Monday, July 27, 2015

তিন দিনের হজের স্বল্প পরিসরেই মাইমুনাকে বিয়ে


সপ্তম হিজরীতে অর্থাৎ ৬২৯ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ বিয়ে করেন ২ বছর বয়সী বিধবা নারী মাইমুনাকে । মুহাম্মদের স্ত্রীদের বয়স বেশী করে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় মুসলিম লেখক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে । তাঁরা বোঝাতে চান যে নারীদের যৌবন ও রূপ-লাবণ্যের কারণে নয়, তিনি বহু  বিয়ে করেছিলেন ইসলামের প্রয়োজনে, অথবা মানবতার কারণে । সে জন্যে মাইমুনার বয়সও বেশী করে দেখিয়েছেন তাঁরা  । যেমন মহম্মদ সাদাত আলি লিখেছেন, “হযরতের সঙ্গে যখন মাইমুনার বিবাহ হয় তখন রাসুলের [সাঃ] – এর বয়স ৬০ এবং মাইমুনার বয়স ৪৬ ।” [দ্রঃ মহানবী [সঃ] এঁর বিবাহ, পৃ – ১২৪]  বয়সের এই তথ্যটি খণ্ডন করেছেন অন্যান্য মুসলিম পণ্ডিতগণও   মুহাম্মদের একজন একনিষ্ঠ অনুরাগী  ড.ওসমান গণি এক্ষেত্রে সাদাত আলীর মতো মিথ্যাচার করেন নি । তিনি  লিখেছেন যে মাইমুনার বয়স ছিলো তখন মাত্র ২৮ বছরতিনি কী বলেছেন তা একটু পরে উদ্ধৃত করবো । মাইমুনা নামটি কিন্তু তাঁর আসল নাম ছিলো না, ওটা মুহাম্মদ প্রদত্ত নামমাইমুনার আসল নাম ছিলো বাররাহ । তাঁর পিতা হারিস বিন হাযন ছিলেন কোরেশ বংশের হাওয়াজিন গোত্রের একজন  গণ্যমান্য ব্যক্তি  মুহাম্মদের সঙ্গে বিয়ের পূর্বে মাইমুনার আরো দু’বার বিয়ে হয়েছিলো । প্রথমে বিয়ে হয়েছিলো মাসউদ বিন উমর-এর সঙ্গে । মাসউদের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন সুখের ও স্থায়ী হয় নি  । তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে দ্বিতীয় বিয়ে হয় আবু রাহাম বিন উজ্জার সঙ্গে । আবু রাহাম কিছুদিনের মধ্যে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান । মাইমুনা আর একটি বিশেষ পরিচয় বহন করতেন । তিনি ছিলেন মুহাম্মদের আপন কাকা  আব্বাসের   শ্যালিকা । অর্থাৎ মাইমুনা ছিলেন সম্পর্কে মুহাম্মদের কাকীমা  । মুহাম্মদ ও মাইমুনার মধ্যে বিয়েটি অনুষ্ঠিত হয় মক্কা নগরীতে । মক্কা  থেকে মুহাম্মদ ৬২২ খৃস্টাব্দে মদিনায় চলে  যান তাঁর নিজের ধর্ম  ইসলামের  প্রচারের  জন্যে । মদিনা যাওয়ার আগে বারো-তেরো  বছর ধরে তিনি মক্কা শহরে  ইসলামের প্রচার করেন । কিন্তু মক্কার মানুষ তাঁর আহ্বানে  সাড়া দেয় নি, ঘুরিয়ে তাঁকে পাগল ও প্রতারক বলে উপহাস করতো   তখন তখন তিনি মদিনা চলে  যান তারপর মক্কার কোরেশদের সঙ্গে  তাঁর সম্পর্কের ক্রমশঃ অবনতি  হতে থাকে  ফলে মুহাম্মদ দীর্ঘ ছ’ বছর মক্কায়  পা রাখতে পারেন নি । ৬ষ্ঠ হিজরীতে মক্কায় যাওয়ার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোরেশদের একটি চুক্তি  [হুদায়বিয়ার  চুক্তি] হয় সেই চুক্তির  একটা শর্ত ছিলো এরূপঃ   মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যরা  মক্কায় হজ করতে  যেতে পারবেন, তবে  হজ সম্পন্ন করার জন্যে মক্কায় তাঁরা   তিন দিনের বেশী  অবস্থান করতে পারবেন না   সেই চুক্তি  অনুসারে পরের বছরেই  সদলবলে তিনি মক্কা হজ করতে যান এবং ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যেই মাইমুনাকে বিয়ে করেন     
হজের জন্যে  মাত্র তিন দিন সময়,  এই তিন দিনে হজ ক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজে  প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকার কথা, তার মধ্যেই বিয়ে ? অবাক কাণ্ডই বটে !  কিন্তু না, মুহাম্মদের বেলায় ‘অবাক’ শব্দটাই একেবারে   বেমানান কারণ, তাঁর  কাছে  একটা বিয়ে করার জন্যে তিন দিন মোটেই কম সময় নয়, বরং বলা যায় যে  যথেষ্ট বেশীই   তিনি তো এর আগে এক পলক দেখা মাত্রই  তাঁর অনেক স্ত্রীকেই পছন্দ করেছেন এবং  তৎক্ষণাৎ তাঁদের সঙ্গে  বিয়ের কার্যাদিও সম্পন্ন করেছেন । রায়হানা ও জুয়াইরিয়াকে তো তিনি এক পলক দেখেই বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছিলেন এবং কয়েক ঘন্টা যেতে না যেতেই  বিয়েও করেছিলেন ।       এ হেন মুহাম্মদের পক্ষে  তাই হজ করতে গিয়ে মাত্র তিন দিনের স্বল্প সময়ের পরিসরে  মাইমুনাকে  বিয়ে করতে   কোনো সমস্যাই হয় নি । 
মাত্র তিন দিন সময়, তার মধ্যেই তিনি হজও করলেন, আবার বিয়েটাও সম্পন্ন করলেন ! এ বিয়ে তো শ্ত্রুদের পদানত বা বিনাশ করে, তাদের নারীদের দখল করে, বন্দি করে, তাদের মধ্যে  যাকে পছন্দ হলো তাকে বিয়ে করে নিলাম – এভাবে তো হয় নি ।  বিয়ের আগে তো রীতিমতো মেয়ের সঙ্গে বা মেয়ে পক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হয়েছে । আবার মুহাম্মদের হয়েও তো কেউ কথাবার্তা বলেছে ।  কারা  তারা ?  আর কেই বা ছিলেন সেই  ঘটক ?  এতো স্বল্প সময়ে কীভাবেই বা ঘটকালি পর্ব সেরে হজের ক্রিয়াকর্মের  মধ্যেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো ? এসব প্রশ্ন এখনও মুসলমানদে  তাড়া করে ফেরে । আর  এর উত্তর দিতে গিয়ে ইসলাম ও মুহহাম্মদের পক্ষ সমর্থনকারী ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণদেরও  নাকানি-চোবানি খেতে  হয় তাঁরাও যে যার মতো করে উত্তর দেবার চেষ্টা করেন । ফলে মুহাম্মদ ও মাইমুনার বিয়ের ইতিহাস নিয়ে তাঁদের মধ্যে  প্রবল মতভেদ পরিলক্ষিত হয়  কেউ কেউ বলেছেন মাইমুনা স্বয়ং বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন । কেউ কেউ বলেছেন যে মুহাম্মদের কাকা আব্বাস বিন মোত্তালেব মুহাম্মদের কাছে মাইমুনার হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । কেউ কেউ আবার মানতেই চান নি যে ৭ম হিজরিতে বিয়ে হয়েছিলো । তাঁরা ভেবেছেন যে হজ করতে গিয়ে, তাও আবার তিন দিনের সময়-সীমার মধ্যে বিয়ের ঘটনাকে স্বীকার করলে মুহাম্মদের মহত্ত্ব ভুলুণ্ঠিত হয় । তাই তাঁরা বলেছেন যে মাইমুনাকে মুহাম্মদ বিয়ে করেছিলেন ৮ম হিজরীতে যে বছর মুহাম্মদ  মক্কা বিজয় করার পর ।    মুহাম্মদ ও মাইমুনার বিয়ে নিয়ে এই তিন প্রকার মতামত আমরা শুনতে পায় । তাঁরা ঠিক কি বলেছেন শোনা যাক ।  একটা মত হলো এ রকমঃ   ‘মহানবী [সঃ] এঁর বিয়ে’ গ্রন্থের লেখক মহম্মদ সাদাত আলী লিখেছেন -  “পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য রাসুলুল্লাহ [সাঃ] তিনিদিন মক্কায় ছিলেন । এ সময় তিনি কারো গৃহে না গেলেও আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের মধ্যে কারো কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে ।  অল্প-বিস্তর আলাপও হয়েছে কারো কারো সঙ্গে । এই স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ঘটে গেছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা । হযরতের এক আত্মীয়া নাম বাররাহ [নতুন নাম মাইমুনা বিবি], যিনি একজন বিধবা রমণী, হযরতের পাণি প্রার্থিনী হয়ে পয়গাম পাঠান  রাসুলুল্লাহ [সাঃ] বিবি মায়মুনার সাধ পূরণ করেন । তিনি মায়মুনাকে বিবাহ-পূর্বক সঙ্গে করে মদিনায় নিয়ে যান । [পৃ-১২২,১২৩]    মহম্মদ হেইকল বলেছেন মাইমুনার পক্ষে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন আব্বাস । সাদাত আলি হেইকলকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “মাইমুনা যখন মুসলমানদেরকে ওমরা পালনরত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেন, তিনি ইসলামের প্রতি মোহিত হয়ে পড়েন এবং আল-আব্বাসকে ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে তার [মাইমুনার ] বিবাহ পয়গাম পেশ করতে অনুরোধ করেন। মুহাম্মদ বিবাহে সম্মতি দেন এবং চারশত দিরিহাম মোহরানা প্রদানে রাজী হন । [দ্রঃ – ঐ, পৃ-১২৩]    ড.ওসমান গণি তৃতীয় মতটি ব্যক্ত করেছেন । তিনি লিখেছেন, “২৮ বছরের মায়মুনা ছিলেন উম্মুল ফজলের বোন । উম্মুল ফজল ছিলেন – আব্বাস বিন মোত্তালিবের স্ত্রী । যখন মক্কা বিজয় হলো, তখন মায়মুনা মুসলমান হলেন । স্বয়ং আব্বাস হযরতকে অনুরোধ করলেন – হযরত ও কুরাইশদের মধ্যে প্রীতির বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও প্রবল করার জন্য মায়মুনাকে বিবাহ করতে । হযরত অনুরোধ রক্ষা করলেন । [দ্রঃ – মহানবী, ওসমান গণী, পৃ – ৩৯২,৩৯৩]   ওসমান গণির এই তথ্য হলো  এক নগ্ন মিথ্যাচারের নমুনা । মুহাম্মদের বিয়েটাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে  দেখানোর জন্যে তিনি সম্পূর্ণ মনগড়া তথ্য ও যুক্তি দিয়েছেন । মাইমুনার সঙ্গে মুহাম্মদের বিয়ে ৭ম হিজিরীতেই অর্থাৎ মক্কা বিজয়ের আগের বছরেই সম্পন্ন হয়েছিলো তা জানিয়েছেন সকল ঐতিহাসিক ও মুহাম্মদের জীবনীকাররাই । সাদাত আলি বলেছেন ৭ম হিজিরিতে সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ।  মুহাম্মদের  জীবনীকার ও বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’র লেখক কবি গোলাম মোস্তফাও সে কথাই লিখেছেনতিনি এই গ্রন্থের ২৩০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “কিন্তু এই অল্পপরিসর সময়ের মধ্যে আর একটি কাণ্ড ঘটিল । হযরত যে - তিনিদিন মক্কায় ছিলেন, সে – তিনিদিন কাহারও গৃহে প্রবেশ করেন নাই বটে, কিন্তু কোন কোন কোরেশ নাগরিকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ ও আলাপ-পরিচয় হইয়াছিল । সেই সূত্রে মাইমুনা নাম্নী তাঁহারই জনৈক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া বিধবা রমণী হযরতের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইবার জন্য প্রস্তাব পাঠাইয়া দেন  হযরত তাঁহার এ বাসনা পূর্ণ করেন ।”
মুহাম্মদ যখন মাইমুনাকে বিয়ে করেন তখন তাঁর হারেম ৯/১০ জন স্ত্রীর উপস্থিতিতে কোলাহল মুখরযে স্ত্রীরা তখন তাঁর হারেমে কোলাহল করছেন তাঁরা ছিলেন সওদা, আয়েষা, হাফসা, উম্মে সালমা, জয়নাব, রায়হানা, জুয়াইরিয়া, উম্মে হাবিবা, মারিয়া  প্রমুখ । এতো জন স্ত্রীর উপর আবার বিয়ে ? এই সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে মুহাম্মদের অনুসারীরা যে যুক্তি সাজিয়েছেন তা যেমন বালখিল্য তেমনই হাস্যকরও বটে । মাইমুনা নাকি পাণিপ্রার্থী হয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন তাই মুহাম্মদ তাঁকে বিয়ে করেছিলেন ।  এতে  নাকি মুহাম্মদের উদারতার প্রকাশ ঘটেছে !  একজন নারীর প্রতি উদারতা দেখাতে কি অন্য নারীদের অপমান ও সর্বনাশ করা যায় ? আর  নবিকে উদারতা দেখানোর জন্যে নারীদেরই বলি চড়াতে হয় কেনো ? আবার মাইমুনা কেনো মুহাম্মদের প্রতি মুগ্ধ ও অনুরক্ত হয়েছিলেন সে কথা বলতে  গিয়ে তাঁরা যা বলেছেন তা  গোঁজামিল  ছাড়া কিছুই নয় । তাঁরা লিখেছেন যে মুসলমানদের ওমরা দেখে মাইমুনা মোহিত হয়ে পড়েছিলেন । হজ করার আচার-অনুষ্ঠানগুলি পালন করার অপর নাম ‘ওমরা’  । প্রাক ইসলাম যুগে  কোরেশরা হজ সম্পন্ন করতে গিয়ে  যা যা করতো মুসলমানরাও তা তা করে । সুতরাং ‘ওমরা’ দেখে মাইমুনার মোহিত হওয়া এক ভয়ঙ্কর গোঁজামিল ছাড়া কিছুই নয়। আর  এর মধ্যে দিয়ে  আরবের ইতিহাস  সম্পর্কে তাঁদের নিদারুণ অজ্ঞতাটাও উন্মোচিত হয়েছে ।  মোদ্দা কথা হলো, মাইমুনা নিজেই তাঁর বিয়ের প্রস্তাব পঠিয়েছিলেন এটা নিশ্চিতভাবেই ইতিহাসসিদ্ধ নয় । তাই মুহাম্মদের কাকা আব্বাসই এই বিয়েতে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন এ তথ্যটা অনেকখানিই বিশ্বাসযোগ্য ও  গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় । যাঁরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইসলামের ইতিহাস ও মুহাম্মদের উপর আলোকপাত করেছেন তাঁরাও বলেছেন আব্বাসের উদ্যোগেই এই বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।  ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী  ঐতিহাসিক আনোয়ার হেকমতও  এই মতই ব্যক্ত করেছেন । তিনি জানিয়েছেন যে আব্বাস তাঁর শ্যালিকাকে তাঁর ভাইপোর হাতে তুলে দিয়েছেন ।  তিনি যা লিখেছেন -  
Muhammad’s marriage with Maymuna was contracted with the help of his uncle, ‘Abbas, who acted as her guardian. In fact, he was giving away his sister-in-law to his own nephew, Muhammad.  [Vide: Women and the Koran, p-66, 67]
আব্বাস নিজে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন নি । তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা ও শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও তাই । তাহলে, তিনি কেনো  মুহাম্মদের সঙ্গে মাইমুনার বিয়ে দিতে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন ? এর পশ্চাতে নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো । সেটা উদ্ঘাটন করতে গিয়ে আনোয়ার লিখেছেন যে আব্বাস ছিলেন একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং  অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব। তিনি এটা বুঝতে পারছিলেন যে আরব উপদ্বীপের শক্তির ভারসাম্য ক্রমশঃ মুহাম্মদদের অনুকূলে ঢলে যাচ্ছে এবং নিশ্চিতভাবে মুহাম্মদই হতে যাচ্ছেন সেখানকার ভবিষ্যতের নায়ক ও ক্ষমতার মালিক ।  তাই তিনি তাঁকে খুশি করার জন্যে তাঁর সঙ্গে তাঁর শ্যালিকা মাইমুনার বিয়ে দিয়েছিলেন । এদিকে মুহাম্মদও শুধু হজ করতেই মক্কা যান নি । তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো মক্কার  কোরেশদের মধ্যে থেকে কিছু লোককে  ইসলামের পতাকার নীচে নিয়ে আসা  । তার জন্যেই তিনি  একটা উপায় খুঁজছিলেন কীভাবে নির্ধারিত তিনদিনের থেকে কিছু বেশী সময়  মক্কায় অবস্থান করা যায়    এ মতাবস্থায় মাইমুনাকে বিয়ে করার জন্যে আব্বাসের প্রস্তাব তাঁর কাছে যেনো মেঘ না চাইতেই জলের মতো আশীর্বাদ হয়ে ঝরে পড়লো মাইমুনা একদিকে রূপবতী ও যৌবনবতী নারী, তারপর একজন ধনী ব্যবসায়ী, সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী ব্যক্তির কন্যা । সুতরাং মাইমুনাকে বিয়ে করলে যেমন  মন পছন্দ আর একজন স্ত্রী পাওয়া যাবে যে স্ত্রী কোরেশদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্র সহায়ক  হতে পারে , এবং বিয়ে উপলক্ষ্যে মক্কায় অবস্থান কালের নির্ধারিত তিনদিনের সময়সীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রও তৈরী হবে    মুহাম্মদ তাই আব্বাসের প্রস্তাবে হাসি মুখে সম্মতি দিতে তিলমাত্র বিলম্ব করেন নিমুহাম্মদ যে তিনদিনের অধিক সময় মক্কায় অবস্থান করতে চেয়েছিলেন তা মুহাম্মদের মুসলিম জীবনীকাররাও অস্বীকার করেন না ।  সাদাত আলি মার্টিন লিঙ্গসকে উদ্ধৃত করে   লিখেছেন, “ হযরত যখন মুলতুবি হজ্ব সম্পন্ন করলেন, তৃতীয় দিনে কোরেশরা এসে হযরতকে বললেন, ‘সময় শেষ, সুতরাং বিদায় হও ।’ ইতিমধ্যে বিবি মাইমুনার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ [সাঃ] – এর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে মহানবী [সাঃ] কোরেশদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘একটু সুযোগ দিলে তোমাদের কি কষ্ট হবে, আমি বিবাহ-উৎসবে তোমাদের জন্যে ভোজ দিচ্ছি ?’ কিন্তু কোরেশগণ কোন সময় দিতে রাজি নয় ।”  [দ্রঃ মহানবী [সঃ] এঁর বিবাহ, পৃ – ১২৪, ১২৫]  ঐতিহাসিকরা অনেকেই এই মত পোষণ করেছেন যে, মাইমুনাকে বিয়ে করার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিলো । মাইমুনাকে বিয়ে করে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পরেই তাঁর [মাইমুনার]  দিদির ছেলে প্রখ্যাত বীর খালিদ দু’জন বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী কোরেশকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় গিয়ে ইসলামের পতাকা গ্রহণ করেন । এ প্রসঙ্গে কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন, “এই বিবাহের এক আশ্চর্য ফল ফলিল । বীর কেশরী খালিদ ছিল মাইমুনার আপন ভগিনীর পুত্র । পাঠকের নিশ্চয় স্মরণ আছে এই খালিদের অসাধারণ বীরত্ব ও রণচাতুর্যের ফলেই ওহদ-যুদ্ধে মুসলমানদিগের ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটিয়াছিল । মাইমুনার বিবাহের পরই খালিদ অপ্রাত্যাশিতভাবে মদিনায় গিয়া হযরতের হাতে হাত রাখিয়া ইসলাম গ্রহণ করিলেন । শুধু কি খালেদ ? আরও দুইজনকে তিনি সঙ্গে লইয়া গেলেন । একজন মক্কার প্রখ্যাত কবি আমর ইবনুল আ’স অন্যজন কাবা গৃহের কুঞ্জি-রক্ষক ওসমান-বিন তালহা । এই তিনজন শক্তিমান পুরুষের ইসলাম গ্রহণে কোরেশদিগের মেরুদণ্ড যে একেবারে ভাঙিয়া পড়িল সে কথা বলা বাহুল্য ।   [বিশ্বনবী, পৃ-২৩০]   
এর পরেও সংশয় থেকে যায় - মুহাম্মদ ও মাইমুনার বিয়ে কি সত্যিই তিন দিনের স্বল্প পরিসরেই আকস্মিকভাবে সংঘটিত হয়েছিলো ?  না কি এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো ঢের আগে থেকে ? আর শুধু কি মাইমুনার খাতিরেই খালিদ স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ? না কি এর পেছনে অন্য কোনো বড়ো কারণ নিহিত ছিলো ? এরূপ সংশয় বা প্রশ্নগুলিকে অবান্তর বলে উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে  না । এই প্রশ্নগুলির জবাব অন্বেষণ করার জন্যে  মুহাম্মদ তখন কীভাবে প্রায় রকেটের গতিতে  তাঁর সামরিক ও আর্থিক শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি  করে মক্কা বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সে কথাটা এই পরিসরে হিসেবের মধ্যে রাখা দরকার । মদিনায় আসার পর  মাত্র ৫/৬ বছরেই  মুহাম্মদ  অঢেল সম্পত্তির মালিক ও বিরাট বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন   তাঁর শিষ্যরাও একই সাথে প্রত্যেকেই বিত্তবান  হয়ে উঠেছে । রাতারাতি এভাবে  বিত্তবান হয়ে ওঠার ঘটনা ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ প্রবাদকেও যেনো  হার মানায় । এ খবর  নানা সূত্রে মক্কার কোরেশদের কানে ক্রমাগত পৌঁছে  যাচ্ছিল  যা তদের অনেককেই প্রলুব্ধ করছিলো এবং   ইসলামের দিকে হাতছানি দিচ্ছিলো  মুহাম্মদ ও মুসলমানদের রাতারাতি এরূপ ধনী হয়ে ওঠার খবর যে স্রেফ  মিথ্যে বা গুজব নয়  তার এক ঝলক তারা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছিলো  আগের বছরই [৬ষ্ঠ হিজিরীতে] মুহাম্মদ যখন বিরাট  দলবল নিয়ে  হজ করতে এসে ফিরে গিয়েছিলো কেবল একটি চুক্তি [হুদায়বিয়ার চুক্তি] সম্পদন  করে তখন তাঁর সঙ্গে ছিল ১৫০০ জন মুসলমান এবং কোরবানি দেওয়ার জন্যে ছিলো ৭০টি উট । মুহাম্মদের এই জনবল ও অর্থবল কোরেশরা কমবেশী  সবাই চাক্ষুস করেছিলো । তারা এ খবরও অবগত হয়েছিল যে যারা মুহাম্মদের  সঙ্গে ডাকাতি, রাহাজানি, হত্যাকাণ্ড ও লুটপাঠে অংশ নেয় তারা  শুধু প্রচুর অর্থই নয়, তার সঙ্গে ভাগে পাচ্ছে বিধর্মী নারীও  এ খবরে  মরুবাসী মেষপালকদের মনে ঝড় ওঠারই কথা ।  ওঠেওছিলো । খবরটা তাই বৈদ্যুতিক চুম্বকের মতো  তাদের ক্রমাগত আকর্ষণ করছিলো । আর মরুবাসী কোরেশদের মনের এই  খবর  সম্পর্কে মুহাম্মদও  ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন । ফলে  মক্কার সে সব  কোরেশদের  সঙ্গে মুহাম্মদের কিছু লোকের মাধ্যমে  গোপনে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতেন   এক্ষেত্রে তাঁর কাকা আব্বাস  ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম  হুদায়বিয়া চুক্তি সম্পাদন করে ফিরে যাওয়ার সময় খুব সম্ভবত মুহাম্মদ তাঁর কাকা আব্বাসের সঙ্গে এ বিষয়ে বিশদে কিছু আলোচনা করে গিয়েছিলেন র তারই ফলশ্রুতিতে মাইমুনার সঙ্গে বিয়ে এবং খালিদের ইসলাম গ্রহণের  ঘটনা ঘটেছিলো 
মুহাম্মদ ও মাইমুনার বিয়ের সঙ্গে আর একটা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যোগ আছে । সেটার  উল্লেখ  উল্লেখ না করলে মুহাম্মদ ও মাইমুনা উপাখ্যানটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে । ঘটনাটির উল্লেখ আবশ্যক আর একটি কারণে, কারণ এটি মুহাম্মদের একটি বিশেষ চারিত্রিক ও নৈতিক বৈশিষ্টকে উন্মোচিত করতে সাহায্য করে ।  হজ পালনের সময় অবশ্য পালনীয় কিছু বিধি-নিষেধ আছে যা প্রত্যেকের জন্যে সমানভাবে প্রযোজ্য ।   হজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময়  কা’বা শরীফে অবস্থান কালে  স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা নিষিদ্ধ । এ নিষেধাজ্ঞার প্রথা চলে আসছিলো ছিলো প্রাক-ইসলাম যুগ থেকেই যাকে  মুহাম্মদ বাতিল  করেন নি   সুতরাং এই প্রশ্নটা অবধারিতভাবে মুসলিমদের তাড়া করে যে, মুহাম্মদ ঠিক কোথায় মাইমুনাকে বিয়ে করেছিলেন এবং বিয়েটা যাপন করেছিলেন কোথায় ? এ প্রশ্নে মুসলিম লেখকদের মধ্যে প্রবল মতভেদ দেখা যায় এবং   তাঁরা  দুটি পরষ্পরবিরোধী তথ্য পরিবেশন করে থাকেন । একদল বলেন যে, মুহাম্মদ মক্কা নগরী থেকে ৮/৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত সারফ নামক স্থানে মুহাম্মদ ও মাইমুনার বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এবং সেখানেই মুহাম্মদ বিয়েটা যাপন করেছিলেন । অন্য দল বলেন যে, বিয়েটা হয়েছিলো মক্কাতেই, কিন্তু মুহাম্মদ মক্কায় অবস্থানকালীন বিয়েটা উদযাপন করেন নি,  অর্থাৎ ঐ তিন দিন মাইমুনার সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা থেকে বিরত ছিলেন  এ দুটো মতই  বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না ।  তার কারণ হলো,  বিধবাদের সঙ্গে বিয়ে ও তাদের  সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মুহাম্মদ এর পূর্বেও কয়েকবারই ইসলামি নিষেধাজ্ঞা হেলায় লঙ্ঘন করেছেন  স্বামী মারা গেলে বিধবাদের ক্ষেত্রে ইসলামের  বিধি হলো পুনরায় বিয়ের আগে  চার মাস দশ দিন অপেক্ষা  করা  এই সময়কালটাকে ইসলামের পরিভাষায় বলে  ‘ইদ্দত’ । মুহাম্মদ  ইহুদি নারী রায়হানা ও জুয়াইরিয়ার ক্ষেত্রে এই বিধি লঙ্ঘন করেছিলেন ।  তাঁর শিষ্যরা তাঁরই নির্দেশে  এই  দু’জন নারীর স্বামীদের যেদিন হত্যা করেছিলো সেদিনই  তিনি তাঁদের বিয়ে করেছিলেন এবং সে রাত্রেই তিনি তাঁদের সঙ্গে যৌনক্রিয়াও করেছিলেন । পরে আর একজন ইহুদি নারী সাফিয়ার বেলাতেও তিনি একই ভাবে  ইদ্দত বিধির লঙ্ঘন করেছিলেন । এই নৃশংস ও অমানবিক বিবাহ-উদযাপনের কথা সর্বজন বিদিত ।  সুতরাং এটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য যে মুহাম্মদ মাইমুনাকে মক্কা শহরে বিয়ে করেছিলেন এবং  সেখানেই  বিয়েটা  উদযাপন করেছিলেন   




KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...