Saturday, October 31, 2015

মুসলিম নারীদের ন্যায় বিচার দিতে হলে ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’কে বাতিল করা জরুরী



সর্বোচ্চ আদালতের দুই সদস্যের (এ.আর.দাভে ও এ.কে.গোয়েল) একটি বেঞ্চ সম্প্রতি মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছেবেঞ্চটি প্রধান বিচারপতিকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেও অনুরোধ করেছেবিচারপতিদের  মন্তব্যগুলি এবং প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া তাঁদের  প্রস্তাবগুলি   খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অনুধাবনযোগ্য এবং ভীষণ সময়োপযোগী । বিচারপতিদ্বয়  বলেছেন যে, মুসলিম মহিলারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে খুবই  প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে রয়েছে,  কারণ এই আইনে বহু বিবাহ এবং তালাকের স্বৈরাচার ও স্বেচ্ছাচার রোধের কোনো ব্যবস্থা নেই ।  ফলে মুসলিম মহিলাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারগুলি  লঙ্ঘিত হচ্ছে ।  বিচারপতিদ্বয় তাই এই আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা  আছে কী না খতিয়ে দেখা আবশ্যক বলে  মন্তব্য করেছেন । তাঁরা বলেছেন বহু বিবাহ জননৈতিকতার পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক । এর আগে এ প্রসঙ্গে আদালতের একটি রায় রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে,  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বিচার ব্যবস্থা (জুডিসিয়ারি) হস্তক্ষেপ করতে পারে না,  কারণ এটা নীতিগত বিষয় । এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে শুধু সরকার ও আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলি । সেই  রায়ের প্রসঙ্গ টেনে এ.আর.দাভে ও এ.কে.গোয়েলের  বেঞ্চ বলেছে যে বহু বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার শুধু ধর্মের বিষয় নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে  মুসলিম নারীদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়টিও ।  এটা তাই শুধু নীতির বিষয়ই নয়,  এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সংবিধান প্রত্যকের জন্যে সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার যে অঙ্গীকারের  কথা বলেছে  সেটাও ।   সুতরাং কোনো আইনে সেটা লঙ্ঘিত হচ্ছে কী না তার উপর  লক্ষ্য রাখাও  বিচার  ব্যবস্থার সাংবিধানিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত    যদি দেখা যায়  কোনো আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে , তবে সর্বোচ্চ  আদালত  সেই অসাংবিধানিক আইনটি  সম্পর্কে নীরব থাকতে  পারে না বিচারপতিদ্বয় আরো  বলেন যে, সতীদাহ প্রথার মতো মুসলিম সমাজে চলতে থাকা বহু  বিবাহ ও তালাক প্রথাও বাতিল  করা আবশ্যক  এবং   এটাই হচ্ছে উপযুক্ত সময়  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি পর্যালোচনা করে দেখার । তাঁরা বলেন যে,  সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম ব্যক্তিগত   আইনেও পরিবর্তন আনা জরুরী  সমগ্র বিষয়টি পর্যালচনা করার জন্যে তাঁরা প্রধান বিচারপতির নিকট একটি পৃথক বেঞ্চ গঠন করার  প্রস্তাব রেখেছেন ।   মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে শীর্ষ আদালতের আরো কয়েকটি রায় বিশ্লেষণ করার পর বিচারপতিদ্বয় আ্যাটর্নি জেনারেল ও ন্যাশন্যাল লিগেল সার্ভিসের অথরিটিকে একটি নোটিশ জারি করেছেন । আগামি ২৩শে নভেম্বরের মধ্যে ঐ নোটিশের নোটিশের জবাব দিতে  নির্দেশ দেওয়া  হয়েছে  
সর্বোচ্চ আদালত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করার কথা এর আগেও বলেছে । ১৯৮৫ সালে শাহবানু  মামলার রায় দিতে গিয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চও সরকারকে বলেছিলো সমস্ত ব্যক্তিগত আইনগুলি রদ করে সকলের জন্যে এক আইন তৈরী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে । সরকারকে সংবিধানের নির্দেশাত্মক অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বেঞ্চ বলেছিলো যে, সংবিধান প্রণেতাগণ জানিয়েছিলেন  যে পৃথক পৃথক ব্যক্তিগত আইন একটি সাময়িক ব্যবস্থা, যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশে সকলের জন্যে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন করতে হবে ।  প্রতিবারই  সংবিধানের শপথ নিয়ে সরকার তৈরী হয় বটে,   কিন্তু  কোনো সরকারই সংবিধানের সেই নির্দেশ  রূপায়ন করার চেষ্টা করে না  । ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ শুধু অগ্রাহ্যই করে নি, তালাক প্রাপ্তা মুসলিম মহিলাদের পক্ষে খোরপোষের যে রায় দিয়েছিলো সেই রায়কেও সংসদে নতুন আইন করে বাতিল করে দিয়েছিলো । অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি করার ক্ষেত্রে কোনো উৎসাহ দেখায় নি ।
বিচারপতি দাভে ও গোয়েলও এবার মুসলিম ব্যক্তিগত আইন রদ করার জন্যে বলেছেন । এ প্রসঙ্গে তাঁরা যা যা বলেছেন তার সবগুলিই মুসলিম নারীদের মনের কথা ।  মুখের কথাও । তাঁরা   যথার্থই  বলেছেন যে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে পুরুষের বহু বিবাহ ও ইচ্ছে হলো তালাক দিলাম প্রথার বিরুদ্ধে কোনো রক্ষাকবচ নেই । উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও মুসলিম নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে । ফলে পদে পদে মুসলিম নারীদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে  এবং  তারা ন্যায্য অধিকার, সমানাধিকার ও  ন্যায় বিচার  থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । মুসলিম মেয়েরাও এখন  লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শিখে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে, স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর হচ্ছে, আধুনিক যুগের  সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের আধুনিক করে গড়ে তোলার সাধনা করছে । কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে শরিয়তি সংস্কৃতি ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন প্রতি পদে বাধাগ্রস্ত করছে । বিচারপতি দাভে ও গোয়েল তাই সঙ্গতঃ কারণেই বলেছেন যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনেরও সংস্কার ও  উন্নতি বিধান করা জরুরী ।  ভারতীয় মুসলিম নারীরাও তাই চাই । মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বাধীন একটি স্বাধীন   সংস্থা, বিএমএমও (ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন) সম্প্রতি এই বিষয়েই একটি সমীক্ষা চালায় তাতে দেখা গেছে যে প্রায় ১০০%  মুসলিম মহিলাই চাই যে বহু বিবাহ ও তালাক প্রথা বাতিল করা হোক ।   ২০১৩ সালের জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতের দশটি রাজ্যে ৪৭১০ জন নারীর মধ্যে একটি  সমীক্ষা চালানো হয় । তাদের মধ্যে  ৯২.১% নারীই বলেছে যে তারা মৌখিক  তালাক  আইনের অবসান চায়, আর ৯১.৭% নারী বলেছে তারা বহু বিবাহ আইনের বিরুদ্ধে । তারা এমন  একটা আইন  চায় যাতে পুরুষরা একতরফা খেয়াল খুশীমতো   তালাক দিতে না পারে । তারা চাই যে  সালিশি বা আদালতের মাধ্যমে তালাকের বিষয়টা    নিষ্পত্তি হোক   যে রাজ্যগুলিতে সমীক্ষা চালানো হয় তারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গও আছে,  বাকি রাজ্যগুলি হলো  মহারাষ্ট্র, গুজরাট,  কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহার । 

বিএমএমও অনেকদিন ধরেই মুসলিম মহিলাদের স্বার্থে কাজ করে আসছে । তারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করে এমন একটা নতুন আইন প্রণয়ন করার দাবীতে আন্দোলন করছে যে আইনে মুসলিম নারীদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার সুব্যবস্থা থাকবে । সর্বোচ্চ আদালত সম্প্রতি মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বাতিল করার জন্যে যে জোরালো বক্তব্য রেখেছে তা নিশ্চয় তাদের   প্রচুর উৎসাহ ও সাহস  জোগাবে  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় নিয়ে তারা খুব শীঘ্রয় দিল্লীতে একটি  কর্মশালা সংগঠিত করতে চায়  পশ্চিবঙ্গেও দুটি মহিলা সংগঠন  মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সংস্কার  করার দাবিতে আন্দোলন করছে । সংগঠন দুটি মূলতঃ মুসলিম মহিলাদের নিয়ে তৈরী এবং নেতৃত্বেও রয়েছে মুসলিম পরিবারের মেয়েরাইসংগঠন দুটির একটি হলো ‘রোকেয়া উন্নয়ন সমিতি’ যার নেতৃত্ব রয়েছেন খাদিজা বানু এবং অন্যটি হলো ‘ফোরাম ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন ইন ইণ্ডিয়া’ যার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক আফরোজা খাতুন । তাঁরা যে দাবিগুলি নিয়ে আন্দোলন করছেন তার মধ্যে  প্রধান দাবিগুলি হলো – এক).   বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করতে হবে ।  দুই).   আদালতের বাইরে তালাক দেওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তালাক দেওয়ার বিষয়ে নারী ও পুরুষ উভয়কেই  সমানাধিকার  দিতে  হবে ।  তিন). উত্তরাধিকার আইনে নারী ও পুরুষ উভয়কেই  সমান অধিকার দিতে হবে । চার). মুসলিমদেরকে দত্তক আইনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে । সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও অভিমত তাদের সংগঠন ও আন্দোলনকেও নিশ্চিতভাবেই শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে ।
মুসলিম সমাজের রক্ষণশীল ধার্মিক মহিলারাও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে বদল চান, তাঁরাও চান নতুন বিবাহ আইন যে আইনে পুরুষের বহু বিবাহ ও  যখন খুশী তালাক প্রদান রোধে মুসলিম নারীদের হাতে রুক্ষাকবচের ব্যবস্থা থাকবেতাঁরা অবশ্য শরিয়তি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন । ফলে প্রতি  পদে উলামার সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ও সংঘাত হচ্ছে  । তারই ফলশ্রুতিতে  ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’  থেকে বেরিয়ে তাঁরা পৃথক ‘অল ইণ্ডিয়া  মুসলিম মহিলা পার্সোনাল ল বোর্ড’ গঠন করেছেন ।  এই বোর্ড ২০১১ সালে   একটি পৃথক ‘নিকাহ নামা’ (বিবাহ আইন) প্রণয়ন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠিয়েছে এবং দাবি জানিয়েছে তার ভিত্তিতে নতুন করে ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ প্রণয়ন করার     তাঁরাও তাঁদের প্রস্তাবিত নতুন ‘নিকাহ নামা’য় নারী ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করেছেন নস্যাত করে দিয়েছেন  ইন্টারনেট, স্কাইপ, মোবাইল ইত্যাদির মাধ্যমে তালাক প্রদানের বৈধতাকে  । পতি যদি অন্য নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তবে পত্নীর তাকে  তালাক দেওয়ার অধিকারও তাঁরা দাবি করেছেন । এমনকি  পত্নী চাইলে  এইডস রোগাক্রান্ত পতিকে  তালাক দেবার  অধিকারও তাঁরা দাবি করেছেন । পতি যদি প্রকৃতিবিরুদ্ধ   পদ্ধতিতে পত্নীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করার জন্যে পত্নীর উপর অত্যাচার করে তবে সে ক্ষেত্রেও নতুন ‘নিকাহ নামা’য়  পতিকে পত্নীর তালাক দেওয়ার অধিকারও চাওয়া হয়েছে । মোদ্দা কথায় ধার্মিক মুসলিম মহিলারা প্রায় একটি বৈপ্লবিক ‘মুসলিম নিকাহ নামা’ প্রণয়ন  করেছেন এবং তা আদায়ের জন্যে  আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন । এ কথাগুলি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে অবিশ্বাস নিরসনের জন্যে এই লিংকটি খুলতে পারেন - http://www.muslimwomenpersonallaw.com/aboutus.html
সুপ্রীম কোর্ট ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ সম্পর্কে যা বলেছে তা উপলব্ধি করেছে বিশ্বের  বহু মুসলিম দেশই এবং তারা এই আইনটির ব্যাপক সংস্কার করেছে । সে রকম  কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশ হলো   ইরাক, ইরান, মরক্কো, লিবিয়া, লেবানন, জর্ডন,  ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মিশর, আলজিরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি   পাকিস্তান ১৯৬১ সালে এই আইনের সংস্কার করে আদালতের বাইরে তালাক ও প্রথম পত্নীর অনুমতি ব্যতিরেকে দ্বিতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম হলে সে দেশটিও সেই আইনকেই বহাল রেখেছে  কয়েকটি দেশ তো বহু বিবাহ সম্পূর্ণরূপেই  নিষিদ্ধ করেছে যার মধ্যে  মিশর, তুরস্ক ও ইরান রয়েছে  । বাকি দেশগুলিতে বহু বিবাহ  আদালতের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ নিষিদ্ধ । তালাকের ক্ষেত্রেও একই আইন করেছ,  অর্থাৎ আদালতের বাইরে তালাক দেওয়া বেআইনী ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং তালাকের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে । মূল কথা হলো  গোটা  বিশ্ব  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে বর্জন করেছে অথচ ভারতে  এই আইন আজো চালু আছে ।  
আমাদের  দেশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কারের পথে প্রধান বাধা উলামা (মুসলিম সমাজের  ধর্মগুরুগণ)তাদের পক্ষ থেকে প্রবল বাধা আসাটা স্বাভাবিক । যে সব দেশে এই আইনে সংস্কার  হয়েছে সে দেশগুলিতেও তারা বাধা দিয়েছে প্রবল । সেই প্রবল বাধা অগ্রাহ্য করেই তারা সংস্কার  করেছে । তাহলে ভারত  পারছে না  কেনো ?  পারছে না এ জন্যে যে এ দেশের কোনো সরকারেরই রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই । প্রত্যকটি রাজনৈতিক দলের (বিজেপি বাদ) মুসলিম নেতৃবৃন্দও চাই না যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কার হোক । এই নেতাদের মধ্যে দু’ শ্রেণীর লোক রয়েছে । তাঁদের একটা দল ধর্মান্ধ ও গোঁড়া, তাঁরা উলামার মতোই শরিয়ত আইনে (শরিয়ত আইনের একটা অংশ হলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইন) সামান্য সংস্কারেরও ঘোরতর বিরোধী । আর একদল আছে যারা প্রগতিশীল,  শরিয়ত আইন কতোটা  অপকারি, ক্ষতিকারক ও অপ্রাসঙ্গিক তা তাঁরা উপলব্ধি করেন, কিন্তু মুসলিম ভাবাবেগ আহত  হবে বলে তাঁরা এই আইনে  সংস্কার ও  সরকারি  হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন ।  এঁরা জ্ঞানপাপী ও স্বার্থপর, ভোটে জেতার জন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠলেই মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে উলামার সঙ্গে এক সুরে কথা বলেন ।   এই  গোঁড়া ও ধর্মান্ধ এবং জ্ঞানপাপী মুসলিম নেতাদের কথাতেই সীলমোহর লাগিয়ে দেয় সমস্ত রাজনৈতিক দল । এ ব্যাপারে ডান,  বাম, অতি বাম সবাই একই গোত্রভুক্ত,  কারণ নীতি ও  আদর্শগতভাবে সব দলই দেউলিয়া দশাপ্রাপ্ত । ফলে  তারা  মতাদর্শগতভাবে ইসলামি ধর্মান্ধতা ও  গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই করতে অপরাগ ও অক্ষম  এ দেশের বুদ্ধিজীবি ও বিদ্বজন বলে খ্যাতি ওয়ালা মানুষরাও আদর্শগতভাবে দেউলিয়া । হয় তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তল্পীবাহক, না হয় মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীহিন্দুত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা হৈ হৈ করে প্রতিবাদে করেন, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের ভয়ঙ্কর হিংস্র আক্রমণেও তাঁদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙে না । মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল মানুষরা আক্রান্ত হলে, কিংবা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে  লক্ষ লক্ষ  মুসলিম নারী নির্যাতিত হলে, তাদের মানবাধিকার লংঘিত হলেও তাঁরা রা কাড়েন না । বলেন,  ওটা মুসলমানদের ব্যাপার,  মুসলমানদেরই বুঝে নিতে হবে । ওঁদের বিচারে মুসলিম মহিলারা শুধু মুসলিমই, মানুষ নয়, তাই তাদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার থাকতে নেই ।
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরুদের  চেয়ে এই সমাজের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা অনেক বেশী ক্ষতিকারক ।  ধর্মগুরুরা তো সোজা ব্যাটে খেলেন, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন না । তাঁরা সাফ সাফ বলেন,  আল্লাহর আইনে হস্তক্ষেপ মানবো না ।   এই আইনে  বহু বিবাহ ও তালাক সহ যা যা আছে   তা যতই প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাদপদ হোক সবই তাঁদের চোখে সবই উৎকৃষ্ট, তাঁরা বলেন আল্লাহর চেয়ে উৎকৃষ্ট আইন মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় ।  তাই  তাঁরা যে কোনো মূল্যে শরিয়ত আইনকেই আঁকড়ে থাকতে চান ।   অপরদিকে মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা ও বুদ্ধিজীবীরা  অসৎ ও প্রতারক ।  তাঁরা  মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে টিকিয়ে রাখার জন্যে নানা যুক্তির অবতারণা করেন যা আসলে অপযুক্তির নামান্তর  তাঁদের যুক্তি হলো, ভারতে সব ধর্মের মানুষের জন্যেই  ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত আইন রয়েছে ।   ভারতের মতো বহু বর্ণ, ভাষা ও ধর্মের দেশে এই ভিন্নতা স্বাভাবিক জোর করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক  বিষয়ে  অভিন্ন আইন  প্রবর্তন করলে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । সতিকারের সৎ প্রগতিশীল মানুষদের উচিৎ সমস্ত প্রকার পশ্চাদপদ ব্যক্তিগত আইনগুলির অবসান করে সকলের জন্যে একটি অধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ  অভিন্ন আইন প্রণয়ন করার দাবি তোলা এবং তার পক্ষে জনমত গঠন করা । কিন্তু মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবিরা ভিন্ন ভিন্ন যে ব্যক্তিগত আইন রয়েছে তাকেই  ঢাল করে বা যুক্তি হিসেবে খাড়া করে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে রক্ষা করতে চাইছেন ।  এটা যে অপযুক্তি তা বলা বাহুল্য । অপযুক্তি ছাড়াও এই লোকগুলো শরিয়ত আইনের পক্ষে সীমাহীন মিথ্যা প্রচারণা করতে সিদ্ধহস্ত তাঁরা বলেন যে এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া শরিয়ত আইন সমর্থন করে না এবং  শরিয়ত আইন  বহু বিবাহকেও  উৎসাহ দেয় নাতাঁদের দাবি হলো বহু বিবাহ ও তালাকের যে ঘটনাগুলো ঘটে তারজন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন দায়ী নয়, দায়ী এই আইনের অপব্যবহার  সুতরাং বহু বিবাহ ও তালাকের ঘটনাগুলি রোধ করার জন্যে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বদল বা রদ করার দরকার নেই, দরকার হচ্ছে এই আইন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা ।   
শরিয়ত আইনে একসঙ্গে তিন তালাক অবৈধ এবং এই আইন বহু বিবাহকেও উৎসাহিত করে না বলে যে প্রচারণা তাঁরা করেন তা নির্জলা মিথ্যাচার বৈ নয় । শরিয়ত আইনের প্রধান দু’টি স্তম্ভ হলো কোরান ও হাদিস । হাদিস বলছে যে মুহাম্মদ নিজেই  তিন তালাককে বৈধতা  দিয়ে যান ।  পরে  দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক ডিক্রি জারি করে  এক সঙ্গে তিন তালাককে  শরিয়তি আইনের অন্তর্ভুক্ত করে যান । এর সপক্ষে অনেক হাদিস  আছে , সে রকম একটি হাদিস হলো – “ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম(রঃ)  রেওয়ায়েত করেছেন, তাউস(রঃ) বলে যে, আবু ছাহাবা (রঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) –কে বললেন, আপনার সে দুষ্প্রাপ্য এবং অভিনব ধরণের হাদীস হতে কিছু পেশ করুন । রাসূলে পাক(সাঃ) এবং আবুবকর (রাঃ) –এর যমানায় তিন তালাক কি এক তালাক ছিল না ? তিনি বললেন, তা ছিল বৈ কি ।  পরে যখন ওমর (রাঃ) – এর যমানায় লোকগণ অহরহ এবং উপর্যুপুরি তালাক দিতে শুরু করলো । তখন ওমর (রাঃ) তিন তালাকের যথার্থ বিধান তাদের জন্য বাস্তবায়িত করলেন(  মুসলিম শরীফ, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, বাংলাদেশ, ত্রয়োদশ অধ্যায়, হাঃ নং – ৩৫৪০) । শরিয়ত আইন বহু বিবাহকে নিরুৎসাহিত করে বলে যে দাবি করেন মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ  তার পক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ তাঁরা  পেশ করেন  না । আসল কথা হলো,  নেই তো রাখবেন কী করে । বরং দেখুন কোরান ৪/৩ নং আয়াতে  কী বলছে -  বিয়ে করবে স্বাধীন নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভাল লাগে, দুই, তিন, বা চার জনকে ।’’  এই আয়াতটি  স্পষ্টতই বহু  বিবাহকে  উৎসাহ প্রদান করছে তাছাড়া মুসলমানদের নিকট যাঁরা চিরো আদর্শ পুরুষ  সেই মুহাম্মদ ও তাঁর খলিফাগণও তো বহু বিবাহ করে বহু বিবাহে ব্যাপক উৎসাহ দিয়ে গেছেন । মুহাম্মদ ঠিক কয়টি বিয়ে করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছেতবে সর্ব নিম্ন চোদ্দটি যে বিয়ে করেছিলেন তা  তর্কাতীত ও সংশয়াতীত আর  তাঁর   সেরা চার জন খলিফা আবু বকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি এবং  আলিও   অনেকগুলি বিয়ে করেছিলেন । প্রথম খলিফা আবু বকর করেছিলেন চারটি বিয়ে, দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক করেছিলেন সাতটি, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি করেছিলেন আটটি এবং চতুর্থ খলিফা মুহাম্মদের জামাই  আলি করেছিলেন এগারোটি ।  তবে কোরানের নির্দেশ কেউ লঙ্ঘন করেন নি,  কেউই  চারজনের বেশী পত্নী  এক সঙ্গে  একত্রিত  করেন নি । বিবাহিত পত্নী ছাড়াও তাঁদের সকলেরই বহু উপপত্নী ছিলো । আলির ছিলো ১৯ জন উপপত্নী 
ভারত জুড়ে মুসলিম সমাজে বহু বিবাহ ও তালাকের যে সংস্কৃতি চালু আছে তা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের কারণেই । এই সত্যটাকে আড়াল করার জন্যে এ দেশের ধান্দাবাজ মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীগণ মিথ্যাচার করে চলেছেন ।  আর তাদের মিথ্যাচারের বলি হচ্ছে ভারতীয় মুসলিম মহিলারা । সেই মহিলাদের রক্ষা করার জন্যে সর্বোচ্চ আদালত তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করার জন্যে সৎ ও সাহসি পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হয়েছে । এই আদালতের দুই সম্মানীয় বিচারপতি বলেছেন যে মুসলিম মহিলাদের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার দিতে হলে সতীদাহ প্রথার মতো ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’কেও বাতিল করতে হবে না, সত্যি এর কোনো বিকল্প নেই ।

Wednesday, October 28, 2015

হিযাবঃ নারী দাসত্বের প্রতীক



প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারী আজকের মুসলিমদের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতো এবং অনেক বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলোএ বিষয়টি পৃথক একটি অধ্যায়ে একটু বিশদে আলোচনা করা হয়েছেএখানে শুধু এ প্রসঙ্গে এ টুকু বলার যে মুসলিমদের ধারণা ও বিশ্বাস ঠিক এর বিপরীত। শুধু মুসলিমদের মধ্যেই নয়, একই ধারণা ও বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে  অমুসলিমদের   মধ্যেও। তাঁরা মনে করেন যে  মুহাম্মদ যখন  আরবে জন্মগ্রহণ করেন তখন নারীদের অবস্থা ছিলো খুবই সঙ্গীন, ক্রীতদাসীর মতো তাদের জীবন যাপন করতে হতো, এমনকি তাদের জন্মের পর মেরে ফেলাও হতো। মুহাম্মদ সেই অবস্থা থেকে নারীকে উদ্ধার করেন এবং তাদের  পুরুষের সমান অধিকার ও স্বাধীনতা দেন। মুসলিম সমাজ তো মুহাম্মদকেই নারীর একমাত্র নারীর ত্রাণকর্তা ও মুক্তিদাতা বলে মানেন। মুসলিমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে মুহাম্মদই বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীবাদী ব্যক্তিত্ব। নারীর  প্রতি কতো দরদ ছিলো এবং সারা জীবন কীভাবে নারীর স্বাধীনতা, মুক্তি ও কল্যাণের জন্যে মুহাম্মদ সংগ্রাম করেছেন তাঁর বিবরণ দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একজন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও ইসলামি পণ্ডিত লিখেছেন, “নিখিল জগতের দুর্গত রমণীকুলের অচিন্ত্যণীয় ঐতিহাসিক ত্রাণকারী মানব, যিনি তাঁর সমস্ত শক্তির অর্ধেকটা নিযুক্ত করেছিলেন সারা সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য, দুর্গত মানুষের জন্য। বাকি অর্ধেকটা নিয়োগ করেছিলেন শুধু মাত্র মায়ের জাতি, অবহেলিত, নির্যাতিত নারী সম্প্রদায়ের জন্য ... ” (দ্রঃ মহানবী, ড. ওসমান গণি, পৃ – ৩৯০) মুহাম্মদ সম্পর্কে এরূপ মূল্যায়ন ও দাবী সম্পূর্ণ অবাস্তব ও ভিত্তিহীন। বরং সত্যিটা হলো এই যে, আরব বেদুইন রমণীরা যে সব স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতো মুহাম্মদ সেগুলির সবই একে একে হরণ করে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে সর্বাগ্রে হিযাবের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রাক ইসলাম যুগে আরবে ‘হিযাব’- এর প্রচলন ছিলো না। ‘হিযাব’ হলো নারী দাসত্বের একটি ঘৃণ্য প্রতীক যা মুহাম্মদ আরোপ করেন মুসলিম নারীর উপর। প্রাক ইসলাম যুগে আরব নারী প্রায় পুরুষের মতোই স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতো। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো এবং যুদ্ধেও অংশ নিতো। মুহাম্মদ নারীর সেই সব স্বাধীনতাগুলির ওপর হস্তক্ষেপ করে তাদের গৃহবন্দি ও  পর্দানসীন  করেন। নারীর পর্দানসীনতাই ইসলামের পরিভাষায় ‘হিযাব’। মুহাম্মদ আল্লাহর দোহাই দিয়ে ‘হিযাব’ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এবং বিশ্বাসিনী নারীদিগকে বলো, তারা যেনো স্ব স্ব দৃষ্টি সকলকে বদ্ধ করে এবং কণ্ঠদেশে স্বীয় বস্ত্রাঞ্চল ঝুলাইয়া রাখে।” (কোরান, ২৪/৩১) কোরানে এ প্রসঙ্গে আর একটি আদেশনামা রয়েছে। সেটা হলো – “হে নবী (সঃ)! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে এবং মুমিনদের নারিদেরকে বলঃ তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ তাদের নিজেদের উপরে টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে; ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু ।” (৩৩/৫৯) 
নারী কী করবে কী করবে না, কী পরবে ও কীভাবে পরবে এবং কী পরবে না, কীভাবে চলবে কীভাবে চলবে না, কীভাবে কথা বলবে কীভাবে বলবে না, এ সব নানাবিধ নিয়ম-কানুন বা বিধান যা সমাজে চালু আছে তা সবই পুরুষেরদের রচিত। নারীকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয় সেই বিধান মেনেই। এ সব বিধানের সামান্য উল্লঙ্ঘন করলে বা এদিক ওদিক করলে নারীকে পেতে হয় শাস্তি ও নানারূপ ভর্ৎসনা। অসতী, কুলটা, বেহায়া, চরিত্রহীন, বেশ্যা এরূপ পুরুষ রচিত কুৎসিত ভাষা ও নোংরা গালাগাল শুনতে হয় তাদের। পাছে নারী এসব গালাগাল ও অপবাদ অগ্রাহ্য করে সেজন্যে তাদের পরকালের শাস্তির ভয়ও দেখানো হয়। নারীকে পুরুষ শিখিয়েছে, তার প্রধান ধর্ম হলো পতিসেবা করা। নারী যদি পতিসেবায় সামান্য ত্রুটি করে তবে মৃত্যুর পর তার জন্যে রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি, এ কথা তাকে পুরুষ বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। নারীর ‘মুক্তিদাতা’ মুহাম্মদ পুরুষ রচিত সেই কুৎসিত বিধানগুলি শুধু অনুমোদনই করেন নি, আপন ভঙ্গিমায় সেগুলিকে আরো নবরূপে এবং আরো কঠোর ও নিবিড় করে আল্লাহর নামে আইনরূপে প্রবর্তন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন অবলীলায় যে, পতিসেবায় সামান্য ত্রুটি হলে পরকালে নারীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে তা তিনি নিজের চোখে দেখে এসেছেন আল্লাহর নিকট গিয়ে। কী দেখেছেন তা বর্ণনা করতে গিয়ে  তিনি বলেছেন, “তিনি বললেন আমি তো জান্নাত দেখেছিলাম এবং একগুচ্ছ আঙ্গুরের প্রতি হাত বাড়িয়েছিলাম, আমি তা পেয়ে গেলে, দুনিয়া কায়েম থাকা পর্যন্ত তোমরা তা খেতে পারতে।  তার পর আমি জাহান্নামে  দেখলাম, আজকের মতো ভয়াবহ দৃশ্য আর কখনও দেখিনি। আর দেখলাম  জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী স্ত্রীলোক। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কী কারণে? তিনি বললেন, তাদের কুফুরীর কারণে। জিজ্ঞাসা করা হলো, তারা কি আল্লাহর সাথে কুফুরী করেছে? তিনি উত্তর দিলেন, স্বামীর অবাধ্য থেকে এবং তাদের এহসান অস্বীকার করে।”  (বোখারী শরিফ, ১ম-৭ম খণ্ডে একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং ৩৬৪) নারীকে কীভাবে পতিসেবা করতে হবে তার খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে গেছেন মুহাম্মদ। তিনি যা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে এ হাদিসটি, “হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - স্বামী যদি স্ত্রীকে বিছানার প্রতি আহ্বান করে এবং তাতে স্ত্রী অসম্মতি প্রকাশ করে, যদ্দরুণ স্বামী অসন্তুষ্টির সহিত রাত্রি যাপন করে তবে সেই স্ত্রীর রাত্রি এই অবস্থায় অতিবাহিত হয় যে, ফিরিস্তাগণ রাত ভোর পর্যন্ত তার প্রতি লানত (অভিশাপ) বর্ষণ করে ।” (সূত্র – ঐ, হাদিস নং ১১১৫) এ হাদিস অনুযায়ী এটা স্পষ্ট হয় যে, পতির যৌন কামনা ও যৌন-ক্ষুধা পূরণে পত্নীর কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি বাধা হতে পারে না। পতির যৌন আবেদনে সাড়া দেওয়াই যে নারীর প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য সেটা মুহাম্মদ স্পষ্ট করে দিয়েছেন আর একটি হাদিসে। হাদিসটি হলো – “যদি কোন ব্যক্তি সঙ্গম করার ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তার নিকট উপস্থিত হয় যদি সে উনানের উপর রন্ধনের কাজে লিপ্তও থাকে।” (মুসলিম শরীফ) নারীর ধর্মের নামে নারীর প্রতি এ সব নির্দেশ হলো নারী দাসত্বের এক একটি ঘৃণ্য বিধান। নারী দাসত্বের অনেক বিধান আছে যা নারীকে সর্বদা স্বীয় অঙ্গে বহন করতে হয়। যেমন হিন্দু নারীর হাতের শাখা, সিঁথির সিঁদুর, পতির পদবী ধারণ ইত্যাদি। তবে স্বীয় অঙ্গে বহন করার সবচেয়ে ঘৃণ্য দৃষ্টান্তটি হলো ‘হিযাব’। নারী দাসত্বের এই ঘৃণ্যতম ও অসভ্যতম প্রতীকটি বহন করতে হয় কেবল মুসলিম নারীদেরকেই।

হিযাবের পক্ষে মুসলিম পণ্ডিতগণ অনেক যুক্তি (আসলে অপযুক্তি বা কুযুক্তি) দেখালেও মুসলিম নারীরা কিন্তু হিযাবকে তাদের স্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে। ইসলামি রাষ্ট্রগুলিতে মুসলিম নারীরা সবাই বোরখা পরে। তা এ জন্যে নয় যে, তারা সকলেই বোরখা পরিধান করাকে সমর্থন করে। খুব কম মেয়েই আছে যারা বোরখা পরার আল্লাহর নির্দেশকে নীতিগতভাবে সমর্থন করে এবং স্বেচ্ছায় বোরখা পরে। অধিকাংশ নারীই ভয়ে বোরখা পরে যেহেতু সে সব দেশের আইনে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক এবং বোরখা না পরে রাস্তায় বের হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে সব মুসলিম দেশে সাংবিধানিক আইনে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক নয় এবং বোরখা না পরলে শাস্তির মুখে পরতে হয় না সেখানে ৮০-৯০% মুসলিম নারীই বোরখা বর্জন করেছে। ভারতের সংবিধানেও মুসলিম নারীদের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক নয় বলে ভারতের মুসলিম নারীরাও ৮০-৯০ শতাংশই বোরখা পরে না। এটাই সত্যি যে মুসলিম নারীরা বোরখা বা হিযাব পরতে চায় না। না, এটা  কারো মনগড়া কথা নয়, ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।  মুসলিম নারী  যুগে যুগে দেশে দেশে হিযাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। সে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। হিযাব সম্পর্কে মুসলিম নারীদের মনোভাব জানবার জন্যে সে ইতিহাস আমাদের জানা আবশ্যক। সেই ইতিহাসের পাতায় একটু চোখ বুলানো যাক।  ইরানের আমেরিকা প্রবাসী একজন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও লেখক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “In the struggle for the liberation for the Muslim woman the veil has become a symbol of her servitude. Thus in 1923 the president of the Egyptian Feminist Union Mr. Houda Cha’araoui, and her colleagues defiantly threw their veils into the sea. Similarly in 1927 there was a campaign of “de-hijabization” in communist Turkestan. Not less than 87,000 Uzbek women publicly repudiated their “black cowls”, though not  less than 300 of their sisters had been killed by the male heads of the Muslim families for betraying Islam. In 1928, at the independence celebrations, the Shah of Afghanistan ordered his wife to “unveil” herself in public. Following the public scandal, the shah was obliged to backtrack and cancel his projects for the emancipation of women. He himself was obliged to abdicate. In 1936 Reza Shah of Iran forbade the tchador by a special decree. Obviously the people were not ready to break with tradition and so after mass protests in 1941 he also had to retreat and abrogate law. (Why I am not a Muslim, Ibn Warraq, p. 315, Prometheus Books, New York)  মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে হিযাব একটি দাসত্বের প্রতীক হয়ে উঠে। তাই ১৯২৩ সালে ইজিপ্টের নারীবাদী সঙ্ঘের সভানেত্রী ও তাঁর সহকর্মীরা সমুদ্রের জলে হিযাব  ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে ১৯২৭ সালে কম্যুনিস্ট শাসিত তুর্কিস্তানে হিযাব-বিরোধী প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিলো। সে সময় কম পক্ষে ৮৭০০০ (সাতাশি হাজার) মুসলিম নারী একযোগে তাদের “কালো মস্তকাবরণ” প্রকাশ্যেই বর্জন করেছিলেন যদিও তার জন্যে কম পক্ষে ৩০০ জন মুসলিম নারীকে ইসলাম বর্জন করার অভিযোগে তাদের পরিবারের পুরুষ অভিভাবকরা হত্যা করেছিলো। ১৯২৮ সালে আফগানিস্তানের শাহ তাঁর পত্নীকে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে ‘হিযাব’ বর্জন করতে বলেছিলেন। পরে প্রবল লোক নিন্দার কারণে তিনি  পিছু হটতে বাধ্য হন এবং নারী মুক্তির কর্মসূচী বাতিল করেন। ১৯৩৬ সালে ইরানের শাহ চাদর (হিযাব) বর্জনের জন্যে একটি বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করেন। কিন্তু ইরানের জনগণ সে ঐতিহ্য বর্জনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না, ফলে মানুষের তীব্র প্রতিবাদের  মুখে ১৯৪১ সালে শাহ পিছু হটতে বাধ্য হন  এবং  আইনটি (অধ্যাদেশটি) প্রত্যাহার করেন। ‘হিযাব’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ হাযাবা থেকে। ‘হাযাবা’র মানে হলো আড়াল করা বা গোপন করা। শরিয়তি আইনে  হিযাবের উপর একটি অধ্যায় বিদ্যমান। হিযাব-আইনটি থেকে বোঝা যায় যে, প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারী ও পুরুষ স্বচ্ছন্দে এক সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা  করতো। আধুনিক সমাজেও মুসলিম মেয়েদের কাছে হিযাবের গ্রহণযোগ্যতা নেই তা চারিদিকে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, এবং হয় তো কোনো কালেই ছিলো না। আধুনিক মুসলিম সমাজ যেহেতু হিযাব পরতে সম্মত নই, তাই ইসলামি আইনের সংস্কারপন্থীরা অনেকেই হিযাবকে সংশোধিত রূপে উপস্থাপিত করার চেষ্টায় মগ্ন রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বলেন যে, হিযাব শুধু মুহাম্মদের পত্নীদের জন্যে প্রযোয্য, সমস্ত মুসলিম নারীদের জন্যে নয়। আবার হিযাবকে আধুনিক সমাজের মুসলিম নারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার উদ্দেশ্যে সংস্কারপন্থীরা হিযাবের আকার, আকৃতি ও আয়তন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ও মশলা ব্যক্ত করেছেন। তাদের একটা অভিমত হলো, নারীর কিয়দংশ চোখ, নাক, হাত ও পায়ের অগ্রভাগ খোলা রেখে শরীরের বাকি অংশ কাপড় দিয়ে ঢাকতে হবে। কিন্তু কোরানের উপরে উল্লেখিত আয়াত দু’টি সংস্কারপন্থীদের এই মতকে নস্যাত করে দেয়। সংস্কারপন্থীদের অভিমত ও বাখ্যা-বিশ্লেষণ কোরান দ্বারা সমর্থিত ও স্বীকৃত না হলেও তার প্রভাব পড়েছে মুসলিম সমাজে। তৈরী হয়েছে হিযাবের খুঁটিনাটি নিয়ে মতভেদ। ফলে হিযাবের ভিন্ন পোশাক ও ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদের প্রচলন দেখা যায় বিভিন্ন দেশে ও   ভাষায়। বাংলায় হিযাব বলতে বোঝানো হয় পর্দা, বোরখা, চাদর ইত্যাদি। ইংরাজীতে ব্যবহার করা হয় Veil, Cloak, Outer Garment, Shawl  ইত্যাদি শব্দ। মুসলিম দেশগুলিতে হিযাবকে কী বলে সে প্রসঙ্গে ইবন ওয়ারাক তাঁর উক্ত গ্রন্থে একটি বর্ণনা দিয়েছেন । তিনি লিখেছেন – In Morocco, Algeria, and Tunisia we find haik, safsari, akhnif, and adjar. In Egypt, Israel, Syria, Iraq, and among the Bedouins, we find abaya, tarna, izar, milhafa, khabara, chambar, niquab, litham, and bourqou; in Iran, bourda, tchadar, pitcha, and rouband; in Turkey, yatchmek, yalek, harmaniya, and entari; in India and Pakistan, burka.


নারী গৃহবন্দী
বিভিন্ন দেশে এবং একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিযাবের পোশাকেও বিভিন্নতা দেখা যায়। আগেই বলেছি যে হিযাব শব্দের মানে হলো কোনো বস্তুকে লুকানো বা আড়াল করা। কিন্তু নারীকে এক টুকরো কাপড়ে সম্পূর্ণ লুকানো সম্ভব নয়। তাই হিযাবের মধ্যেই রয়েছে কিছু কিছু উপধারা যাতে নারীকে সম্পূর্ণই লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়। কোরানে দু’টি আয়াত আছে যেখানে নারীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা যাতে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। আয়াতদ্বয়ের একটি হলো – “এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহিলী যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে নাতোমরা নামায কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সঃ) - এর  প্রতি অনুগত থাকবে; হে নবীর পরিবার। আল্লাহতো চান তোমাদের হতে শুধু অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”  (৩৩/৩৩)  আর একটি আয়াত আছে যাতে নারীদের পরপুরুষের সাথে কার্যতঃ কথা বলতে বারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষদের নিকট থেকে নারীকে পৃথক রাখা বা লুকিয়ে রাখার জন্যেই এই নির্দেশ। সেই আয়াতটি হলো - হে নবী পত্নীরা! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পর পুরুষের সঙ্গে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না  যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়, এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে কথা বলবে।” (৩৩/৩২)  অজুহাত অন্বেষণকারীরা বলতেই পারেন যে, এ আয়াতটি তো নবী পত্নীদের উদ্দেশ্যে এসেছে। তাদের জবাব দিয়েছেন স্বয়ং মুহাম্মদ আয়াতটির উদ্দেশ্য বাখ্যা করার সময়। সেটা এ রকমঃ “আল্লাহ তা’আলা স্বীয় প্রিয় নবী (সঃ) – এর সহধর্মিণীদেরকে আদব-কায়দা ও ভদ্রতা শিক্ষা দিচ্ছেন। সমস্ত স্ত্রীলোক তাদের অধীনস্থ। সুতরাং এই নির্দেশাবলী  সমস্ত মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোজ্য।”  (দ্রঃ- ইবনে কাথিরের তফসির, পঞ্চদশ খণ্ড, পৃ – ৮৭৩ সূত্রঃ http://.IslamiBoi.wordpress.com)   ইসলামি পণ্ডিত প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাথিরের এই  বিবরণ  থেকে এটা স্পষ্ট যে হিযাবের বিধান সমস্ত মুসলিম নারীদের জন্যেই। হিযাবের উদ্দেশ্য কী তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যেই এ আয়াত দু’টিতে নারীকে একেবারে গৃহবন্দি করে পুরুষ সমাজ থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঘরের ভিতরেও নারীকে তার স্বাভাবিক, স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ জীবন-যাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।  স্বগৃহেও (অবশ্য নারীর নিজের সত্যিকারের গৃহ বলতে কিছু নেই) নারীকে কাপড়ে অবগুণ্ঠিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারীকে অবগুণ্ঠিত হওয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে কেবল পিতা, পুত্র, ভাইপো, ভাগ্নে, এবং নারীদের সামনে। বাকি সকলের সামনে নারীকে পর্দায় অবগুণ্ঠিত থাকতে হবে । কোরান এ প্রসঙ্গে বলছে – “নবী-পত্নিগণের জন্য তাদের পিতৃগণ, পুত্রগণ, ভ্রাতৃগণ, ভ্রাতুষ্পুত্রগণ, ভগ্নিপুত্রগণ, সেবিকাগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের ব্যাপারে পর্দা পালন না করা অপরাধ নয়।” (৩৩/৩৫)  যা নবীপত্নীদের জন্যে আদেশ তা যে সকল মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোয্য, এ কথা যে  মুহাম্মদ বলেছেন তা আগেই উল্লেখ করেছি। মুসলিম নারীকে  অবগুণ্ঠনের মধ্যে থাকতে হবে ঘরের বাইরে এবং ঘরের মধ্যেও – এই হলো হিযাবের মূল নির্দেশ। পুরুষের কারণে যাতে নারীর হিযাববন্দি জীবনের শৃঙ্খলায় (শিকলে) কোনো ব্যত্যয় না ঘটে তার জন্যে পুরুষের উপরেও হিযাবের একটি ধারা আরোপ করা হয়েছে। মুসলমান পুরুষদের বলা হয়েছে পরের ঘরে ঢুকে পরনারীদের কাছে কিছু না চাইতে। অবশ্য এক্ষেত্রেও নবীপত্নীদের দোহাই দেওয়া হয়েছে। আল্লাহকে দিয়ে মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলিয়েছেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্য নবী-গৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদের ডাকলে – তোমরা প্রবেশ করো, এবং আহার শেষ হলে চলে যেয়ো। তোমরা কথা-বার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না, কারণ এ নবীর জন্য কষ্ঠদায়ক; সে তোমাকে উঠে যাবার জন্য বলতে সংকোচ বোধ করেকিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ করে না। তোমরা তার পত্নীদের নিকট হতে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল হতে চাইবে, এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কারও পক্ষে রসুলকে কষ্ট দেওয়া অথবা তার মৃত্যুর পর তার পত্নীদের বিবাহ করা কখনও সঙ্গত নয়।”  (৩৩/৫৩)  নিজের পত্নীদের  মানুষের বৃহত্তর সমাজ থেকে  বিচ্ছিন্ন করে গৃহবন্দি ও কাপড়বন্দি করে সম্পূর্ণ তালুবন্দি করতে মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের তাঁর গৃহে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দ্বিধা করেন নি। যা যা তাঁর পত্নীদের উপর আরোপ করেছেন সেগুলি পরে সমস্ত মুসলিম নারীদের উপরেও আরোপ করেছেন। এভাবে হিযাবের নামে নারীকে ঘরে বাইরে সর্বত্রই সম্পূর্ণ বন্দি, অবরুদ্ধ, সম্পূর্ণ পরাধীন ও শৃঙ্খলিত করা হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে আল্লাহর ওহির দোহাই দিয়ে। প্রত্যেকটি ওহি বা আয়াতের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট (তফসির বা শানে নুযুল) রয়েছে যা পাওয়া যায় হাদিসে ও কোরানের তফসিরে। অবশ্য হাদিস ও তফসির নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও রয়েছে। হিযাবের প্রেক্ষাপট  নিয়েও  মতভেদ  রয়েছে।
হিযাবের প্রেক্ষাপট নিয়ে যে কথাগুলি শোনা যায় তার মধ্যে একটি এ রকমঃ - দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক যিনি ছিলেম মুহাম্মদের অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবী এবং একজন শ্বশুরও, একদিন মুহাম্মদকে বলেন তাঁর (মুহাম্মদের) ঘরে যে সব মুসলমানরা ঢোকেন তাদের মধ্যে মন্দ চরিত্রের লোকও থাকতে পারে, তাদের হাত থেকে নবী-পত্নীদের মান-মর্যাদা রক্ষা করার স্বার্থে তিনি কেনো তাঁদের (নবী-পত্নীদের) আড়ালে থাকার নির্দেশ প্রদান করছেন না। তারপরই ২৪/৩১ নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অন্য একটি মত হলো – ওমর ফারুকের একদিন মুহাম্মদের কনিষ্ঠতম ও প্রিয়তম পত্নী আয়েশার সঙ্গে আকষ্মিকভাবে দৈহিক সংস্পর্শ ঘটে এবং তারজন্যে তিনি ভীষণ লজ্জিত ও বিব্রত বোধ করেন। তারপরেই তিনি মুহাম্মদকে বলেন কেনো তিনি তাঁর পত্নীদের আড়ালে থাকার নির্দেশ প্রদান করছেন না। এর প্রেক্ষাপটেই হিযাব সংক্রান্ত ওহিগুলো অবতীর্ণ হয়।
হিযাবের আদেশ (তথাকথিত ওহি বা প্রত্যাদেশ) মুসলিম নারীদের উপর চাপানো হয় চতুর্থ হিজরীতে (৬২৫ খৃস্টাব্দে) অর্থাৎ মুহাম্মদের মদিনায় হিযরত করার চতুর্থ বছরে। মুহাম্মদ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে দাবি করেন যে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে নবী করে পাঠিয়েছেন। স্বভাবতঃই এ প্রশ্নটি ওঠে যে, মন্দ চরিত্রের লোকদের হাত থেকে নবী-পত্নীদের শ্লীলতা, সতীত্ব ও মর্যাদার হেফাজত (রক্ষা) করার জন্যে হিযাবের ওহিগুলি পাঠাতে আল্লাহ এতো বিলম্ব করেছিলো কেনো? তাঁর প্রথম পত্নী খাদিজার জীবদ্দশায় হিযাবের আদেশ আল্লাহ পাক কেন পাঠায় নি? সে কি এজন্যে যে খাদিজা ছিলেন একজন মক্কার সবচেয়ে ধনী বণিক, প্রবল প্রভাবশালী ও  প্রতাপশালী এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন  মহিলা? ইসলামি পণ্ডিত কিংবা মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিকট থেকে এ প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় না। সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয় যে মুসলিম নারীদের উপর হিযাব আরোপ করার অন্য কোনো প্রেক্ষাপট আছে।
ইতিহাস বলে যে মুহাম্মদই প্রথম আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়ে নারীদের উপর হিযাব চাপিয়েছেন তা নয়। ইসলামের আবির্ভাবের বহু কাল আগে থেকেই পার্সিয়ানদের সমাজে হিযাবের প্রচলন ছিলো। হিযাবের বিধানটি মুহাম্মদ পার্সীদের কাছ থেকেই নিয়েছিলেন। আবার নারীদের ঘরের অভ্যন্তরে আবদ্ধ থাকার কুপ্রথাটিও বাইজান্টাইন সমাজে বিদ্যমান ছিলো প্রাক ইসলাম যুগে। বাইজান্টাইনের মানুষ সেটা গ্রহণ করেছিলো গ্রীকদের কাছ থেকে। মদিনায় হিযরত করার পর কয়েক বছরের মধ্যে মুহাম্মদের আরবের বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসার ব্যাপক সুযোগ ঘটে। তার আগেও অবশ্য বাণিজ্য করার সুবাদে মুহাম্মদকে বেশ কয়েকবার আরবের বাইরে যেতে হয়েছিলো। এর ফলে আরবের বাইরের বিভিন্ন দেশের মানুষদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে তিনি আসেন এবং বহু ক্ষেত্রেই সেগুলির দ্বারা প্রভাবিত হন। যে গুলির দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন সেগুলির তিনি ইসলামিকরণ করেন আল্লাহর দোহাই দিয়ে। হিযাবের সংস্কৃতিও তিনি পার্সী ও বাইজান্টাইনের থেকে নেন এবং তার  ইসলামিকরণ করে মুসলিম সমাজে প্রবর্তন করেন।  হিযাব বাদে আর যে সব পশ্চাদপদ  প্রথা ও  নিয়ম-কানুন  অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে আল্লাহর ওহির নামে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে ছিলেন তার মধ্যে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতও আছে। এগুলির কোনোটাই ইসলামের তথা মুহাম্মদের আবিষ্কার নয়। খাতনাও (মুসলমানী)  সে রকম একটি ভয়ংকর কুপ্রথা যা মুহাম্মদ গ্রহণ করেন ইহুদিদের নিকট থেকে। খাতনা সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে এ নিবন্ধটি শেষ করবো। মুসলমানরা মনে করে ছেলেদের খাতনা করার আদেশ মুহাম্মদ আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাই তা নিয়ে তাদের গর্বের অন্ত নেই। খাতনা বা ৪/৫ বছরের পুং শিশুদের লিঙ্গের ত্বকের অগ্রভাগ কেটে ফেলাকে শিশুকে কষ্ট দেওয়া তারা বিজ্ঞানসম্মত বলে বিশ্বাস করে। এর পরিপ্রেক্ষতে তারা বলে আল্লাহ যে একজন মহাবিজ্ঞানী তার একটা বড়ো প্রমাণ নিহিত আছে এই খাতনার মধ্যে। খাতনা প্রথাটা মুসলমানদের কাছে একটা গর্ব ও অহঙ্কারের বিষয়ও বটে। খাতনা উপলক্ষে তারা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে যার মধ্যে বিশাল ভোজের আয়োজনও থাকে। মুসলমানরা দাবি করে যে কোরান শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, এটা একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থও। আর কোরান যে  একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থ তার প্রমাণ হিসেবে মুসলিমরা এই খাতনার দৃষ্টন্তটির উল্লেখ করে থাকেন।  কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো খাতনা একটি অবৈজ্ঞানিক ও বর্বর প্রথা যাতে সর্বদায় বিপদের ঝুঁকি থাকে। খাতনার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুদের বিপদে পড়তে হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। খাতনা নিয়ে গর্ব ও অহঙ্কার করার মত হিযাব নিয়েও গোঁড়া মুসলমানরা গর্ব করে। হায় রে! তারা যদি জানতো যে, হিযাবের পশ্চাদপদ ও  কুৎসিত বিধানগুলি আসমান থেকে আসা কোনো প্রত্যাদেশ নয়, মুহাম্মদ এই বিধানগুলি নিয়েছিলেন পারস্য ও বাইজান্টাইন থেকে !   

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...