো ‘বিয়ে’টা   একটা   প্রথা বৈ নয়  যা ছাড়াই মানব সমাজ আদিতে  হাজার হাজার বছর  পথ পরিক্রমা করেছিলোএবং তার জন্যে   তখন যে সমাজে বড়ো কোনো সংকট দেখে দিয়েছিলো তাও নয় ।  সে কালে যুগের পর যুগ নারী ও পুরুষ অবাধে মেলামেশা করতো,  যার যাকে পছন্দ সে তার  সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো, বৈধ বা অবৈধ সম্পর্ক বলে কিছু ছিলো না ।  স্বভাবতঃই সকল সন্তানই ছিলো বৈধ সন্তান, ‘জারজ সন্তান’  বলে কোনো শব্দবন্ধ  তখনকার  সমাজের  অভিধানে ছিলো না । বলা বাহুল্য যে, ‘জারজ সন্তান’ একটা ভয়ঙ্কর শব্দবন্ধ যা ঈশ্বর বিশ্বাসী সমাজে একটি ভয়ঙ্কর অভিশাপ রূপেই বিরাজ করে এই অভিশাপ মানব সমাজের মাথায় চেপে বসেছিলো সেদিন যেদিন ‘বিয়ে’ প্রথার  প্রচলন হয়েছিলো ।  আর তখন  থেকেই নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈধ ও অবৈধ সম্পর্কের  তথাকথিত বিধিমালার ও নীতিমালারও প্রচলন শুরু হয়েছিলো । এর ফল যে মোটেই ভালো হয় নি তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রতিদিন ।  ‘ব্যাভিচার’, ‘অবৈধ সম্পর্ক’, ‘জারজ সন্তান’ এ সব ভয়ানক বিষয়গুলি ‘বিয়ে’ প্রথার গর্ভজাত সন্তান যা আমাদের সমাজকে প্রতিদিন ভাইরাল হয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়  এর ফলশ্রুতিতে আজকের এই আধুনিক ও সভ্য সমাজেও প্রতিদিন কত নারীকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে আত্মহত্যা করতে হয়, কিংবা তার গর্ভের নির্দোষ সন্তানকে হয় নষ্ট করতে হয়,   কিংবা  জন্ম দিয়েই  নবজাতককে নিভৃতে রাতের অন্ধকারে  নির্জন কোনো অঞ্চলে বা ঝোপ-ঝাড়ে চিরদিনের  জন্যে ফেলে চলে যেতে হয় তার ইয়ত্তা নেই আবার কতো গর্ভবতী নারী  মিথ্যা পরিচয় দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে  সন্তানের জন্ম দিয়ে  তাদের হাসপাতালের বেডে রেখেই  পালিয়ে যায়   সন্তান জন্ম  দেওয়ার পর পরই   তাকে চিরদিনের জন্যে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া যে কত যন্ত্রণার তা  পুরুষরা   কোনো দিনই  উপলব্ধি করা সম্ভব নয়,  এবং হয়তো করার চেষ্টাও তারা করে না এমনকি এ রকম  দুঃসহ  যন্ত্রণায় কত শত নারীকে যে জীবনভোর পিড়ীত হতে  হয়, দগ্ধ হতে হয়  পুরুষরা  তার  খোঁজও   রাখার চেষ্টা করে না  । তার পরিবর্তে  তারা সবাই  সেই অসহায় ও নির্দোষ নারীদের নষ্টা, কুল্টা ও বেশ্যা বলে গালাগাল দিয়ে নিজেদের সাধু প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে  । হ্যাঁ, ঐ নারীরা যারা তথাকথিত ‘জারজ’ সন্তান  গর্ভে ধারণ করে তারা  নির্দোষইহ্যাঁ,  সম্পূর্ণই নির্দোষ  কারণ, তাদের গর্ভে তথাকথিত  ‘জারজ’ সন্তানের জন্ম তাদের দোষে হয় না ।  তারা পরিস্থিতির শিকার হয় মাত্র । হয়  পুরুষদের  ভালোবাসার অভিনয়ের ফাঁদে পড়ে  তারা গর্ভে সন্তান ধারণ করে থাকে,  না হয় পুরুষদের কাছে ধর্ষিতা হয়ে পেটে সন্তান ধারণ করতে বাধ্য হয় ।  এতে তাদের দোষ কোথায় ?  এভাবে পুরুষদের প্রতারণা কিংবা জোর জবদস্তির  ফলে পৃথিবীর বুকে প্রতিদিন   শত শত তথাকথিত ‘জারজ’ সন্তান  ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই হয় মরণের কোলে ঢলে পড়ে,  না হয়  সরকারী অনাথ আশ্রমে  অনাদরে মা-বাবার পরিচয় ছাড়াই বড়ো  হয় এগুলো  বিয়ে প্রথার এক অবশ্যম্ভাবি কুৎসিত কুফল  যা আমরা হাজার হাজার বছর ধরে ভোগ করে চলেছি । এগুলোই শেষ নয়, আরো অগুনতি কুফল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করি ।  বলা বাহুল্য যে যাবতীয় কুফল ভোগ করতে হয় মূলতঃ নারীকেই । পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক যেহেতু অবিচ্ছেদ্য তাই নারী যে যন্ত্রণা ভোগ করে তার কিছুটা পুরুষকেও ভোগ করতে হয় । 
‘বিয়ে’ হলো একটা চুক্তি । একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর চুক্তি ।  একটি অসম ও সম্পূর্ণ একপেশে  চুক্তি । ‘বিয়ে’র পরিকল্পনা এসেছে পুরুষের মাথা থেকে এবং তার চুক্তিও তৈরী  করেছে পুরুষ । স্বভাবতই  চুক্তিটি  পুরুষের স্বার্থ রক্ষাকারী ।  মানুষের তৈরী চুক্তি সর্বদা পরিবর্তনশীল, বিয়ের চুক্তিরও তাই  বারবার সংশোধন ও পরিবর্তন হয়েছে । আদিম যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত এর প্রতিটি সংশোধন ও পরিবর্তনই সাধিত হয়েছে পুরুষের অনুকূলে তাদের স্বার্থ পূরণ করার জন্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অন্তিম কালেই বিয়ে প্রথার উদ্ভব হয়েছিলো বলে প্রথম দিকে বিয়ের চুক্তি এখনকার মতো পুরোপুরি পুরুষের পক্ষে একপেশে ছিলো না । বিয়ের পর তখন বাবা-মাকে কাঁদিয়ে এবং নিজে কেঁদে বুক ভাসিয়ে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি যেতে হতো না, উল্টে ছেলেরাই যেতো শ্বশুর বাড়ি । নারী ও পুরুষ উভয়েই উপার্জন করতো । ফলে বিবাহিত যুগলের মধ্যে এখনকার মতো প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক ছিলো না তারা পরষ্পর পরষ্পরের জীবনসঙ্গী ছিলো হ্যাঁ, এখন একটা  ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের বিয়ে হলে তাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা কার্যতঃ প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কই তাইতো বিয়ের পর বিবাহিত যুগলকে  স্বামী-স্ত্রী এবং পতি-পত্নী রূপে অভিহি করা হয়  স্বামী মানে প্রভু, অতএব স্ত্রী তার  ভৃত্য,  আবার পতি মানে প্রভু, কর্তা, অধীশ্বর  ইত্যাদি, অতএব পত্নী হলো একজন নারী যে পতির ভৃত্যমাতৃতান্ত্রিক সমাজ যেমন যেমন পুরুষতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছে তেমন তেমন বিয়ের চুক্তিটিও পুরুষের অনুকূলে ঝুঁকেছে এবং একটু একটু করে ঝুঁকতে ঝুঁকতে একটা সময়ে এসে পুরোটাই ঝুঁকে গেছে পুরুষের অনুকূলে । চুক্তিটি  যতো বেশী পুরুষের পক্ষে ঝুঁকেছে বিয়ের কুফল ও নারীর যন্ত্রণাও তত বেশী  বৃদ্ধিলাভ করেছে । সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলাও ততো বেড়েছে ।  
‘বিয়ে’র পশ্চাতে যে চুক্তিটি থাকে তা অগুন্তি ধারা বা শর্তবিশিষ্ট   জাতি-উপজাতি ও গোষ্ঠী ভেদে  শর্তগুলির মধ্যে  প্রচুর  ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় দু/চারটা বাদ দিলে শর্তগুলির অবশ্য  কোনোটাই লিখিত-পঠিত  থাকে  না । অলিখিত থাকলেও   তাতে এতো জোর নিহিত থাকে যে কোনো একটা শর্তও  মেয়েদের পক্ষে  অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বা উপায়  নেই  যদি কোনো নারী তা করার সামান্য চেষ্টা করে তবে গোটা সমাজ তাঁকে ছিঁড়ে খায়, এবং   এমনকি  অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনের  নেমে আসে তাঁর উপরফলতঃ  তা দেখে সমাজের  বাকি মেয়েরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে খুব সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক গবেষণার রিপোর্ট থেকে জানিয়েছে যে, বিবাহিত জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ৮৭% নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে(সূত্রঃ www.thebengalitimes.com )  বিয়ের পর কী কী  অলিখিত শর্তে   নারীকে বেঁধে ফেলা হয় সেগুলির উপর একটু  দেখে নেওয়া  যাক । শর্ত - এক). বিয়ের পর নারীকে  মা, বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের কাঁদিয়ে এবং   প্রবল বিচ্ছেদ ব্যথায়  কাঁদতে কাঁদতে স্বামীরূপী সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত মানুষের  বাড়িতে  গিয়ে উঠতে হবেদুই). নিজের পদবী ত্যাগ করে স্বামীর পদবী ধারণ করতে হবে এবং সারা জীবন স্বামীর পরিচয়েই তাঁকে বাঁচতে হবে । স্বামীর পদবী ধারণ শুধু হিন্দু মেয়েদেরই করতে  হয় তা নয়, মুসলিম  সমাজেও এ শর্তের প্রচলন রয়েছে বা শুরু হয়েছেবাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির   সভানেত্রীর নাম বেগম খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমান ছিলেন তাঁর স্বামী  খালেদাকে তাই তাঁর স্বামীর নামটি ধারণ ও বহন করতে হয় তাঁর নিজের নামের সঙ্গে দেশেরই প্রধানমন্ত্রীর নাম সেখ হাসিনা  ওয়াজেদ । ‘সেখ’ এবং ‘ওয়াজেদ’ দু’টোই তাঁর স্বামীর নামের অংশ যা তাঁকে তাঁর নামের সঙ্গে ধারণ করতে হয়েছে । বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের  স্ত্রীর নাম ছিলো সেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাঁকেও তাঁর স্বামীর নাম থেকে ‘সেখ’ ও  ‘মুজিব’ উপাধি দু’টি নিয়ে তাঁর নামের আগে পিছে লাগাতে  হয়েছিলো । মুসলিম নারীদের বিয়ের পর  নামের শেষে ‘বিবি’ ও ‘বেগম’ এই দু’টি লেজুড় জুড়ে দেওয়া হয় । এটা   হিন্দু নারীদের  সিঁদুর ও শাঁখার  মতো  কারো  সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাখা থাকার মানে যেমন  তার একজন স্বামী (মালিক) আছে, তেমনি কারো নামের শেষে ‘বিবি’ ও ‘বেগম’ লেজুড় থাকা  মানে তার একজন সাহেব (প্রভু) বা বাদশা (সর্বময় কর্তা) আছে ।  তিন).  নারীকে   সিঁথিতে সিঁদুর পরতে হবে ।  চার).   নারীকে শাঁখা পরতে হবে পাঁচ). স্বামীর কল্যাণ কামনা করে স্ত্রীকে নানা  তিথিতে নানা রকম ব্রত পালন করতে হবে  তাঁর নিজের  কল্যাণ কামনা করার স্বপ্ন দেখা ছাড়তে হবেছয়).  নারীকে তাঁর পছন্দের পোশাক ছেড়ে স্বামীর পছন্দের পোশাক পরতে হবে । সাত). পড়তে পড়তে বিয়ে হলে নারীকে পড়াশোনা ছাড়তে হবে । আট). সাইকেল ও বাইক চালানো বন্ধ করতে হবেনয়). খেলাধূলা বন্ধ করতে হবে । দশ). বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা ও  আড্ডা দেওয়া  বন্ধ করতে হবে । এগারো). মোটা অংকের অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার দিতে হবে যৌতুক হিসেবে ।   
অমর্যাদাকর, অবমাননাকর, স্বাধীনতার পরিপন্থী  এই শর্তগুলির বাইরেও  আরো  কতো শর্ত যে আছে তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু এসব শর্ত ছাড়াও আর একটি শর্ত আছে যেটা  মূল বা প্রধান শর্ত যাকে  ঘিরে  বাকি শর্তগুলি আবর্তিত হয় সে শর্তটি হলো  দাসত্বের শর্ত,  বিয়ের পর  স্ত্রীকে আজীবন   স্বামীর দাসত্ব করতে হবে   নারী শিক্ষিত  কিংবা  নিরক্ষর হোন , গরীব কিংবা ধনীর সন্তান হোন,  গ্রাম কিংবা শহরের মেয়ে হোন, আত্মীয় কিংবা অনাত্মীয়ের মেয়ে হোন,  চেনা বা অচেনা মেয়ে  হোন, নারী যেই হোক না কেনো, সকল নারীর ভবিতব্যই এক, সব নারীকেই   স্বামীর দাসত্ব করতে হবে ।  এই দাসত্ব সুচারুরূপে রূপায়নের জন্যে স্ত্রীর জন্যে  চারটি প্রধান কর্তব্য  নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে । সেগুলি হলো - এক). হলো স্বামীর সেবা করা, দুই). স্বামীর মনোরঞ্জন করা, তিন). স্বামীর বংশ রক্ষা করা,  এবং চার).  বিনা প্রশ্নে ও প্রতিবাদে স্বামীর যাবতীয় আজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞা পালন করা  কর্তব্যগুলি রূপায়নে  মানসিকভাবে তৈরী করার জন্যে নারীকে শিশু অবস্থা থেকেই  সংসার ধর্মের পাঠ দেওয়া হয় ।  সে পাঠে তার মগজে কতকগুলি মন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়  যার মধ্যে কয়েকটি হলো   -  ‘পতির  পূণ্যে সতী  পূণ্য,  ‘পতিই সতীর গতি’,  ‘পতির পদতলে পত্নীর স্বর্গ’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’,  ইত্যাদি ইত্যাদিবিয়ের আগেই নারীকে এ কথাটা (আসলে শর্ত) বুঝে ও স্বীকার করে নিতে হয় যে, সংসার সুখে রাখার দায় শুধু তার (পত্নীর), পতির কোনো দায় নেই । আর সংসারের সুখ মানে তো বোঝায়  স্বামীর সুখ । তাই  নারীকে শিশুকালেই  শিখিয়ে দেওয়া হয় যে,  পতি অসন্তুষ্ট বা রুষ্ট হয় এমন কোনো কাজ যেনো স্ত্রীগণ  না করে,   স্ত্রীগণ যেনো কখনোই  স্বামীর অবাধ্য না হয়, স্বামীর অনুমতি ছাড়া যেনো একটি পাও না ফেলে, স্বামী প্রহার করলেও তারা যেনো মুখ বুঁজে সহ্য করে, ইত্যাদি ইত্যাদি । স্ত্রীরা কি  শুধু  স্বামীর দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে ?   না ।  স্ত্রীগণকে শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবর-সহ পরিবারের সকলেরই দাসত্ব করতে হবে  এ যুগের মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষ এই সত্যটা (স্ত্রীগণের দাসত্ব করা কথা)  কিন্তু  স্বীকার করতে  নারাজ এটা গণতন্ত্রের যুগ, সমাজতন্ত্রের যুগ, এবং সর্বোপরি সভ্যতার যুগ, তাই উচ্চ শিক্ষিত নারী ও পুরুষদের এটা  স্বীকার করতে লজ্জা হয় যে এ যুগেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আসলে মালিক-দাসীর সম্পর্কই এবং নারীকে বিয়ের পর স্বামীর সংসারে গিয়ে দাসত্বই করতে হয় । তথাকথিত শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের মানুষদের মতো পশ্চাদপদ শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষরা কিন্তু এ লজ্জা ঢাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না    কিছু কিছু  সমাজে তাই এ প্রথা আজো চালু আছে যেখানে দেখা যায়  ছেলেরা যখন বিয়ে  করতে যায় তখন মাকে বলে -  মা, আমাকে আশীর্ব্বাদ করো, আমি তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি ।   আবার  তথাকথিত বর্তমান সভ্য যুগেও  এটাই দস্তুর হলো পাত্রীর সম্পর্কে খোঁজ খবর  নিতে গিয়ে পাত্রপক্ষ অন্ততঃ দু’টি বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে চায়, তাহলো,  পাত্রী  ঘর-সংসারের  কাজ জানে কী না ও করে কী না,  এবং   নিরীহ, শান্তশিষ্ট ও মা-বাবার অনুগত কী না  অর্থাৎ পাত্রপক্ষ আসলে সেই মেয়েকেই বধূ করে আনতে চায় যে সব দিক দিয়েই হবে স্বামীর সংসারে  দাসীর মতো কাজ করার উপযুক্ত   যারা  শ্বশুর বাড়ি গিয়ে দাসীসুলভ কাজ ও আচরণ করে তাদেরকে এ সমাজ গৃহলক্ষী বলে । এ হচ্ছে পুরুষদের চালাকি । নারীকে দাসীর মতো খাটিয়েও ভালো ভালো শব্দ বা বিশেষণে ভূষিত করে  যাতে নারী পুরুষদের চালাকি ধরতে না পারে এবং সারাজীবন তাদের দাসীগিরি করে । স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে বলা হতো ‘সতী’ নারী স্বেচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে সহমরণে গেছে আর সব মেয়ে  যেতে সে পথ অনুসরণ করে তাই পুরুষদের উদ্যোগে তৈরী হতো (এখন যে একেবারেই হয় না তা নয়) ‘সতী মন্দির’ এবং সেই মন্দিরে পুরুষদের উদ্যোগে মহা সাড়ম্বরে পূজা ও মেলার আয়োজন করা হতো । আজোও হয় ।
‘গৃহলক্ষী’দের দুর্দশা দেখে আমার মনে পড়ে যায় দাসযুগের কথা । সে যুগে দাসদের নিজের জীবনের উপরেও তাদের নিজেদের অধিকার ছিলো না । মালিক তার অধীনস্থ দাসদের শুধু অমানুষিকভাবে খাটানোর এবং তাদের উপর অমানবিকভাবে নৃশংস অত্যাচার করার অধিকারীই ছিলো না, তাদের বিক্রী  এবং হত্যা করারও আইনসঙ্গত অধিকারও ছিলো তাদের । দাসযুগের অবসানের পরেও আরবে ইসলাম  সেই দাসপ্রথার পুনঃপ্রবর্তন করেছিলো ।  ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মদ স্বয়ং এই নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক প্রথা চালু করেছিলেন আল্লাহ্‌র নামে । আধুনিক যুগে স্ত্রীগণের অবস্থা কার্যতঃ দাসযুগের দাস-দাসীদের মতোই । তফাৎ কেবল দু’টি ক্ষেত্রে – স্ত্রীদের বিক্রি বা হত্যা করার আইনসঙ্গত অধিকার স্বামীদের হাতে নেই । কিন্তু আইনসঙ্গত অধিকার না থাকলে কী হবে,  স্ত্রীগণকে বিক্রি বা হত্যা করার ঘটনা  এখন আকছারই ঘটে । বিশেষ করে বিয়ের পর স্ত্রীর বাবা-মা’র কাছ থেকে আরো আরো যৌতুক আদায়ে ব্যর্থ হলে আজো কত শত স্ত্রীকে যে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় তার ইয়ত্তা নেই । এমনকি স্বামীর পরকীয়ায়   স্ত্রী অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেও স্বামী তাকে হত্যা  করতে দ্বিধা করে না । সাংবিধানিক আইনে এ যুগে স্ত্রীগণের নিজেদের শরীরের ওপর তাদের অধিকার যে টুকু আছে তা কেবল শারিরীকভাবে বেঁচে থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তার বাইরে নয় । স্ত্রীগণ  নিজেদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মালিক  নিজেরা নয় । বিয়ের পর পরই নারীর শরীরের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়ে যায় স্বামীর কাছে । স্ত্রীর ঠোঁট, স্তন, জরায়ু-সহ গোটা শরীরের উপর তার আর কোনো অধিকার থাকে না, তার শরীরের সব কিছুর মালিক তার স্বামীস্বামীর মনোরঞ্জন করা স্ত্রীগণের প্রধান কর্তব্য।  স্বামীর সে মালিকানা আছে বলেই তারা এ কথা বলার অধিকারী যে,  যখন যে মুহূর্তে সে তার যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্যে স্ত্রীকে কাছে ডাকবে তখন সে মুহূর্তেই তাকে  ছুটে যেতে হবে, কোনো প্রকার অনিচ্ছা, অনাগ্রহ, অসুবিধার কথা চলবে না, যদি বলে সেটা অজুহাত ও অবাধ্যতা  হিসেবে গণ্য হবে  স্ত্রী তার গর্ভে কখন সন্তান ধারণ করবে, কী সন্তান  (ছেলে না মেয়ে) ধারণ করবে তাও স্থির করার মালিক সে নিজে নয়, মালিক  স্বামী  স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার পর যদি  স্বামীর মনে হয় যে এটা সন্তান নেওয়ার উপযুক্ত সময় নয়, তাহলে স্ত্রী চাক বা না চাক তাকে  তার গর্ভের সন্তানকে নষ্ট (হত্যা)  করতে হবে ।  এমনকি স্ত্রী যে সন্তানের জন্ম  দেয়  এবং তার প্রতিপালন  করে, সে সন্তানের মালিকও সে নয়,  মালিক তার  স্বামী  সন্তানকে কী পড়াবে, ইঞ্জিনিয়রিং না ডাক্তারী না অন্য কিছু তা ঠিক করবে একমাত্র বাবাই,  মা নয় ছেলে ক্রিকেটার বে না ফুটবলার,  না অন্যকিছু,  তাও ঠিক করবে বাবাই, মা নয় । কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় সে কার সন্তান, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক,  সবাই তার বাবার নাম বলে, মায়ের নাম কেউ বলে না, কারণ সে জানে প্রশ্নকর্তা তার বাবার নামটাই জানতে চেয়েছে ।  স্কুলে-কলেজ বা হাসপাতালে ভর্তির সময় পিতা বা স্বামীর পরিচয়ই জানতে চাওয়া হয়, জানতে চাওয়া হয় না মা ও স্ত্রীর  পরিচয় । এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে সন্তানদের উপর অধিকার কেবল বাবাদেরই, মায়েদের নয়। এমনকি ভারতীয় সংবিধানও বাবাকেই সন্তানের (দুগ্ধপোষ্য বা নেহাতই শিশু না হলে) আইনসঙ্গত অভিভাবক বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে ।
স্ত্রীর অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো  স্বামীর বংশ রক্ষা করা । কোনো স্ত্রী যদি  স্বামীকে সন্তান দিতে ব্যর্থ হয়, তার জন্যে সে দায়ী যদি নাও হয়,  তাকে গঞ্জনা  ও অত্যাচার সইতে হয়  বিবাহিত জীবনে নারীর জন্যে এটাই দস্তুর । শুধু গঞ্জনা ও অত্যাচারই নয়, তার জন্যে তখন আরো কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করে । সন্তান লাভের জন্যে স্বামী আর একটা বিয়ে করে ।  সেক্ষেত্রে আগেকার স্ত্রীকে সতীনের জ্বালা ও অত্যাচারও মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়  এবং    স্বামীর পরিবারের সকলের  দাসত্ব  করার পাশাপাশি সতীনেরও দাসত্ব করতে হয় । দ্বিতীয় স্ত্রীও যদি  সন্তান দিতে ব্যর্থ হয় তবে তারও  পরিণতি হয় প্রথম স্ত্রীর মতোই  অনেক  ক্ষেত্রে  সন্তান দিতে ব্যর্থ স্ত্রীকে স্বামী ইস্তফা দিয়ে  বাড়ি থেকেই তাড়িয়েও দেয় ।    
পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ পুরুষগণ কথার মায়াজাল বিস্তার করে ‘বিয়ে’ প্রথাকে যতোই মহিমান্বিত করার প্রয়াস করুক না কেনো, ‘বিয়ে’ প্রথা আসলে পুরুষদের তৈরী একটি প্রভুত্ববাদী প্রথা যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো নারীর দাসত্বএই প্রথাকে প্রত্যেকটা ধর্মই যুগে যুগে ঈশ্বরের দোহায় দিয়ে  আরো শক্তপোক্ত ও মজবুত করেছে  এবং  মানব সমাজের গভীর থেকে  গভীরে প্রোথিত করেছে । ইসলাম ধর্মও সে একই পথ ধরে হেঁটেছে   শুধু তাই নয়, ইসলাম  বরং এই ‘প্রথা’টির সামাজিক অবস্থানের উত্তোরণ ঘটিয়েছে । ইসলাম ‘বিয়ে’ নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন তৈরী করেছে । অর্থাৎ যেটা ছিলো ‘প্রথা’ তাকে ‘আইনে’র মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান করেছে ।    এটা করেছে আল্লাহ্‌র দোহায় দিয়ে এবং বলেছে এই আইনে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না । তাই  ইসলাম  প্রণীত বিয়ের আইন তথা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেও  আমরা দেখি যে নারীর দাসত্বের বন্ধন শিথিল হয়নি, বরং আরো নিগূঢ় ও দৃঢ় হয়েছে ।  সুতরাং শরিয়ত আইনের অন্তর্গত মুসলিম সমাজের বিয়ের আইনে যে নারীর পক্ষে ভালো কিছু  আশা করা যায় না ।   মুসলিম বিয়ের আইনে কী আছে  এবার তা দেখবো  তবে তারো আগে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া অভিশাপ ‘বিয়ে’ প্রথা নিয়ে  আরো  কয়েকটি  কথা বলা বাকি আছে সেগুলি আগে বলে নিই ।  

এক). কিছু পুরুষ আছেন যাঁদের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা অন্য রকম । তাঁদের মধ্যে পুরুষের স্বাভাবিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট থাকে না । তাঁরা স্বভাবগতভাবেই নিরীহ প্রকৃতির । প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার মালিকসুলভ অপগুণগুলি  তাঁদের চরিত্রবিরোধী । স্বভাবতই তাঁরা  দাম্পত্য জীবনেও তাঁদের জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সচরারচর কর্তা বা মালিকসুলভ আচরণ করেন না । এ প্রকৃতির মানুষের সংখ্যা কিন্তু সমাজে খুবই কম ।  তাঁরা হয়তো নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার নিরিখে এটা মানতে পারবেন যে,  ‘বিয়ে’  হলো নারীর উপর চাপানো পুরুষদের একটি চরম প্রভুত্ববাদী সামাজিক প্রথা  

দুই). পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একটি মেয়েকে শিশুকাল থেকেই নিরীহ, শান্ত, ধীর-স্থির ও অনুগত প্রকৃতির করে গড়ে তোলে ।  বাবা, মা ও পরিবারের অন্যান্য যারা বড়ো তাদের আনুগত্য করতে করতেই সে বড়ো হয় । ফলে মেয়েরা সাধারণভাবে ব্যক্তিত্বশালী ও প্রতিবাদী হয় না এবং বিবাহিত জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যার সঙ্গে তার বিয়ে তার অনুগত হয়ে ওঠে । কিন্তু সমাজে কিছু নারীকেও আমরা দেখতে পাই  যাঁরা  ব্যতিক্রমী ও স্বাভাবিক নারীচরিত্রবিরোধী । তাঁরা ব্যক্তিত্বশালী, তীক্ষ্ণ আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, স্বাধিকারে বিশ্বাসী এবং প্রতিবাদী । তাঁদের সংখ্যা নগণ্য ।  তাঁরা স্বভাবতই বিবাহিত জীবনে দাসত্ব মেনে নিতে চাই না । এই দাসত্ব মেনে না নেওয়াটা সাধারণভাবে পুরুষরা  মেনে নেয় না ।  পুরুষদের এরূপ প্রভুত্ববাদী মনোভাবের কারণে কখনো কখনো (যা খুবই কম ঘটে)  তাঁদের দাম্পত্যজীবনে দ্বন্দ ও সংঘাত দেখা দেয় ।  আর তার দায় চাপানো হয়  সম্পূর্ণ  নারীর উপর। তখন ‘স্বামীর উপর স্ত্রীর নির্যাতন’-এর অভিযোগ খাড়া করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ একদল পুরুষ । তাঁরাই তথাকথিত ‘স্ত্রীর নির্যাতনের হাত থেকে স্বামী’-কে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে আইন প্রণয়নের  দাবি তোলেন । এঁদের কাছে একথা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে  ‘বিয়ে প্রথা’টা নারীর উপর পুরুষদের চাপানো একটা প্রভুত্ববাদী প্রথা । তাঁরা স্বভাবতই এ প্রথার বিলোপের কথা শুনলে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন এবং যাঁরা এই প্রথাটার সমালোচনা করেন তাঁদের পুরুষবিরোধী তকমা দিয়ে তাঁদেরকে  অশালীন, অরুচিকর  ও অসংলগ্ন ভাষায় আক্রমণ করেন ।   
 
তিন).  ‘বিয়ে’ প্রথার মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে বলা হয় যে মানব সমাজে এই প্রথার আবিষ্কার ও প্রচলন একটি মহৎ ঘটনা । এই প্রথাটি মানব সমাজকে বিশৃঙ্খলার হাত থেকে উদ্ধার করেছে এবং সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে । এ দাবিটি যে   অবাস্তব এবং বিয়ে প্রথা ছাড়াই  হাজার হাজার বছর আদিম মানব সমাজের উত্তোরণ ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে সে কথা আগেই বলেছি ।  আজকের যুগেও বিয়ে না করেও একজন পুরুষ ও একজন নারী যে স্বচ্ছন্দে সুষ্ঠ, স্বাভাবিক ও আনন্দঘন জীবন যাপন করতে পারে এবং তারজন্যে সমাজে কোনোরূপ বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরী হয় না তার  বহু দৃষ্টান্ত  আমরা দেখতে পাই সুতরাং ‘বিয়ে’টা মানব সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপন করেছে এবং শৃংখলা রক্ষা করার জন্যেই এ প্রথাটার প্রয়োজন আছে এটা মিথ বৈ নয় । বরং যেটা একেবারেই মিথ নয় এবং চরম ও নির্মম সত্যি তা হলো - নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের পরিপন্থী হলো বিয়ে নামক প্রথাটি
চার). তাই নারীকে অধিকার, স্বাধীনতা ও সমানাধিকার দিতে হলে এ প্রথাটার অবলুপ্তি ঘটানো একান্ত আবশ্যক, কারণ  বিয়ে মানেই স্ত্রীর উপর স্বামীর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব  
পাঁচ). আইন সংক্রান্ত কয়েকটা  দাবী তোলা  জরুরী মনে করি -

ক)  যতদিন না  বিয়ে প্রথা বা ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটছে ততোদিন বিয়েটা থাকুক ঐচ্ছিক নারীর উপর বিয়ের জন্যে জোর  খাটালে তার জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান আনতে হবে । এবং অপরদিকে ধর্ম ও জাত-পাতের কারণে বিয়েতে বাধা  কিংবা বিবাহিত দম্পত্তির উপর অত্যাচার ও আক্রমণ প্রতিহত করতে কঠিন শাস্তির বিধান তৈরী করতে হবে ।
খ).  সংবিধানে  বিয়ের আইনে  নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক যে সব ধারা আছে তা বাতিল করা হোক এবং বাতিল করা  হোক  স্বামী, পতি এবং স্ত্রী ও পত্নী শব্দগুলি আইনের বাখ্যা ও বিবরণ থেকে কারণ এই  শব্দবন্ধগুলির মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য ও কর্তৃত্বের  অলিখিত ও অঘোষিত বিধান । আইনের বইয়ে স্বামী-স্ত্রী বা পতি-পত্নীর  পরিবর্তে  অন্য শব্দ  নিয়ে আসতে  হবে ।  এটা করতে হবে এজন্যে  যাতে বিয়ের পর দম্পত্তি পরষ্পরকে স্বামী-স্ত্রী কিংবা পতি-পত্নী হিসেবে  না  ভেবে পরষ্পরের জীবনসঙ্গী  হিসেবে ভাবে ।
গ). বিয়ের আইনে এই ধারা আনতে হবে যেখানে স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় সন্তানের মায়ের পরিচয়কেই মুখ্য  বলে গণ্য করা হবে, বাবার পরিচয় দেওয়া বাধ্যতামূলক থাকবে নাএবং বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হলে সন্তানের উপর বাবার অধিকার সম্পূর্ণ রদ করতে হবে, অধিকার থাকবে কেবল মায়ের । তবে সন্তান যদি বাবার কাছে থাকতে চায় তবে সেক্ষেত্রে মায়ের অধিকার রহিত হয়ে যাবে ।
ঘ). উচ্চবিদ্যালয়সমূহের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে অভিভাবকদের নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকায় (ভোটার তালিকায়) শিক্ষার্থীর মা ও বাবা দু’জনের নামই রাখতে হবে। যদি একজনের নাম রাখতে হয় তবে মায়ের নামটাই রাখতে হবে।    
 
   
  

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...