Wednesday, April 15, 2015

ভাগবত-মোদি জুটির নেতৃত্বে ভারতে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে



গত লোকসভা [২০১৪] নির্বাচনের আগে আরএসএস বা তার প্রধান তথা সঙ্ঘচালক ভাগবত সামনে আসেন নি।  আরএসএস এবং বিজেপি উভয়েই বলেছিলো যে আরএসএস একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন  ও বিজেপি একটি স্বাধীন রাজনৈতিক দল, দুটোই চলে স্বাধীনভাবে। আরএসএস আরো বলেছিলো যে বিজেপি ক্ষমতায় এলে সরকারের উপর তারা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবে  না। কিন্তু আরএসএস ও বিজেপি যে পরষ্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয় সে কথাটা অনেকের কাছেই অজানা ছিলো না। আবার এটাও সত্যি যে এই তথ্যটা বেশীরভাগ মানুষরেেই জানা ছিলো না। ফলে বহু মানুষই আরএসএস ও বিজেপির কথায় বিশ্বাস  স্থাপন করেছিলোএখন মানুষের মন থেকে সেই বিশ্বাসটা ক্রমে ক্রমে ফিকে হয়ে আসতে শুুুরু করেছে গত লোকসভা নির্বচনের আগে নরেন্দ্র মোদির মুখে উন্নয়ন, সুশাসন ও সুদিনের যে শ্লোগান ছিলো সেটা আসলে যে মুখোশ ছিল তা ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে এটাও যে কেন্দ্রীয় সরকারের রিমোট কণ্ট্রোলটি রয়েছে আরএসএসের হাতেই,  মোদির হাতে নয়।  কেন্দ্রীয় সরকারের বয়স এখনও দু' বছর পূর্ণ হয় নি, অথচ ইতিমধ্যেই এমন  বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা  আরএসএস ও বিজেপির মধ্যেকার আড়ালে থাকা গূঢ় সম্পর্কের রসায়নটি মানুষের কাছে অনেকটাই দৃশ্যমান করে তুলেছে। সেই ঘটনাগুলি উল্লেখ করার আগে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক মানুষ কেনো মোদির উপর আস্থা রেখেছিলো।
  
কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতা মোদির পথ প্রশস্ত করেছে 

কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের টানা দশ বছরের জনবিরোধী শাসন, ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ও সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি  জনগণকে বেজায় অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো যার ফলশ্রুতিতে মানুষ কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকারকে আর একদমই চাইছিলো না। জনগণের এই মনোভাবটি নরেন্দ্র মোদি ভালোভাবেই পড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই [আরএসএস নেতাদের সঙ্গে বোঝাপারার ভিত্তিতে] তিনি আরএসএসকে পেছনে একেবারে পর্দার আড়ালে রেখে বিজেপির ঝাণ্ডা নিয়ে  নির্বচনী আসরে  অবতীর্ণ হন নির্বাচনী প্রচারে  তিনি বলেছিলেন যে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানো তাঁর লক্ষ্য নয়, তাঁর লক্ষ্য ভারতের উন্নতি ও বিকাশ সাধন করা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য হ্রাস করা, দুর্নীতি মুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন উপহার দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।  যারা কংগ্রেসের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও ক্ষুব্ধ, কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ঘৃণা করেন তাদের একটা অংশও মোদির এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো। এমনকি মুসলিমরাও কংগ্রেসের প্রতি এতো বিরূপ ও ক্ষুব্ধ ছিলো যে তাদেরও  একটা অংশ চেয়েছিলো  কংগ্রেস যেন ক্ষমতায় আর ফিরে না আসে তাতে বিজেপি আসে আসুক। তাদের মধ্যে এ রকম বিশ্বাস তৈরী হয়েছিলো যে  মোদি যদিও আরএসএস লোক, তবুও তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে আরএসএসের হিন্দুত্বের নীতি ও আদর্শ রূপায়ণ করার চেষ্টা থেকে বিরত  থাকবেন, কারণ তিনি তো ভারতের সংবিধানকে উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।  ফলে গত নির্বাচনে চারিদিক থেকে বিপুল সংখ্যক নেতিবাচক ভোট বিজেপির পক্ষে যায় এবং বিজেপি একা নিরঙ্কুশ  সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার তৈরী করতে সক্ষম হয়  
এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মোদিজীকে এনডিএ-এর শরিকদলগুলির প্রতি নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেয়ফলে মোদিজী সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁর আসল এজেণ্ডা  যথাসম্ভব রূপায়ণের ক্ষেত্রে  অতি দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠেনতিনি যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সে কাজ  করছেন তা কিন্তু নয়।  অতি সন্তর্পণে ও আড়াল-আবডাল রেখেই সে কাজ করে যাচ্ছেন। মুখে অবশ্য উন্নয়ন ও সুশাসনের কথাই বলছেন, কিন্তু ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর লক্ষ্যে যা যাা করার সেগুলি করছেন ভিতর ভিতর। মোদিজী ও তাঁর দল এমন এক হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চায় যেখানে হিন্দু ধর্ম, হিন্দু সংস্কৃতি এবং  হিন্দুদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকবে। তাঁরা সেই ভারতের স্বপ্ন দেখেন যে ভারতে থাকবে শুধু একটাই ধর্ম [হিন্দু ধর্ম], একটাই ভাষা [হিন্দি ভাষা] এবং একজন নেতা (মোদি)। আর হিন্দুদের আধিপত্য মানে বর্ণ হিন্দুদের আধিপত্য। কিন্তু মোদি এটা ভালো করেই জানেন যে এ কাজটা করবো বললেই সহজে করা সম্ভব নয়, কারণ দেশের সংবিধানটি তিনি ইচ্ছা করলেই  পাল্টে দিতে  বা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন না। সে কাজ সংবিধান সংশোধন করেই তবে করা সম্ভব। কিন্তু তা করতে লাগবে সাংসদের দুু' কক্ষেই (লোকসভা ও রাজ্যসভায়) তাঁর দল বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবশ্যক। লোকসভায় তা থাকলেও রাজ্যসভায় নেই। রাজ্যসভায় তা অর্জন করতে তাঁদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দু' কক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই হবে না, সংবিধান সংশোধন করতে দু'ই তৃতীয়াংশের সমর্থনও লাগবে। সে তো আজও দূর অস্ত।  তা হলে কি  হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করার কাজ স্থগিত রাখতে হবে? ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে? না, তা হতে পারে না। সঙ্ঘ নেতারা ঠিক করেন  বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই রাষ্ট্রশক্তি  ও সাংগঠনিক শক্তির জোরে  প্রশাসনে এবং সামাজিক জীবনের শাখা-প্রশাখায় বহু ক্ষেত্রেই হিন্দুত্বের আদর্শ ও আচার-অনুষ্ঠান চাপিয়ে দেওয়ার যে সুযোগ আছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। না, এটা অবাস্তব কোনো আইডিয়া বা পরিকল্পনা নয়,  সংবিধান  সংশোধন না করেও এটা অনেকাংশেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর হাতে রয়েছে অশেষ ক্ষমতা, এবং আরো কয়েকটি রাজ্যে তাঁর দলের লোকেরাই মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও মুুখ্যমন্ত্রীদের ক্ষমতাগুলি ব্যবহার করে তা করা সম্ভব। তাই বিজেপি কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরপরই দেশজুড়ে হিন্দুত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে আরএসএস বিলম্ব করে নি। রীতিমতো পরিকল্পনা করে কাজে নেমে পড়ে। একদিকে সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত এবং  অন্য দিকে নরেন্দ্র  মোদি তাঁদের সমগ্র বাহিনীকে আসরে নামিয়ে দেন সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্যে    

ভগবত-মোদি জুটির নেতৃত্বে হিন্দুত্বের অভিযান 

একদিকে সঙ্ঘ পরিবারের সকল শাখা সংগঠন, বিশেষ করে বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরং দল, দূর্গাবাহিনী জোর কদমে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং ভাগবতঅপরদিকে মোদির ইশারায় তাঁর মন্ত্রীসভা ও সংসদের কিছু সদস্য এবং বিজেপির রাজ্য সরকারগুলিও সেই কাজে শামিল হয়েছে ত্রিমুখী কৌশল নিয়ে তাঁদের হিন্দুত্বের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তার প্রথমটি হলো ভয়ানক মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুত্বের পক্ষে জনমত এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি অবিশ্বাস, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়টি  হলো, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও রাজ্য সরকারগুলির ক্ষমতাকে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদী ভাবনা ও কর্মসূচিগুলিকে যথাসম্ভব বাস্তবায়িত করা।তৃতীয়টি  হলো, কোথাও প্রলোভন ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে, কোথাও দমনপীড়নের মাধ্যমে অহিন্দুদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা। ওদের ভয়ানক ও  বিষাক্ত সেই মিথ্যা ও উস্কানিমূলক প্রচারণার কয়েকটা নমুনা এ রকম। মোহন ভাগবত খোলাখুলিই প্রচার করছেন যে  ভারতবাসী মানেই হিন্দু। ভারতের মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকটি শিশুই হিন্দু, কারণ ভারত  হলো হিন্দুদের পবিত্র ভূমি। কারণ, এ দেশে অহিন্দু যারা বাস করে তাদের পূর্ব পুরুষরাও ছিলো হিন্দু। তাদের জোর করে বৌদ্ধ, মুসলমান ও খৃষ্টান বানানো হয়েছে। তাই তিনি অহিন্দুদের সবাইকে ঘরে ফেরার  [হিন্দু  ধর্ম গ্রহণ করার] ডাক দিয়েছেন। শুধু ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, ভারতের অধিবাসী সমস্ত অহিন্দুদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রক্রিয়াও শুরু করে দিয়েছেনএই প্রক্রিয়ায় তাঁদের উল্লেখযোগ্য দুটি শ্লোগান বা কর্মসূচী হলো ‘ঘর ওয়াপসি’ ও ‘লাভ জিহাদ’। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা প্রবীণ তোগাড়িয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর ব্যাপারে খুবই পটু। তিনি বীরভূম জেলার রামপুরহাটে সম্প্রতি [২৮শে জানুয়ারি ২০১৫]  তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে সেই বিষাক্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ উগড়ে দেন  মুসলিমদের বিরুদ্ধে। রাজ্য সরকারের কাছে তিনি দাবি জানান  যে অবিলম্বে বাংলাদেশি মুসলমানদের ভারত থেকে তাড়াতে হবে। আসলে সব মুসলমানদের সম্পর্কেই বলেছেন ওকথা, কারণ তাদের হিন্দুত্বের দর্শন অনুযায়ী ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র যেখানে অহিন্দুদের স্থান নেই। তিনি আরো বলেন যে, মুসলমানদের তাড়ানোর ব্যবস্থা না করলে ঢাকা থেকে যেমন হিন্দুদের পালিয়ে আসতে হয়েছে, তেমনি এই রাজ্য  থেকেও হিন্দুদের পালাতে হবে। তিনি যে আসলে সব মুসলমানদের উদ্দেশ্যেই বলেছেন তা স্পষ্টই বোঝা যায় তাঁর অমৃত [!] ভাষণের পরের অংশে। সেখানে হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেছেন -   বাংলাদেশি মুসলমানদের  ঢাকায় পার্সেল করে দিন। আপনাদের সঙ্কল্প নিতে হবে – বাংলাদেশি মুসলমানদের এ রাজ্যে থাকার জায়গা দেবেন না। তাদের কাজ করতে দেবেন না, তাদের ঘর ভাড়া দেবেন না, তাদের কাছ থেকে সব্জী কিনবেন না, তাদের কাছে চুল কাটবেন না, তাদের রিক্সায় চাপবেন না, তাদের দিয়ে কোনো কাজ করাবেন না, তাদের কাজে লাগাবেন না, ইত্যাদি। রামপুরহাটে যদি বাংলাদেশি মুসলমান কিছু থেকেও থাকে তবে তারা সংখ্যায় কতজন আছে যে তারা  দলে দলে সব্জী বিক্রি করে, রিক্সা চালায়, চুল কাটে, ঘর ভাড়া করে থাকে, দিন মজুরী করে? আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর এ এক ঘৃণ্য কৌশল বৈ নয়। কেনো এমন আশঙ্কা করছেন যে মুসলমানদের তাড়াতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পালাতে হবে তার বাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, মমতা দিদি তিন কোটি বাংলাদেশি মুসলমানকে ভোটে জেতার জন্যে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। তারা দশটি করে সন্তান নিয়ে ত্রিশ কোটি হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। সঙ্ঘ পরিবারের  এই মিথ্যে প্রচারণা  নতুন কিছু নয়। এতদিন তারা এ প্রচারণা চালাতো গোপনে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর করছে প্রকাশ্যেই।মুসলিমদের জন্মহার বেশী ঠিকই, কিন্তু এটা চূড়ান্ত মিথ্যে যে তারা দশটা করে এখন সন্তান জন্ম দেয়। ২০০১ ও ২০১১ - এর আদমশুমারির রিপোর্ট বলছে যে মুসলিমদের জন্মহার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং তা ক্রমহ্রাসমান। তবুও তারা হিন্দুদের মধ্যে  উন্মাদনা সৃষ্টি করার জন্যে এসব প্রচার করে থাকে। অপরদিকে হিন্দু নারীদের বহু সংখ্যক সন্তান জন্ম দেওয়ার পরামর্শও দেওয়াা হচ্ছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক নেত্রী স্বাধ্বী প্রাচী উত্তর প্রদেশে একটি জনসভায় সম্প্রতি বলেছেন হিন্দুদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে হিন্দু নারীদের কমপক্ষে চারটি সন্তান প্রসব করতে হবে। কেউ কেউ তো আবার দশটি সন্তান জন্ম দেওয়ারও ডাক দিচ্ছে।বিজেপির  পক্ষ থেকে কেউ কেউ স্বাধ্বীর এই বক্তব্যের সমালোচনা  করেছেন বটে, তবে তা নেহাতই লোক দেখানো। স্বাধ্বী প্রাচী সেই সমালোচনাকে  কটাক্ষ করে  কয়েক দিন পরেই উত্তর প্রদেশেরেই বদায়ুঁতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আর একটি জনসভায় বলেন যে, “আমি চার সন্তানের জন্ম দিতে বলেছি, ৪০টি কুকুরের বাচ্চার জন্ম দিতে তো বলি নি।” ওই সভাতেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে বহু সন্তানের জন্ম দেওয়া অভিভাবকদের সম্বর্ধনাও দেওয়া হয় লাভ জিহাদ এখন সঙ্ঘপরিবারের আর একটি কর্মসূচী। এর উদ্দেশ্যও সেই একই অর্থাৎ মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মন বিষিয়ে দেওয়া। এই কর্মসূচিতে তাদের প্রচার হলো মুসলিম যুবকরা ভালোবাসার প্রলোভন দেখিয়ে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করছে তাদের ধর্মান্তরিত করার জন্যে তারা হিন্দু যুবকদের বলছে, তোমরাও মুসলিম মেয়েদের ভালোবাসার প্রলোভন দেখাও, তারপর  ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করো। আর অপরদিকে হিন্দু নারীদের বলছে তোমরা মুসলিম যুবকদের ভালোবাসার ফাঁদে পড়ো না। এ প্রসঙ্গে বদায়ুঁর সেই সভায় স্বাধ্বী প্রাচী যা বলেছেন তা যেমন কুৎসিৎ তেমনই অশ্লীল। স্বাধ্বীর সেই মণি-মুক্তো ছড়ানো ভাষণের অংশ হলো -  “লাভ জিহাদের নামে মুসলমানরা আমাদের মেয়েদের ফাসাচ্ছে,  ... তারপর এই হিন্দু মেয়েরাই মুসলিম হয়ে ৩৫-৪০ জনের জন্ম  দিচ্ছে।”  তিনি প্রশ্ন করেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায় শুধু কেন হিন্দুদের উপরেই বর্তাবে? লাভ জিহাদ প্রসঙ্গে ম্যাঙ্গালুরুতে ৩/৩/১৫ তারিখ একটি জনসভায় আর একজন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেত্রী সাধ্বী বালিকা সরস্বতী মিশ্র যে ভাষণ দেন তা আরো উত্তেজক ও উস্কানিমূলক। বালিকা সাধ্বী হিন্দু মেয়েদের মুসলিম যুবকদের পাথর ছুঁড়ে মারার ডাক দিয়েছেন।  ভিএইচপির সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে মধ্যপ্রদেশের নেহেরু ময়দানে একটি জনসভায় এই নেত্রী বলেন, “মুসলিম যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কীভাবে তারা হিন্দু মেয়েদের ফাঁসাবে এবং ইসলামের অন্তর্ভুক্ত করবে। ..  আমি হিন্দু মেয়েদের বলছি আপনারা মুসলিম যুবকদের থেকে দূরে থাকুন। কেউ যদি প্রেম নিবেদন করে তাহলে তাদের পাথর ছুঁড়ে মারুন। ... বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু মেয়েদের মুসলিম বানিয়ে ফেলা হয়। এইভাবে বাড়ছে মুসলিমদের জনসংখ্যা। তারা বিয়ে করে একের পর এক সন্তান ধারণ করতে বাধ্য করে।” তিনি আরো বলেন যে, "এক একজন হিন্দু মেয়েকে ১০-১৫টি বাচ্চার জন্ম দিতে হয়।” নরেন্দ্র মোদি সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যদেরও হিন্দুত্বের প্রচারে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রী স্বাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি বলেছেন হিন্দুদেরই কর্তব্য হলো হিন্দুত্বের অভিযানে  বিজেপিকে সমর্থন করা।একটি নির্বাচনী জনসভায় তিন বলেন, যারা মোদির পক্ষে তারা রামজাদা, যারা বিপক্ষে তারা হারামজাদা। 
এই একই ফ্যাসিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর গলাতেও, তবে তা ছিলো সংসদীয় প্রলেপ মাখানো। আরএসএসের একটি গুরুত্বপূর্ণ  কর্মসুচী হলো ভারতে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা।  বিগত শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ – এর দশকে হিন্দুত্ববাদীরা এই ইস্যুতে গোটা দেশ জুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। তারপর এই ইস্যুটি নিয়ে আর বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় নি। এমনকি বিজেপি যখন কেন্দ্রের ক্ষমতায় এসেছিলো বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সে সময়েও নয়। সেই ইস্যুটি নিয়ে এখন আবার  সরব সঙ্ঘপরিবার। সঙ্ঘপরিবারের সুরে সুর মিলিয়ে বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার  সারা  দেশে [ঐক্যমতের ভিত্তিতে] গো-হত্যা বন্ধ করার  চেষ্টা করবে।  ৩০শে মার্চ’১৫ ইন্দোরে শ্বেতাম্বর জৈনদের ধর্মগুরুদের সম্মেলনে তিনি এই  ঘোষণা দেন‘ঐক্যমতের’ চেষ্টার কথা বলে তিনি সুকৌশলে তাঁদের ফ্যাসীবাদী ভাবনা ও কণ্ঠস্বরটিকে আড়াল করেছেন। তারপর তিনি আরো বলেন যে, “মহারাষ্ট্র সরকার  যখনই  গো-হত্যা বন্ধে বিল এনে কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছে, আমরা সেই বিল তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, বিন্দুমাত্র দেরী করি নি।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাষ্ট্রপতিও [তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব প্রণব মুখার্জী]  সেই বিলে স্বাক্ষর করে বিলটিকে আইনে রূপান্তরিত করতে বিলম্ব করেন নি। রাজনাথ  সিং-এর এই কথায় এটা স্পষ্ট যে আরএসএসের গোহত্যা বন্ধের ইস্যুটি মোদির সরকার রূপায়ণে বদ্ধপরিকর যদিও মোদি নিজে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আরএসএস ও বিজেপি এভাবে রাজ্য সরকারের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে গো-হত্যা বন্ধের হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচীটি যে রুপায়ণ করতে চাইছে  মহারাষ্ট্রের সরকারের পাঠানো গো-হত্যা রদ করা বিলটি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করার ঘটনা তার জ্বাজল্যমান প্রমাণ। রাষ্ট্রপতি উক্ত বিলে স্বাক্ষর করার পর হিন্দুত্ববাদীরা গো-হত্যা ইস্যুতে অতি মাত্রায় আগ্রাসী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে।  যেখানে গো-হত্যা নিষিদ্ধ সেখানে  কেউ যদি গো-মাংস খায় তবে তার বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাকে শাস্তি দিতে পারে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা  আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই সংখালঘু মুসলমানরা কোথাও গো-মাংস খাচ্ছে কী না তার নজরদারী শুরু করছে এবং তাদের ঘরে ঢুকে খানা-তল্লাশী শুরুু করছে। হিন্দুত্ববাদীরা এমনকি  গো-মাংস ইস্যুকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্ত্যাচার করার একটি হাতিয়ারও বানিয়ে ফেলেছে। গত বছর (২০১৫) এটাকে ইস্যু করে তারা বহু জায়গায় মুসলিমদের উপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছে যে অত্যাচারে চারজন মুসলমানের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। তার মধ্যে হরিয়ানার দাদরির ঘটনাও রয়েছে যেখানে আখলাক নামক একজন বৃদ্ধ মানুষ নিহত হন। ঘটনাটি নিয়ে গোটা দেশে তোলপাড় হয়। আখলাকের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যে অভিযোগে তাঁকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে একদম ঠাণ্ডা মাথায় হিন্দুত্ববাদীরা হত্যা করে। আখলাকের বাড়ির ফ্রিজের মাংস পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে সেগুলো খাসির মাংস ছিলো। সেই ঘটনার কয়েকদিন পরই দিল্লীর পুলিশ বিনা অনুমতিতে দিল্লীতে কেরালা ভবনে গিয়ে হানা দিয়েছিলো গো-মাংস আছে এই মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে। এভাবে পুলিশ ও হিন্দুত্ববাদীরা গোটা দেশজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করতে চাইছে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। গো-মাংস ইস্যুতে পুলিশ ও হিন্দুত্ববাদীদের এই আগ্রাসী স্বৈরুতান্ত্রিক ভূমিকার বিরুদ্ধে গোটা দেশে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও প্রাধানমন্ত্রী এবং বিজেপি দল চুপচাপ ছিলো যা প্রমাণ করে যে হিন্দুত্ববাদীরা যা করছে তাতে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপির অনুমোদন আছে। তাঁদের অনুমোদন যে আছে সেটা আরো স্পষ্ট করে দেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যেই বলেন যে গো-মাংস যারা খেতে চায় তারা পাকিস্তান চলে যাক। গো-হত্যা বন্ধ করা  একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতির পরিপন্থীকে কী খাবে, কী খাবে না,  তা ব্যক্তির নিজস্ব রুচি ও অধিকারের বিষয়, এবং এটা একটা মৌলিক অধিকারও বটে। এই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে নামানুষের এই অধিকার রক্ষা করাই রাষ্ট্রের কর্তব্য অথচ মোদি সরকার সেই অধিকারটি রক্ষা না করে হরণ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে  যার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসীবাদের ঝোঁক ও লক্ষণ স্পষ্টতঃ ফুটে উঠছে।  মোদিও স্বয়ং  গত গুড ফ্রাইডের দিনে, ৪ঠা এপ্রিল ২০১৫, একটা বার্তা দিয়ে রাখলেন যে ভারতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলিকে তাঁরা [হিন্দুত্ববাদীরা]  গুরুত্বহীন করে তুলতে চান এবং সংখ্যালঘুদের তা মেনে নিতে হবে। গুড ফ্রাইডে খৃস্টানদের কাছে একটি বিশেষ পবিত্র দিবস এবং এই দিনটিতে তাদের কাছে একটি  উৎসবের দিনও বটে। তাদের বিশ্বাস এই দিনেই যীশুকে ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিলো, কিন্তু দুদিন পর যীশু পুনর্জীবন লাভ করেন এবং হেঁটে স্বর্গে চলে যান। এই দিনটিতে ভারতে  সরকারি ছুটি থাকে যাতে খৃস্টানরা সপরিবারে উৎসব পালন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এবার খ্রিষ্টানদের এই উৎসবের দিনটিতে বিচারপতিদের সম্মেলন করলেন যা অতীতে কখনও ঘটে নি। স্বভাবতঃই খ্রিষ্টান সমাজ এতে আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে। এর প্রতিবাদ করে চিঠি  দেন সুপ্রীম কোর্টের খ্রিষ্টান  সম্প্রদায়ের একজন বিচারপতি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সম্মেলনের দিনটি অপরিবর্তিতই রেখে দেন। এটা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতপূর্ণ ঘটনা। এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে ভারতের বর্তমান ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ  নরেন্দ্র মোদির পছন্দ নয়, এবং তাঁর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হলো সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করা। এই পরিসরে আর একটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা খুবই প্রাসঙ্গিক হবে। এবারের ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র শব্দদুটি ছিলো না। প্রথমে প্রায় সকলেরই ধারণা হয়েছিলো যে ভুলক্রমে শব্দদুটি ছুটে গেছে। সেই ভুল নিয়ে যখন চারিদিকে হৈচৈ  শুরু হয় এবং দ্রুত সশোধনের দাবি ওঠে তখন শিবসেনার পক্ষ থেকে  জানানো হয় যে ভুল যদি হয়ে থাকে তবে সে ভুলটাই থাক এবং সেটাই যেন চিরকাল থাকে, কারণ তাতে ভারতবাসীর মনের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারও জানিয়ে দেয় যে, সরকার কোনো ভুল করে নি। এই ঘটনাটিও আগের ঘটনাটির মতোই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ হলো হিন্দুরাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী। সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও  সমাজতন্ত্র শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার ক্ষমতা এই মূহুর্তে মোদি সরকারের হাতে নেই। মোদিজী তাই  সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে শব্দ দুটি তুলে দিয়ে তাঁর মনোভাবটিি প্রকট করেছেন শিবসেনার মুখপত্র সঞ্জয় রাউত সম্প্রতি সামনায় [শিবসেনার মুখপাত্র] একটি নিবন্ধে লিখেছেন যে মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত।তিনি যা বলেছেন তা যে শিবসেনারই  মত  সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখেছেন -  বালাসাহেব এক সময় মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ওয়াইসি ভাইরা মুসলিমদের ভোট নিয়ে রাজনীতি করছে। তারা জাতির জন্য বিপজ্জনক। রাউত আরো লিখেছেন – মুসলিমদের ভোট নিয়ে যেভাবে রাজনীতি করা হয়, তাতে তাদের উন্নতি তো হয় না, উল্টে গোটা দেশের ক্ষতি হয়। মুসলিমরা কাকে ভোট দেবেন তা আগে ঠিক করতেন  জামা মসজিদের ইমাম। এখন ঠিক করে ওয়াইসি ভাইরা।

ভারতকে মুসলিম ও খ্রিষ্টান মুক্ত করাই লক্ষ্য

আরএসএসের হিন্দুত্বের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার অভিযানে মিথ্যা প্রচারণা ও রাষ্ট্রশক্তিকে হাতিয়ার করার পাশাপাশি যে হাতিয়ারটি ব্যবহার করছে তা হলো সংখ্যালঘুদের উপর  সশস্ত্র আক্রমণ।  সশস্ত্র আক্রমণ সংগঠিত করে সংখ্যালঘুদের মনে ভয়-ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করার চেষ্টা করছে। এর উদ্দেশ্য হলো ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচীর অনুকূল পরিবেশ তৈরী করা। সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করার পর ধর্মান্তরের প্রক্রিয়াটিকে সহজ করে তোলার জন্যে একটা আর্থিক প্যাকেজর পরিকল্পনাও  তাদের রয়েছে। সেই প্যাকেজে আর্থিক বরাদ্দ হলো,  হিন্দু হলে খ্রিষ্টানদের জন্যে মাথা পিছু দু’ লাখ এবং মুসলমানদের জন্যে পাঁচ লাখ টাকা। আরএসএস ভারতকে খ্রিষ্টান ও মুসলমান মুক্ত করার জন্যে একটা সময়সীমাও নির্ধারণ করেছে। গত বছর [২০১৪] ১৮ই ডিসেম্বর সংখ্যালঘু দিবসে ধর্ম জাগরণ মঞ্চের প্রধান রাজেশ্বর সিং ঘোষণা করেন যে, ২০২১ সালের মধ্যে ভারতকে খ্রিষ্টান ও মুসলিম মুক্ত করা হবে। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য বস্তু হলো খ্রিষ্টানরা, তারপর মুসলিমরা। খ্রিষ্টানরা যেহেতু সংখ্যায় খুবই কম এবং শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করে, তাই তারাই সহজতম শিকার [Soft target]। তাছাড়া তাদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের আক্রোশটাও বেশী,  কারণ চার্চের মাধ্যমে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা বিতরণ করে আদিবাসীদের খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কাজটা পাদ্রীগণ সবার চোখের সামনে এখনো সমানে জারি রেখেছে। মুসলিমদের উপরেও হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে, তবে খ্রিষ্টানদের তুলনায় অনেক কম। সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনাগুলি সব ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের নজরে আসে না এবং কিছু কিছু ঘটনা নজরে আসলেও সেগুলির সব সময় খবর হয় না। ফলে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণাত্মক চেহারাটি এখনও সেভাবে সামনে আসে নি। কিছু কিছু ঘটনা যখন খবর হচ্ছে তখন বিজেপি ও আরএসএসের পক্ষ থেকে সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতিদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছেকিন্তু মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সব থেকে বেশী হামলা হয়েছে গীর্জার উপর। শুধু দিল্লীতেই এই সময়ের মধ্যে ৭/৮ টি গীর্জা আক্রান্ত হয়েছে। শুধু গীর্জা নয়, আক্রমণের শিকার গীর্জার মধ্যে প্রার্থনারত থাকা খ্রিষ্টানরাও, সেই আক্রমণের রেহাই পায় না নারী ও শিশুরাও। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর পরই হিন্দুত্ববাদীরা  গীর্জা ও খ্রিষ্টানদের ওপর  মারমুখী হয়ে ওঠে। এসব ঘটনা যে স্রেফ কাকতলীয় নয় তা বুঝতে বিজেপি ও আরএসএস ছাড়া আরো কারো অসুবিধা হচ্ছে না। খ্রিষ্টান সমাজের নানা সংগঠন ইতিমধ্যেই অভিযোগের আঙুল তুলেছে আরএসএসের দিকে। অল ইণ্ডিয়া খ্রিষ্টান পার্টি বলেছে, “আরএসএস নির্লজ্জভাবে আমাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অপ্রীতিকর আক্রমণাত্মক বিদ্বেষ ও সন্ত্রাস অভিযান লঞ্চ করেছে।”  আরএসএসের হিন্দুত্বের অভিযানের সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী কর্মসূচী হলো ‘ঘর ওয়াপসি’ এবং এই কর্মসূচীর মূল টার্গেট হলো আদিবাসী খ্রিষ্টানরা। আদিবাসীরা হিন্দু নয়, তবুও জমি-জায়গা জবরদখল করার মতো হিন্দুত্ববাদীরা আদিবাসীদের হিন্দু বলে দাবি করে থাকে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে আদিবাসীরা হিন্দু, তাহলেও কি কেউ তাদের অন্য ধর্মে যাওয়ার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে? কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীরা তো  যুক্তি ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।  তাই আদিবাসীদের খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়াটা মেনে নিতে পারে না। আদিবাসীরা যেন হিন্দুত্ববাদীদের পৈতৃক সম্পত্তি যেগুলি খ্রিষ্টান পাদ্রীরা ক্রমে ক্রমে দখল করে নিচ্ছে। তাই হিন্দুত্ববাদীদের সবচেয়ে বেশী রাগ গীর্জা, গীর্জার ফাদার ও ধর্মান্তরিত হওয়া আদিবাসীদের উপর। সেজন্যে একদিকে তারা যেমন সশস্ত্র আক্রমণ চালাচ্ছে গীর্জা ও গীর্জার পাদ্রীদের উপর, তেমনই অপরদিকে  আদিবাসী খ্রিষ্টানদের জোরজবরদস্তি হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছে। এই বলপূর্বক ধর্মান্তরের কাজ চলতো মূলতঃ হিন্দুত্ববাদীরা যেখানে শক্তিশালী সে সব অঞ্চলে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই কাজ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং  আদিবাসী এলাকায় সর্বত্র তাদের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। খুব সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বীরভূম জেলার রামপুরহাটে একটি আদিবাসী অঞ্চলে ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘ঘর ওয়াপসি’র কর্মসূচী করতে দেখা গেলো। শতাধিক খ্রিষ্টান আদিবাসীকে যজ্ঞ করে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে সেখানে। খবরে প্রকাশ যে, সেখানেও ধর্মান্তরের পশ্চাতে বলপ্রয়োগ ও আর্থিক প্রলোভনের ঘটনা রয়েছে। একদিকে গীর্জা ও গীর্জার ফাদার-মাদারদের উপরে আক্রমণের ঘটনা আর একদিকে খ্রিষ্টান আদিবাসীদের জোরজবরদস্তি ধর্মান্তরিত করার ঘটনা – এই দ্বিবিধ ষাঁড়াশি আক্রমণের ফলে খ্রিষ্টান সমাজ এখন ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ২০২১ সালের মধ্যে ভারতকে খ্রিষ্টান ও মুসলমান মুক্ত করার ঘোষণায়  তাদের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা আরো বেড়েছে। ওয়াসিংটন রিপোর্ট অন মিডল ইস্ট অ্যাফেয়ার্সে এই উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে – বিজেপির ছাতার নীচে সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলের লক্ষ্য হলো ভারতবর্ষে ‘হিন্দুত্ব’ [শুধু হিন্দুরা থাকবে]-এর প্রতিষ্ঠা। ... কোনও সংখ্যালঘু ভারতে নিরাপদ নয়। খ্রিষ্টান পারসিকিউশন ইণ্ডিয়ায় লেখা হয়েছে – আমরা এক প্রচণ্ড ভয়ংকর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। ... আমাদের চার্চগুলি ভেঙে ফেলা হচ্ছে।  দিল্লির আর্চবিশপ অনিল কৌটোর গলায়ও একই সুর। তিনি বলেছেন, চার্চগুলির উপর আক্রমণের ঘটনা সংখ্যালঘু ও তাদের ধর্মীয় কাঠামোর নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটায়। জন দয়াল, সর্বভারতীয় খ্রিষ্টান কাউন্সিলের সম্পাদক, বলেছেন – আরএসএসের হেট ক্যাম্পেনের উত্থানে খ্রিষ্টান নেতৃত্ব উদ্বিগ্ন। চরম উদ্বিগ্নতা, অসহয়তা ও অনিশ্চয়তার ছবি ধরা পড়েছে  অল ইণ্ডিয়া খ্রিষ্টান পার্টির সভাপতি সিভিএন রাও-এর কণ্ঠে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন একটি বিবৃতিতে, “রাজেশ্বর সিং – এর ঘৃণ্য কর্মসূচীর [ভারতকে খ্রিষ্টান ও মুসলমান মুক্ত করা] বিষয়ে মিডিয়া, রাজনৈতিক দলগুলির উচ্চবাচ্য নেই। তাই দ্বিতীয় কান্ধমাল হওয়ার স্পষ্ট আভাস দেখা যাচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কয়েক বছর আগে ওড়িষার কান্ধমালে একটি চার্চের ফাদার গ্রাহাম স্টেইনসকে শিশুপুত্রসহ পুড়িয়ে মেরেছিল হিন্দুত্ববাদীরা।
আরএসএসের প্রধান শত্রু মুসলমানরা হলেও  খ্রিষ্টানদের তুলনায় মুসলমানদের উপর আক্রমণ ও দমনপীড়নের ঘটনা কম। কারণ, মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও সংখ্যায় যথেষ্ট বেশী। তাছাড়া তারা খ্রিষ্টানদের মতো নিরীহ ও নির্বিবাদী নয়। বরং তাদের ধর্মীয় আবেগ অনেক অনেক বেশী উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতায় পরিপূর্ণ।তাদের উপর আক্রমণ হলে প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা  থাকে। তাই  হিন্দুত্ববাদীরা যথেষ্ট ভেবেচিন্তে ও পরিকল্পনা করে মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সংগঠিত করে। মুসলিমরা যেখানে খুবই সংখ্যালঘু সে সব অঞ্চলগুলিতে সাধারণতঃ সীমাবদ্ধ থাকে। এ সব আক্রমণের ঘটনা বেশীর ভাগই খবর হয় না। তবুও কিছু কিছু ঘটনার খবর সামনে চলেই আসে। বাল ঠাকরে মারা যাওয়ার পর শোক পালনের নামে ঠাকরের অনুগামী কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মুম্বাই শহরকে জিম্মি করে রেখেছিলো। ফেসবুকে তার প্রতিবাদ করেছিলো একটি মুসলিম মেয়ে এবং সেটাকে সমর্থন করেছিলো তারই ছোট বোন। দুজনকেই পুলিশ জেলে পুড়েছিলো এবং ধর্মান্ধ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাদের বাবার হোটেলকে নির্মমভাবে ভেঙে প্রায় গুড়িয়ে দিয়ে সর্বস্ব লুট করে নিয়েছিলো। এই বর্বর আক্রমণ শুধু ফেসবুকে পোস্ট করার কারণে ঘটেনি, তাদের যেটা সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হিন্দুত্ববাদীদের কাছে সেটা হলো তারা মুসলমান। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পরই [৪.৬.১৪] মাশুল দিতে হয়েছিলো পুনে শহরে টেক্সটাইল বিভাগের আইটির ম্যানেজার ২৮ বছরের তাজা যুবক মহসিন মহম্মদ সিদ্দিক সেখকে। তারও প্রধান অপরাধ ছিলো একটাই, সে ছিলো একজন মুসলিম যুবক। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ তোলা হয়েছিলো যে সে ফেসবুকে আপত্তিকর কিছু একটা পোস্ট করেছিলো। সিদ্দিক ও তার বন্ধু রাতের খাবার খেয়ে মোটর সাইকেলে যখন মেসে ফিরছিলো তখন হিন্দুত্ববাদীরা তাদের পথ আটকে নির্মমভাবে প্রহার করে তাকে মেরেে ফেলে। মোদীর প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে মুসলমানদের উপর সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণের ঘটনাটি ঘটেছে মুজফফরনগরে। অনেককে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই মহল্লার বাকি সমস্ত মুসলমানদের তাদের মহল্লা ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে প্রাণে বাঁচার তাগিদে।
উপরের কয়েকটি ঘটনার দ্বারা বোঝা যাবে না সংখ্যালঘুদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের মাত্রাটা কতটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং মুসলিম সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদি বলা হয় যে উপরে উল্লেখিত আক্রমণের ঘটনাগুলি হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া মাত্র,  তাহলে বোধ হয় খুব অত্যুক্তি করা হবে না।

হিন্দুত্বের অভিযানে অনুপ্রবেশ ইস্যুটি হলো প্রধান হাতিয়ার

ভারতে অনুপ্রবেশ একটি বড়ো ইস্যু। বিজেপির কাছে আপাতত প্রধান ইস্যু। সংখ্যালঘুদের উপর হিন্দুত্ববাদীদের দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসের অধ্যায়টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি এই ইস্যুটি অনুল্লেখিত থেকে যায়।  অনুপ্রবেশ  কিন্তু  কেবল ভারতের সমস্যা নয়, এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা।পৃথিবীর সর্বত্রই এক দেশ থেকে আর এক দেশে মানুষ বৈধ অনুমতি ছাড়াই যাতায়াত করে এবং তাদের একটা অংশ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে না।বিশেষ করে অনুন্নত ও গরীব দেশগুলি থেকে প্রতিবেশী  দেশগুলিতে গরীব শ্রেণির মানুষরা কাজের জন্যে ছুটে যায়। এক দেশ থেকে আর এক দেশে মানুষের এই  প্রবাহ ততদিন থাকবে যতদিন পৃথিবীতে উন্নত ও অনুন্নত এবং ধনী ও গরীব দেশের বিভাজন থাকবে। এই কারণেও বাংলাদেশ থেকে বৈধ অনুমতি ছাড়াই বহু মানুষ ভারতে অনুপ্রবেশ করে। অনুপ্রবেশের এই ঘটনা সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে অধিক ঘটে থাকে। আবার ভারতে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দুদের অনুপ্রবেশও ঘটে। মুসলিম মৌলবাদীরা বাংলাদেশকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান মুক্ত করার লক্ষ্যে সে দেশে অমুসলিমদের উপর নিরন্তর যে সীমাহীন অত্যাচার চালায়  তার হাত থেকে রক্ষা পেতে তারা ভারতে পাড়ি দিয়ে থাকে। এই দু রকমের অনুপ্রবেশই খুবই স্পর্শকাতর এবং একে  মানবিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। এর সমাধানের জন্যে উভয় দেশের মানুষ ও সরকারেরও মানবিক  দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই অগ্রসর হওয়া কাম্য। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা সর্বদা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে  অনুপ্রবেশের এই স্পর্শকাতর সমস্যাটির সমাধান চায় হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের শরণার্থী হিসাবে দেখে এবং তাদের ভারতের অধিবাসী করে নিতে চায়। অপরদিকে মুসলিম  অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান কট্টর ও শত্রুমনোভাবাপন্ন। তারা চায় অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের ঝেঁটিয়ে বার করে দিতে। মুসলিমদের ক্ষেত্রে  তারা একটি মারাত্মক অভিযোগ করে থাকে যা সর্বৈব মিথ্যা।মুসলিমরা নাকি ভারতে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ ও  আসাম সহ ভারতের কিছু অংশ  নিয়ে বৃহত্তর বাংলাদেশ তৈরী করার ষড়যন্ত্রকে রূপায়ণ করার জন্যে এবং সেই ষড়যন্ত্রে নাকি ভারতীয় মুসলমানরাও অংশীদার। 

হিন্দুত্ববাদীদের চোখে  মুসলিমরা জাতশত্রু এবং তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ভারতকে মুসলিম মুক্ত করা। হিন্দুত্ববাদীরা তাই সেই লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের ইস্যুটিকে একটা জবরদস্ত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী অসংখ্য গরীব মুসলমানরা কাজের জন্যে দিল্লি, মুম্বাই, রাজস্থান সহ হিন্দি বলয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।বাংলাদেশী  মুসলমান বলে তাদের মাঝে মধ্যেই হেনস্থার শিকার হতে হয়। গত শতাব্দীতে ৮০ ও ৯০ – এর  দশকে  হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশী মুসলমানদের খেদানোর নামে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরও ভারত থেকে খেদানোর অভিযান শুরু করেছিলো।   এ কাজে পুলিশের একাংশও নগ্নভাবে তাদের সাহায্য করেছিলো।হিন্দুত্ববাদীদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ  মুসলমানদের দলে দলে ধরে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশী বলে কোর্টে চালান করে পুশ ব্যাকের নির্দেশ চায়তো। অভিযুক্ত সেই গরীব মানুষগুলো তারা যে ভারতীয় তার প্রামাণ্য কাগজপত্র সব সময় যোগাড় করে উঠতে পারতো না। ফলে  অসংখ্য ভারতীয়  মুসলিম  বাঙালির বিরুদ্ধে সে সময়  নেমে এসেছিলো পুশ ব্যাকের নির্মম  আদেশ পুলিশ সেই আদেশ পেয়ে অতি তৎপরতার সঙ্গেই তাদের বাংলাদেশ পাঠানোর  ব্যবস্থাও  করেছিলো। এই  ঘটনার বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তীব্র আলোড়ন হয় এবং বামপন্থীরা  সে সময় এই অন্যায় পুশ ব্যাক রুখতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। তাদের তৎপরতায় সে যাত্রা হিন্দুত্ববাদীদের  এই অন্যায় ও অমানবিক পুশ ব্যাক অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেটা বামফ্রন্টের সময়ের ঘটনা। সেই ভয়ঙ্কর পুশ ব্যাকের পদধ্বনি আবার নতুন করে শোনা যাচ্ছে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীদের কণ্ঠে। আসামে বাংলাদেশি মুসলমানদের তাড়ানোর নামে ভারতের মুসলিম বাঙালিদের তো  হামেশায় হেনস্থা করা হয় যা  এখন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

 মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্বের এই অভিযান কোনো নতুন ঘটনা নয়

‘মুসলমানদের ঢাকা পার্সেল করে দাও’ – প্রবীণ তোগাড়িয়ার এই হুঙ্কার বুঝিয়ে দেয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা কত তীব্র। এই উক্তি এবং গো-বলয়ে ও মহারাষ্ট্রে দিকে দিকে মুসলিমদের উপর হিন্দুত্ববাদীরা যে ভাবে  আক্রমণ সংগঠিত করে চলেছে তাতে মুসলিমদের অবস্থা হয়েছে ঘর পোড়া গরুর মত। তাই বিজেপি যেখানে যেখানে শক্তিশালী সে সব অঞ্চলে তারা  আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে ও পরে এবং ২০০২ সালের গুজরাটকাণ্ডের ভয়াবহ স্মৃতি বারবার তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির তৈরী করার জন্যে আরএসএস লালকৃষ্ণ আদবানিকে চাপিয়ে দিয়েছিলো রামরথে। সেই রথে চেপে সারা দেশ ঘুরে ঘুরে আদবানি ছড়িয়েছিলেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদেশী তকমাসহ তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা।সমানে দেওয়া হয়েছিলো মুসলিম সমাজ ও মসজিদের বিরুদ্ধে হিংসায় উস্কানি। ফলশ্রুতিতে ১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর সারা দেশ থেকে  কয়েক লক্ষ করসেবক নামের বর্বরের দল অযোধ্যায় গিয়ে বাবরি মসজিদটাকে ধ্বংস করে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছেলো। শুধু ওই মসজিদটিকেই নয়, সারা দেশে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো আরো বহু মসজিদ, বহু জায়গায় দাঙ্গা বাধিয়ে বহু মুসলিমকে হত্যা করেছিলো, বহু মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করেছিলো এবং মুসলিমদের বিপুল ধন-সম্পত্তি হয় লুঠপাট, নয় তো  ধ্বংস করেছিলো। সে সময় ‘জয় শ্রী রাম’-এর ধ্বনির সাথে   যে সব  স্লোগানগুলি  হিন্দু মৌলবাদীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতো সেগুলি ছিলো ভীষণ আক্রমণাত্মক, উত্তেজক ও  উস্কানিমূলক। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলা হতো যে শ্লোগানগুলির সাহায্যে তার কয়েকটি আজো যেনো মুসলিমদের কানের কাছে হাতুড়ি পেটায়সেই বিষাক্ত শ্লোগানগুলির কয়েকটি   হলো এ রকম – ‘ভারত ছাড়ো না হয় কোরান ছাড়ো’, ‘হিন্দুস্তান হিন্দু কা, নেহি কিসি বাপকা’, ‘হিন্দুস্থান মে রহনা তো হিন্দু বানকে রহনা’। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার  দু বছর আগেই ১৯৯০ সালেই অযোধ্যা ও ফৈজাবাদ শহরে বাড়ি ও মন্দিরের দেওয়ালগুলিতে  লেখা হয়েছিলো – ‘হিন্দুদের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কাজ হলো যারা গোহত্যা করে তাদের হত্যা করা’।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং  ধ্বংসকাণ্ড উত্তর দাঙ্গার রক্ত ও দগদগে ঘা শুকোতে না শুকোতেই ২০০২ সালে গুজরাটে  ঘটানো হয়েছিলো  একতরফা মুসলিম নিধনকাণ্ড মোদি তখন  মুখ্যমন্ত্রী। আদালতে প্রমাণিত  হোক বা না হোক ভারতবর্ষের মানুষ বিশ্বাস করে যে তাঁর মদতে ও ইশারাতেই সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত হয়েছিলো। তবুও  তিনি সেই গণহত্যাকাণ্ডটিতে দোষের কিছু দেখেন নি। নিউটনের তৃৃৃতীয় গতিসূত্র (Every action has its equal and oppsite reaction.) উদ্ধৃত  করে তিনি তাঁর দোষ স্খলন করেছিলেন। এবং সেই নারকীয় গণহত্যাকাণ্ডের জন্যে মুসলমানদের ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে  দিতে দ্বিধা করেন নি।বলেছিলেন যে মুসলমানরা গোধরাকাণ্ড না ঘটালে ঐ হত্যাকাণ্ডটি ঘটতো না। এবং তিনি অবলীলায় বলেছিলেন যে গুজরাটে যা ঘটেছে তা অনিবার্যই ছিলো।  আজ পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর মুসলিম গণহত্যার জন্যে তিনি কোনো প্রকার অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ করেন নি। গণহত্যার শিকার মুসলিম পরিবারগুলির জন্যে একটু সহানুভূতিও জানান নি। সেই হত্যাকাণ্ড এমন ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছিলো যে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী ও বিজেপির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ীর বুকও  কেঁপে উঠেছিলো এবং তিনি যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেছিলেন। তিনি  মুসলিমদের নিরাপত্তা দিতে মোদিকে অনুরোধ করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘রাজধর্ম’ পালন করতে। তথাপি  কট্টর হিন্দু নেতা এবং আরএসএসের পোষ্টার বয় নরেন্দ্র মোদির বিবেক জাগ্রত হয় নি।

আরএসএস ও বিজেপি এবং হিন্দুত্ব

বিজেপি আদতে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক  দল। দলটি  রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তথা আরএসএসের রাজনৈতিক  প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মূল লক্ষ্য হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করাই হলো বিজপির প্রধান কাজ।মিশরের ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ ও ‘ফ্রিডাম এণ্ড জাস্টিস পার্টি’র মধ্যে যে  সম্পর্ক,  রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ ও বিজেপির মধ্যেকার সম্পর্ক  ঠিক তেমনই। ‘মুসলিম  ব্রাদারহুড’ হলো একটি কট্টরবাদী মুসলিম মৌলবাদী  সংগঠন যার মূল লক্ষ্য হলো মিশরকে ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা,  আর ‘ফ্রিডাম এণ্ড জাস্টিস পার্টি’ হলো তার রাজনৈতিক শাখা। ‘ফ্রিডাম এণ্ড জাস্টিস পার্টি’ মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তার প্রকৃত লক্ষ্য হলো মিশরে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের জন্যে কাজ করা। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েই ‘ফ্রিডাম এণ্ড জাস্টিস পার্টি’ মিশরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলো এবং ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে নির্বাচনে জয়লাভ করে মহম্মদ মুরসির নেতৃত্বে সরকার তৈরী করতে সমর্থও হয়েছিলো। কিন্তু সরকার গঠন করেই শুরু করেছিলো মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মসূচী রূপায়ণ করার কাজ। মিশরের জনগণ ও সেনাবাহিনী মুরসির সংবিধানবিরোধী সেই কার্যকলাপ মেনে নেয় নি এবং  মাত্র দেড় বছরের মাথায় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সেনাবাহিনী মুরসি সরকারকে বরখাস্ত করে মিসরের ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমুন্নত রেখেছিলো। ভারত হলো একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানেও কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন  কমিশনের অনুমোদন ও স্বীকৃতি পেতে হলে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের ঘোষণা দিতে হয়।বিজেপির নেতারাও তাই তাঁদের হিন্দু  মৌলবাদী  ভাবাদর্শ এবং কর্মসূচী [ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার কর্মসূচী] গোপন রেখে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের ঘোষণা  দিয়েই নির্বাচন কমিশনে  বিজেপির নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন। বিজেপি তাই খাতায়-কলমে একটি অসাম্প্রদায়িক দল এবং সেই তকমার আড়ালে তাদের সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধিকে আড়াল করে রেখেছে। সেই বিজেপিই গত বছর [২০১৪] রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের পোষ্টার বয় নরেন্দ্র দামদর ভাই মোদির নেতৃত্বে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার তৈরী করেছে। এর আগেও দুবার অটলবিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে দু’বার কেন্দ্রে সরকার জোট সরকার তৈরী করেছিলো যে সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সরকার তৈরী করেই নরমে-গরমে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু করে দেন। বিজেপির সুবিধা হলো এই যে, ভারতে মিসরের মতো সেনাবাহিনী সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করবে সে ভয় নেই।
ড.কে.বি.হেডগাওয়ারের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ আত্মপ্রকাশ করে ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিনে। এই দিনটিতেই সঙ্ঘের আত্মপ্রকাশ করার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা মনে করে এই দিনটি হলো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়ের দিন। সঙ্ঘের কাছে অহিন্দুরা, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা হলো অশুভ শক্তি, তাদের হাত থেকে মাতৃভূমি তথা ভারতকে মুক্ত করাই সঙ্ঘের মূল লক্ষ্য, তাই তারা বিজয়া দশমীর দিনটিকে বেছে নিয়েছিলো। এটা বলা হয় যে সঙ্ঘের জন্ম হয় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও আদর্শ এবং মুসলিম লীগের [প্রতিষ্ঠা ১৯০৬ সালে] আদর্শের বিপরীতে। উকিপিডিয়া এ প্রসঙ্গে বলছে - আরএসএস সংঘ পরিবার নামে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর একটি অংশ।১৯২৫ সালে নাগপুর-বাসী ডাক্তার কে. বি. হেডগেওয়ার একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রূপে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করেন।তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ও মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধিতারাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আগে জন্ম হয়েছিলো অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ১৯১৫ সালে যার সভাপতি  ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকার [বীর সাভারকার নামে অধিক পরিচিত] এবং সহ-সভাপতি ছিলেন ডা.কে.বি.হেডগাওয়ার। পরে আদর্শগত বিরোধের কারণে হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ডা.কে.বি.হেডগাওয়ার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ তৈরী করেন। সাভারকার এবং  হেডগাওয়ার কেনো হিন্দু মহাসভার জন্ম দিয়েছিলেন সে প্রেসঙ্গে উকিপিডিয়া লিখেছে – “অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা (হিন্দি: अखिल भारत हिन्दू महासभा, ইংরেজি: All-Indian Hindu Assembly) একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন ১৯১৫ সালে মুসলিম লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়দলের সভাপতি ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর ও সহ-সভাপতি ছিলেন কেশব বলীরাম হেডগেয়ার হেগওয়ার পরবর্তীকালে মহাসভা ত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গঠন করেন  এই দুটি তথ্যে যা দাবি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ যথার্থ নয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সঙ্ঘকে  সদর্থক  ভূমিকা  পালন করতে দেখা যায় নি। বরং সংঘ সর্বদাই বৃটিশ সরকারকে সহযোগিতাই করে গিয়েছিলো।  এ প্রসঙ্গে  তপন বসু, সুমিত সরকার, তনিকা সরকার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, “ঈর্ষণীয় সাংগঠনিক শক্তি ও শৃঙ্খলা  সত্ত্বেও, আর এস এস বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত সংগ্রাম থেকে বরাবরই তফাতে থেকেছে। সাভারকারের প্রাথমিক বৃটিশ-বিরোধী ভূমিকা অনস্বীকার্য ও বীরত্বব্যাঞ্জক; কিন্তু ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝি তাঁর অনুরূপ ভূমিকা সম্পর্কে মন্তব্য করা শক্ত। এর মধ্যেই তিনি হিন্দুত্বের প্রধান তাত্ত্বিক প্রবক্তা ও হিন্দু মহাসভার নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ১৯৪২-এর আন্দোলনের সময়ে বিভিন্ন পৌর ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান, আইনসভা এবং বিভিন্ন চাকুরিতে মহাসভার সদস্যদের ‘নিজ নিজ পদে অবিচলিত থেকে দৈনন্দিন-কর্ম করে যেতে’ আহ্বান জানিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় তাঁর শ্লোগান ছিল ‘রাজনীতির হিন্দুকরণ এবং হিন্দুধর্মের সামরিকীকরণ।’ বাস্তবে এর আসল তাৎপর্য ছিল একই সঙ্গে তীব্র মুসলিম-বিরোধী প্রচার এবং বৃটিশদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা।” [দ্রঃ খাকি প্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ডা, পৃ-৪]
মুসলিম লীগ তৈরী না হলেও হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বনয়ং সেবক সংঘ তৈরী হতোই। কারণ যাঁরা এই দুটি সংগঠন তৈরী করেছিলো তাঁদের পক্ষে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে আদর্শগত কারণেই থাকা সম্ভব ছিলো না। কংগ্রেস ছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ব্যাপক মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শ ও ভাবধারার  মানুষ জড়ো হয়েছিলেনএকদল ছিলেন অহিংসবাদী, আর একদল ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ভাবধারায় বিশ্বাসী। এই দুটি ভাবধারার মানুষরাই একটি  ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ   গঠনের স্বপ্ন দেখতেন । কিন্তু তাঁদের বাইরে ছিলো একদল মানুষ যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। তাঁরা হিন্দু মৌলবাদ এবং মুসলিম মৌলবাদ – এই দুটি বিপরীত ভাবধারায় বিশ্বাসী। তাঁদের কাছে  বৃটিশরা কখনই প্রধান শত্রু ছিলো না, তারা নিজেরা পরষ্পরকে প্রধান শত্রু জ্ঞান করতো। তাঁদের পক্ষে কংগ্রসের মঞ্চে থেকে কাজ করা সম্ভব ছিলো না। তাই  উভয় মৌলবাদীরাই কংগ্রেসের মঞ্চ ছেড়ে গিয়ে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী দল গঠন করেছিলো যাদের একটির [মুসলিম লীগ] জন্ম হয়েছিলো ১৯০৬ সালে এবং অপরটির [হিন্দু মহাসভা] জন্ম হয়েছিলো ১৯১৫ সালে। পরে হিন্দু মহাসভা ভেঙে ১৯২৫ সালে তৈরী হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। বীর সাভারকারের হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের জন্ম হলেও সংঘ কিন্তু গড়ে উঠেছিল সাভারকারের ভাবাদর্শ হিন্দুত্বের তত্ত্বের ভিত্তিতেই।
‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি সাভারকারের নিজের সৃষ্টি। সাভারকার জানিয়েছেন, হিন্দুইজম [বা হিন্দুধর্ম] থেকে হিন্দুত্ব আলাদা’। ‘হিন্দুত্ব’ হলো একটি নতুন মতবাদের জন্যে  একটি নতুন শব্দ – হিন্দুরাষ্ট্রের মতবাদ’।  [দ্রঃ-বীর সাভারকার, ইতিহাসের আলোয়/রঞ্জন গুপ্ত, পৃ-৫৭] সাভারকার ১৯২৩ সালে আন্দামান জেলে বসে ‘হিন্দুত্ব’-এর তত্ত্বকে একটি বইয়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেন, বইটির নাম – ‘হিন্দুত্বঃ হিন্দু কে?’ এই বইয়ে তিনি ‘হিন্দু’র এক অভিনব ও স্বতন্ত্র বাখ্যা দেন। তিনি লেখেন – ‘সেই ব্যক্তিই হিন্দু যে সিন্ধু নদ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বেদ-বর্ণিত ‘সপ্তসিন্ধুস্থান’ বা ‘ভাররতবর্ষ’কে নিজের পিতৃভূমি ও পূণ্যভুমি বলে মনে করে; সংস্কৃত যার আদিভাষা এবং যা [যে দেশ] তাঁর ধর্মের বৈশিষ্ট ।’ তিনি আরো লেখেন, ‘তাকে বিশ্বাস করতে হবে এখানেই আমাদের ধর্মমতের স্থাপয়িতা ও ভবিষ্যতদ্রষ্টাদের আবির্ভাব ঘটেছিল, এখানেই উদ্ঘাটিত হয়েছিল চিরন্তন বেদজ্ঞান। অর্থাৎ ভারতবর্ষ একই সঙ্গে হতে হবে সেই ব্যক্তির ‘পিতৃভূমি’,  ‘পূণ্যভূমি’, ‘ধর্মের সূতিকাগার’ এবং সে হবে আদি সংস্কৃত উদ্ভূত কোনো ভাষাভাষি।’  [ উদ্ধৃতিঃ প্রাগুক্ত, পৃ-ঐ]  সংঘচালকরূপে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দু বছর পরে ১৯৩৮ সালে এম এস গোলওয়ালকার প্রকাশ করেন ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইণ্ড’ [আমরা বা আমাদের জাতিত্বের সংজ্ঞা]। পরে তিনি একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেন যার নাম ‘বাঞ্চ অফ থটস’ [এক গুচ্ছ ভাবনা]। গোলওয়ালকারের লেখায় হিন্দুত্বের  ভাবনারই প্রতিফলন দেখা যায়। ‘তিনি উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইণ্ড’ গ্রন্থে ৫২ হিন্দু, অহিন্দু ও হিন্দুস্থানের বাখ্যা দিয়েছেন এ ভাবে – “হিন্দুস্থানে সমস্ত অহিন্দু মানুষ হয় হিন্দু ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করবে, হিন্দু ধর্মকে  শ্রদ্ধা করবে ও পবিত্র জ্ঞান করবে, হিন্দু জাতির গৌরব-গাথা ভিন্ন অন্য কোন ধারণাকে প্রশ্রয় দেবে না, অর্থাৎ তারা শুধু তাদের অসহিষ্ণুতার মনোভাব  এবং এই সুপ্রাচীন দেশ ও তার ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার মনোভাবই ত্যাগ করবে না, এর প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তির মনোভাব তৈরী করবে; এক কথায় তারা হয় আর বিদেশী থাকবে না, না হলে সম্পূর্ণ হিন্দু জাতির এই দেশে তারা থাকবে অধীনস্থ হয়ে, কোনও দাবি ছাড়া, কোনও সুবিধা ছাড়া এবং কোনও রকম পক্ষপাতমূলক ব্যবহার ছাড়াএমনকি নাগরিক অধিকারও থাকবে না।” [উদ্ধৃতি সূত্রঃ খাকি প্যান্ট গেরুয়া ঝাণ্ডা/ এই দেশ এই সময়, পৃ-২৩]  গোলওয়ালকারের ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে নেওয়া।  তিনি ওই গ্রন্থেই  লিখেছেন, “জার্মানদের জাতিত্বের গর্ব আজ মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে। নিজেদের জাতীয় সংস্কৃতিকে কলুষমুক্ত করতে জার্মান জাতি গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে সেমিটিক জাতি-ইহুদিদের দেশ থেকে বিতারণ করেছে। জাতিত্বের গর্ব এখানে তার সর্বোচ্চ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। জার্মানি এটাও প্রমাণ করেছে যে, নিজস্ব ভিন্ন শিকড় আছে এমন জাতি বা সংস্কৃতির একসঙ্গে মিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা তৈরী করা অসম্ভব। এই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা এবং তার থেকে লাভ করা প্রয়োজন।” [উদ্ধৃতি সূত্রঃ প্রাগুক্ত]  এই গ্রন্থে ভারতীয় খৃস্টান ও মুসলমানদের সম্পর্কে গোলওয়ালকার লিখেছেন “তারা এ দেশে জন্মেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কি যথার্থ এ দেশের প্রতি অনুগত? ... না। তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাতির প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি চলে গেছে।” [উদ্ধৃতি সূত্রঃ প্রাগুক্ত, পৃ-২৪] গোলওয়ালকার মুসলমানদের তো সরাসরি বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী বলেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, “তারা এ দেশের শত্রুদের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে ফেলেছে। তাদের পূণ্যভুমি বিদেশে। তারা নিজেদের শেখ এবং সৈয়দ বলে ...  তারা এখনও মনে করে যে তারা এ দেশ জয় করতে এবং রাজ্য স্থাপন করতে এসেছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এটা শুধু ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তন নয়, এমনকি জাতির পরিচয়েও পরিবর্তন। নিজের মাতৃভূমিকে ফেলে রেখে শত্রুশিবিরে যোগ দেওয়াকে দেশদ্রোহ ছাড়া কী বলা যায়?” [উদ্ধৃতিঃ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৪]  গোলওয়ালকারের এই কথাগুলি রয়েছে তাঁর ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইণ্ড’-এর যথাক্রমে ৫২, ২৭, ১২৭-২৮ এবং ১২৮ পৃষ্ঠায়]
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও তার সহযোগীরা হিন্দুরাষ্ট্রের এই সংজ্ঞাকে কি কখনো অস্বীকার করেছে? না।  বরং প্রত্যেকটি কথা ও বর্ণকে শিরোধার্য করেছে। এ কথা ঠিক যে বিজেপি দলে হিন্দুরাষ্ট্রের এই সংজ্ঞা নিয়ে দ্বন্দ আছে, সবাই সংঘের কট্টর মতাদর্শকে সমর্থন করে না।অটলবিহারি বাজপেয়ী ছিলেন সংঘের নরমপন্থী সদস্য। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সংঘের সব কথা মেনে চলেন নি, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতায় এ উপলব্ধি তাঁর হয়েছিলো যে তা মানা সম্ভব নয়। তাই তো তিনি গুজরাটে যখন মুসলিমদের নিধন যজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছিল তখন নির্বিকার মোদিকে ‘মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজধর্ম’ পালন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বাজপেয়ীর এই ভূমিকা সংঘের নেতাদের পছন্দ হয় নি, আর তখন থেকেই  সংঘ পরিবার  মোদিতেই অধিক আস্থাবান হয়ে ওঠে। একদা কট্টরপন্থী লৌহ পুরুষ আদবানিও উপলব্ধি করেছিলেন বাজপেয়ীজীর কথা। তাই তাঁকে কোনোদিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা নিয়ে আমরা গর্ব করতে দেখি নি,  বোধ হয় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে  ঐ কাজটি করা  তাঁর ঠিক হয় নি। ফলে আদবানি ধীরে ধীরে সংঘ পরিবারের কাছে ব্রাত্য হয়ে ওঠেন। ফলে গত নির্বাচনে সংঘ পরিবার আদবানিকে বিজেপির নেতৃত্ব থেকে  সরিয়ে তাঁর জায়গায় মোদিকে স্থলাভিষিক্ত করে এবং  মোদিকেই পরবর্তী  প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরে।  
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের পরিচালক লোক চিনতে ভুল করেন নি। মোদি এ কথা প্রকাশ্যেই বলেন যে ‘আমি সংঘের কর্মী, এটা আমার গর্ব। এটা যে কথার কথা নয় তা তিনি প্রমাণ করেছেন গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন। সংঘ তাই মোদিতেই ভরসা রেখেছেন। মোদিও তাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই ভারতকে যথাসম্ভব হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার মহান [!] কর্মসূচি রূপায়ন করার যথাসাধ্য চেষ্টায় ব্রত রয়েছেন। একদল  সংঘকর্মী যখন গীর্জায় হামলা করছে এবং খ্রিষ্টানদের হত্যা করছে তখন মোদি থাকছেন মৌনীবাবা! যখন একদল হিন্দু মৌলবাদী  মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তাদের হত্যা করছে, তাদের বাড়ি-ঘর লুঠপাট করছে [স্মরণ করুন মজফফরপুরের ঘটনা],  তখনও তিনি মৌনীবাবা! একদল যখন বলছে, মুসলমানদের বাংলাদেশ পার্শেল করে দাও, মুসলমানদের ঘর ভাড়া দিও না, মুসলমানদের কাজ দিও না, মুসলিমদের রিক্সায় চাপবে না, মুসলিমদের কাছ থেকে শব্জি ও কোনো জিনিষ কিনবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি,  তখনও তিনিমৌনীবাবা! একদল যখন বলছে, হয় তুমি রামজাদা না হয় হারামজাদা, তখনও মৌনৈবাবা! একদল যখন বলছে, লাভ জিহাদ করে মুসলিম মেয়েদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করো, তখনও মৌনিবাবা! একদল যখন হিন্দু মেয়েদের বলছে, মুসলিম যুবকরা প্রেম নিবেদন করতে আসলে পাথর ছুঁড়ে মারো, তখনও মৌনীবাবা!  একদল যখন বলছে, মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে হবে। তখনও মৌনীবাবা! একদল যখন বলছে, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র শব্দদুটি তুলে দিতে হবে, তখনও মৌনীবাবা! প্রধান্মন্ত্রী মোদি এভাবেই মৌনীবাবা সেজে হিন্দুমৌলবাদীদের ভারতকে মুসলিম ও খৃস্টান মুক্ত করা ও হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর মহান [!] কাজে পেছন থেকে মদত ও উৎসাহ দিয়ে চলেছেন।  
(প্রবন্ধটি ১০.০১.১৬ তারিখ আপডেট করা হয়েছে) 





KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...