Wednesday, September 14, 2016

ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার গল্পটা একটা পৌরাণিক গল্প বৈ নয়



সারা বিশ্বে ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ সারা বিশ্বের মুসলমানদের ২য় বৃহত্তম উৎসব। এ উৎসবটি উদযাপিত হয় মহাসমারোহে দু’দিনে। গতকাল (১২.০৯.১৬) সৌদি আরবে  উদযাপিত হয়েছে, আর আজ (১৩.০৯.১৬) ভারত-সহ এশিয়া মহাদেশে উদাযাপিত হলো। ঈদ-উল-আযহা উদযাপন মানে পৈশাচিক  উল্লাসে বিশ্বজুড়ে প্রাণীনিধনযজ্ঞে মেতে ওঠা। এতো বিশাল সংখ্যক প্রাণীর নিধন হয় এই ঈদে যে একদিনে এই নিধনযজ্ঞ  সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। তিন ধরে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে দানবীয় উল্লাসে। বিশ্বে প্রায় এখন ১৭০ কোটি মুসলিম জনসংখ্যা।  তারা আনুমানিক ১২ কোটি প্রাণীকে এই ঈদে আল্লাহর নামে হত্যা করবে  শুধু  ১২ কোটি প্রাণীকেই   হত্যা করবে না, তার সঙ্গে আনুমানিক সাড়ে চার লক্ষ হাজার কোটি টাকার শ্রাদ্ধও করবে এটাকে   কাল্পনিক বা আবোলতাবোল হিসেব ভাবলে ভুল হবে। ২০১৪  সালে এ রকমই একটা ঈদের দিনে এই ঈদ নিয়েই একটা ব্লগ  (http://giasuddinonline.blogspot.in/2014/10/blog-post_4.html )  লিখেছিলাম যেখানে এই হিসেবটি কষা হয়েছে।         
মজার ব্যাপার হলো এই হত্যাযজ্ঞকে আবার মহান ত্যাগ (!) – এর উৎসব বলে দাবি  করা হয়। এমন অবাস্তব, উৎকট ও উদ্ভট দাবি বোধ হয় আর হয় না। যারা এরূপ দাবি করে তাদের মানসিক চিকিৎসার   প্রয়োজন আছে কী না ভেবে দেখা দরকার।  আর যদি তা না হয় তবে তো ত্যাগের আভিধানিক অর্থ বাতিল করে নতুন অর্থ লিখতে হয়।  সে কথা থাক, তার চেয়ে বরং এই ঈদ নিয়ে যে গল্পটি সত্য ঘটনা বলে প্রচলিত আছে তার ময়না তদন্ত করতে গিয়ে যে নতুন ও প্রায় অবিশ্বাস্য  তথ্য উঠে এসেছে সেটা সবার গোচরে আনা যাক। 
‘ঈদ-উল-আযহা’ হলো এই ঈদের পোশাকি নাম যা অধিকাংশ মুসলমানই জানে না। তারা জানে এটাকে  কোরবানির ঈদ বা কুরবানির ঈদ নামে। এই  ঈদ কীভাবে এসেছে তা নিয়ে একটা পৌরাণিক গল্প চালু আছে। মুসলিমরা অবশ্য গল্পটাকে আসল ঘটনা বলে জানে ও বিশ্বাস করে, কারণ তাদের বিশ্বাস কোরানের সব কথাই সত্য ও বাস্তব। কিন্তু গল্পটা যে সত্যিই গল্প, আসল কোনো ঘটনা নয় তা গল্পটা পড়লে বোঝা যায়। গল্পটা সংক্ষেপে এ রকম। ইব্রাহীম নবি একদিন স্বপ্ন দেখছেন যে  আল্লাহর  হুকুমে তিনি একদিন তাঁর পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি দিচ্ছেন। তিনি  সেই স্বপ্নের কথা ইসমাইলের নিকট ব্যক্ত করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, এবার বলো তোমার অভিমত কী? ইসমা তখন তাঁর পিতাকে বলেন, কী আশ্চর্য কথা, এতে বলার কী আছে। এ তো আমার সৌভাগ্য যে আল্লাহ কোরবানি করার জন্যে আমাকে নির্বাচন করেছে। তুমি দেরী না করে এখনই আল্লাহর আদেশ পালন করো, আমি প্রস্তুত আছি। ইব্রাহীম তখন ইসমাইলকে জবেহ বা কুরবানি করার উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হলেন। সেখানে পৌঁছে ইসমাইলকে অধোঃমুখে শোওয়ালেন যাতে তাঁর মুখমণ্ডল দেখে  পুত্রস্নেহ প্রবল না হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে আপন পুত্রকে জবাই করার সুমহান কর্তব্য সম্পাদনে কোনো প্রকার বিঘ্ন না ঘটে।  ইব্রাহীম যখন ইসমাইলকে জবাই করতে উদ্যত তখন তিনি একটি আসমানি স্বর শুনতে পান। আল্লাহ তাঁকে বলছে, হে ইব্রাহীম! তুমি তো সত্যি সত্যিই আমার স্বপ্নাদেশ পালন করলে। তুমি পিছনে তাকাও, দেখো তোমাকে কোরবানি করার জন্যে একটি মহান জন্তু দিলাম। ইব্রাহীম পিছন ফিরে  তাকালে দেখতে পেলেন একটি হৃষ্ট-পুষ্ট দুম্বা দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ বলল, আমি এভাবেই আমার প্রতি বিশ্বাসী, আনুগত্যশীল ও সৎকর্মশীলদের পুরষ্কৃত করি। ইব্রাহীম সেই দুম্বাটিকে আল্লাহর ওয়াস্তে জবাই করলেন।   
তারপর থেকেই নাকি মুসলমানদের প্রতি আদেশ হয় যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ একটা জন্তু কোরবানি করার। এই হলো সংক্ষেপে মুসলিম সমাজে ‘কোরবানি’  চালু হওয়ার প্রেক্ষাপট। এখন প্রশ্ন হলো, ‘কোরবানি’ নিয়ে কোরানে বর্ণিত এই কথাগুলি কি সত্যিই ঘটেছিলো, না কি এটা পৌরাণিক গল্প মাত্র? আধুনিক যুগের মানুষ, এমনকি মুসলিমরাও, এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজছেন। প্রশ্নটির উত্তর এড়ান সম্ভব নয় মানছেন ইসলামি পণ্ডিতরাও। তাই তাঁরাও প্রাণান্ত  চেষ্টা করে  যাচ্ছেন ইব্রাহীম ও ইসমাইলের গল্পটাকে সত্যি বলে প্রমাণ করার। যারা বিশ্বাসী মুসলমান তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, এক). আল্লাহ ইব্রাহীমকে স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে কেনো তাঁর পুত্রকে কোরবানি করার আদেশ দিয়েছিলো? একটা ওহি পাঠিয়ে এই আদেশটি দিলে  তো অধিক বিশ্বাসযোগ্য হতো। স্বপ্ন তো যে কেউ দেখতে পারে। কোনটা আল্লাহর দেখানো স্বপ্ন আর কোনটা শয়তানের তা মানুষ বুঝবে কি করে?  জিজ্জাসা -  দুই). কোনো মানুষ যদি সত্যিই এমন স্বপ্ন দেখে তবে সে কী করবে? নিশ্চয় এমন একটা স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন ভেবে মন থেকে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতে চেষ্টা করবে। ধর্মভীরু মানুষ হলে ভাববে যে নিশ্চয় এটা শয়তানের কাজ এবং শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। জিজ্ঞাসা – তিন).  কোনো মানুষ যদি ভোর  বেলা বিছানা থেকে উঠে তার পুত্রকে বলে, আল্লাহ আমাকে গত রাত্রে স্বপ্নে  আদেশ করে বলেছে, “এই বান্দা! যে পুত্রকে তুই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসিস তাকে ভোরে উঠে আমার উদ্দেশ্যে কোরবানি করবি। এটা তোর ঈমানের পরীক্ষা।” এমন উদ্ভট স্বপ্নের কথা শুনে তার পুত্র ও পরিবারের লোকজন কী বলবে বা করবে?  নিশ্চয়ই লোকটার মাথার গণ্ডোগোল হয়েছে ভেবে  তারা মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। এভাবে যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ইসমাইলকে কোরবানি করার গল্পটা  পৌরাণিক গল্প বৈ সত্যি ঘটনা মনে হয় না।  
তো গেলো যুক্তির কথা। বিশ্বাসী ধর্মান্ধ মুসলমানরা, এমনকি শিক্ষিত মুসলমানরাও যারা কথায় কথায় ইসলামকে  যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি মহান সত্যবাদী ধর্ম বলে দাবি করেন তারাও এক্ষেত্রে বলবেন যে আল্লাহর কর্মকাণ্ডকে সব সময় যুক্তি দিয়ে বিচার করা মূর্খামি। হ্যাঁ, নিজেদের মূর্খামি ঢাকতে তারা প্রায়শঃই রকম শিশুসুলভ হাস্যকর কথা বলে থাকেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, যুক্তির কথা ছেড়ে দিয়ে শুধু কোরান হাদিসের কথা থেকেও এটা প্রমাণ করা যায় না যে ইব্রাহীম নবি  ইসমাইলকেই কোরবানি দিতে গিয়েছিলেন।   হ্যাঁ, আবার বলছি যে, কোরান হাদিস কোথাও বলে নি যে ইসমাইলকে কোরবানি করার স্বপ্নাদেশ হয়েছিলো এবং ইব্রাহীম ইসমাইলকে জবাই করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলেন।  আসুন, এবার  চোখ রাখি কোরান হাদিসের পাতায় যেখানে ইব্রাহীমের প্রতি তাঁর পুত্রকে কোরবানি করার স্বপ্নাদেশের পৌরাণিক গল্পটি বর্ণনা করা  হয়েছে। প্রথমে চোখ রাখবো কোরানের পাতায়।   কোরানের ৩৭ নং আস-সাফাত সুরায়  এই গল্পটির বর্ণনা রয়েছে। কোরানে বর্ণিত গল্পটি হলো রকমঃ
·         আর নিশ্চয়ি তার পশ্চাদবরতীদের মধ্যে ছিলেন ইব্রাহীম। স্মরণ কর! তিনি তাঁর প্রভুর কাছে এসেছিলেন বিশুদ্ধ চিত্ত নিয়ে, -  যখন তাঁর পিতৃপুরষ স্বজাতিকে তিনি বলেছিলেন তোমরা কিসের উপাসনা করছ? তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কি এই মিথ্যা উপাসককেই কামনা কর? তাহলে বিশ্বজগতের প্রভু সম্বন্ধে তোমাদের কী ধারণা? তারপর তারকারাজির দিকে তিনি একবার তাকালেন, তখন তিনি বললেন আমি যারপর নাই বিরক্ত! সুতরাং তারা তাঁর কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে গেলতারপর তিনি তাঁর উপাস্যদের কাছে ফিরে গেলেন এবং বললেন তোমরা খাও না কেন? তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা কথা বলছ না?  কাজেই তিনি তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডানহাতে আঘাত করে। তখন তারা তাঁর দিকে ছুটে এল হতবুদ্ধি হয়ে। তিনি বললেন তোমরা কি তার উপাসনা কর যা তোমরা কেটে বানাও, অথচ আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন  তাও? তারা বললে এর জন্য একটি কাঠামো তৈরী কর, তারপর তাকে নিক্ষেপ কর এক ভয়ঙ্কর আগুনে। কাজেই তারা তাঁর বিরুদ্ধে এক চক্রান্ত ফাঁদলো, কিন্তু আমরা তাদের হীন বানিয়ে দিলাম। ইব্রাহীম বলল – আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম, তিনি অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করবেন। হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। আমি তার জন্যে বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে, ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন  (আয়াত নং ৮৩-১১৩)  
পাঠকগণ, আপনারা ভালোভাবে লক্ষ্য করুন কোরানের আয়াতগুলির প্রতি। কোথাও ইসমাইলের নাম উল্লেখিত হয়েছে? না, হয় নি। ইব্রাহীম আল্লাহর কাছে একজন সৎপুত্রের প্রার্থনা জানিয়েছেন এবং আল্লাহ তাকে একজন সৎপুত্র দান করার কথা জানিয়েছেন এবং তাঁকেই কোরবানি করার স্বপ্নাদেশ দিয়েছিল। সে সৎপুত্রটি যে ইসমাইলই সে কথা কোরানের এই আয়াতগুলিতে নেই।  সুতরাং কোরান থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে, ইসমাইলকে কোরবানি করার স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন  ইব্রাহীম। পাঠকগণ  এই আয়াতটির প্রতি চোখ রাখুন যেখানে ইব্রাহীমের সেই পুত্রটির বয়সের প্রতি  আলোকপাত করা হয়েছে। আয়াতটি হলো – ‘সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি;’। এখানে পুত্রটি বয়সে যে  তরুণ ছিলো তার উল্লেখ রয়েছে। হাদিস কিন্তু তা বলছে না। হাদিস কী বলছে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। হাদিসেও অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে ইসমাইলকেই কোরবানি করতে গিয়েছিলেন ইব্রাহীম নবী। সেই হাদিসটি দেখা যাক কী বলেছে -     

·         ইবনে আব্বাস বর্নিত: তিনি বলেন যখন ইব্রাহীম তাঁহার স্ত্রী( সারাহ) এর যা হইবার তা হইয়া গেল অর্থাৎ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইল, তখন ইব্রাহীম শিশুপূত্র ইসমাইল ইসমাইলের মাতা হাজেরাকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। তাহাদের সাথে একটি মশক ছিল আর তাতে পানি ছিল। ইসমাইলের মাতা মশক হইতে পানি পান করিতেন আর শিশুপূত্রের জন্য তাহার দুগ্ধে প্রাচুর্য আসিত। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহীম মক্কায় আসিয়া গেলেন এবং হাজেরাকে তার শিশুপূত্র সহ একটি বৃক্ষমূলে বসাইয়া রাখিলেন। তারপর তিনি তার নিজ স্ত্রী সারাহ এর নিকট ফিরিয়া চলিলেন। তখন ইসমাইলের মাতা তাহাকে অনুসরণ করিয়া কিছুদুর গেলেন ইব্রাহীমকে জিজ্ঞাসা করিলেন- হে ইব্রাহীম আমাদিগকে কাহার নিকট রাখিয়া যাইতেছেন? ইব্রাহীম বলিলেন- আল্লাহর নিকট। হাজেরা বলিলেন- আমি আল্লাহর নিকট থাকিতেই রাজি। .....................................................................................
ইবনে আব্বাস বলেন, জুরহুম গোত্রের একদল লোক প্রান্তরের মধ্য দিয়া পথ অতিক্রম করিতেছিল, হঠাৎ তাহারা দেখিল, একদল পাখী উড়িতেছে। তাহারা যেন তাহা বিশ্বাসই করিতে পারিতেছিল না।তাহারা বলিল, যেখানে পানি থাকে সেখানেই তো এইসব পাখি উড়িতে দেখা যায়। তখন তাহারা পাখী উড়িবার স্থলে তাহাদের একজন লোক পাঠাইল। সে তথায় গিয়া দেখিল সেখানে পানি মৌজুদ আছে। তখন সে দলের লোকদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে পানির খবর দিল। তারপর তহারা সকলেই হাজেরার নিকট আসিল এবং তাহাকে বলিল, হে ইসমাইল জননী! আপনি কি আমাদিগকে আপনার প্রতিবেশী হওয়ার বা আপনার সাথে বসবাস করিবার অনুমতি দিবেন ?হাজেরা তাহাদিগকে বসবাসের অনুমতি দিলেন এবং এইভাবে অনেক দিন চলিয়া গেল। """"তারপর হাজেরার শিশুপূত্র প্রাপ্ত বয়স্ক হইলেন, তখন তিনি জুরহুম গোত্রেরই এক কন্যাকে বিবাহ করিলেন। ইবনে আব্বাস বলেন, অত:পর নির্বাসিত পরিজনের কথা ইব্রাহীম এর মনে উদয় হইল। তিনি তাহার স্ত্রী সারাহ কে বলিলেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজনের কথা জানিতে চাই। ইবনে আব্বাস বলেন, অত:পর ইব্রাহীম তাহাদের নিকট আসিলেন এবং সালাম দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন- ইসমাইল কোথায় ?ইসমাইলের স্ত্রী বলিল- তিনি শিকারে গিয়াছেন।""""""....................... (সূত্রঃ বুখারী হাদিস, বই নং ৫৫, হাদিস নং – ৫৮৪)
হাদিসের বর্ণনায় এ কথা বলা হয়েছে ইসমাইল কিশোর বয়সে ইব্রাহীমের কছে ছিলেন না। ইসমাইল যখন দুধের শিশু তখনই ইব্রাহীম নবী তাঁর স্ত্রী সারাহ-র প্ররোচনায় তাঁকে তাঁর মা হাজেরার সঙ্গে নির্বাসিত করেছিলেন এবং দীর্ঘকাল তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন নি। ইব্রাহীম যখন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক একজন যুবক এবং বিবাহিত। মুসলিমরা মনে করে হাদিস হলো কোরানের প্রায় সমতুল্য। মুসলিমদের নিকট সর্বাধিক সহিহ (সঠিক ও নির্ভুল) হাদিস হিসেবে বুখারী হাদিসই  স্বীকৃত ও সমাদৃত। সেই বুখারী হাদিস অনুযায়ী ইব্রাহীম যখন ইসমাইলের কাছে দেখা করতে যান তখন তিনি কৈশোর উত্তীর্ণ  এবং বিবাহিত একজন যুবক। কিন্তু কোরানের ভাষ্য অনুসারে  ইসমাইলকে যখন কুরবানি দেওয়া হচ্ছিল তখন তিনি একজন কিশোর। সুতরাংতাহলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, প্রতি বছর মহাসমারোহে যে বিশ্বাসে লক্ষ লক্ষ পশুহত্যার বীভৎস উৎসব মেতে ওঠে সারা বিশ্বের মুসলমানরা সেই বিশ্বাসটাই ভূয়া এবং একটা পৌরাণিক গল্প বৈ নয়। অতএব দেখা যাচ্ছে যে,  কোটি কোটি মুসলমান  ‘কোরবানি’ দেওয়াকে মহান ত্যাগের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত জ্ঞানে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ হাজার কোটি টাকা এবং অঢেল  সময় ও উদ্যোগ যে ব্যয় করে তা সম্পূর্ণ বিফলেই যায়। 

ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার ঘটনাটি যদি মিথ্যা হয় তবে একটা প্রশ্ন ওঠে, কোরানে বর্ণিত ইব্রাহীমের সেই পুত্রটি কে ছিলেন যাকে তিনি জবাই করছিলেন?  প্রশ্নটি মুসলিম ধর্মগুরুদের মধ্যেও ছিলো এবং এখনও আছে। এই প্রশ্নের উত্তরে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতৈক্য নেই, তাঁরা  আড়াআড়িভাবে দ্বিধাবিভক্ত।  ইসলামের গোড়ার যুগের অধিকাংশ ধর্মগুরুই বিশ্বাস করতেন যে ইসমাইল নয় ইব্রাহীম নবী তাঁর আর এক পুত্রকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। সে সময়ের অল্প কয়েকজন আলেম মত দিয়েছিলেন যে ইসমাইলকেই কোরবানি দিতে যাচ্ছিলেন ইব্রাহীম নবী।  কারা কী বলেছেন তা ঐ আয়াতগুলির তফসির থেকে জানা যায়।  প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাসির তাঁর গ্রন্থে ধর্মগুরুদের দু’টো মতই সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, -
·         ইকরামা (রঃ), ইবনে আব্বস (রঃ), আব্বাস (রঃ) , আলী (রঃ),  জায়েদ ইবনে জোবায়ের (রঃ), মুজাহিদ (রঃ) , শাবি (রঃ), উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ), জায়িদ ইবনে আসলাম (রঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক (রঃ), কাশিক ইবনে আবি বুরযা (রঃ),  মাকহুল (রঃ),  উসমান ইবনে আবি হাযির (রঃ),  সুদ্দি (রঃ) ,  হাসান (রঃ),  কাতাদা (রঃ),  আবু হুযায়েল (রঃ),  ইবনে সাবিত (রঃ) , কাবুল আহবার (রঃ) প্রভৃতি আলেমরা এই মত পোষণ করেন যে , যাবীউল্লাহ হযরত ইসহাকই ছিলেন। অর্থাৎ ইসহাককেই কোরবানী করা হয়েছিল। ইবনে জারিরও একই মত পোষণ করেছেন। (দ্রঃ তফসির ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা-২১৭, ১৬শ খন্ড,   http://www.quraneralo.com/tafsir/ )  
ইবনে কাসির অন্য আরো দু’টো জায়গায় এই একই মতের উল্লেখ করেছেন। সেটা হলো, -
·         হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মুসা (আঃ) বলেনঃ ‘হে আমার প্রতিপালক! মানুষরা মুখে মুখে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ইসহাক (আঃ) এবং হযরত ইয়াকুব (আঃ) – এর মা’বূদের শপথ করে থাকে – এর কারণ কি?’  উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘কারণ এই যে, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) প্রত্যেকটা বিষয়ে আমাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। ইসহাক (আঃ) আমার পথে কুরবানি হওয়ার জন্যে নিজেকে আমার হাতে সমর্পণ করে। আর ইয়াকুব (আঃ) –কে আমি যতই বিপদাপদে নিপতিত করি, তার শুভ ধারণা ততই বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।’  (দ্রঃ – ঐ, পৃ – ২১৬)

·          আলী (রঃ), জায়েদ ইবনে জোবায়ের,  মুজাহিদ , শাবি, উবায়েদ ইবনে উমায়ের, জায়িদ ইবনে আসলাম, আব্দুল্লাহ ইবনে শাকিক, কাশিক ইবনে আবি বুরযা, মাকহুল, উসমান ইবনে আবি হাযির, সুদ্দি , হাসান, কাতাদা, আবু হুযায়েল, ইবনে সাবিত , কাবুল আহবার প্রভৃতি আলেমরা এই মত পোষণ করেন যে , যাবীউল্লাহ হযরত ইসহাকই ছিলেন। অর্থাৎ ইসহাককেই কোরবানী করা হয়েছিল। ইবনে জারিরও একই মত পোষণ করেছেন।  (দ্রঃ – ঐ, পৃ – ২১৭)
·          
আলেমদের একাংশ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে ইব্রাহীম নবি ইসমাইলকেই কুরবানি দিয়েছিলেন।  তাঁরা কারা এবং কী মত দিয়েছেন তার বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, -
·         হযরত ইবনে উমার (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), শা’বী (রঃ), হাসান বসরী (রঃ), মুহাম্মদ ইবনে কা’ব কারাযী (রঃ), প্রমুখ গুরুজন মত প্রকাশ করেন যে, যাবীউল্লাহ হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন। (দ্রঃ – ঐ, পৃ – ২১৮)  
আলেমদের দু’টো মত এবং হাদিসে দেওয়া তথ্যটি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে এই মতটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যে ইসমাইলকে নয় ইসহাককেই কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন ইব্রাহীম।  তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আজকের আলেম ও মুমিনরা  কেনো ইসমাইলকেই কোরবানি দেওয়া হয়েছিলো বলে জোর করছেন। এর পেছনেও একটা কারণ আছে। সেটা হলো এ রকমঃ তৌরাত গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে যে ইসহাকের পূত্র ইয়াকুব যার অন্য নাম ইসরাইল, তার বংশেই নবী আসবে । মুহাম্মদ ইসমাইলের বংশধর বলে দাবি করা হয়। সুতরাং ইসহাককে কুরবানী করা হয়েছে মেনে নিলে , মুহাম্মদ ভূয়া নবী বা মিথ্যাবাদী প্রমানিত হয়। তাই আজকের আলেমরা গায়ের জোরেই এই মতটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চান যে যাবীউল্লাহ হয়েছিলেন ইসমাইল, ইসহাক নয়।  


১৩.০৯.১৬



 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...