Saturday, October 29, 2016

ইচ্ছাপত্র (Will)



 ইচ্ছাপত্র

২৫.৬.০৫

বৈকাল – ৩টা ২৫মি.

স্নেহের বহ্নি,

* স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি।  আমার মৃত্যুর জন্য কোনো ব্যক্তি দায়ী নহে।

* আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এই সমাজ। সমাজের তথাকথিত নিয়ম-শৃংখলা ও মূল্যবোধে বহুদিন থেকেই আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যারা সমস্ত রকম সংস্কার ভাঙতে চাই বা অস্বীকার করতে চাই এই সমাজ তাদের কাছে একটা ভয়ঙ্কর কারাগার। এখানে স্বাধীনভাবে শ্বাস নেওয়া যায় না। দীর্ঘকাল এই কারাগারে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত, অবসন্ন। তাই এই সমাজকে চির বিদায় জানিয়ে মুক্তি নিলাম।
* না, (দলীয়) রাজনীতি ছেড়ে আমি হতাশ হই নি। দীর্ঘকাল রাজনীতি করেছি। কিন্তু শেষের দিকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ আর মিথ্যার সঙ্গে সঙ্গে আপোষ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পার্টি শৃংখলা মেনে সব সহ্য করতে হচ্ছিল। স্বেচ্ছারোপিত শৃঙ্খলা আক্ষরিক (বাস্তবে) হাতে-পায়ে-মুখে শৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। পার্টি ছেড়ে অবশ্যই নিজেকে শৃঙ্খল মুক্ত করেছিলাম। তারজন্য আপশোষ তো ছিলই না, ছিল বরং স্বস্তি।

  •      * আমার মৃত্যুর পর যেন কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না হয়।
  •      * আমার লাশ নিয়ে যেন জানাযা না হয়।

  •      * আমার লাশ যদি ‘Medical Science’ নেয় তবে কলকাতায় যে কোনো Medical College – এ পৌঁছে দিস, যদি পারিস।
  •      * যদি না পারিস তবে আমাদের যেটুকু জায়গা আছে সেখানে সমাধিস্থ করবি এক কোণে যাতে জায়গা কম নষ্ট হয়।


* জঙ্গীপুর গৌড় গ্রামীণ ব্যাংকে দুটো সার্টিফিকেট (NSC) বন্ধক দিয়ে ১০০০ টাকা ঋণ নেওয়া আছে।

* LIC অফিস থেকে দুটো পলিসির বিপরীতে ৫০০০০ টাকার কিছু কম ঋণ নেওয়া আছে।


ঃ-একান্ত ইচ্ছাঃ-

ক) কতকগুলি নিবন্ধ আমার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু চিঠি প্রকাশিত হয়েছে ‘আজকাল’ পত্রিকায়। কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দুটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়। পারলে সেগুলো সংরক্ষণ করিস। আমার দৃষ্টিভিঙ্গী খুঁজে পাবি সে সব লেখায়।

খ) বিভিন্ন খাতে তোরা যে টাকা পাবি তাতে জানি না তোদের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণের অসুবিধা হবে কি না। যদি মনে করিস ভীষণ রকমের অসুবিধা হবে না, তবে প্রাপ্ত টাকা থেকে ৫০০০০ টাকা [পঞ্চাশ হাজার] MIS  না কি একটা স্কীম আছে সেখানে জমা রাখিস। সেখান থেকে যে টাকাটা মাসে মাসে বা বৎসর শেষে পাবি সে টাকা দিয়ে গরীব ছেলে মেয়েদের বই কিনে দিস।



* ধর্ম তৈরী হয়েছে অজ্ঞানতা ও আতঙ্ক থেকে। যারা ধর্ম বিশ্বাস ও পালন করে তারা নিজেরা জানে না ধর্ম আসলে কী এবং এর ভিতর কী আছে। দরিদ্র মানুষকে ধর্ম শেখায় আল্লাহ তোমার ঈমান পরীক্ষা করছে। তুমি অনাহারে আছো, তোমার সন্তান বিনা ঔষধে বিনা চিকিৎসায় মরছে, তোমার সন্তান খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা পায় না, দুর্ঘটনায় তোমার স্বজন মরেছে - এসবই তারই ইচ্ছা।  তুমি এ সবের জন্য ক্ষোভ করো না, অসন্তুষ্ট হবে না, আল্লাহ/ভগবান রুষ্ট হবে।  তাহলে তোমার নরকবাস হবে। এভাবে ধর্ম মানুষকে শেখায় প্রতিবাদ না করতে। ধর্ম এ যুগে শোষক শ্রেণীর শক্তিশালি হাতিয়ার। মানুষ মানুষকে শোষণ করে তাই একদল লোক বিত্তবান হয় আর বিশাল সংখ্যক মানুষ বিত্তহীন হয় – ধর্ম অর্থনীতির এই রহস্যকে আড়াল করে শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করেধর্ম এ ভাবেই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে।

নারীর প্রতি সবচেয়ে অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন হয় ধর্মের কারণে। নারীকে বলেছে ধর্ম, স্বামী তোমার দেবতা, স্বামীর পূজা ও সেবা করা তোমার ধর্ম, স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখো আল্লাহ/ভগবান সন্তুষ্ট হবে, শত অত্যাচারেও স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করবে না, করলে স্বামী যদি অসন্তুষ্ট হয় তবে ওপরওয়ালাও অসন্তুষ্ট হবে, তাহলে তোমার নরকবাস হবে। নরকের ভয় দেখিয়ে ধর্ম নারীকে পুরুষের পদানত করে রেখেছে। হাতে শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় আঁচল বা বোরখা পরে নারীকে বোঝাতে হয় যে তার একজন মালিক আছে, মালিকটি হলো তার স্বামী-দেবতা। স্বামীর মৃত্যুর পরও স্ত্রীকে শাঁখা-সিঁদুর ভেঙে-মুছে, থান-কাপড় পরে, কৃচ্ছ্বসাধন করে বোঝাতে হয় যে তার একজন মালিক ছিল সে এখন আর নাই। নারীর নিজস্বতা বলতে কিছু নেই, স্বাধীনতা তো অনেক বড় বিষয়। নারীর নিজস্ব পরিচয় থাকতে নেই, হয় পিতার নামে না হয় স্বামীর নামে তাকে চেনাতে হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও স্বামীর চিহ্ন বহন করতে হয় তার নামের সঙ্গে। কী হিন্দু কী মুসলমান বিয়ের পর নারীকে সর্বদা স্বামীর পদবী ধারণ করতে হয়। নারী যদি অন্য ধর্মাবলম্বী পুরুষকে বিয়ে করে তবে তাকে পুরুষ স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে হয়। নারী ধর্ষিতা হলে পুরুষ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে দূর দূর করে তেড়ে দেয় অথচ ধর্ষক পুরুষ বুক ফুলিয়ে সমাজে বাস করে, সমাজ তাকে আদর করে বরণ করে, বিধায়ক করে, মন্ত্রী করে। পুরুষতন্ত্র এ সব নিয়ম চালু করেছে, আর ধর্মের থেকে জল-আলো-বাতাস নিয়ে পুরুষতন্ত্র ক্রমশঃ যেন অপরাজেয় হয়ে উঠছে। নারীর ওপর সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে নারী কার্যতঃ চুপ, কারণ নারী মনে করে এসব বিধান আল্লাহ/ভগবন প্রদত্ত। ধর্ম এভাবেই নারীকে চুপ করিয়ে রেখেছে পরকালের নরকবাসের ভয় দেখিয়ে। এসবই মিথ্যে, মনুষ্য সৃষ্টি, মানুষ যদি বেশী শিক্ষিত হতো এবং সব ধর্মকে নিজের মাতৃভাষায় ভালো করে পড়ে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করতে পারত তবে ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস বহগুণে দূর হোত। তাহলে সমাজের চেহারাটাই বদলে যেত।

বহ্নি, তোকে এসব কথাগুলো লিখলাম এজন্য যে, তুইও অন্ধভাবে আল্লাহ-কোরান এসবে বিশ্বাস করিস। তোর প্রতি পরামর্শ – কোনো কিছুই অন্ধভাবে বিশ্বাস ও মেনে চলবি না। ধর্ম মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। আমার কথাগুলোও অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে না। আমার আলমারিতে বহু বই আছে, তাতে ধর্মপুস্তক আছে, ধর্মের পক্ষে লেখা বই আছে, আছে কিছু বই যাতে ধর্মের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা আছে। সেগুলো পড়ে নিজস্ব স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করবি।

আর একটা কারণে এসব কথা লিখলাম – আমি চেয়েছিলাম এইসব বিষয়ে লেখালেখি করে মানুষকে সমাজ সচেতন করার কাজে একটু অবদান রেখে যেতে। সমাজের সকল অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। কিন্তু সেটা আর হলো না। এই একমাত্র আক্ষেপ নিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। আর কোনো আক্ষেপ আমার নেই।

* যতদূর স্মরণে আছে, আমার ঋণ যা ছিল সব শোধ করে দিয়েছি।

* আমার এই ‘উইল’টি (ইচ্ছাপত্র) ‘জংগীপুর চিঠি’-র দপ্তরে জেরক্স করে পৌঁছে দিস, যদি সম্পাদক মনে করে তবে ছাপাবে। ছাপালে যেন পুরোটাই ছাপায়। জানি, অনেক গুজব বা জল্পনা-কল্পনা হবে আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর পর।  কাগজে যদি এটা ছাপে তবে সেই কল্পনা-জল্পনার কিয়দংশে অবসান হতে পারে।  ইতি তোর বাবা – গিয়াসুদ্দিন

২৫/৬/০৫, বিকাল – ৫টা।


 (বিঃদ্রঃ- ইচ্ছাপত্রটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। কথাগুলি হলোঃ- প্রথমতঃ  এটা লিখেছি ১১ বছর আগে যখন মাত্র কয়েক ঘন্টা পর পৃথিবী থেকে নিশ্চিতভাবেই বিদায় নিতে যাচ্ছি ঠিক তখন। তখন মস্তিষ্কের কোষগুলি আমার কী মাত্রায় চঞ্চল ও অস্থির ছিলো তা সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া এই ১১ বছরে আমার চিন্তাধারা ও অভিজ্ঞতায় আরো স্বচ্ছতা এসেছে। স্বভাবতই ইচ্ছাপত্রটি সম্পাদনা ও হালনাগাদ (update) করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু করিনি। কারণ সে সময়ের ‘আমি’ (অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হলেও) কী ভেবেছিলাম, কী চেয়েছিলাম তা সংরক্ষণ করতে চাই।  দ্বিতীয়তঃ  তখনো আমার কলম থেকে আল্লাহ, মুহাম্মদ ও কোরানকে সরাসরি অস্বীকার ও আক্রমণ করে কোনো লেখা বের হয় নি। স্বভাবতই ‘মোরতাদ’ ও ‘মুণ্ডুচ্ছেদ’ এর ফতোয়া তখনো আমার উপর জারি হয় নি। অর্থাৎ তখনো মুসলিম সমাজে আমি একজন বিশিষ্ট সম্মানিত মুসলিম ব্যক্তিত্ব। তৃতীয়তঃ ‘বহ্নি’ হলো আমার পুত্র যাকে উদ্দেশ্য করে ইচ্ছাপত্রটি লিখেছিলাম।  সে কিন্তু এখন আর আস্তিক নেই, তবে আমার মতো অনুশীলনকারী নাস্তিকও (practicing atheist) সে নয়।    তাং - ২৯.১০.২০১৬)        



Wednesday, October 26, 2016

মুসলিম বিয়েঃ চুক্তি বিয়ে – (তিন)

                     কন্যাশিশু ও দত্তক-পুত্রের একদা জীবনসঙ্গিনীকে বিয়ে করা জায়েজ 

ইসলাম বাল্যবিবাহে  বৈধতা দিয়েছে


                                                

বাল্যবিয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের পশ্চাদপদ সমাজের নিকৃষ্ট ব্যাধিগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ব্যাধি। এ ব্যাধিটি মানবসমাজের যতোটা ক্ষতিসাধন করে ততোটা ক্ষতি বোধ হয় আর অন্য কোনো সামাজিক ব্যাধির দ্বারা সম্ভব হয় না।  যে সব ছেলেমেয়েদের বাল্যাবস্থায় বিয়ে হয় তাদের কাঁধে অপরিণত বয়সেই  সংসারের বোঝা চেপে বসে। ফলতঃ অচিরেই তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে, জীবনে তাদের নেমে আসে অকালবার্ধক্য, খুব তাড়াতাড়িই তারা সমাজের বোঝা হয়ে ওঠে এবং নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে ভুগতে ভুগতে অকালেই নিভে যায় তাদের জীবনদীপগুলোও বাল্যাবস্থায় বিয়ের কুফল শুধু সংশ্লিষ্ট বালক-বালিকাদেরই ভোগ করতে হয় এমন নয়, এর কুফল ভোগ করতে হয় তাদের গোটা পরিবারকেই এবং পরিশেষে গোটা সমাজ ও গোটা দেশকেই। বাল্যাবস্থায় বিয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো অধিক সন্তান, দারিদ্রতা,অপুষ্টি, অপরিচ্ছন্নতা, অসচেতনতা, রোগ-ব্যাধি, অকালমৃত্যু, কুসংস্কার ইত্যাদি। স্বভাবতই বাল্যবিয়ে যে মানব সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথে একটি  বিরাট বড়ো প্রতিবন্ধক তা বলা বাহুল্য। এই প্রতিবন্ধকতা তথা বাল্যবিয়ে মানব  সমাজ থেকে দূর ও নির্মূল করার জোর অভিযান চলছে বিশ্বজুড়ে।
ভুবন জুড়ে যে ছবিটি আমরা দেখি তা হলো সেই জাতি ও সেই দেশ ততো বেশী উন্নতি করেছে যারা যতো বেশী বাল্যবিয়ের অভিশাপকে মানব সমাজের দেহ থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, এবং অপরদিকে যে জাতি ও যে দেশের সমাজদেহে যতো বেশী বাল্যবিয়ের ব্যধি রয়েছে সে জাতি ও সে দেশ  ততো বেশী পশ্চাদপদ রয়ে গেছে।  অর্থাৎ মানব সমাজের উন্নয়ন বা অনুন্নোয়ন, অগ্রগতি বা পশ্চাদপদতা, বিকাশ বা বদ্ধদশার সঙ্গে বাল্যবিয়ের একটি গভীর বন্ধন রয়েছে। সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও বিকাশ এবং বাল্যবিয়ে দু’টো হাত একসঙ্গে হাত ধরাধরি চলতে পারে না। মানব সমাজের পশ্চাদপদতা এবং বিকাশের বদ্ধদশা বা রুদ্ধদশা কাটাতে হলে বাল্যবিয়ের সঙ্গে বন্ধন বা গাঁটছড়া ছিন্ন করতেই হবে।    
ভুবন জুড়ে আর একটি ছবিটি আমরা দেখতে পাই, তা হলো, মুসলিম সমাজের দেহে বাল্যবিয়ের ব্যাধিটা সবচেয়ে বেশী প্রকট এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম দেশগুলিতেই দারিদ্রতা, অনুন্নোয়ন, অশিক্ষা, অচেতনতা, অস্বাস্থ্য, অস্থিরতা, হিংসা ও কুসংস্কার সব চেয়ে বেশী। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাল্যবিয়ের ব্যাধি ও অভিশাপ মুসলিমদের পশ্চাদপদতার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এখন প্রশ্ন হলো এতো খারাপ একটি সামাজিক ব্যাধির প্রকোপ মুসলিম সমাজেই কেনো সব চেয়ে অধিক? এ প্রশ্নের উত্তরে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যে কৈফিয়ত দেন তা হলো, মুসলিমদের মধ্যে দারিদ্রতা ও শিক্ষা কম থাকাই প্রধান কারণ এর বাইরে অন্য কোনো কারণ তাঁরা দেখতে বিশেষ পান না। আসলে তাঁরা দেখতে চান না। শুধু  দারিদ্রতা ও শিক্ষায় পশ্চাদপদতার জন্যেই মুসলিম সমাজে বাল্যবিয়ের চল সর্বাধিক এটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। এই দু’টি কারণ ছাড়াও রয়েছে আর একটি মস্ত বড়ো কারণ, তা হলো ধর্মীয় কারণ। অন্য সকল ধর্মেও বাল্যবিয়ে বৈধ ঠিকই, কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলাম বাল্যবিয়েতে শুধু বৈধতার সীলমোহরই মারে নি, তাতে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে।  এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে বাল্যাবস্থায়  সন্তানদের, বিশেষতঃ মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা সুন্নত। সুন্নত হলো এক ধরণের ঈমানী কর্তব্য যা পালন না করলে দোষ বা পাপ হয় না, কিন্তু পালন করলে সওয়াব (পূণ্য) পাওয়া যায়। তাদের এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে স্বয়ং মুহাম্মদ। তিনি ছ’ বছর বয়সী একটি শিশু কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন যখন তাঁর বয়স
ছিলো পঞ্চাশ। খাদিজার মৃত্যুর সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই প্রথমে বিয়ে করেন সওদাকে, এবং তার অল্প কিছুদিন পরেই বিয়ে করেন তাঁর প্রধান ও প্রথম সাহাবি আবুবকরের মেয়ে আয়েশাকে যাঁর বয়স ছিলো মাত্র ছ’বছর। আর বিয়ের মাত্র তিন বছর পরেই আয়েশার সঙ্গে সহবাস করেছিলেন। মুহাম্মদ যখন আবুবকরকে আয়েশার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন আবুবকর আঁতকে উঠেছিলেন এবং সে প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন নি। মুহাম্মদ তখন আল্লাহর দোহায় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মুহাম্মদের সঙ্গে আয়েশার বিয়ে হোক এটা আল্লাহর ইচ্ছা, আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নের মাধ্যমে সে ইচ্ছার কথা জানিয়েছে। এ কথা শোনার পর আবুবকর আর না করতে পারে নি, কারণ আল্লাহর ইচ্ছার পূরণ না করলে তো আর মুসলমান থাকা যায় না এবং ইসলাম ও মুহাম্মদকে ত্যাগ করে গেলে তো মক্কার কোরেশদের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যায়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আবুবকর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়েতে সম্মতি দেন। মুসলমানরা আজো বিশ্বাস করে যে আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশেই আয়েশার সঙ্গে  মুহাম্মদের বিয়ে হয়েছিলো। সে কারণেই তারা মনে করে যে নাবালক মেয়েদের বিয়ে দেওয়াটা তাদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তব্য বা সুন্নত, আর সেই বার্তাটা দিতেই আল্লাহ  মুহাম্মদ ও আয়েশার মধ্যে বিয়েটা সম্পাদন করেছিলেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন তাঁর একজন অন্যতম প্রধান বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ২য় খলিফা ওমর ফারুক। তিনি ৪র্থ খলিফা ও মুহাম্মদের জামাই আলির নাবালক কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন যিনি ছিলেন তাঁর নাতনির বয়সি। মুহাম্মদের পর যে সাহাবিরা মুসলমানদের নিকট রোল মডেল হিসেবে সর্বাধিক সমাদৃত ও সম্মানিত তাঁরা হলেন এই তিনজন (আবুবকর, ওমর ফারুক ও আলি)।  সুতরাং এ কথাটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, ইসলাম বাল্যবিয়েতে শুধু বৈধতাই দেয় নি, মুহাম্মদ (যাঁকে মুসলমানরা আল্লাহর নবি বলে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে) এবং তাঁরই সর্বাধিক বিশ্বস্ত ও প্রিয় সাহাবিগণ নিজেরা হয়  নাবালক কন্যাকে বিয়ে করে কিংবা নাবালক কন্যার বিয়ে দিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দিয়ে গেছেন। এর প্রভাব আজো ব্যাপকভাবেই রয়ে গেছে যা মুসলিম সমাজ কাটিয়ে উঠতে পারছেনা।
                       দত্তক-পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা পত্নী দত্তক-পিতার জন্যে বৈধ  
কোন কোন নারী পুরুষদের (বিয়ের) জন্যে বৈধ এবং কোন কোন নারী অবৈধ এই তালিকা যখন ইসলাম প্রণয়ন করে বা প্রকাশ করে কোরানের বিভিন্ন আয়াতে (যেমন ৪/২২,২৩,২৪, ৩৩/৫০) তখন দত্তকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা পত্নী সে তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। ইসলাম পুরুষদের জন্যে এই নারীদের বৈধ করেছে বা সংযোজন করেছে অনেক পরে কেনো এ সংযোজনটি করা হয়েছিলো? এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিলো?  পালিত পুত্র তো আপন সন্তান তুল্যই, এবং বলা বাহুল্য যে পালিত পুত্রবধু আপন পুত্রবধুসমইআর সর্বকালের সামাজিক সংস্কৃতি অনুযায়ী পুত্রবধূ তো আপন কন্যাসমই। কারো দত্তক পুত্র যদি তার বধূকে পরিত্যাগ করে তবে তাকে বিয়ে করা কি সে লোকটির পক্ষে শোভা পায়? কোনো সভ্য সমাজে কি এরূপ আইন বা প্রথার কথা কল্পনাও করা সম্ভব? এমন কুৎসিত ও অসভ্য আইন বা প্রথা কোনো সভ্য সমাজে কল্পনাতে ঠাঁই না পেলেও ইসলাম এই প্রথাটিকে ঠাঁই দিয়েছে বা সংযোজিত করেছে তার বিয়ের বিধানে।  এখন প্রশ্ন হলো, ইসলামে কেনো এরূপ কুৎসিত বিধান সংযোজন করা হয়েছে?  এর উত্তরটা শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হবে, এবং শ্রুতিকটূও লাগতে পারে, তথাপি এটাই সত্যি যে  মুহাম্মদের স্বার্থ পূরণের জন্যে এই সংযোজনটা করা হয়েছিলোহ্যাঁ, কোনো সন্দেহ ও সংশয় নেই যে শুধু তাঁর স্বার্থ পূরণের জন্যেই কুৎসিত এ বিধিটি সংযোজন করা হয়েছিলো। কে সংযোজন করেছিলেন জানার জন্যে কথাটি প্রত্যক্ষ্য ভাষ্যে (active voice)  বলা যাক। তা হলো এই যে,  মুহাম্মদই একেবারেই তাঁর নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে তিনি নিজে এটা সংযোজন করেছিলেন, করে তা  প্রচার করেছিলেন আল্লাহর নামেএটা তিনি সংযোজন করেছিলেন তিনি যখন নিজে তাঁর দত্তক সন্তানের তালাকপ্রাপ্তা সুন্দরী ও যুবতী নারীকে বিয়ে করবো বলে স্থির করেন। এর জন্যে তিনি  কয়েকটি অধ্যাদেশ (তথাকথিত ওহি বা প্রত্যাদেশ) জারি করেছিলেন।   না,  মুহাম্মদ বা ইসলামকে কালিমালিপ্ত করার জন্যে কারো মনগড়া বা কষ্টকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কুৎসা এটা নয়। এটা যে নির্ভেজাল ও নিরেট সত্যি কথা তার  অকাট্য সাক্ষ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোরান। কোরানের ৩৩/৪ ও ৩৩/৩৭ নং আয়াত দু’টি তার সব চেয়ে বড়ো সাক্ষী। এ বিষয়টি বিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে ‘মুহাম্মদের হারেম সংবাদ’ অধ্যায়ে ‘জয়নাবের সঙ্গে মুহাম্মদের বিয়ে’ প্রসঙ্গে আলোচনায়।   তাই এখানে প্রাসঙ্গিকতাহেতু ঘটনাটি সংক্ষেপে বলা হলোঘটনাটি হলো এ রকমঃ খাদিজা (মুহাম্মদের প্রথম বধূ) মুহাম্মদকে বিয়ের পর একজন ক্রীতদাসকে (জায়েদ বিন হারিসকে) উপহার দেন। মুহাম্মদ জায়েদকে কিছুদিন পরে মুক্ত করে দেন। কিন্তু তথাপি জায়েদ নিজের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে না গিয়ে মুহাম্মদের কাছেই থেকে যান। মুহাম্মদ কিছুদিন পরে তাঁকে দত্তক নেন এবং নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাঁর নিজের আত্মীয় জয়নাব নামের একটি মেয়ের সঙ্গে যায়েদের বিয়ে দেন। জয়নাব ছিলেন ভরপুর যৌবনা এবং অপার সুন্দরী ও মনোহরিণী একজন নারী। একদিন হঠাৎ  জায়েদের গৃহে প্রবেশ করে জয়নাবকে  দেখে মুহাম্মদ চমকিত হয়ে পড়েন। মুহাম্মদ যখন জায়েদের গৃহে যান তখন জায়েদ ঘরে ছিলেন না। স্বভাবতই গৃহের অভ্যন্তরে একাকী থাকা জয়নাবের  সারা শরীর পোশাকে ঢাকা ছিলো না, এবং    অর্ধনগ্ন শরীর থেকে তাঁর রূপ ও যৌবন যেনো ছিটকে বেরুচ্ছিলো  সেই অপরূপ দেহসৌষ্ঠব ও উদ্দাম যৌবন  দেখে মুহাম্মদের বিমোহিত ও বিমুগ্ধ হয়ে যান। জয়নাবকে ঐ অবস্থায় তিনি দরজাতেই থমকে দাঁড়িয়ে যান এবং কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জয়নাবকে কিছু না বলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যান।    বেরুনোর আগে দরজায় দাঁড়িয়ে স্বগতোক্তির মতো তিনি বিড়বিড় করে তাঁর রূপের প্রশংসা এবং আল্লাহর তারিফ করেন।  কথাগুলি কিন্তু স্বল্প দুরত্বে থাকা জয়নাবের কানে প্রবেশ করে মুহাম্মদের (তাঁর আল্লাহর নবীর) মুখ নিঃসৃত তাঁর রূপের প্রশংসা শুনে তাঁর বুক গর্বে ও আনন্দে ভরে ওঠে। জায়েদ গৃহে ফিরলে মুহাম্মদ কী বলে তাঁর রূপের প্রশিংসা করে গেলেন তা তাঁর সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে ব্যক্ত করে বসেন। জায়েদ এ কথা শুনে বিষণ্ণ না হয়ে আঁতকে ওঠেন। নিজের বধূ কাছে  পরপুরুষের  উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনতে কারো ভালো লাগে না ঠিকই, কিন্তু তা শুনে কারো আঁতকে ওঠার কথা নয় যেমনটা জায়েদের ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। জায়েদ আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর নিজের জীবনের কথা ভেবে। জয়নাবের চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে গিয়ে মুহাম্মদ নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠবেন তাঁকে (জয়নাবকে) পাওয়ার জন্যে - এ বিষয়ে তিনি (জায়েদ) সুনিশ্চিত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা  থেকে এ বিষয়েও সংশয়হীন ছিলেন যে তাঁর (মুহাম্মদের) কামনার সামনে যতো শক্ত প্রতিবন্ধকতাই থাক না তা তিনি যেকোনো মূল্যে উৎপাটন করবেনই।  আর জায়েদের দুশ্চিনার কারণ হলো তিনিই সেই প্রধান বাধা, কারণ জয়নাব যে তাঁরই বধূ। জায়েদ তাই কালবিলম্ব না করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে জয়নাবকে তালাক দিয়ে মুহাম্মদের পথের প্রধান কাঁটাটা সরিয়ে দেন। কিন্তু তারপরেও আর একটা বড়ো কাঁটা ছিলো। সেটা তৎকালীন সমাজের একটি চলমান সংস্কৃতি ও প্রথা। প্রথাটা ছিলো এই যে, দত্তক পুত্র তার বধূকে তালাক দিলে পালক পিতার জন্যে সেই বধূটি অবৈধ। কাঁটাটা ছিলো কোরানের পূর্ব ঘোষিত আয়াতেও যেখানে বলা হয়েছে পুত্রবধূকে বিয়ে করা অবৈধ। এই বাধাটি অপসারিত করার জন্যে আল্লাহকে দিয়ে ঐ দু’টি আয়াত বা ওহি বলিয়ে নেন। ৩৩/৪ নং আয়াতে আল্লাহকে দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে দত্তক সন্তান আসল সন্তান নয় এবং সন্তান নেওয়া অবৈধ কাজ। আর ৩৩/৩৭ নং আয়াতে আল্লাহকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়েছে যে আল্লাহর আদেশ পালন করতেই মুহাম্মদ জয়নাবকে বিয়ে করেছিলেন, কারণ আল্লাহ অনেক পূর্বেই বেহেস্তে (স্বর্গে) মুহাম্মদ ও যয়নাবের বিয়েটা পড়িয়ে দিয়েছিলো এবার আয়াতদুটির ভাষ্য  উদ্ধৃত করা যাক। “আল্লাহ কোনো মানুষের জন্য তার ধড়ের মধ্যে দু’টো হৃদয় বানান নি; আর তোমাদের স্ত্রীদেরও যাদের থেকে তোমরা যিহার করে ফিরে গেছ তাদের তিনি তোমাদের মা বানান নি, আর তোমাদের পোষ্য-সন্তানদেরর তোমাদের সন্তান বানান নি। এসব হচ্ছে তোমাদের মুখ দিয়ে তোমাদের কথা। আর আল্লাহই সত্য কথা বলেন, আর তিনিই পথে পরিচালিত করেন।” (কোরান,  ৩৩/৪, অনুবাদ – ডাঃ জহরুল হক) অন্য আয়াতটি হলো - .. জায়েদ যখন জয়নবের সহিত বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাকে তোমার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সহিত বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে-সব রমণীকে বিবাহ করায় মুমিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহ্‌র আদেশ কার্যকর হতে বাধ্য।” (কোরান- ৩৩:৩৭)
মুহাম্মদ এভাবে তাঁর নিজের যৌন-কামনা পূরণ করার জন্যে সন্তান দত্তক নেওয়া ও তাকে উত্তরাধিকার দেওয়ার মতো সুন্দর ও সুস্থ সামাজিক প্রথা এবং একটি উচ্চ মূল্যবোধকে হত্যা করেন এবং সন্তান তূল্য দত্তক-পুত্রের বধূকে বিয়ে করার বৈধতা প্রদান করে পৃথিবীতে একটি অতি নিকৃষ্ট প্রথার প্রচলন শুরু করেন।  
ইসলামি বিয়ে-বিধি প্রসঙ্গে আলোচনায় এ পর্যন্ত যে ছবি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ইসলামের চোখে নারী পুরষের জন্যে একটি ভোগ্যপণ্য ছাড়া কিছু নয়  অবিশ্বাসী নারী সধবা হোক বিধবা হোক মায়ের তূল্য হক মেয়ের তূল্য হোক সবাই ভোগ্যবস্তু। বিশ্বাসী নারীও যে তার ব্যতিক্রম তা নয়। কন্যাশিশু যদি ছ’বছর/ন’বছরের হয় সেও ভোগ্য, নারী যদি দত্তক-পুত্রের বধূ হয় সেও। কন্যাশিশুদের শুধুই স্নেহ ও ভালোবাসা দাও, তাদের প্রতি কামদৃষ্টিতে তাকিও না - এমন কথা ইসলাম বলে নি। এবং এ কথাও বলে নি যে,  দত্তক-পুত্র-বধূদের আপন মেয়ের মতো স্নেহ ও মর্যাদা দেবে, তাদের প্রতি কামাতুর হয়ে উঠবে না।  বরং কন্যাশিশু ও দত্তক-পুত্রের বধূদের দেখে পুরুষদের যৌনপ্রেমের উদ্রেক যদি হয় তবে ইসলাম তাদের ভোগ করার ঢালাও লাইসেন্স প্রদান করেছে, বলেছে তারাও তোমাদের জন্যে বৈধ, তাদের বিয়ে করো এবং ভোগ করো।
বিয়ে সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ সম্পর্কিত যে সব আয়াত কোরানে আছে সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সর্বক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভুমিকায় রাখা হয়েছে পুরুষকে। বিয়ে ব্যবস্থার সমগ্র প্রক্রিয়ায় পুরুষের ভূমিকাই প্রধান এবং নারীর ভূমিকা সম্পূর্ণরূপেই গৌণ। আয়াতগুলিতে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে পুরুষের বিয়ের জন্যে নারীর মধ্যে কারা বৈধ এবং কারা অবৈধের। এর বিপরীতে একটি আয়াতও নেই যেখানে   উল্লেখ করা হয়েছে নারীর জন্যে কোন কোন পুরুষ বৈধ আর কারা অবৈধ। এর দ্বারা বোঝা যে ইসলামের চোখে নারী কতো গুরুত্বহীন। অথচ ইসলামের মুরুব্বীরা দাবি করেন যে একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে অধিকার দিয়েছে বিয়েতে তাদের মতামত দেবার, স্বাধীনতা দিয়েছে তাদের পছন্দ অপছন্দ অবাধে ব্যক্ত করার, এবং ইসলাম বলেছে নারীর সম্মতি ব্যতিত কোন বিয়েই বৈধ নয়। এটা হাস্যকর দাবি বৈ নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, বিয়ে পড়ানোর সময় পুরুষ ও নারী উভয়ের মত নেওয়া হয়। নারীকে পিতৃগৃহের অন্দরে বসিয়ে রেখে তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয় যে অমুকের ছেলে অমুককে এতো টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে সে কবুল করছে কীনা। সে হ্যাঁ বলে এবং তারপর একই কায়দায় পুরুষকেও প্রায় একই কথা তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়।  বলা বাহুল্য যে পুরুষটিও তিনবারই হ্যাঁ বলে, এবং তারপর বিয়েটা পড়ানো হয়। এভাবেই বিয়ের প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হয় এবং ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই পুরুষটি সেই নারীর কর্তা হয়ে যায়। না, এটা কথার কথা নয়। এটা আক্ষরিক ও মর্মগত অর্থেই একেবারে সত্যি কথা তার স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াতে। এ কথা থাক। বিয়েতে নারীর মতামত প্রদান, অনিচ্ছা-অনিচ্ছা অবাধে ব্যক্ত করার স্বাধীনতা ও অধিকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিয়ে পড়ানোর প্রাক্কালে নারীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে সে বিয়েটা কবুল করছে কীনা ঠিকই, এবং এটাও ঠিক যে সে যদি কবুল না করে অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’ না বলে তবে বিয়েটা ভেস্তে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো নারীর যদি সেই বিয়েতে অমত থাকে তবে তার কি সেই মুহূর্তে ‘না’ বলার পরিস্থিতি ও পরিবেশ থাকে? বলা বাহুল্য যে থাকে না, তার ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।  এটা সর্বজন সুবিদিত যে বিয়ের প্রাক্কালে নারকে ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নেওয়া হয়, তাকে না বলার স্বাধীনতা বা অধিকার কোনোটাই দেওয়া হয় না। যার ফলে এখন দেখা যাচ্ছে মুসলিম মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তাদের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করছে। এমন ঘটনা এখন ব্যাপক সংখ্যায় ঘটছে এবং এর সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছেইসলামি বিয়ের বিধানে নারীর বর বা পাত্র পছন্দ করার স্বাধীনতা ও অধিকার থাকলে এমন ঘটনা ঘটতো না, ঘটার প্রয়োজন হতো না তাছাড়া যেখানে বাল্যবিয়ে অনুমোদিত সেখানে নারীর বর পছন্দ করার অধিকার বা স্বাধীনতার প্রশ্নই আসে না। পাত্রী বা বধূর বাবার পাত্র পছন্দ এবং সম্মতিতেই বিয়ে হয়। এটা সাবালিকা নারীর ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। বাবা বা বাড়ির পুরুষ অভিভাবকরাই পাত্র পছন্দ করে, যার বিয়ে সেই নারী বা পাত্রীর কোনো মতামত নেওয়া হয় না, সে  থাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে, বিয়ে পড়ানোর সময় তাকে দিয়ে ‘‘হ্যাঁ” দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হয়। মোদ্দা কথা হলো এই যে,  আলেম সমাজ ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যাই বলুক না কেনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্যান্য ধর্মীয় বিয়ে-ব্যবস্থার মতো ইসলামি বিয়ের কর্মকাণ্ডেও  পুরুষই সর্বেসর্বা; পুরুষ বিয়ে করে আর নারীর বিয়ে হয়; বিয়ের আইন-কানুন ও অনুষ্ঠান সবকিছুই একপেশে ও পুরুষকেন্দ্রিক;  বিয়ের সমগ্র কর্মকাণ্ডে প্রতিটি ধাপে পুরুষকে বসানো হয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে, আর নারীর স্থান পুরুষের পদতলে; বিয়ের সমগ্র প্রক্রিয়া জুড়ে পুরুষই থাকে শুধু সক্রিয়, নারী থাকে কার্যতঃ অক্রিয়; পুরুষের ইচ্ছাই সব, নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম নেই; এবং  পুরুষের ভূমিকাই প্রধান,নারীর ভূমিকা একেবারেই গৌণ।       

চুক্তিবিয়ের আর একটা বিধি আছে যেটা উল্লেখ করা হয় নি। এ বিধিটাও প্রমাণ করে যে ইসলামি বিয়ের বিধান নারীর প্রতি ন্যায়বিচার তো করেই নি, বরং নারীকে করেছে চরম অপমান। এই বিধিটি হলো  একজন নারীকে বিয়ে করতে হলে তার বিনিময়ে তাকে মোহর প্রদান করতে হবে। মুসলিমরা বলেন ‘মোহর’ হলো নারীর জন্যে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। মোহর প্রদানের মাধ্যমে নারীকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয় এবং এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসানো হয়। এটা একটি হাস্যকর দাবি।  আসলে ‘মোহর’ প্রদান মানে পাত্রীকে নগদ কিছু টাকা (অর্থমূল্য) প্রদান করা। নগদ টাকার পরিবর্তে সোনাদানা ও আসবাবপত্র বা জমিজায়গা দিয়েও ‘মোহর’ প্রদান করা যাবে, কিংবা নগদ টাকা এবং গয়নাগাটি ও জিনিষপত্র দুটোই দেওয়া যাবে। ‘মোহর’ কতো হবে তা দরদাম করে ঠিক করা হয় বিয়ের আগেই। দরদাম করার সময় বরপক্ষ কনের নানান দিক খতিয়ে দেখে। যেমন দেখে কনের পিতার  সামাজিক অবস্থান, পিতার আর্থিক অবস্থা,  রঙ-ঢঙ কেমন অর্থাৎ কনে ফর্সা না কালো না বাদামী, তার শিক্ষাদীক্ষা কতোটা আছে, কনে রান্নাবান্না ও ঘরের কাজকর্ম করতে জানে কী না, ইত্যাদি ইত্যাদি।  বরপক্ষের বিচারে যে মেয়ের গুণাগুণ যেমন তার তেমন ‘মোহর’ বা দাম ঠিক হয়। মোহর আসলে হলো পাত্রীর বিক্রয়মূল্য। একজন পুরুষ সেই দাম বা মূল্য মিটিয়ে দিয়ে পাত্রীটিকে কিনে নেয়। সুতরাং  চুক্তিবিয়ের মূল কথা হলো কিছু অর্থের বিনিময়ে একজন নারীর একজন পুরুষের কাছে বিক্রি হওয়া। এই বিক্রি হওয়াটা জন্মের জন্যে, কারণ ইসলামি বিয়ের বিধানে বিয়ের পর বধূ তার বরকে কোনো কারণেই ত্যাগ করতে বা তালাক দিতে পারবে না। পুরুষ পারবে, ইচ্ছা হলেই পারবে, কারণে অকারণে পারবে, জামাকাপড় ফেলে দেওয়ার মতো যখন তখন তার বধূকে তালাক দিয়ে চির তরে তাড়িয়ে দিতে পারবে,  কিন্তু বধূ শত অত্যাচারেও তার বরকে তালাক দিতে পারবে না। সে যে তার বরের কেনা ক্রীতদাসী, কিছু টাকা ও গয়না তথা ‘মোহর’-এর বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া এক নারী। ‘মোহর’-এর এমনই মাহাত্ম্য!          
   


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...