Tuesday, March 31, 2015

কাজী মাসুম আক্তারের বিরুদ্ধে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ বাক-স্বাধীনতার উপরেই আক্রমণ


কাজী মাসুম আক্তার মুসলিম মৌলবাদিদের হাতে গত বৃহষ্পতিবার [২৬.০৩.১৫] আক্রান্ত হলেন তাঁর নিজের স্কুলের মধ্যেইতিনি মেটিয়াবুরুজের একটি হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ।  তিনি লেখকও । আক্রান্ত হলেন লেখালেখির কারণেই । স্কুলের ভিতর ঢুকে তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে ও তাঁকে স্কুল থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে বলে চিৎকার করলে তিনি পুলিশে খবর দেন । পুলিশ এসে তাঁকে স্কুল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সামনেই ঐ দুষ্কৃতিরা তাঁর উপর চরাও হয়ে কিল চড় লাথি ঘুষি মারতে থাকে । এরই মাঝে লোহার রড দিয়ে আঘাত করে দুষ্কৃতিরা তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেয় ।  তিনি অভিযোগ করেছেন যে সে সময় পুলিশ তাঁকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করে নি । কাজী মাসুম এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন । তিনি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করা সত্ত্বেও পুলিশ কাউকে ধরার তৎপরতা দেখায় নি ।
ধর্মগুরুদের সমালোচনা করলে কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বললে এ রকম আক্রমণের  ঘটনা বারবার  ঘটছে । ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের প্রতি মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে হিন্দু সমাজের ধর্মগুরুরা চিকিৎসার নামে যে রমরমা ব্যবসা করে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিলেন এবং  ভণ্ড ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজ করছিলেন বলে  হিন্দু মৌলবাদিরা দাভোলকারকে ২০.০৮.১৩ তারিখে গুলি করে হত্যা করে । বালা সাহেব ঠাকরের মৃত্যুর পর গোটা মুম্বাই শহরকে গায়ের জোরে  স্তব্ধ করে রেখেছিলো তাঁর অনুসারীরা । এর সমালোচনা করে  একটি মেয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট  করেছিলো বলে তাঁর বাবার হোটেলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিলো । কিছুদিন আগে সিপিআই নেতা পানিক্করকে পাঞ্জাবে হত্যা করে ধর্মীয় মৌলবাদীরা । ধর্মীয় মৌলবাদীদের - তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন – আক্রমণ সমাজের পক্ষে উদ্বেগের এবং তার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে । না হলে সমাজে শান্তি-সম্প্রীতি ও গণতন্ত্র বিলুপ্ত হবে ।  এ কথাও মনে রাখতে হবে যে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর হিন্দু মৌলবাদের বিপদ অনেকটাই বেড়েছে এবং সেই বিপদের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিতে হবে । তৎসত্ত্বেও আমাদের দেশ ও রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে  আমি একটা কথা বিশেষভাবে বলতে চাই যে, মুসলিম মৌলবাদের সঙ্গে অন্য সব ধর্মীয় মৌলবাদকে  গুলিয়ে দিলে বা এক করে দেখলে ভুল হবে । মুসলিম মৌলবাদ অনেক বেশী ভয়ঙ্কর এবং মুসলিম মৌলবাদীরা অনেক বেশী সংগঠিত ও শক্তিশালী ।  মুসলিম মৌলবাদ মতাদর্শগতভাবেই বেশী ভয়ঙ্কর কারণ তার ধর্ম তথা ইসলামের মধ্যেই তার শিকড় আছে ।  সেখান থেকেই সে সর্বদা বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার রসদ পাচ্ছে । তবে সেই রসদ পেয়েই তারা সব চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা নয়, তারা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সর্বদা শাসক দলের মদত ও প্রশ্রয়  পেয়ে এবং কোনো দিক থেকে কোনো প্রকার বাধা না পেয়ে । এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের দেখতে হবে কাজী মাসুম আক্তারের উপরে আক্রমণের ঘটনা ।
আক্তারের উপর আক্রমণ হলো কেনো ? তিনি কারবালা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন । মুসলিম মৌলবাদিরা সেই লেখা পড়েই ক্ষিপ্ত হয়েছেন তাঁর উপর । লেখাটায় না কি ইসলামের অবমাননা হয়েছে । আক্তার অবশ্য দাবি করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ভিত্তিহীন । তিনি দাবি করেছেন যে তিনি কারবালার সঠিক ইতিহাসটাই তুলে ধরেছেন এবং  কোনোভাবেই ইসলামের অবমাননা করেন নি । এক বছর আগে কারবালা নিয়ে আমি একটি বই লিখেছি । আমার বইয়ে কারবালার যে ইতিহাস তুলে ধরেছি তাতে ইসলামের অবমাননা হয়েছে এরূপ মনে হওয়ার যথষ্ট উপাদান আছে । মাসুম আক্তারের  লেখাটা পড়ি নি, সুতরাং জানিনা সেই লেখায় মুসলিম মৌলবাদিদের  ক্ষিপ্ত হওয়ার মতো কিছু আছে কী না । তবে আক্তারের কথায় আমি বিশ্বাস রাখছি যে তিনি এমন কিছু লেখেন নি যাতে ইসলামের অবমাননা হতে পারে । এ বিশ্বাস আমার হয়েছে,  কারণ আমি তাঁর লেখা কয়েকটি নিবন্ধ পড়েছি । তিনি তাঁর প্রতিটি লেখায়  যে কথা বলেন তা হলো ইসলাম হলো একটি সত্য ও সঠিক ধর্ম, কিন্তু মুসলিম ধর্মগুরুরা হয় ইসলামটা ভালো করে জানেই না,  না হয় নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ইসলামের অপবাখ্যা করে ইসলামের বদনাম করছে এবং মুসলামানদের সর্বনাশ করছে ।  মৌলবাদীদের হাতে মার খাওয়ার পরও তিনি দৈনিক স্টেটসম্যানকে একই কথা বলেছেন । তিনি বলেছেন, “আমি মোটেই ইসলাম-বিরোধী নই । আমি ইসলামের প্রকৃত বাখ্যায় বিশ্বাস আগ্রহী । ইসলামের যে অপবাখ্যা দিয়ে থাকে  তার সঙ্গে আমি মোটেই একমত নই । আমি বিশ্বাস করি, ইসলামে অপর ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সহনশীলতা আছে, যেটা মৌলবাদীরা হয় জানে না, নচেৎ জেনেও সাধারণ মানুষকে তারা ভুল বোঝায় । এদের জন্যই মুসলমান ও ইসলাম ধর্মকে মানুষ ভুল বুঝতে শুরু করেছে ।”
আমরা [আমাদের সংখ্যা অতিশয় নগণ্য, ভারতে তো দ্বিতীয় কাউকে দেখি না ] যাঁরা মুসলিম পরিবারে জন্মে ও বড়ো হয়ে এ কথা সোচ্চারে বলি যে  ইসলাম ধর্ম আর পাঁচটা ধর্মের মতই মানুষেরই সৃষ্টি এবং মানব সমাজের কল্যাণ ও বিকাশের পথে একটা মস্ত বড়ো অন্তরায়   তাঁরা মুসলিম মৌলবাদিদের ঘোষিত শত্রু । মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তাতে মুসলিম মৌলবাদীদের দোষ দেখেন না, বরং বেশ খুশীই থাকেন  মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই ভূমিকায় মুসলিম মৌলবাদীরাও খুব সন্তুষ্ট থাকে । তাই তাঁদের  উপর সাধারণতঃ আক্রমণ নেমে আসে না । মাসুম আক্তার হয় তো সে কারণে ভাবতেই পারেন নি যে তাঁর মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমানও আক্রান্ত হতে পারেন এবং এভাবে কখনো মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে এবং তাঁর জীবনও সংশয় হতে পারে ।   এ রকম  ধারণা কারো থাকলে তা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত ধারণা ।   মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও অতীতে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে, তবে সংখ্যাটা খুবই কম । মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের উপর [তাঁরাই মুসলিম বুদ্ধিজীবী যাঁরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ও ইসলামের গুণগ্রাহী]  মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের আক্রমণের ধারা চলে আসছে অখণ্ড ভারত ও অখণ্ড বঙ্গদেশের সময় থেকেই । ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে পূর্ববঙ্গে মুসলিম মৌলবাদিদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আব্দুল কাদির ও আবুল হোসেন প্রমুখ বিশিষ্ট মুসলিম বুদ্ধিজবীরা । তাঁদের শেষ পর্যন্ত কলকাতা পালিয়ে আসতে হয়েছিলো প্রাণ বাঁচাতে । এই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা সবাই ইসলাম ধর্মেই বিশ্বাস করতেন,  কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিলো না । তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে সকল সমস্যার সমাধান কোরান-হাদিস নেই,  মুসলিম সমাজকে এগোতে হলে চিন্তা-ভাবনার জগতটাকে উন্মুক্ত করতে হবে এবং আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ও অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাবনাগুলিকে গ্রহণ করতে হবে । এটা ছিলো তাঁদের অপরাধ ।  ১৯৪৭ সালে [দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে ] স্বনামধন্য ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি সৈয়দ মুজতবা আলিকেও মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে । তিনি তখন ছিলেন খুব সম্ভবতঃ বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ । তিনি বলেছিলেন যে কাব্য প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি ইকবালের চেয়ে এগিয়ে । এ কথা বলার জন্যে তাঁকে নাস্তিক ও হিন্দুদের দালাল বলে তাঁর উপর হামলা চালানো হয়েছিলো । ২০০৫ সালে আক্রান্ত হন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার আক্রা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লা । তাঁর লেখা কয়েকটি বই তখন পশ্চিমবঙ্গে হাই মাদ্রাসার পাঠ্যতালিকাভূক্ত ছিলো । তিনি একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় ‘সত্য মিথ্যা’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন । তিনি ইসলাম ও মুহাম্মদ সম্পর্কে খুবই নিরীহ কয়েকটি কথা লিখেছিলেন    তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, যদি  দেখা যায় যায় যে কোনো বিষয়ে কোরান ও বিজ্ঞানে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে, তা হলে কোনটা সত্য  বলে ধরা উচিৎ ?  মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে মুহাম্মদ হলেন পৃথিবীর সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ । মোরসেলিন লিখেছিলেন যে, মুহাম্মদের পর অনেক বড়ো বড়ো বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও মনীষী জন্ম গ্রহণ করেছেন । মুহাম্মদ তাঁর যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে কি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলা যায় ?  এ রকম কিছু কথা লেখার জন্যে মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁকে মোরতাদ ঘোষণা করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিয়েছিলো । তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করতে চেয়েছিলো । যে পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন তাঁর সম্পাদক একজন মুসলমান । তাঁর উপরেও একই ফতোয়া দিয়ে তাঁর বাড়িতেও অগ্নি সংযোগ করা হয়েছিলো । শেষ পর্যন্ত দুজনকেই   মুসলিম মৌলোবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুচলেকা লিখে দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছিলো । এ ছাড়া প্রাণে বাঁচার জন্যে তাঁদের সামনে বিকল্প পথ ছিলো না, কারণ পুলিশ ও শাসক দল সিপিএম যাদের আক্রান্তদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিলো তারা ফতোয়াকেই সমর্থন জানিয়েছিলো ।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন এ রকম আক্রমণ ইসলাম সম্মত নয় । তাঁরা মিথ্যাচার করেন । এমন কোনো কথা বলা যাবে না যাতে ইসলাম এবং ইসলামের নবী এবং ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি  নিয়ে কোনো সংশয় প্রকাশ পায় । ইসলামের উপর পরিপূর্ণ আস্থা ও আনুগত্য রাখতে হবে, যারা কিছু মানবে কিছু মানবে না বা কোনো কোনো বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করবে তারা কপট মুসলমান, ইসলামের পরিভাষায় যাদের  মুনাফেক বলা হয় । মুনাফেকদের বিরুদ্ধেও কঠোর মনোভাব নিতে এবং যুদ্ধ করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে । কোরানে তাদের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ভাষ্য আছে ।  একটি ভাষ্য এ রকম -  “মুনাফেক নরনারী  একে অপরের দোসর, কুকাজের নির্দেশ দেয়, সৎকর্মে নিষেধ  করে ।”  [৯/৬৭]   কোরান স্পষ্ট ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে - - “হে নবী ! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন ও কঠোর হউন, তাহাদের আবাস জাহান্নাম, উহা নিকৃষ্ট স্থান ।” [৯/৭৩]  কাজী ওদুদদের কোরান-হাদিসের বাইরে গিয়ে মুসলিম সমাজকে উন্নতির পথের সন্ধান করতে বলার পরামর্শ, কিংবা কোরানের সত্যতা নিয়ে মোরসেলিনের সংশয় প্রকাশ প্রভৃতি ঘটনাগুলি কুকাজ বৈ নয় । কবি ইকবাল ইসলাম-অন্তপ্রাণ, তাঁকে একজন কাফেরের সঙ্গে তুলনা করে ছোট করে দেখানোর পেছনেও অসৎ উদ্দেশ্যের গন্ধ খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না ধর্মান্ধ মুসলিম  সুতরাং তাঁরা মুনাফেক । হয় তো মাসুম আক্তারের কারবালা প্রবন্ধে সে রকম কিছু গন্ধ খুঁজে পেয়েছেন মুসলিম মৌলবাদীরা । 
মাসুম আক্তারের উপর আক্রমণের এই ঘটনার জন্যে শুধু মুসলিম মৌলবাদিদের  বিরুদ্ধে আঙুল তুললেই  হবে না ।  এটা তো ইসলামিক রাষ্ট্র নয় যে তারা স্বচ্ছন্দে এভাবে ইসলামের নীতি অনুসারে মুনাফেক বা কাফিরদের উপর হামলা চালাবে, তাদের হত্যা করবে কিংবা ক্ষত-বিক্ষত করবে । এটা তো গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে লেখকের উপর আক্রমণ করলে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া এবং আক্রমণকারীকে আইনের অধীনে শাস্তি দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য   । আর যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদেরও তো লেখকের পাশে দাঁড়ানো ও আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ করা কর্তব্য । রাষ্ট্র   এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষেরা যে যার  দায়িত্ব পালন করলে কি মুসলিম  মৌলবাদীরা এ রকম আক্রমণ করার সাহস পাবে ?  নাগরিক সমাজ চোখ বন্ধ করে থাকে আর রাষ্ট্র তো সরাসরি মুসলিম মৌলবাদিদের পক্ষেই  দাঁড়িয়ে যায় । অমুসলিম বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনরা  এ প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া চাইলে জড় পদার্থের মতো নিরুত্তর থাকেন । হিন্দু মৌলবাদিদের ক্ষেত্রে তাঁরা আবার ভীষণ সরব । তাঁদের এই দ্বিচারিতা আমাকে অবাক করে, লজ্জিতও করে । তাঁদের প্রতি আমার যতো রাগ হয় তার চেয়ে বেশী করুণা হয় । ধর্মীয় মৌলবাদিদের জাত বিচার করা এই বুদ্ধিজীবীরা কি ভিতু ?  না কি মুসলমানরা মুসলমানদের মারছে  আমরা তার মধ্যে নাক গলাবো না, ওটা মুসলমানরা বুঝে নেবে -  এ রকম হীন ও দৈন্য চিন্তার শিকার ? আমার মনে হয় দুটোই । এই সব বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা নাকি জাতির বিবেক । তাঁরা যাই হোন না কেনো, তাঁরা মুসলিম সমাজের চোখে কিন্তু খুবই সজ্জন ও ধর্মনিরপেক্ষ  মহাপুরুষ । এই বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা কিন্তু জেনে করুক কিংবা না জেনে করুক মুসলিম মৌলবাদীদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছেন । আর মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল । তাঁরা তো ইসলাম শান্তির ধর্ম বলেই খালাস । মুসলিম মৌলবাদীরা ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা কী সর্বনাশ করছে সে ব্যাপারে তাঁরা ভাবিত নয়, তাঁরা ভাবিত এটা ভেবে যে ইসলামের বদনাম হচ্ছে । মানুষ মরুক, দেশ ডুবুক অন্ধকারে, গণতন্ত্র এবং শান্তি-সম্প্রীতি ধ্বংস হয় হোক, কিন্তু তবুও কীভাবে ইসলামকে শান্তির ধর্ম, দয়া ও ক্ষমার ধর্ম, মানবতার ধর্ম বলে জাহির করা যায় সেই  চিন্তা ও কাজে তাঁরা বিভোর ! মুসলিম মৌলবাদীদের পাশে কিন্তু আমরা দেখতে পাই আর একটা বিরাট শক্তিকে । সংবাদ মাধ্যম – খবরের কাগজ ও বৈদ্যুতিন চ্যানেল, দুটোই । মুসলিম মৌলবাদীরা যতই ফতোয়া দিক, যতই হামলা করুক, সেই হামলাই যতই ক্ষয়ক্ষতি হোক সংবাদ মাধ্যমগুলি নীরব থাকে । বৈদ্যুতিন চ্যানেলগুলো কতো নামে কতো টক শো করে, কিন্তু কোনোদিন মুসলিম মৌলবাদিদের বাড়-বাড়ন্ত নিয়ে টক শো করা তো দূরের কথা, তাদের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডগুলো সবই চেপে যায় । মাসুম আক্তারের উপর আক্রমণের ঘটনা নিশ্চয় ছোটো ঘটনা নয় । কিন্তু কোনো মিডিয়াতেই খবরটা করা হয় নি ।  এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম দৈনিক স্টেটসম্যান । এই কাগজই একমাত্র খবরটা করেছে । সংবাদ মাধ্যমগুলির এই ভূমিকা মুসলিম মৌলবাদিদের মনোবল ও উৎসাহ বাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করে ।
মুসলিম মৌলবাদীদের আজ এতো শক্তি ও সাহস হয়েছে তার পশ্চাতে রয়েছে রাষ্ট্রের মোল্লাতন্ত্রতোষণ নীতি এ ব্যাপারে ডান-বাম সবাই সমান । মোরসেলিনের উপর যখন আক্রমণ হয়েছিলো তখন খোলাখুলি বাম সরকারের প্রশাসন মৌলবাদীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো । তসলিমার উপর যখন আক্রমণ হয়েছিলো তখনও বাম সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে ও মোল্লাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো । ২০০৫ সালে যখন আমার মুণ্ডু কাটার ফতোয়া দিয়েছিলো তখনো বাম সরকার আমাকে নিরাপত্তা দেয় নি   থানা  আমার অভিযোগই নেয় নি । প্রশাসন ফতোয়াবাজদেরই সমর্থন জানিয়েছিলো । মাসুম আক্তারকে তো পুলিশের সামনেই মেরে মাথা ফাটিয়ে দিলো ও নিগ্রহ করলো । পুলিশ না দিলো তাঁকে নিরাপত্তা, না আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলো । পুলিশের এই ভূমিকার পেছনে সরকারের মোল্লাতোষণ নীতি ছাড়াও আর একটা বড়ো কারণ আছে ।  মাসুম আক্তার শুধু মুসলিম ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধেই সরব নন,  মুসলিমদের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জী যে প্রতারণা করে চলেছেন তার বিরুদ্ধে তিনি সমানে সরব    তাই এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে তাঁর উপর যে হামলা হয়েছে তাতে প্রশাসনের ইন্ধন ছিলো । মাসুমের তবু বরাত ভালো বলতে হবে এ জন্যে যে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ইসলামের অবমাননার অভিযোগ  তোলে নি । তসলিমা, মোরসেলিম মোল্লা ও আমার বিরুদ্ধে তো পুলিশ ও শাসক দল এই অভিযোগই করেছিলো । কয়েক মাস আগে মেটিয়াবুরুজের ফারুক উল ইসলাম নামে একজন যুক্তিবাদী যুবক ফেসবুকে শুধু একটা হাদিস শেয়ার করেছিল । তার জন্যে   মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁর বাড়িতে হামলা করেছিলো । অল্পের জন্যে সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো    পুলিশ কিন্তু তাঁকেই  মুসলিমদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছিলো,  আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কেস দেয় নি ।  
কাজী মাসু আক্তারের বিরুদ্ধে মুসলিম  মৌলবাদীদের হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । এই হামলা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধেও নয় । এটা বাক-স্বাধীনতার উপর হামলা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হামলা । এই হামলা কোনো একজন মুসলমান লেখকের উপর কিছু ধর্মান্ধ মোল্লা ও মুসলমানদের হামলা নয় । এটা একজন লেখকের উপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলা । লেখকের যেমন কোনো জাত হয় না, তেমনি ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও জাত হয় না  সব ধর্মীয় মৌলবাদীদের চরিত্র কম বেশী একই রকম -  তারা বিশ্বাসে গোঁড়া, অসহিষ্ণু, হিংস্র, অমানবিক, আধিপত্যবাদী ও সন্ত্রাসবাদীএকজন লেখক যে মতেরই হোক, মতাদর্শেরই হোক, আস্তিক বা নাস্তিক বা সংশয়বাদীই হোক, সে একজন লেখক ।  কেউ  যদি ধ্বংসের কথা না বলে, কাউকে হত্যা করার কথা না বলে, কাউকে হত্যার প্ররোচনা না দেয়, সে যে মতেরই লেখক হোক তাঁর বাক-স্বাধীনতার পক্ষে ও মত প্রকাশের পক্ষে আমাদের সকলকেই দাঁড়াতে হবে । না হলে  ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে, বিশেষ করে মুসলিম মৌলবাদীদের  হাত থেকে আমরা কেউই রেহাই পাবো না ।  


KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...