Saturday, June 27, 2015

ভগবান রাম নারী ও শুদ্রদের মানুষই মনে করত না



হিন্দু ধর্মের সাধারণ মানুষদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই । সমস্যা হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে । তারা ভারতের বুকে, পারলে পৃথিবীর বুকেও হিন্দুত্ব কায়েম করতে চায় । সেটা কিন্তু ভয়ঙ্কর এক তত্ত্ব । হিন্দুত্বের তত্ত্ব মানে ভারতের মাটিতে রামায়ণ ও মহাভারতের যুগ ও আদর্শকে ফিরিয়ে আনা, প্রাচীন বৈদিক সমাজের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা । হিন্দুত্বের তত্ত্ব কী ভয়ঙ্কর তা বোঝাতে বেদ, রামায়ণ ও মহাভারত থেকে নিয়ে কয়েকটা কথা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম । তাতেই গোঁড়া হিন্দুরা চটে লাল । তারা চটলো না ফাটলো তাতে কিছু যায় আসে না । কিন্তু  অনেক হিন্দুই আছেন যারা হিন্দুত্ববাদের মৌলবাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেন না,  তাদেরও কিন্তু রামায়ণ, মহাভারত ও বেদ সম্পর্কে গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা রয়েছে । তারাও আমার লেখায় ব্যথিত হয়েছেন হয়তো এটা ভেবে যে আমি মিথ্যা কথা লিখে হিন্দুদের ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে কলঙ্কিত করেছি । তাদের জন্যেই এই পোস্টটি । পরে আরো কয়েকটি পোস্ট সময় পেলে লিখতে হবে । এই পোস্টটির কয়েকটি কথা কেবল রাম ও রামায়ণকে নিয়ে । 
রাম হিন্দুদের কাছে ভগবান । সেই ভগবানও যে তার স্ত্রী সীতাকে অপমান করতে পারে তা ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের বিশ্বাসের অতীত । কিন্তু নির্মম সত্যিটা হলো যে সীতা রামের কাছে চূড়ান্ত অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিলো । এই সত্যিটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি । না, তারজন্যে একটাও মনগড়া কথা লিখি নি । সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা  ‘বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা’  পুস্তিকা থেকে মাত্র কয়েকটা কথার উল্লেখ করেছিলাম । সেই পুস্তিকা থেকেই তুলে এখন আবার দিচ্ছি রাম ও সীতার কথোপকথনের কিছু অংশ । সীতাকে উদ্ধার করার পর প্রথম দর্শনে রাম সীতাকে কী বলে সম্ভাষণ করেছিলো তার বর্ণনা প্রসঙ্গে সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন,
·         “সীতা রামের কাছে এসে প্রণাম করে দাঁড়ালে নতমুখী মৈথিলীকে দেখে রাম তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গতভাব ব্যক্ত করতে শুরু করলেন [৩/১১৫/১] । কী সেই ভাব ? যে – সীতাকে না দেখতে পেয়ে বনে বনে হা হুতাশ করে বেড়িয়েছিলেন রাম, তাঁকে দেখতে পেয়েই কী বললেন ? ‘যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি, তোমাকেও মুক্ত করেছি, ভদ্রে । পৌরুষ দিয়ে যা করবার ছিল তা আমি করেছি । বৈরভাবের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি, ধার্ষণ প্রমার্জনা করেছি । শত্রু এবং অপমান একই সঙ্গে শেষ করেছি। আজ আমার পৌরুষ প্রকাশিত হয়েছে, আমার শ্রম সফল হয়েছে । প্রতিজ্ঞা থেকে আজ উত্তীর্ণ হয়েছি, নিজের প্রভুত্ব ফিরে পেয়েছি , [৬/১১৫/১-৪] । একথা শুনে সীতার চোখ দুটি মৃগীর মত  উৎফুল্ল হয়ে উঠল, জল ভরে এল চোখে [৬/১১৫/১০] তারপর, তা দেখেও রাম বলতে লাগলেন, ‘তোমার কুশল হোক, জেনে রাখ, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয় । আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের  কলঙ্ক মোচন করার জন্যেই তা করেছি । তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে । আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই । তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছা তুমি চলে যাও আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে – তোমাকে আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই । কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে ? রাবণের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দৃষ্টা তুমি, তোমাকে গ্রহণ করে আমি আমার উজ্জ্বল বংশের গৌরব নষ্ট করব ? যেজন্যে যুদ্ধ জয় করেছি তা পেয়েছি, তোমার প্রতি আমার অভিলাষ নেই, যেখানে খুশী চলে যাও তুমিঃ বুদ্ধিমান আমি তোমাকে বলছি, লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব বা বিভীষণ এদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করে নাও । তোমার মত দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে রাবণ নিজগৃহে খুব বেশীদিন চুপচাপ সহ্য করে নি’ [৬/১১৫/১৫-২৪] । [পৃ-১০]
সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন যে মহাভারতে বনপর্বের অন্তর্গত রামোপখ্যানে রামের বয়ান একটু অন্য রকম এবং আরো বেশি অপমানকর । সেখানে  রাম সীতাকে কী বলছেন সে কথাগুলি  সুকুমারী ভট্টাচার্য বর্ণনা করেছেন  এভাবে –
·         ‘যাও বৈদেহী, তুমি মুক্ত । যা করণীয় ছিল তা করেছি । আমাকে স্বামী পেয়ে তুমি রাক্ষসের  বাড়িতে বুড়ো হয়ে যাবে এটা হয় না, তাই রাক্ষস [রাবণ]-কে হত্যা  করেছি । আমার মত ব্যক্তি ধর্ম ও অধর্মের ভেদ জেনেও পরহস্তাগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্ত ধারণ করবে ? তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, মৈথিলী তোমাকে আমি ভোগ করতে পারিনে, [তুমি[ যেন কুকুরে চাটা ঘি ।’ [৩/২৭৫/১০-১৩] । [পৃ-১১]
·          
·         রামের এই উক্তির তাৎপর্য বাখ্যা করতে গিয়ে সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “রাম স্পষ্টই বলেছেন সীতার চরিত্র ভাল হলেও তাকে গ্রহণ করা যায় না, কারণ সে ‘পরহস্তাগতা’ হয়েছিল,  অতএব কুকুরে চাটা ঘি দিয়ে যেমন যজ্ঞীয় কর্ম করা যায় না, তেমনি সীতাকে তিনি ‘পরিভোগ’ করতে পারেন  না । প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বামি-স্ত্রী সম্পর্কের মূলমন্ত্র উচ্চারিত হল, ‘পরিভোগ’ । খুব নির্মমভাবে  সীতাকে বলেছেন রাম, যে সীতাকে উদ্ধারের জন্যে রাম মোটেই যুদ্ধ করেননি, করেছেন ইক্ষুবাকু কূলের রাজবধূ রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে গেলে তাঁর বংশ মর্যাদা হানি হয়, তাই । ... সীতাকে পরিত্যাগ কালে রাম অনায়াসেই বলছেন লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, সুগ্রীব, বিভীষণ যাকে ইচ্ছা পতিত্বে বরণ কর । বিধবা নারীর পক্ষেই শুধু শাস্ত্রের বিধান ছিল, দেবরকে বরণ করা । তবে কি রাম বলতে চান, সীতার পক্ষে তিনি মৃত ? স্বামী পরিত্যক্তা নারী কি বিধবার তুল্য ? আর সুগ্রীব, বিভীষণ ? বানর রাক্ষসকেও সীতা গ্রহণ করতে পারেন ? এ অপমান করার অধিকার রাম কোথা থেকে পেলেন ? শূর্পণখাও রামকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তবে রামও কি কুকুরে চাটা ঘি ? সীতার জন্যে এত যে বিলাপ তা কি শোকোচ্ছ্বাস না পরিভোগবঞ্চিত কামুকের আর্তনাদ ?” [পৃ-১১]  

রামের মুখ থেকে ওই সব কুৎসিত ও কদর্য কথাবার্তা শুনে চরম লাঞ্ছিত ও অপমানিত সীতা কী বলেছিলেন ? তা শোনা যাক সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখনি থেকেই । তিনি লিখেছেন, রামের মর্মন্তুদ কথা শুনে সীতা বললেন,
·         ‘আমার গাত্র যে স্পর্শ করা হয়েছে তখন ত আমি বিবশা দুর্বল বলে প্রবলের বশে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম । স্বেচ্ছায় আমি সেটা ঘটাই নি, এখানে অপরাধ দৈবের । আমার অধীন যেটা,  আমার হৃদয়, সেটা ত তোমাতেই সমর্পিত । দেহটা পরের অধীনে গেলে অসহায় আমি কি করব ? হে, মানদ, তোমার সঙ্গে এক সঙ্গে বেড়ে উঠেছি । তাও যদি তুমি আমাকে না জেনে থাক, তাহলে চিরিদিনের মতই আমি অভিশপ্ত । ... লঘুচিত্তে মানুষের মত তুমি আমার নারীত্বকেই সামনে রাখলে, জনকের সামনে পৃথিবী থেকে উত্থিত হয়েছিলাম সে কথাটা, আর, হে চরিত্রজ্ঞ আমার চরিত্রের বহুতর নিদর্শন ছিল তাকে প্রাধান্য দিলে না । স্বীকার করলে না যে বালিকা বয়সেই তুমি আমার পাণি গ্রহণ করেছিলে, আমার ভক্তি, চরিত্র এসব পেছনে ফেলে দিলে’ [৬/১১৬/৬,৯,১১০,১৫,১৬] । [পৃ-১২]   
·          
সীতাকে অকারণে যেভাবে রাম অপমান করে পরিত্যাগ করেছে তা শুধু ব্যক্তি নারী সীতার অপমান নয় । এ অপমান সমগ্র নারী জাতির এই রাম হিন্দুদের কাছে বিশ্বাসে ভগবান হতে পারে, কিন্তু রামের এ আদর্শ গ্রহণযোগ্য নয় । তাই রামরাজ্য আরএসএস ও বিজেপি চাইতে পারে কিন্তু যারা নারীর স্বাধীনতা ও সমান অধিকারে বিশ্বাস করে তাদের কাছে রামরাজ্য  কাঙ্খিত নয় । সুকুমারী ভট্টাচার্য রামের এই আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “বালিকাবয়সে বিবাহের উল্লেখের তাৎপর্য হল, সীতার যৌবন কেটেছে রামের সান্নিধ্যে, তাতে কখনই কি কিছু সন্দেহের লেশ মাত্র পেয়েছেন রাম ? আর একটা তাৎপর্য আছে দেহ ও মনের পার্থক্যে । যে দেহটাকে পরের স্পর্শ থেকে বাঁচানোর বল বা সামর্থ ছিল না সেইটেই বড় হয়ে উঠল ? যে-মনটা আকৈশর অবিচল-ভাবে রামের উদ্দেশ্যে সমর্পিত থেকেছে, তার কোন মূল্য নেই ?  আগেই বলেছি রামের সঙ্গে বনে আসার কোন দরকারই ছল না সীতার ।  শুধু রামকে ছেড়ে থাকা তাঁর পক্ষে দুঃসহ ছিল বলেই জোর করে সঙ্গে এসেছিলেন । এসব তুচ্ছ হয়ে গেল, শুধু তার গায়ের জোরটা রাবণের চেয়ে কম ছিল বলে ? ... লোকাপবাদের ভয়ে তিনি নির্দোষ অন্তঃসত্ত্বা নারীকে বনবাস দিচ্ছেন। নিত্যদিন প্রেমের একনিষ্ঠতা নিয়ে যে নারী স্বামীর সহচারিণী ছিলেন, তাঁকে ত্যাগ করবার আগে প্রজাদের কাছে নিজে একবার বলাও দরকার মনে করলেন যে সীতা লঙ্কায় অগ্নিশুদ্ধা, রাম ও লক্ষণ তার সাক্ষী । সমস্ত কর্তব্য শুধু ভ্রান্ত সন্দেহে সন্দিহান প্রজাদের  প্রতি, দীর্ঘদিনের নিষ্কলুষ অন্তঃশুদ্ধা সঙ্গিনীর প্রতি কোন কর্তব্য নেই ?” [পৃ – ১২]
রামরাজ্যে নারীর সম্মান, মর্যাদা, স্বাধীনতা ও অধিকার যেমন ছিল না তেমনি নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের অবস্থাও ছিলো তদ্রুপই । বরং বলা যেতে পারে তাদের অবস্থান ছিলো আরো হীনতর । হিন্দুত্ববাদীরা 'ঘর ওয়াপসি' করছে । তাদের কাছে প্রশ্ন, তারা যাদের হিন্দু করে ঘরে তুলছে তাদের বর্ণগত অবস্থান কী হবে ? নিশ্চয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় তথা উচ্চ বর্ণে তাদের বরণ করা হবে না । তাদের অবস্থান হবে নিম্ন বর্ণের সমতুল্য বা তাদেরও নীচে । শুদ্ররা হলো সর্ব নিম্ন বর্ণের মানুষ যাদের রামরাজ্যে মানুষ বলেই মনে করা হতো না । তা ভগবান রামের চোখে শুদ্রদের অবস্থান কত নিম্নে ছিলো তা শোনা যাক রামায়ণের বর্ণনা থেকেই । সেই বর্ণনা দিচ্ছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা’ পুস্তিকাতেই ।  তিনি লিখেছেন –
·         এর কিছুদিন পরে এক ব্রাহ্মণের বালকপুত্র অসময়ে মারা যায় রাজপুরোহিতরা রামকে বলেন, রাজ্যে কেউ পাপ করেছে, যার ফলে এই অঘটন ঘটল । খোঁজ করতে করতে দেখা গেল শম্বুক নামে এক শুদ্র সশরীরে দেবত্ব পাবার জন্যে তপস্যা করছে, সে নিজেই সে কথা স্বীকার করল [৭/৬/২] । ‘সেই শুদ্রটি কথা বলতে বলতেই উজ্জ্বল খড়্গ কোষ থেকে বের করে তার মুণ্ডু ছেদ করলেন রাঘব ।’ তখন দেবতারা রামকে সাধুবাদ দিয়ে বললেন, ‘রাম তুমি দেবতাদের কার্যসাধন করলে, তোমার জন্য এই শুদ্র স্বর্গভাক হতে পারল না ।’ [পৃ – ১৩]  
সুকুমারী ভট্টাচার্য রামায়ণ থেকে বর্ণ-বৈষম্যের আর একটি চিত্র তুলে ধরেছেন । সেটা এ রকম –
·         বনে যাবার পথে প্রথম রাত্রে তিনজন এলেন রামের বন্ধু নিষাদ রাজ গুহকের রাজ্যে । গুহক নানা খাদ্যসম্ভারে আয়োজন করতে চাইলে রাম বললেন, ‘তাঁরা বনবাসী, ফলমূলই খাবেন, অন্যের দান প্রতিগ্রহণ করবেন না [২/৫০/৪৩,৪৪] । গুহক যদি রথের ঘোড়াদের জন্যে খাদ্য দেন তাহলে উপকার হয়বনবাসে কিন্তু রাম-লক্ষণ-সীতা, অত্রি-অনুসূয়া, ভরদ্বাজ ও অন্যান্য মুনিদের দেওয়া ফলমূল ভোজন করেছেন, গুহকের কাছেও তা করতে পারতেন, কিন্তু তা না করে তারা রাত্রিতে তাঁরা উপবাসে কাটালেন । সেটা কি গুহক জাতিতে নিষাদ ছিল বলে?  [পৃ – ৭]
সুকুমারী ভট্টাচার্য রামের এই আচরণের তীব্র সমালোচনা  করেছেন । তিনি লিখেছেন, “গুহকের আতিথ্য গ্রহণ না করার মধ্যেও বর্ণ-বৈষম্যের প্রশ্ন ওঠে । ফলাহারী ঋষিরাও অন্যের দেওয়া ফল খেতে পারেন, বনবাসকালে রাম বেশ কয়েকজন মনুঋষির আতিথ্য নিয়েওছেন । গুহক চণ্ডাল,  তাই তার কাছে  শুধু পশুর খাদ্যই গ্রহণ করলেন ।” [পৃ – ১৫]   তিনি আরো লিখেছেন, “অন্ধমুনি বৈশ্য, তাঁর স্ত্রী শুদ্রা [২/৫৭/৬৩] । তিনি নিজেকে ‘বানপ্রস্থী’ বলেন কী করে ? তাহলে শম্বুকের সাধনাও তো অশাস্ত্রীয় হয় না ? এই শম্বুককে রাম বধ করেছেন এক ব্রাহ্মণের অকাল মৃত পুত্রকে বাঁচাতে । তাহলে প্রাণের মূল্য রামরাজত্বে বর্ণগতভাবে আপেক্ষিক, ব্রাহ্মণ-পুত্রের প্রাণ শুদ্রদের প্রানের চেয়েও দামি ? এটা মেনে নেওয়া হচ্ছে সমস্ত প্রক্ষিপ্ত অংশে । রামরাজ্যে চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুধু কথায় ? যে ফল জল ব্রাহ্মণ ঋষিদের কাছে নেওয়া যায় তা চণ্ডাল বন্ধুর কাছে নেওয়া যায় না ? শুদ্র শম্বূক  তপস্বী, কৃচ্ছ্রসাধনে রত কিন্তু সাধারণ এক ব্রাহ্মণ বালকের তুলনায় তার প্রাণের মূল্য কিছু নেই । [পৃ – ১৫]    
এই সেই রামরাজ্য যেটা সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে  ভারতের মাটিতে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে !

Monday, June 22, 2015

ভারতীয় সমাজের গৈরিকীকরণ করাই হলো বিশ্ব যোগা দিবস উদযাপন করার প্রধান উদ্দেশ্য



২১ শে জুন ছিলো আন্তর্জাতিক বাবা দিবস । সেই বাবা দিবস আর এক বাবা-দিবসের তলায় চাপা পড়ে গেলো । সে দিনই একই সঙ্গে উদযাপিত বিশ্ব যোগা দিবস । বিশ্ব যোগা দিবসের প্রচার ও  সাফল্যের আলোয়  সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেলো আন্তর্জাতিক বাবা দিবস ।  বিশ্ব যোগা দিবসের পরিকল্পনা মোদিজির, আর মনে হয় চিত্রনাট্য রচনায় প্রধান ভূমিকায় ছিলেন বাবা রামদেবজি ।  প্রযোজনায় ছিলো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তথা ভারত সরকার ।  তাই বিশ্ব যোগা দিবসকে বাবা রামদেব দিবস বলা যেতেই পারে । তাই বলছি বাবা রামদেব দিবসের নীচে চাপা পড়ে গেলো আন্তর্জাতিক বাবা দিবস । সরকার ও ভারতীয় মিডিয়া  এই যোগা দিবসকে মহান করে  চিত্রায়িত  করার জন্যে তারস্বরে চিৎকার করে যে সব কথা প্রচার করেছে এবং এখনও সমানে করা  যাচ্ছে  তার মূল কথা  হলো, ‘যোগা’ হলো এমন একটা খাঁটি সংস্কৃতি যা দারুণভাবে ভারতীয়ত্বকে ধারণ করে  ‘যোগ’ যে ভারতীয় সহস্র বছর প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তা সংশয়াতীত । এবং যতই  বিতর্ক থাক তবু  এটাও অনস্বীকার্য  যে  শরীরকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে যোগাভ্যাস বা যোগ-ব্যায়াম কিছুটা  ভূমিকা রাখতে  সক্ষম ।  কিন্তু প্রশ্ন হলো সহস্র বছর প্রাচীন যে ‘যোগ’কে ভারত ধারণ করতো বর্তমান ভারত তো আর সে ভারত নেই । প্রাচীন সে ‘যোগ’-এর সর্বাঙ্গে ছিলো সনাতন ধর্ম তথা  প্রাচীন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু শাস্ত্রের প্রায় অবিচ্ছেদ্য যোগ ।  আধুনিক ভারত কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন  ও পশ্চাদপদ সেই ভারতকে পেছনে ফেলে এসেছে ।  এখনকার ভারত  তো অনেক আধুনিক ও উন্নত সমাজ ব্যবস্থা তথা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে । কিন্তু ‘যোগ’ তো যেখানে ছিলো প্রায় সেখানেই থেকে গেছে, হিন্দু ধর্মের আবহ ও হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির আবহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নি । ‘যোগ’-এর কপিরাইট তাই সম্পূর্ণরূপেই থেকে গেছে বাবা রামদেব ও অন্যান্য  সাধু-সন্ন্যাসি তথা হিন্দু যাজকদের  হাতেই ।  মোদিজির সরকার সেই সনাতনি ‘যোগ’ থেকে হিন্দুত্বকে বিয়োগ করে তার সঙ্গে বিজ্ঞান-ভাবনা ও বিজ্ঞান-চেতনাকে যোগ করে আধুনিক ভারতের উপযুক্ত ও  সর্বজনগ্রাহ্য করে  তোলার কোনো প্রয়াসই করেন নি  তিনিও চান যে যোগাভ্যাস ও যোগ-ব্যায়ামের শরীর-চর্চা হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুদের সম্পত্তি হয়েই থাকুক । স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে ভারতীয়ত্বের মোড়কে মোদিজি আধুনিক ভারতকে  প্রাচীন ভারতের আদলে নির্মাণ করার প্রয়াস করছেন না তো ? এ রকম প্রয়াস করার জন্যে মিশর আজ চরম অস্থিরতায় ভুগছে । মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসি ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসে মিশরের ইসলামিকরণ করে মিশরকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে  চেষ্টা করেছিলেন তার ফল যে ভালো হয় নি এবং নিশরের মানুষ মেনে নেয় নি তা বলা বাহুল্য ।  মুরসির মতো মোদিজিও কি আধুনিক ভারতের হিন্দুত্বকরণ করার চেষ্টা করছেন ? -  এ প্রশ্ন উঠছে । প্রশ্ন তো এমনি এমনি উঠছে না । যোগা দিবসের সঙ্গে যোগ করেছেন সূর্য নমস্কার । তার আগে গঙ্গা নদীকে গঙ্গামাতা জ্ঞানে পূজা করা শুরু করেছেন । উদ্দেশ্য হলো ভারতবাসীর মধ্যে  গঙ্গানদী সম্পর্কে  হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ও ভ্রান্ত  বিশ্বাস ও হিন্দু ভাবধারার পুনর্জ্জীবন ঘটাবার চেষ্টা করামহাভারতের কাল্পনিক চরিত্র কর্ণকে     তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র বলে প্রচার করা শুরু করেছেন ।  বলছেন  কর্ণের জন্ম-বৃত্তান্ত প্রমাণ করে যে প্রাচীন ভারতে জেনেটিক বিজ্ঞান আধুনিক ভারতের চেয়েও অনেক উন্নত ছিলো ।  গণেশের ধড়ে হাতির মুণ্ডু বসানোর  পৌরাণিক গল্পকে তিনি প্রাচীন ভারতের উন্নত প্লাস্টিক সার্জারীর সাফল্য বলে প্রচার  চালাচ্ছেন ।  ব্যক্তি মোদি তা বিশ্বাস করতেই পারেন এবং প্রচারও করতে পারেন, কিন্তু  প্রধান  মন্ত্রীর পদকে তিনি ব্যবহার করছেন এ সব অন্ধ বিশ্বাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরার জন্যে যা অনৈতিক এবং সংবিধানের মুল মর্মকথার পরিপন্থী । উক্ত ঘটনাগুলি থেকে এটা স্পষ্টঃই প্রতিয়মান হয় যে তিনি পরিকল্পনামাফিক ধাপে ধাপে  ভারতের গৈরিকীকরণ করার প্রয়াস করছেন প্রয়াস করছেন ভারতকে পিছন দিকে বৈদিক যুগের দিকে টেনে নিতে । বিশ্ব  যোগা দিবস উদযাপনের কর্মসূচীর মধ্যেও তাই অনেকেই ভারতকে গৈরিকীকরণের অভিসন্ধি দেখছেন । গৈরিকীকরণের চেষ্টা করা মানে তো গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্জলি যাত্রার আয়োজন করাকিছুদিন আগে লালকৃষ্ণ আদবানিজিও সে আশংকাই প্রকাশ করেছেন । তিনি বলেছেন যে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলো খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তাদের হাত ধরে যে ভারতে জরুরী অবস্থা ফিরে আসবে না, এ কথা  হলফ করে বলা যায় না ।   
প্রবীণ রাজনীতিবিদ যা বলেছেন তা যে মিথ্যে আশঙ্কা নয় তা সহজেই বোঝা যায় চারিদিকে কী কী  ঘটছে সে দিকে লক্ষ্য করলে । রাম মন্দির নির্মাণ, গো-হত্যা বন্ধ, ঘর ওয়াপসি কর্মসূচী, লাভ জিহাদ ইত্যাদি সব হিন্দু মৌলবাদী দাবী, শ্লোগান ও কর্মসূচীগুলি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে মোদিজি ক্ষমতায় আসার পরপরইআরএসএস প্রধান বারবার  ঔদ্ধত্য ভরে উচ্চারণ করছেন ভারতবাসী মানেই হিন্দু, ভারতীয় ঐতিহ্য মানেই হিন্দু ঐতিহ্য, ভারতীয় সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি ।  ‘আমরা সবাই হিন্দু’ – এই  পোস্টার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ    মোদি মন্ত্রীসভার এক নারী মন্ত্রী বলছেন সব ভারতবাসীকেই বিজেপিকে ভোট দিতে হবে, কারণ ভারত হলো হিন্দুদের বাসভূমি আর বিজেপি হলো হিন্দুদের পার্টি । সেই মন্ত্রী মহোদয়ের সদম্ভ আস্ফালন ও উক্তি,  যারা বিজেপিকে ভোট দেবে তারা রামজাদা, যারা দেবে না তারা হারামজাদ । এমন কথা বলার পরও তিনি মন্ত্রীসভা আলো করে বসে আছেন । সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাঁর [মন্ত্রীর] মাথায় মোদিজির আশীর্বাদপুষ্ট  হাত রয়েছে । শুধু হিন্দুত্বের প্রচারমাত্রাই বাড়ে নি । হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়েছে । দিকে  দিকে খৃস্টানদের উপর হামলা হচ্ছে, হামলা হচ্ছে তাদের গীর্জার উপর, খৃস্টান আদিবাসীদের জোর করে ধর্মান্তর করা হচ্ছে ।  সমস্ত মুসলমানকেই ভারত ও হিন্দুদের শত্রু বলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাগাতার বিদ্বেষ, বিষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে   ফলে গো-বলয়ে মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছে ।  যে সব অঞ্চলে আরএসএস ও বিজেপির শক্ত সংগঠন আছে  সে সব অঞ্চলে মোদিজির শাসনে সংখ্যালঘুরা  বিশেষ করে খৃস্টান ও মুসলিমরা আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে । এই সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষপূর্ণ আবহের মধ্যে সাড়ম্বরে উদযাপিত হলো বিশ্ব যোগা দিবস তাই প্রশ্ন উঠছে,  আড়ম্বরপূর্ণ এতো আয়জন আরএসএস ও বিজেপির ভারতকে গৈরিকীকরণের রাজনৈতিক কর্মসূচীরই  অংশ নয় তো ?  মোদিজি ভারতকে সেই বেদের যুগে নিয়ে যেতে এই যোগা দিবসের আয়োজন করেন নি তো ? এই প্রশ্ন তুলেছে কংগ্রেস, বামদলগুলি সহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলিও এবং তারা যোগা দিবস উদযাপন থেকে বিরত থেকেছে ।
যারা যোগা দিবস উদযাপনের কর্মসুচীকে বয়কট করেছে তারা দারুণ একটা সাহসি পদক্ষেপ নিতে পেরেছে । অবশ্য তারজন্যে তাদের হয়তো কিছুটা ক্ষতিই হতে পারে । কারণ এর ফলে হিন্দু ভাবাবেগে কিঞ্চিত আঘাত লাগতে পারে এবং তারফলে হিন্দুদের মধ্যে এই দলগুলির প্রতি কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে ।  কারণ, হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে বেদ হলো ভগবানের সৃষ্টি একটা পবিত্র গ্রন্থ  এবং বেদে যা আছে তার সবই সত্য, কল্যাণকর, মঙ্গলদায়ক, অকাট্য ও চিরন্তন ।  সুতরাং মোদিজি যোগাভ্যাসকে সমুন্নত করার মাধ্যমে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কতিকে ফিরিয়ে  আনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন  তা তো এক শুভ উদ্যোগই, অহেতুক ও  অযথা  ব্যাগড়া দিচ্ছে বিরোধী দলগুলি ।  তারা বিশ্বাস করে যে বেদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে  মানব সমাজের সকল সমস্যার সমাধান । এ ধারণা যতোই ভ্রান্ত হোক, এখনও বহু মানুষ তাদের মনে মণিকোঠায় এই ধারণাই পোষণ এবং লালন-পালন করে   সেটা এ জন্যে যে  বেদ সম্পর্কে এবং  বৈদিক যুগের আইন-কানুন, বিধি-নিষেধ, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা  সম্পূর্ণ অজ্ঞ।  এই অজ্ঞতা শুধু সাধারণ গরীব ও নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত হিন্দু মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়,  অজ্ঞতার শিকার  শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির হিন্দুরাও । মানুষের এই অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও বেদ-পুরাণের প্রতি অন্ধানুগত্য ও শ্রদ্ধাকেই হাতিয়ার করেই টিকে আছে  হিন্দুমৌলবাদী শক্তি ও সংগঠনগুলি ।  অটলবিহারী বাজপেয়ী যাঁকে নরমপন্থী আরএসএস বলে মানা হয় সেই তিনিও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সারা দেশে নতুন করে  বেদ-পাঠশালা  খুলতে চেয়েছিলেন  ধর্মান্ধ মুসলিমরা যেমন মাদ্রাসার অন্ধানুরাগী ধর্মান্ধ হিন্দুরাও তেমনি মনে মনে টোল ও বেদ-পাঠশালার অন্ধানুরাগী, যদিও তারাই নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্যে টোলকে বর্জন করেছে বহুকাল পূর্বেইঅটলবিহারী বাজপেয়ী  ধর্মান্ধ হিন্দুদের ভাবাবেগকেই তাঁর দল বিজেপি ও আরএসএসের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্যেই বেদ-পাঠশালার খোলার কথা বলেছিলেন । আর মোদিজিও ধর্মান্ধ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করে কাছে টানতেই  টেনে এনেছেন বৈদিক যুগের যোগা-সংস্কৃতিকে যা আপাদ-মস্তক হিন্দু ধর্মবিশ্বাস হিন্দু সংস্কৃতির চাদরে মোড়া ।  গগণবিদীর্ণ করা প্রচার ও আড়ম্বর যোগে ‘বিশ্ব যোগা দিবস’ উদযাপন করার তাঁর প্রধান উদ্দেশ্যই হলো সেই সব অন্ধ বেদ-বিশ্বাসী মানুষদের সমর্থন জোগাড়   করা যারা   এই নির্মম সত্যিটা জানে না যে বেদ  একটা ভীষণ পশ্চাদপদ গ্রন্থ, আধুনিক যুগে যার বিন্দুমাত্র প্রাসঙ্গিকতা  নেই  এবং  এটাও জানে না যে বৈদিক সমাজটাও  ছিলো এক ভয়ানক পশ্চাদপদ সমাজব্যবস্থা সেই  বৈদিক সমাজটা ঠিক কেমন  ছিলো তা একটু দেখে নেওয়া যাক
আধুনিক সমাজে বর্ণবাদ ও জাতপাত প্রথাগুলি জঘন্য ও কুৎসিত প্রথা বলে চিহ্নিত ও ধিকৃত । এই জাতপাত চলে আসছে বেদের যুগ থেকে । বেদে মানবমণ্ডলীকে চারটি বর্ণে ভাগ করেছে – ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র । শুদ্রগণ বেদের বিধানে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত,  তারা বঞ্চিত মানবজীবনের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে, এমনকি বঞ্চিত মানুষের পদ মর্যাদা থেকেও   চাষবাস,  পশুপালন সহ উৎপাদন ব্যবস্থার সমস্ত কাজ শুধু তারাই করবে একদিকে, আর অপরদিকে  জীবনভোর   ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের  মুখ বুঁজে সেবা করবে ।  এর এতটুক অন্যথা হলে ভোগ করতে হবে কড়া শাস্তি ।  শাস্তি মানে পার্থিব জগতে অমানুষিক নির্যাতন, আর অপার্থিব জগতে তথা পরকালে অনন্তকাল নরকবাস ।  বেদ শুদ্রদের মানুষ বলেই স্বীকৃতি দেয় নি । মনু সঙ্ঘিতায় শুদ্রদের ঊনমানব বলা হয়েছে । শুদ্রদের জন্মগত অবস্থানকেই অপমান ও হেয় করে দেখানো হয়েছে । গৃহ্যসূত্র মতে কোনো দেবতা থেকেই শুদ্রের উৎপত্তি হয় নি । আর ঋগ্বেদ বলছে ব্রহ্মার পা থেকে শুদ্রের সৃষ্টি । তাই শুদ্রের কোনো গৃহ্যযাগ [দশকর্ম] নেই; তার উপনয়ন নেই অর্থাৎ বেদপাঠ নেই । এমনকি তার মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার নেই, নেই পূজার প্রসাদেও কোনো অধিকার । বেদপাঠে অধিকার তো নেই-ই, এমনকি বেদ যদি সে কানে শোনে তাহলে তার কানে সিসা গলিয়ে ঢেলে দেওয়ার বিধান আছে বেদে । যদি বেদ পাঠ করে তবে তার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলে দিতে হবে বলেছে বেদ । বেদ বলছে, কেউ যদি বেশি খরচের যজ্ঞ শুরু করার পর দেখে তার অর্থে কুলাচ্ছে না তখন সে অনায়াসে অনায়াসে শুদ্রের ধন কেড়ে নিতে পারে যাতে কোনো পাপ হয় না । বেদ আর এক জায়গায় বলছে, ‘শুদ্রের স্ত্রীকে অন্য বর্গের পুরুষরা যথেচ্ছ  ভোগ করতে পারবে ।’ বেদের মতে নারী, শুদ্র, কালো পাখি ও কুকুর মিথ্যা  - এদের দেখা উচিত নয় ।   আর এক জায়গায় বলছে, ছুঁচো, বেজি, নারী, শুদ্র ও কালসাপ মারলে একই প্রায়শ্চিত্ত । বেদে এক জায়গায় বলা হচ্ছে, ব্রাহ্মণকে তৃপ্তি করে খাওয়ালে পাপমুক্তি । যতখুশি পাপ কর, পাপ করে ব্রাহ্মণকে খাওয়াও, ব্যাস । কিন্তু শুদ্রের পাপমুক্তির রাস্তা বন্ধ। কারণ তার অন্ন মানুষের গ্রহণীয় নয় ।   এর থেকে বোঝা যায় বৈদিক সমাজে নারী ও শুদ্রদের সামাজিক অবস্থান ছিলো কতো নীচে ।  বৈদিক যুগে নারীর অবস্থা কেমন ছিলো সেটা একটু দেখা যাক ।
বেদে নিঃসন্তান স্ত্রীকে দশ বছর পর ত্যাগ করার বিধান আছে । কারণ স্ত্রীর কর্তব্যই হলো সন্তান উৎপাদন, তাই এখানে ত্রুটি ঘটলে বৈদিক শাস্ত্র বা সমাজ  তাকে ক্ষমা করত না ।  বেদ মতে যে স্ত্রী স্বামীর মুখের উপর কথা বলে তাকে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করা যায় । বেদ পুরুষের বহুপত্নীকে ভগবানের বিধান  বলেছে ।   মৈত্রায়ণি সংহিতা মনুর দশটি পত্নীর কথা বলে, তৈত্তিরীয়ে চন্দ্রের সাতাশটি স্ত্রীর কথা শোনা যায় । রাজার তো অন্তত চারটি রানী থাকত, মহিষী, বাবাতা, পরিবৃক্তি ও পালাগলি; এছারা উপপত্নী থাকত  অনেক এবং উপপত্নীও নয় এমন ভোগ্যা বহু নারী অন্তঃপুরে স্থান পেত । নারীকে যজ্ঞে দক্ষিণা দেওয়া হত শ’য়ে শ’য়ে; নিতেন ঋত্বিক, গোরু বাছুর ষাঁড় বলদের সঙ্গে এক তালিকায় থাকত দক্ষিণায় দেওয়া নারীও । রামকে অনেক দাসদাসী ও একশ’ কন্যা যৌতুক দেওয়া হয়েছিল । বেদের যুগে ‘যুদ্ধে পরাজিত শত্রুর নারীদের দখল করত বিজেতা ।   দুর্ভিক্ষে দুর্দিনে নারীকে পিতামাতা বিক্রি করতেন, দেবালয়ে দাসদাসীরূপেও পরের যুগে । বেদে বলা আছে, নিজের দেহের বা ধনের উপর নারীর কোনো অধিকার নেই । ঋষি অঙ্গিরা বলেছেন, স্বামীর মৃত্যু হলে সাধ্বী স্ত্রীর অগ্নিতে প্রবেশ করা ছাড়া অন্য ধর্ম নেই । বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, স্ত্রী স্বামীর শয্যসঙ্গিনী হতে অসম্মত হলে প্রথমে তাকে মিষ্টি কথায়, পরে উপহারের লোভ দেখিয়ে কিনে নেবে; তাতেও সে সম্মত না হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মারবে । নারীকে ব্যাভিচারিণী বলেছে বেদ । মনু পুরুষকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন যে নারীর সব সময় ব্যাভিচারিণী হওয়ার প্রবণতা থাকে, এবং সেই কারণে সব বর্ণের পুরুষদের উচিত সর্বদা স্ত্রীকে পাহাড়া দেওয়া । হিন্দু শাস্ত্র বলছে নারী হলো নরকের দ্বার । তাই নারীকে পতিসেবা করা স্বর্গলাভের লোভ দেখানো হয়েছে । মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভীষ্ম বলেছে, জীবলোকে স্ত্রীজাতির পতিসেবাই পরম ধর্ম । স্ত্রীলোকদের জন্যে যজ্ঞ বা শ্রাদ্ধের আলাদা কোনো নিয়ম নেই । তারা কেবল স্বামীর সেবা করেই ইচ্ছামতো পবিত্রলোকে যেতে পারে । নারীর প্রতি পুরুষের কদর্য ও কুৎসিত রুচি ও মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় রামায়ণ ও মহাভারতেও । ধর্মপুত্র যুদ্ধিষ্ঠির জুয়ায় হেরে দেন স্ত্রীকে । ভগবান রাম কুৎসিত ভাষায় অপমান করেন তার স্ত্রী সীতাকে । সীতাকে উদ্ধার করার পর রাম বলছে, ‘তোমার কুশল হোক, জেনে রাখ, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয় ।  এ আমার চরিত্র মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্ক মোচন  করার জন্যেই তা  করেছি । তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে । আমার সামনে  তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই তাই জনকত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে  ইচ্ছা তুমি চলে যাও আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে – তোমাকে আর আমার কোনো প্রয়োজন নেই কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ বন্ধুত্বের লোভে পরগৃহবাস করেছে যে, স্ত্রী, তাকে ফিরিয়ে নেবে ? রাবনের কোলে বসে পরিক্লিষ্ট, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে  ’ হিন্দু ধর্মের ভগবান রাম এ সব কুৎসিত ভাষায় সীতাকে হেয় ও অপমান করেই থেমে থাকে নি । এর চেয়েও জঘন্য ভাষায় সীতার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেছে । রাম বলছে, ‘তোমার মতো দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে দেখে, রাবন নিজগৃহে খুব বেশীদিন চুপচাপ সহ্য করে নি । ... যাও বৈদেহী তুমি মুক্ত । যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি । আমাকে স্বামী পেয়ে তুমি রাক্ষসের বাড়িতে বুড়ো হয়ে যাবে এটা হয় না, তাই রাক্ষস [রাবণ]-কে হত্যা করেছি । আমার মতো ব্যক্তি ধর্ম ও অধর্মের ভেদ জেনেও পরহস্তাগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্ত ধারণ করবে ? তুনি সচ্চরিত্র হও আর অসচ্চিরত্রই হও, মৈথিলি তোমাকে আমি ভোগ করতে পারি নে, তুমি যেন কুকুরে চাটা ঘি ।’ 
ভারত বহু ভাষাভাষি ও বহু ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের দেশ । এ দেশের  এখনকার ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট হলো বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য । বিজেপি ও আরএসএস চায় আমাদের এই ভারতে সেই বৈদিক সমাজকে ফিরিয়ে আনতে এবং রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে ।  সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মোদিজি উদযাপন করলেন ‘বিশ্ব যোগা দিবস’ । 
[বিঃদ্রঃ নিবন্ধটি রচনায় যে বইগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে – সুকুমারী ভট্টাচার্যের মন্থন, প্রাচীন ভারত ও বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা এবং কল্যাণী বন্দোপাধ্যায়ের ধর্ম/সংস্কার ও কুসংস্কার।]

Thursday, June 18, 2015

Reply to the allegations raised against me raised by Abu Taleb Shaikh – 2nd part



“in response to ur post ...kafirder jekhane pao hatta koro...I like to inform u not to avoid the context of the Treaty between the nonbeliever n believers. again u r doing a false propaganda not related to Islam ..u r quoting verse no 5 of chapter 9 . But why r u avoiding verse no ,6 ??, n why r u jumping like a fox into verse 7 ?? . Ok sir I understand why r u jumping bcz verse no 6 answers ALL ur false allegationss.. If u r a real communist ,disclose chapter no 09 verse no...”
 The above words written Abu Taleb Shaikh were posted on my timeline in response to my post given below.
-  “কোরান বলেছে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব না করতে এবং সম্পর্ক না করতে । শুধু তাই নয়, বলেছে ওদের যেখানে পাও হত্যা কর ।
কোরানের কথা তো মিথ্যা হতে পারে না । কারণ, আল্লাহ কি মিথ্যা কথা বলতে পারে ? ভারতে তো স্কুল-কলেজ-অফিস-আদালত-কলকারখানা-ব্যবসাকেন্দ্র-মাঠ-ঘাটে কাফিরদের ছড়াছড়ি । তাহলে এখানকার মুসলমানরা কিভাবে চলবে ? প্রশ্নটা আমার নয়, এই প্রশ্নটা মুসলমানদেরই । তারা উত্তর খুঁজছে ।”
 আবু তালেব-এর উক্ত জবাবের প্রেক্ষিতে এটা আমার জবাবের দ্বিতীয় ভাগ । একজন ধর্মান্ধ ব্যক্তি ও একজন যুক্তিবাদী ব্যক্তির মধ্যে বিতর্ক ও আলোচনা চলতে পারে না জেনেও তার তোলা  অভিযোগগুলির জবাব কেনো দিচ্ছি তা প্রথম ভাগে বলেছি এও বলেছি যে কেনো তার ইংরাজীতে লেখা জবাবের উত্তর বাংলা ভাষায় লিখছি । সুতরাং এখন তবে সরাসরি অর্থাৎ ভূমিকা ছাড়াই দ্বিতীয় ভাগের উত্তরটা শুরু করা যেতে পারে -   
আবু তালেব আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে আমি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যেকার চুক্তিটা এড়িয়ে গিয়েছি এবং  ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক বিবর্জিত যতো  সব মিথ্যা প্রচারণা করছি । আমাকে প্রশ্ন করেছে, আমি  ন’ নম্বর সুরা [অধ্যায়] – এর পাঁচ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেছি, কিন্তু ঐ সুরারই ছ’ নম্বর আয়াতটি কেনো এড়িয়ে গিয়েছি ? এবং  শৃগালের মতো লাফ দিয়ে কেনো ছ’ নম্বর সুরা টপকে সাত নম্বর আয়াতে চলে গিয়েছি ?   
আবু তালেবের এই অভিযোগগুলি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে যে  আমার বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ও ক্রোধ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ মানুষদের যা হয়   । ফলে  একদিকে যেমন তার ভাষায় অসংযম ফুটে উঠছে, অপরদিকে তেমনই আমি কী লিখছি তা ঠিক মতো উপলব্ধি করার জন্যে আমার কথাগুলো ভালো করে পড়ার ক্ষেত্রে তার ধৈর্যচ্যুতিও ঘটছেতালেব আমার বিরুদ্ধে  ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক বিবর্জিত মিথ্যা প্রচারণার অভিযোগ তুলেছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, সে নিজেই আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছে তার সঙ্গে আমার বলা কথাগুলোর কোনো সম্পর্ক  নেই । আমি নাকি বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যেকার চুক্তিটি এড়িয়ে গিয়েছি ! আমি নাকি তওবা সুরার [ন’ নম্বর সুরা] পাঁচ নম্বর  আয়াত উদ্ধৃত করেছি এবং ছ’ নম্বর আয়াত এড়িয়ে গিয়েছি বা পাঁচ থেকে ‘শৃগালের মতো’  লাফ দিয়ে সাত নম্বরে চলে গিয়েছি । তালেবের এ সব অভিযোগ শুনে  তার তিন জন বুন্ধু আবার হৈ হৈ করে হাততালিও দিয়েছে   এই তিন জনের মধ্যে নৈমুদ্দিনও আমার প্রাক্তন ছাত্র এবং বাকি দুজন আমার পাড়ার ছেলে । এরা তিনজনই উচ্চ শিক্ষিত ।
কিন্তু আমি কোথায় ঐ আয়াতটি উদ্ধৃত [আবু তালেব লিখেছে - u r quoting verse no 5]  করেছি ? আমি তো কোনো আয়াতই উদ্ধৃত করি নি । আমি বলেছি কোরান বলেছে যে, ‘ওদের [কাফিরদের] যেখানে পাও হত্যা করো’ । এটা কি কোনো উদ্ধৃতি ?   কাফিরদের হত্যা করার আদেশ তো শুধু ৯/৫ নং আয়াতেই নেই, এরূপ আদেশ কোরানের আরো অনেক আয়াতেই আছে । আমি তাই নির্দিষ্ট করে ৯/৫ নং আয়াতের কথা উল্লেখই করি নি, উদ্ধৃত করা তো পরের কথা ।  সুতরাং বিশ্বাসী ও  অবিশ্বাসীদের মধ্যেকার  চুক্তি এবং  ৯/৬ নং আয়াতটি  এড়িয়ে যাওয়ার বা  ৯/৫ নং থকে লাফ দিয়ে  ৯/৭ নং আয়াতে চলে যাওয়ার  প্রশ্নটাই অপ্রসঙ্গিক, অবান্তর, বিভ্রান্তিকর ও হাস্যকর      
হত্যা করার আদেশ আল্লাহ তথা মুহাম্মদ আর যে আয়াতগুলিতে সরাসরি দিয়েছে তার দু’/একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক । এরূপ  আদেশ বাকারা সুরার [২ নং অধ্যায়]  ১৯১ নং আয়াতেও রয়েছে । আয়াতটি বলছে -   “যেখানেই পাবে তাদের হত্যা করবে, এবং যে স্থান হতে তোমাদের বহিষ্কার করেছে, তোমরাও সে স্থান হতে তাদের বহিষ্কার করবে । ... ”  এর চেয়েও ভয়ঙ্করভাবে হত্যা করার আদেশ আছে কোরানে ৫ নং অধ্যায় তথা সুরা মায়দার ৩৩ নং আয়াতে । আল্লাহ বলছে এ আয়াতে – “যারা আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি উৎপাদন করে, নিশ্চয় তাদের শাস্তি এই যে – তাদের হত্যা করো, কীংবা তাদের শূল-বিদ্ধ করো, অথবা তাদের হাত তাদের পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করো, কিংবা তাদের দেশ হতে বহিষ্কার কর এটাই তাদের পার্থিব প্রতিফল ... ” কোরানে অসংখ্য আয়াত আছে যেখানে মুসলমানদের কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ, উৎসাহ ও প্রেরণা দেওয়া হয়েছে । আর জিহাদ মানেই তো হত্যা করার আদেশ দেওয়া তা বলা বাহুল্য শুধু আত্মরক্ষা করার জন্যে নয়, সারা বিশ্ব ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার আদেশ রয়েছে কোরানে যা অনুসরণ করছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি বিশ্বজুড়ে । কোরান বহু  বার এ রকম কথা বলেছে যে যতদিন না সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় ততদিন জিহাদ করবে।   ২/১৯৩ নং আয়াত  হলো  সে রকম একটি – “তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত অশান্তি দূরীভূত না হয়, এবং আল্লাহর ধর্ম প্রতিষ্ঠিত না হয়  ... ।”  
আবার বলছি যে  ৯/৫ নং আয়াতটি উদ্ধৃত করা তো দূরের কথা, আমি এই আয়াতটির উল্লেখও পর্যন্ত করিনি তবু তালেব এই আয়াতটিকে অকারণ টেনে এনেছে এবং তার সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট চুক্তি ও ৯/৬ নং আয়াতটিকে জুড়ে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ভয়ংকর অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছে  যে, আমি নাকি শুধু শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা করছি । এবং আরো অভিযোগ করেছে যে ৯/৬ নং আয়াতটি আমি একজন ধুর্তের মতো চেপে গেছি । কেনো চেপে গিয়েছি তার জবাব সে নিজেই দিয়েছে, বলেছে এই আয়াতটাতে  নাকি আমার সব মিথ্যা প্রচারণার উত্তর রয়েছেএরূপ গায়ে জ্বালা মেটানো বা নিজের রাগের উপশম করার জন্যে মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগের জবাব দেওয়া  আমার কাছে অরুচিকর মনে হয় এবং জবাব দিতে গিয়ে আমার মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করা  সমীচীনও মনে করি না ।  কিন্তু যেহেতু বলেছে যে ৯/৬ নং আয়াতে সব মিথ্যা প্রচারের জবাব আছে এবং তার এই কথায় অনেকেই প্রভাবিত হয়েছে তাই আমাকে আমার ব্যস্ত সময়ের অনেকটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছেই   
৯/৬  নং আয়াতটি বুঝতে হলে তার আগের কয়েকটি আয়াত আগে জানা আবশ্যক ।  সব আগে    ৯/৫ নং আয়াতটি উদ্ধৃত করা যাক  । আয়াতটি বলছে, “অতঃপর নিষিদ্ধ মাসসমূহ বিগত হলে, অংশীবাদীদের যেখানে পাবে বধ করবে, তাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকবে, কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় তবে তাদের মুক্ত করে দেবে; নিশ্চয় আল্লাহ্ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু   তালেব বলেছে যে এই আয়াতটির সঙ্গে একটি চুক্তির সম্পৃক্ততা আছে যেটা আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়েছি ।  আবারো বলছি তালেব তার কল্পনার জগত থেকে এ সব  অভিযোগ উত্থাপন করেছে যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই । তথাপি  এবার  সেই চুক্তিটির  কথা আলোচনা করতে চাই । কেননা, এটা এখন আমার কাছে  প্রাসঙ্গিক ও আবশ্যক হয়ে গিয়েছে । তালেব কোন  চুক্তিটির কথা বলেছে তা উল্লেখ করে নি । ৯/৫ নং আয়াতের সঙ্গে যে চুক্তিগুলি সম্পৃক্ত সেগুলি সম্পাদিত হয়েছিলো অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসীদের মধ্যে মক্কা জয়ের  পূর্বেই ।  চুক্তি হয়েছিলো মুহাম্মদের সঙ্গে সেই সব অবিশ্বাসী গোত্রগুলির যারা ছিলো কোরেশদের শত্রু । চুক্তিগুলি ছিলো মূলতঃ সন্ধিচুক্তি । সেক্ষেত্রে প্রধান শর্ত ছিলো যে তারা পরষ্পরের  বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না    মক্কা জয়ের পর মুহাম্মদ কিন্তু নির্মমভাবে ও অকারণে সেই চুক্তিগুলি  বাতিল করে দেন যা তাঁর সুবিধাবাদী নীতিকেই প্রকট করে ।
তিনি যখন দুর্বল ও অসহায় ছিলেন তখন সন্ধি করেন,  যেই বিপুল শক্তি অর্জন করলেন তেমন একতরফা  সব চুক্তি বাতিল  করে দেন ।  কোনো আলোচনা ছাড়াই এবং  একতরফাই যে  সকল সন্ধিচুক্ত  বাতিলের ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে ৯/১ নং আয়াতে   ৯/১ নং আয়াতের সেই ভয়ঙ্কর ঘোষণাটি হলো –“   তোমরা  যাদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিলে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ হতে সেই অংশীবাদীগণের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হলো ।” এই ঘোষণাটি পরে একটু সংশোধন করে ৯/৪ নং আয়াতে তিন বললেন  যে  চুক্তির মেয়াদ পর্যন্ত তা পালন করা হবে । সেই ভাষ্যটি হলো –“তবে অংশীবাদীদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ, এবং পরে যারা চুক্তি রক্ষায় কোনো ত্রুটি করে নি, তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে ।” এখানে কিন্ত  চুক্তিটি আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না সে কথা  ঘোষণা করে দেওয়া হলো । ৯/৪ নং এবং ৯/৫ নং আয়াত দু’টির বিস্তারিত ভাব সম্প্রসারণ করা হয়েছে  হাদিসে ও কোরানের তফসিরে । প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাথির লিখেছেন, “ ... ইবনে আব্বাস বলেন যে যাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, আল্লাহ তাদের জন্য চার মাসের সময় নির্ধারণ করে দেন । আর যাদের সাথে চুক্তি ছিল না তাদের জন্য হারাম মাসগুলো অতিক্রান্ত হওয়াকে সীমা নির্ধারণ করেন । ... এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ [সঃ] –কে তাদের সাথে যুদ্ধ করা অনুমুতি দেওয়া হয় যে পর্যন্ত না তারা ইসলাম গ্রহণ করে।   আর যাদের সাথে চুক্তি রয়েছে তারা ১০ই যিলহজ্ব ঘোষণার দিন থেকে নিয়ে ২০শে রবিউল আখির পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করবে । অতঃপর ইচ্ছা হলে মোকাবিলা করবে ।” [সূত্রঃ ইবন কাথিরের তফসির, ৮ম-১১শ’ খণ্ড, পৃ-৬৩৫,৬৩৬]   মুহাম্মদ যখন তাঁর প্রয়োজন হয়েছে তখন সন্ধি করেছেন, যখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তখন সন্ধি ভেঙে দিয়েছেন – এটাই ছিলো তাঁর নীতি ।  কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজী – এই নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন । আবু তালেব আমার বিরুদ্ধে চুক্তির কথা এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনেছে । এমন চুক্তি আমি কেনো আড়াল করবো বা এড়িয়ে যাবো, আড়াল  করলে ওরা করবে  
এবার আসা যাক ৯/৬ নং আয়াত প্রসঙ্গে ।  এই আয়াতটি বলছে – “যদি অংশীবাদীদের কেউ তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করে, তুমি তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লহর বাণী শুনতে পায়, অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দেবে, কারণ তারা অজ্ঞ লোক ।”  এই আয়াতে তালেব দাবি করেছে যে, আমার তথা-কথিত সকল মিথ্যা প্রচারণার  জবাব রয়েছে । আচ্ছা, এই আয়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে কি কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং কাফিরদের হত্যা করার আদেশ বা বিধানগুলি রহিত করে দেওয়া হয়েছে ? না, সে রূপ কোনো কথা নেই । তা হলে  কোরান কাফিরদের হত্যা করতে বলেছে - এটা মিথ্যা প্রচারণা হয় কীভাবে ? এই আয়াতটিতে বলেছে অংশীবাদীরা কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাকে আশ্রয় দিবে এবং পরে তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিবে । কোন অংশীবাদীদের  কথা এখানে বলা হয়েছে তা নিয়ে ইসলামি পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে, অন্ততঃ দুটো মত রয়েছে।   একটা মত হলো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালানো হয় সেই অংশীবাদীদের কেউ আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিতে হবে। আর একটা মত হলো অমুসলিম দেশ বা রাষ্ট্র থেকে কোনো দূত বা অন্য কোনো ব্যক্তি বিশেষ কোনো কাজ নিয়ে যদি ইসলামি রাষ্ট্রে আসে তবে সেই অংশীবাদীকে আশ্রয় দিতে হবে । প্রথম মতানুসারীরা বলছেন, আয়াতটিও বলছে যে আশ্রয় দেওয়াটা কিন্তু নিঃস্বার্থে বা বিনা উদ্দেশ্যে নয়।   তাকে আল্লাহর বাণী শুনিয়ে মুসলমান করা হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। অবশ্য তার মুসলমান না হওয়ার অধিকারও থাকবে  । সেই আশ্রিত মুশরিক যদি  মুসলমান না হয়ে  নিজ বাসভূমে ফিরে যায় তবে কি তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে ? আবু তালেব এখানে খুব জোর দিয়ে বলেছে যে, হ্যাঁ তার নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ঐ আয়াতে বলা হয়েছে । সে পরের কমেন্টে লিখেছে then escort him to where he can be SECURE..... l The right word is SECURE ....not sure which is mistaken in the post..কিন্তু সতিই কী তাই ? মোটেই না । ফিরে গেলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে আল্লাহ যে কথাটা ঐ আয়াতে উহ্য আছে থাকলেও অন্য অনেক আয়াতে রয়েছে । এমনকি ৯/৬ নং আয়াতের তফসিরেও সে কথা  আছে যা পাওয়া যায় ইসলামি পণ্ডিতদের কাছ থেকে । গিরিশচন্দ্র সেন    তফসিরে সে কথাটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন । তিনি লিখেছেন -  “পরে তাহার আশ্রয়ভূমিতে তাহাকে প্রেরণ কর” ইহার অর্থ কোরআন শ্রবণ করিয়া যদি সে এসলাম ধর্ম অবলম্বন না করে, তবে তাহাকে তাহার আশ্রয়ভূমি গৃহে ফিরিয়া যাইতে দাও, পরে তাহার সঙ্গে সংগ্রাম কর(, হো,)  সুতরাং এটা স্পষ্ট হয় যে আশ্রয়প্রার্থী মুশরিককে নিরাপত্তা দেওয়াটা কিছুক্ষণের জন্যে মাত্র, চিরদিনের জন্যে নয়   ‘পরে তাহার সঙ্গে সংগ্রাম কর’ – এর মানে হলো,  হয়  প্রাণের মায়ায় তাকে স্বধর্ম ত্যাগ করতে হবে, নতুবা স্বধর্ম রক্ষায় প্রাণ ত্যাগ করতে হবে । আশ্রয়প্রার্থী মুশরিক ব্যক্তি বলতে ঠিক কাকে বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে দ্বিতীয় মতটি সম্পূর্ণ অন্য রকম ।  সেটা হলো এরূপঃ  “যদি কোন অমুসলিম দেশ থেকে কোন দূত বা ব্যবসায়ী অথবা সন্ধি করতে ইচ্ছুক কোন ব্যক্তি কিংবা জিযিয়া আনয়নকারী কোন ব্যক্তি কোন মুসলিম রাষ্ট্রে আগমন করে এবং ইমাম বা নায়েবে ইমাম যদি তাকে নিরাপত্তা প্রদান করেন তবে যে পর্যন্ত তিনি ইসলামি রাষ্ট্রে অবস্থান করবে এবং স্বদেশে না পৌঁছবে সেই পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হারাম । কিন্তু এরূপ ব্যক্তিকে বছর ধরে বাস করার অধিকার দেওয়া যাবে না ।  [সূত্রঃ ইবনে কাথিরের তফসির, ৮ম-১১শ’ খণ্ড, পৃ-৬৪৭]  সুতরাং এই দু’টি তফসিও প্রমাণ করছে  যে,   কোরান মুশরিকদের   নিরাপত্তার আদেশ দিয়েছে বলে আবু তালেব সেখ উচ্চৈঃস্বরে যে দাবি করছে তা অবাস্তব,  ভিত্তিহীন ও মনগড়া । বরং তালেবের ভাষাতেই এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, তালেব ও তার সমমনস্ক বন্ধুরা যে দাবি করছে যে ইসলাম  হত্যা ও হিংসার কথা বলে না, ইসলাম শান্তির ধর্ম  এবং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে সকল মুশরিকদের  নিরাপত্তা  সুনিশ্চিত করেছে তারাই অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে     

   

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...