Saturday, January 31, 2015

সৌদি আরবের রাজা সালমান কি রাজা আবদুল্লাহর সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, না কি পিছন দিকে হাঁটবেন – গোটা বিশ্ব সে দিকে তাকিয়ে


গত ২৩শে জানুয়ারী সৌদি আরবের  বাদশা আবুদুল্লাহ বিন আজিজ সৌদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর সৎভাই সালমান বিন আজিজ সৌদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। আবুদুল্লাহ কি উপলব্ধি করেছিলেন যে কোরান ও শরিয়তি আইন আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে?  তিনি কি বুঝেছিলেন যে শরিয়তি আইন ও সংস্কৃতির নাগপাশ ছিঁড়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা আবশ্যক হয়ে পড়েছে?  তিনি কি এ রকম কিছু উপলব্ধি করেছিলেন যে, বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে অন্ততঃ কিছুটা হলেও তাল মিলিয়ে না চললে সৌদি আরবের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে? হ্যাঁ, প্রয়াত আবদুল্লাহ এমন কিছু পদক্ষেপ করেন এবং এমন কিছু ঘোষণা দেন তাঁর ম্যৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে যা থেকে ঐ প্রশ্নগুলো অনেকের মনেই তৈরী হয়েছে। 
২০০৮ সালে তিনি ভ্যাটিকানে যান পোপের সাথে দেখা করতে। এটা স্পষ্টতই ইসলামবিরোধী। পোপকে আশ্বাসও দেন যে তিনি খৃষ্টানদের গীর্জা স্থাপন এবং ধর্মাচরণ করার অনুমতি দেবেন। এটা  মুহাম্মদের নির্দেশের বড় উলঙ্ঘন। কারণ, মুহাম্মদ মৃত্যুকালে মক্কা ও মদিনা-সহ আরবকে মুশরিক মুক্ত করার নির্দেশ দেন। ২০১১ সালে তিনি নারীর ভোটাধিকার দেবার ঘোষণা দেন। এটাও ইসলামি আইন বিরুদ্ধ। আবদুল্লাহ প্রথমটা কার্যকরী করে যেতে পারেন নি। নারীর ভোটাধিকারের ঘোষণা আংশিকভাবে কার্যকরী করেন ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালে আর একটা অবিশ্বাস্য সাহসি পদক্ষেপ করেন আবুদুলাহ। তিনি নারীদের খেলাধুলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন।
সৌদি বাদশা আবুদুল্লাহর এই সব পদক্ষেপ নিয়ে সারা বিশ্ব তোলপাড় হয়েছিলো।  তা নিয়ে সে সময় [১২.১০. ২০১১]  আমি একটি প্রবন্ধ লিখি যেটা আজো প্রাসঙ্গিক। সেই প্রবন্ধটি নীচে তুলে দিলাম। তার আগে একটা কথা বলি যেটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে।  কথাটা হলো,  বর্তমান বাদশা সালমান বিন আজিজ সৌদ কি আবদুল্লাহ বিন আজিজ সৌদের আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করবেন, না কি আবদুল্লাহর পথ থেকে সরে এসে সৌদি আরবকে পেছন দিকে চালিত করবেন? 


সৌদিতে গীর্জা স্থাপন ও নারীকে ভোটাধিকার প্রদান করা হলে তা হবে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ        
২০০৮ সালে সংবাদপত্রের একটি  ছবি এবং তার নীচে লেখা সংবাদে চমকে উঠেছিলো সারা বিশ্ব। কারণ, একই ফ্রেমে ছিলো ভ্যাটিকানের পোপ ষোড়শ বেন্ডিক্ট এবং সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহর ছবি সৌদি বাদশা স্বয়ং গিয়েছেন ভ্যাটিকানের পোপের নিকট। গোটা বিশ্বের চোখ আটকে গিয়েছিল ছবিতে সেদিন। আটকে তো যাবারই কথা। মুসলিম-খৃষ্টান বৈরীতামূলক দ্বন্দ যে ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই। সৌদি আরবের বাদশা শুধু একজন রাষ্ট্র-প্রধানই নন, তিনি মুসলিম বিশ্বের একজন প্রধান নেতাও। ইসলামের চোখে খৃষ্টানরা আল্লাহর এবং মুসলমানদের শত্রু। তাই সৌদি বাদশা ও ভ্যাটিকানের পোপের সাক্ষাৎ ও একই ফ্রেমে তাঁদের ছবি দেখতে পাওয়া ততটাই অবিশ্বাস্য যতটা অবিশ্বাস্য দিনের আকাশে চাঁদ দেখতে পাওয়া। ওঁদের দুজনের এক ফ্রেমে দেখতে পাওয়াটা যতটা বিষ্ময়ের ততধিক বিষ্ময়ের ছিলো ছবির নীচের ক্যাপশনটি। ওতে লেখা ছিলো, পোপ বাদশাকে সৌদি আরবে গীর্জা স্থাপনের অনুমতি দিতে অনুরোধ করলে বাদশা সহাস্যে তাতে সম্মতি প্রদান করেন।  

উক্ত সংবাদের বিষ্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই সৌদি আরবের বাদশার আর একটি ঘোষণা আর একবার  চমকে দেয় গোটা বিশ্বকে।  ভ্যাটিকান থেকে ফিরে মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০১১ সালে বাদশা ঘোষণা করলেন যে, সৌদি আরবের নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হলো। নারীরা এবার থেকে ভোট দিতে পারবে, এমনকি পুরুষের সঙ্গে ভোটে দাঁড়াতেও পারবে এবং মজলিসে শুরা (বাদশার উপদেষ্টামন্ডলী) সদস্যও হতে পারবে। পোপের  সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া এবং সৌদি আরবে গীর্জা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া যতটা বিষ্ময়কর ঠিক ততটাই বিষ্ময়কর নারীকে ভোটাধিকার প্রদান করা। ফলে সৌদি আরবে নারীকে ভোটাধিকার দেওয়া হতে পারে তা  বিশ্বের  মুসলিমদের কাছে কল্পনাতীত ছিল। সৌদি আরব হলো মুহাম্মদের জন্মভূমি ও কর্মভূমি। সেই ভূমিতে তাঁর আদেশ-উপদেশের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত বাদশা নিতে পারেন তা ছিলো মুসলমানদের কাছে কল্পনাতীত। সৌদি আরব ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আপাদমস্তক শরিয়তি শাসন ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত।তাই বহিরঙ্গে এই দেশের সর্বত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো সব কর্মকান্ড চোখে পড়লেও এর অভ্যন্তরীণ সমাজে এবং প্রশাসনিক আইন-কানুনে আধুনিক সভ্য সমাজের কোন চিহ্ন চোখে পড়ে না। অভ্যন্তরীণ সমাজে ও সংবিধানে আজও আধুনিক  সমাজের আইন-কানুন ও শিল্প-সংস্কৃতি  প্রবেশ করতে পারে নি, সেখানে শুধুই মধ্য যুগের নিকষ কালো অন্ধকার। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আইনের নিঃসীম অন্ধকারে সৌদি আরব আজও নিমজ্জিত রয়েছে। আর সেই অন্ধকার যুগের আইনের শিকার হলো সকল অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সমগ্র মুসলিম নারীজাতি। মুসলিম নারী সকল প্রকার স্বাধীনতা ও অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। বস্তুতঃ তাদের যাপন করতে হয় মানবেতর এক শোচনীয় জীবন। 
 সৌদি আরবে এখন (২০১১) ৮ লক্ষ মতো খৃষ্টান নাগরিক রয়েছেন । কিন্তু তাঁরা কেউ সে দেশের নাগরিক নন। সেখানে অন্যান্য অমুসলিম যারা থাকেন তাদের অবস্থাও তাই।  নানা পেশায় কর্মরত বিধর্মীরা কেউ সে দেশে আজীবন থেকে যেতে চেয়ে সে দেশের নাগরিকত্ব চাইলেও তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় না। সৌদি আরবের সংবিধানেই সে সুযোগ নেই। একমাত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই সে দেশের নাগরিক হতে পারবে। সে দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করতে হলে বিধর্মীদের ক্ষেত্রে তাঁদের স্বধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। শুধু নাগরিকত্ব অর্জনের উপরেই নয়, বিধর্মীদের স্ব স্ব ধর্ম পালনের উপরেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় শোভাযাত্রা বের করার   অধিকার নেই। নেই নিজেদের ধর্মীয় উপাসনা গৃহ স্থাপন করার অধিকারও। এমন কিছু অঞ্চল আছে (মক্কা, মদীনা ইত্যাদি) যেখানে বিধর্মীদের প্রবেশ করাও নিষেধ। সৌদি আরব এমনিতেই আল্লাহ ও রাসুলের (মুহাম্মদ )পবিত্র ভূখন্ড। তবে বিশেষ করে মক্কা ও মদিনা হলো মুসলমানদের কাছে  সর্বাধিক পবিত্র ভূমি। কারণ মক্কা হলো মুহাম্মদের জন্মভূমি এবং মদিনা হলো তাঁর প্রধান কর্মভূমি। সুতরাং মক্কা ও মদিনার পবিত্রতার সাথে কোনো আপোষ করা চলবে না। অমুসলিমরা অপবিত্র, তাদের স্পর্শে মক্কা ও মদিনার পবিত্রতা বিনষ্ট হবে বলে তাদের জন্যে এই দু'টি নগরীর দ্বার চিরতরে বন্ধ। সৌদি আরবে প্রবেশের সময় খ্রিস্টানরা আগাম অনুমতি ব্যতীত তাদের সঙ্গে ক্রশ ও বাইবেল নিয়ে যেতে পারে না। আর ক্রশ ও বাইবেল সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাওয়াটাও সহজ ব্যাপার নয়। সৌদি আরবে রমজান মাসে দিনের বেলায় পানাহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ। এ আইন শুধু মুসলমানদের জন্যেই নয়, বিধর্মীদের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। সৌদি আরবে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয় ও করুণ। তাঁদের শুধু ভোটাধিকার নেই ব্যাপারটা এমন নয়, বস্তুতঃ কোনো অধিকারই নেই তাঁদের। নেই তাঁদের কোনো প্রকার মান-সম্মান ও আত্মমর্যাদাও। অনাত্মীয় কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করার অধিকার নেই। এমন কি অধিকার নেই অন্য পুরুষদের সঙ্গে একটা কথা বলারও। ঘরের বাইরে একা কোনো নারীর পা রাখার অধিকার নেই। ঘরের বাইরে যাওয়া একান্ত আবশ্যক হলে অনুমতি নিতে হবে পুরুষ অভিভাবকের (পিতা বা পতির) নিকট থেকে। শুধু অনুমতি নিলেই হবে না, তাদের কারো পেছন পেছন যেতে হবে। নারীর গাড়ি চালানোর অধিকার নেই। অধিকার নেই চাকরি বা ব্যবসা করার। উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় নারী সম্পূর্ণ ব্রাত্য। নারী কলুর বলদের মতো বাঁধা পুরুষের সংসারের যাঁতাকলে। এমনই হলো নারীর জীবন যা গৃহপালিত পশুপ্রাণীর থেকে উন্নত তেমন কিছু নয়। নারীর জীবনে ‘অধিকার’ বলতে কিছু নেই, কিন্তু আছে পুরুষের আরোপ করা রাশি রাশি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ও নিষেধাজ্ঞা। পুরুষের সেবা করা, মনোরঞ্জন করা, বংশ রক্ষা করা, সংসারে ঘানি টানা ইত্যাদি কত কর্তব্য নারীর জন্যে রয়েছে মুখ বুঁজে পালন করার। এর বাইরেও রয়েছে আরও কত কি – মুখ বুঁজে পতির আনুগত্য মেনে চলা, পতির তিরস্কার ও প্রহার হাসিমুখে সহ্য করা, পতি অক্ষম হলে নিজের যৌবনকে অবদমিত করে রাখা, নিজের সতীত্ব সযত্নে রক্ষা করা, কুমারী হলে কুমারীত্ব রক্ষা করা ইত্যাদি কত প্রকার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য নারীর ওপর আরোপিত আছে তার ইয়ত্তা নেই। পুরুষতন্ত্রের আরোপ করা এই সব বিধি-বিধানের  অধিকাংশই অন্য সব দেশে হয় শিথিল না হয় বর্জিত হুলেও সৌদি আরবে তা আজও সমানে টিকে আছে। সৌদি আরবের সমাজ ব্যবস্থায় এগুলি শুধু নিয়ম বা প্রথা হিসাবে প্রবর্তিত আছে তা নয়, এগুলি সংবিধানে আইন হিসাবেও লিপিবদ্ধ আছে। না, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সৌদি আরব যে আল্লাহর সংবিধান মেনে চলে কঠোরভাবে। এই সৌদি আরবে সেখানকার বাদশা তাই যখন নারীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার, ভোটে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার এবং খৃষ্টানদের গীর্জা স্থাপন করার অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয় তখন সেটা আকাশে চাঁদ দেখতে পাওয়ার মতোই অবিশ্বাস্য বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সৌদি আরব হলো মুহাম্মদের জন্মভূমি। মক্কা হলো সৌদি আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর যেখানে মুহাম্মদ জন্ম গ্রহণ করেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রচারণা শুরু করেন। মক্কায় তিনি তাঁর ধর্মকে প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যর্থ হলে সৌদি আরবের আর একটি শহর মদিনায় যান এবং সেখান গিয়ে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন। মক্কা ও মদিনা এই দুটি শহরের সৌজন্যে সৌদি আরব বিশ্বের সমস্ত ইমানদার মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পবিত্র, এমন কি তাদের নিজেদের জন্মভূমি ও স্বদেশ অপেক্ষাও। ওই একই কারণে সৌদি আরবের বাদশা তাদের কাছে শুধু একজন বাদশাই নয়, তিনি তাঁদের কাছে সর্বাধিক শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও আস্থাভাজন ধর্মগুরুও। সৌদি বাদশাগণ মুসলমানদের কাছে, বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের কাছে এত উঁচু মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত আরও দুটি কারণে। তাহলো, তারা বিশ্বাস করে যে সৌদি আরবের বাদশাগণ আসলে মুহাম্মদের প্রতিনিধি এবং এবং তাঁরা সর্বদা আল্লাহর করুণা, কৃপা ও সাহায্য প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। আর সে কারণেই বহু কাল ধরে সৌদি আরবের খলিফা তথা বাদশাগণ সে দেশের বুকে শত বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে শরিয়তি শাসন ব্যবস্থাকে অবিকৃত ও অটুট রাখতে তথা ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হয়েছেন। 
                                   , 
    , 

সৌদি আরব ও সে দেশের বাদশার প্রতি এরূপ অন্ধ আবেগ ও বিশ্বাসের কারণে সৌদি আরবের বাদশার উক্ত দুটি সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা গোটা বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম দেশ ও মুসলিম সমাজে একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। শরিয়তি গোঁড়ামিমুক্ত আধুনিক সমাজ নির্মাণের যে আন্দোলন ও প্রক্রিয়া চলছে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে অত্যন্ত মন্থর গতিতে , তাতে এবার আশা করা যায় যে কিছুটা বাড়তি গতি সঞ্চারিত হবে। অপরদিকে উক্ত ঘোষণা গোঁড়া শরিয়তপন্থীদের মধ্যে যথেষ্ট নিরাশা ও হতাশার সঞ্চার ঘটাবে যা তাঁদের গোঁড়ামিপূর্ণ মনোবলের উপর যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সৌদি বাদশার এই ঘোষণায় ইতিমধ্যেই বিশ্বজুড়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। মুসলিম সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মোল্লা-মুফতি ও মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বাদশার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন বাদশা শরিয়ত সম্মত সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ইসলামের উদারনৈতিক চিন্তাধারাকে আরও সমুন্নত করেছেন। অন্য অংশের মতে বাদশার গৃহীত পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অনৈসলামিক, শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ধর্মপ্রাণ ইমানদার মুসলমানদের কাছে খুবই হতাশাজনক ও বেদনাদায়ক। তাঁরা বলছেন বাদশার এই পদক্ষেপ ইসলামের মৌলনীতি ও ভিত্তিভূমিকে আঘাত ও দুর্বল করবে।
দ্বিতীয় অভিমত ও উদ্বেগটি যে আধুনিক, উন্নত ও সভ্য মানব সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত তা সংশয়াতীত। কিন্তু কোরান, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে এটা অনস্বীকার্য যে এই অভিমতটি সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। সৌদি আরবে কোথাও গীর্জা নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হলে তা হবে নিঃসংশয়ে মুহাম্মদের নির্দেশের উলঙ্ঘন। এর অকাট্য প্রমাণ কোরান ও হাদিসের বহুস্থানে রয়েছে। স্বয়ং মুহাম্মদ সৌদি আরবের স্বর্গীয় পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যে সেখান থেকে সমস্ত মুশরিকদের বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়ে গেছেন তাঁর মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে। মৃত্যুশয্যায় মুহাম্মদ তাঁর সাহাবীদের উদ্দেশ্যে কতিপয় নির্দেশ প্রদান করেন যার মধ্যে ছিল একটি এরূপঃ ‘কোনও মোশরেক যেন আরবে থাকিতে না পায়’। ( দ্রঃ মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা/মাওলানা আবুল কালাম আযাদ/পৃ-১৬) । মুহাম্মদ অবশ্য নিজেই তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সময়ে  আরব থেকে মুশরেকদের বহিষ্কারের কাজটি শুরু করেছিলেন এবং মদিনা থেকে ইহুদীদের বহিষ্কার করেছিলেন। শুধু বহিষ্কারই নয়, তিনি অসংখ্য ইহুদীকে নির্মমভাবে হত্যাও করেন। মদিনা থেকে  বিতাড়িত করার জন্যে ইহুদীদের উপর তিনি যেরূপ অত্যাচার ও নির্যাতন সংগঠিত করেছিলেন তার নজির ইতিহাসে খুব কমই আছে। এই সব নারকীয় ঘটনার সাক্ষ্য কোরান ও হাদিস আজও বহন করে চলেছে। হয় ইসলাম গ্রহণ করো, না হয় মদিনা পরিত্যাগ করো – এটা ছিল মুহাম্মদের নীতি ও নির্দেশ। এর প্রমাণ হিসাবে অনেকগুলি হাদিস বর্ণনা করা যায় । এখানে মাত্র দুটি হাদিস উদ্ধৃতি করবো। একটি হাদিসের শিরনাম হলোঃ ইয়াহুদী নাছারাদেরকে হেজাজ (মক্কা-মদীনা) হতে বহিষ্কার করা। হাদিসটি এরূপঃ ‘...  আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একদিন আমরা মসজিদে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ রাসুলে পাক (সাঃ) আমাদের দিকে চলে এলেন। তিনি বললেন, তোমরা ইয়াহুদীদের নিকট চল। অতঃপর আমরা তাঁর সঙ্গে রওয়ানা হলাম। ইয়াহুদীদের নিকট গিয়ে তিনি তাঁদেরকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিয়ে বললেন, হে ইয়াহুদী সম্প্রদায়! তোমরা ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ কর। তা হলে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। ... এর পর তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা দ্বীন-ইসলাম গ্রহণ কর, তা হলে শান্তিতে কাল যাপন করতে পারবে। ... এর পর তিনি তৃতীয়বার তাদেরকে বললেন, তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয় দুনিয়া আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের। আর আমার ইচ্ছা এটাই যে, তোমাদেরকে আমি এ ভূখন্ড থেকে বের করে দিব। অতএব তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি তোমাদের সম্পদ বিক্রয় করে দাও, নতুবা রেখে দাও, সারা দুনিয়া আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসুলের।’ (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং- ৪৪৪১)  আর একটি হাদিস এরূপ যেখানে স্পষ্টাক্ষরে ইহুদীদের নির্মমমভাবে হত্যা করার নির্দেশে রয়েছে। হাদিসটি হলো,  ‘... আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন। বানু কুরাইজার অবরুদ্ধ লোকেরা সা’দ ইবিনে মুয়ায (রাঃ) – এর নির্দেশ মেনে নিতে রাজী হল। রাসুলে পাক (সাঃ) সা’দ (রাঃ) – এর নিকট লোক পাঠালেন। ... তিনি মসজিদের নিকটবর্তী হলে রাসুলে পাক (সাঃ) আনছারগণকে বললেন, তোমরা তোমাদের নেতা এবং উত্তম ব্যক্তির সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাও। রাসুলে পাক (সাঃ) সা’দ (রাঃ)-কে বললেন, এ অবরুদ্ধ দুর্গবাসীরা তোমার নির্দেশ মেনে নিতে রাজী হয়েছে। তখন সা’দ (রাঃ) বললেন, তাদের মধ্যেকার যুদ্ধের যোগ্য লোকদেরকে কতল করা হোক। আর তাদের নারী ও শিশুদেরকে বন্দী করা হোক। তখন রাসুলে পাক (সাঃ) বললেন, তুনি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ফায়ছালা করেছ’। (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং- ৪৪৪৬)  উল্লেখিত হাদিস দুটির প্রথমটিতে মুহাম্মদ ইহুদীদের মদিনা ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন কারণ তাঁরা মুহাম্মদের দাওয়াত (আমন্ত্রণ) রক্ষা করতে তথা স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হতে সম্মত হন নি। আর দ্বিতীয় হাদিস প্রসঙ্গে এ কথা জানানো দরকার যে মুহাম্মদ সা’দের নির্দেশ তথা বিচার অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর করেন এবং তা কার্যকর করতে গিয়ে ৭০০/৮০০ জন পুরুষ ইহুদীকে ন্শৃসভাবে কতল করেন। এভাবেই মুহাম্মদ স্বয়ং আরবকে পবিত্র(!) করার নিমিত্ত মুশরিকদের হত্যা অথবা নির্বাসিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু কাজটি সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেন নি, তাই মৃত্যুর পূর্বে তা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর সাহাবীদের (অনুগামী) উপর। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলামের খলিফারা (মুহাম্মদের প্রতিনিধিরা) সেই নির্দেশটি অতি নির্মমভাবে কার্যকর করেন। ফলে আরবের বিধর্মীরা আত্মরক্ষার্থে হয় মুসলমান হয়ে যায়, না হয় স্বধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয় মুসলমানদের হাতে। সে সময় বলা বাহুল্যে যে আরব ভূখন্ডে বিধর্মীদের যত উপাসনা গৃহ ছিল তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই সৌদি আরবে অমুসলমানদের বসবাস করা বা ধর্ম পালন করা নিষিদ্ধ রয়েছে। স্বভাবতই সৌদি আরবে গীর্জা স্থাপনের অনুমতি প্রদান যে একটি অনৈসলামিক কাজ তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। গীর্জা স্থাপনে অনুমতি প্রদান করার অর্থই হলো খ্রিস্টানদের সাথে তথা মুশরিকদের সাথে সদ্ভাব স্থাপন করা যা কোরান একেবারেই অনুমোদন করে না  কোরানে অনেক আয়াতেই এ বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে । কোরানের কয়েকটি আয়াত এরূপঃ  ‘... তখন তোমরা নামায সংক্ষেপ করলে কোনো অপরাধ নেই, যদি তোমরা ভয় করো- অবিশ্বাসীগণ তোমাদের বিব্রত করবে। নিশ্চয় অবিশ্বাসীরা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’। (৪/১০১)  ‘আল্লাহর নিকট অবিশ্বাসকারীরাই নিকৃষ্ট জীব, যেহেতু তারা অবিশ্বাস করে’। (৮/৫৫) ‘হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের আপনজন ব্যতীত আর কাউকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না। ... এবং তাদের হৃদয়ে যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর’। (৩/১১৮)  এই আয়াতটিতে ‘তোমাদের আপনজন ব্যতীত আর কাউকেই’ – এই কথার অর্থ স্পষ্ট করা হয়েছে কোরানের তফসিরে। তফসিরটি এরূপঃ ধর্মোদ্রোহী লোকের সঙ্গে বিশ্বাসীর বন্ধুতা করা উচিত নহে, তাহারা সর্বদা শত্রু । ( দ্রঃ কুরআন শারীফ/গিরিশ চন্দ্র সেন, পৃ-৬২) 
নারীর ভোটাধিকারের প্রশ্নে আলোকপাত করা যাক। নারীকে ভোটাধিকার ও ভোটে প্রার্থী হবার অধিকার প্রদান করার অর্থ হলো তাঁদের ঘরের বাইরে একা একা ঘোরাঘুরি করার অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করা এবং তাঁদের হাতে দেশ পরিচালনা করার অধিকার অর্পণ করা। ইসলাম ধর্মে কিন্তু এর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রয়েছে।  ঘরের বাইরে নারীর একা বাহির হওয়ার অনুমতি নেই এবং নারীর বোরখা পরা বাধ্যতামূলক। নারী যে ঘরের বাইরে একা একা ও সাজসজ্জা করে ঘোরাঘুরি করতে পারবে না তা স্পষ্ট করে কোরান বলেছে। সেই আয়াতটি হলো – ‘এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রাক-ইসলামি যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়িও না, তোমরা নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অনুগত হবে ‘। ( ৩৩/৩৩ ) নারীর যে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক সে কথা বলা হয়েছে ৩৩/৫৯ নং আয়াতে। আর নারীর নেতৃত্ব?  ইসলাম একেবারে নাকচ করে দিয়েছে সেটা। কোরান বলছে পুরুষ নারীর কর্তা এবং হাদিস বলছে যে জাতি নারীর নেতৃত্ব মেনে চলবে তারা কোনোদিন সফলকাম হতে পারবে না। কোরানের কথাটি হলো – ‘পুরুষগণ নারীদিগের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত কর্তা। যেহেতু আল্লাহ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেহেতু যে তারা স্বীয় ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে থাকে; এই জন্য স্বাধ্বী স্ত্রীরা অনুগত হয়, ...’। (৪/৩৪)  নারী-নেতৃত্ব প্রসঙ্গে মুহাম্মদ বলেছেন – ‘... নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছিল যে, পারস্যের লোকেরা কিসরার কন্যাকে তাদের শাসক নিযুক্ত করেছে তখন তিনি বললেন, সে জাতি কখনই সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসনভার কোন রমণীর হাতে অর্পণ করে’। (বোখারী শরীফ, ১ম-৭ম খন্ড একত্রে, হাঃ নং – ১৮০৩,৩৩৬৬) 
এরূপ আরও অনেক আয়াত ও হাদিস আছে যা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে সৌদি আরবের বাদশার নেওয়া সিদ্ধান্ত দুটি সম্পূর্ণরূপে শরিয়ত ও ইসলাম বিরোধী। বাদশাও তা বিলক্ষণ জানেন। তাই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে যে সব কথা বলেছেন তা কার্যতঃ কৈফয়ত বৈ নয়। তিনি বলেছেন উলামা (ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ) ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলেই নারীকে ভোটাধিকার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং তার ফলে ইসলামের অবমাননা হবে না। সৌদি আরবে গীর্জা স্থাপনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। বাদশার এই জবাব যে বিন্দুমাত্র  বলিষ্ঠতা ও আত্মপ্রত্যয়ের দৃপ্ত স্বর বা ভঙ্গী নেই তা বলা বাহুল্য।
সৌদি আরবের বাদশা সিদ্ধান্ত দুটি কতটা আন্তরিকতার সাথে কিংবা উদারনৈতিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গ্রহণ করেছেন তা বলা মুসকিল আরবের বিভিন্ন দেশ এবং আরবের বাইরে বিভিন্ন মুসলিম দেশে মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্নে বিক্ষোভ ক্রমশঃ বাড়ছে কোথাও সশস্ত্র বিদ্রোহও শুরু হয়েছে। মানুষের প্রধান চাওয়া হচ্ছে  চাইছে গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা। তাই কোথাও বিক্ষোভ তো কোথাও বিদ্রোহ। এই বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে সামিল শুধু পুরুষরাই নয়, সামিল নারীও।  খোদ সৌদি আরবেও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার। এমন কি নারীরাও রাস্তায় নেমে পড়েছে।  তারাও তাদের নিজেদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করছে। তারা ভোটাধিকার চাইছে বহুদিন থেকেই, এখন তো চাইছে গাড়ি চালাবার অধিকারও। সৌদি আরবের বাদশা এসব আন্দোলন ও বিক্ষোভকে হাল্কাভাবে নেওয়ার ভরসা পাচ্ছেন না। ভয় পাচ্ছেন পাছে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো বিদ্রোহের রূপ না নিয়ে নেয় এসব আন্দোলন।  সেই ভয়েই হয়তো তিনি মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবী অনিচ্ছা সত্বেও স্বীকার করে নিতে  বাধ্য হয়েছেন। অপরদিকে অমুসলিমদেরও স্ব স্ব ধর্মাচরোণের অধিকার দিতে হবে মুসলমানরা যেমন সারা বিশ্বে সেই অধিকার ভোগ করছেন – এটা দীর্ঘদিনের একটা আন্তর্জাতিক দাবী। আন্তর্জাতিক এই চাপটি ক্রমশঃ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। ফলে  ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই দাবী বা চাপটি আর অগ্রাহ্য করা বা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।  তাই বোধ হয় একেবারেই নিরুপায় হয়েই সৌদি আরবে কর্মসূত্রে বসবাসকারী আট লক্ষ খৃষ্টান সম্প্রদায়ের গীর্জা স্থাপনের দাবীকেও স্বীকার করে নিতে হয়েছে।  
মোদ্দা কথা হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তবোচিত মূল্যায়ন করেই সৌদি আরবের বাদশাকে প্রায় ১৪০০ বছরের কট্টর শরিয়তি ঐতিহ্য তথা গোঁড়ামি থেকে কিছুটা পশ্চাদপসারণ করতে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও নারী-স্বাধীনতার মুক্ত বায়ু যাতে কোনোভাবেই সৌদি আরবে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্যে শত শত বছর ধরে ছিল সতর্কতা। কড়া প্রহরা এবং তীক্ষ্ণ নজরদারী। অবশেষে অনেক বিলম্বে হলেও, সেই কড়া প্রহরা কিছুটা শিথিল করতেই হলো এবং একটু হলেও ফাঁক করে দিতে হলো শরিয়তি ভূখন্ডের মুক্তবায়ু-নিরুদ্ধ সকল দরজা-জানালার বন্ধ কপাটগুলি। অবশেষে মুহাম্মদের নিজের জন্মভূমি ও কর্মভূমি সৌদি আরবের শরিয়তি ফুসফুসে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নারী-স্বাধীনতার কিছুটা মুক্ত বায়ু প্রবেশ করার ছাড়প্ত্র দিতেই হলো। এটা একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা যা বিশ্ব-মোল্লাতন্ত্রকে নিশ্চিতভাবেই একটা ঝাঁকুনি দেবে। এবং ভবিষ্যতে এই ঘটনাটি   বিশ্বজুড়ে মুসলিম দেশগুলি ও মুসলিম সমাজকে শরিয়তি গোঁড়ামি থেকে বেড়িয়ে এসে আধুনিক সমাজ নির্মাণের প্রশ্নে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে ।

Monday, January 26, 2015

২৬ শে জানুয়ারী দিনটি আসলে প্রতারণা দিবস ছাড়া কিছুই নয়


আজ আমাদের দেশ ৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করছে সাড়ম্বরে, মহাসমারোহে। কিন্তু ১২০ কোটি মানুষের ১০০ কোটিই  জানে না এটা আবার কেমন দিবস? মানুষ নবি দিবস জানে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস জানে, রাম নবমী জানে, গুরু নানকের জন্ম দিবস জানে, আপন গুরুর জন্ম দিবস জানে, একাদশী জানে, কবে কোন দিন কোন তিথিতে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে উপবাস থাকতে হবে জানে, কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবস কী তার কিস্যু জানে না। তবু সাড়ম্বরে, ধূমধাম করে বছর বছর দিবসটি উদযাপন করা হয়, জলের মত খরচ করা হয় দেদার টাকা। যারা উদযাপন করে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা সবাই ভালো করেই জানে যে দেশের অধিকাংশ মানুষ  প্রজাতন্ত্র  কী সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তবু তারা মহা উৎসাহে ২৬ শে জানুয়ারীর দিন সকাল বেলা পতাকা তোলে, প্রজাতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করে,  প্রজাতন্ত্রের অহঙ্কার করে, দেশ কত এগোলো তার  লম্বা লম্বা ফিরিস্তি দেয়, হাসপাতালে যারা সারা বছর অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে অবহেলায় তাদের কাছে গিয়ে দু-একটা ফল তুলে দিয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়, অর্ধমৃত মানুষগুলো হঠাৎ এসব দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে এ ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চায়, বাবুরা ঝড়ের বেগে আসে আর কিছু ফল বিতরণ করে আবার ঝড়ের বেগে চলে যায়। এভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে শাসকশ্রেণী, শোষকশ্রেণি, শাসক দল, বিরোধীদল, সবাই মিলে ফি বছর তারা মানুষকে ঠকায়, ঠকায় বিশ্ববাসীকেও।
শাসক শ্রেণী, শোষক শ্রেণী শাসক দল ও বিরোধী দল, কেউ চাই না যে দেশের মানুষ জানুক প্রজাতন্ত্র দিবস কী, কেন এবং  কার স্বার্থ পূরণ করে এই দিবস? খেটে খাওয়া অর্ধভুক্ত, অভুক্ত মানুষগুলো প্রজাতন্ত্রের মানে জানলে তাদের অনেক অসুবিধা, তাদের শ্রম সস্তা দরে কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো যাবে না, চাষীকে  বেশী দামে সার, বীজ, বিষ বিক্রী করে, তাদের ফসল ও কাঁচামাল  সস্তায় কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো যাবে না, বনবাসীকে বন থেকে উচ্ছেদ করে বনের দখল নেওয়া যাবে না,  খাল-বিল-নদী-সমুদ্র থেকে মৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ করে সেগুলো কব্জায় রেখে অনায়াসে ভোগ করে যাবে না, পাহাড়বাসীকে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করে পাহাড়ের সম্পদ লুঠ করা যাবে না, মানুষের রুজি-রোজগারের প্রতিদিনের সংগ্রামকে আইনশৃঙ্খলার দোহায় দিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে দমন করা যাবে না, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটিতে বুঁদ করে রাখা যাবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে ধর্মের গাঁজা-চরস খাইয়ে মসজিদে-মন্দিরে-গীর্জায় আটকে রাখা যাবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে-বেকারত্বে জর্জরিত থাকা মানুষকে ভাগ্যের দোহায় দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যাবে না, দেশের তথা দেশের মানুষের  সকল সম্পদ যেমন বন-জঙ্গল, পাহাড়, নদ-নদী, ইত্যাদি জলের দরে কিংবা বিনা দামেই আত্মসাৎ করা যাবে না। 
সুতরাং প্রজাতন্ত্র দিবস কী তা মানুষ জানুক – এটা শাসক শ্রেণী চাই না একদম। চাই না তার আরো বহু কারণ আছে।  জানলে  তারা তাদের সমস্ত অধিকার বুঝে নিতে চাইবে, বেঁচে থাকার জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- স্বাস্থ্য ন্যূনতম এই পাঁচটি জিনিষ ন্যূনতম পরিমাণে  সরকারের কাছে দাবী করবে, দাবী করবে এটা জেনে যে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবী করবে তাদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, জাত-পাত, বর্ণবিভেদের পাঁচিল গুঁড়িয়ে  দিয়ে দাবি করবে সমান মর্যাদা পাবার অধিকার, নারী দাবী করবে পুরুষের সমান অধিকার ও ক্ষমতা পাবার, দাবীতে দাবীতে পাগল করে দেবে রাষ্ট্রকে তথা শাসক ও শোষক শ্রেণীকে। এমনি করতে করতে মানুষ একদিন বুঝবে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান নয়, রাষ্ট্র সকলের সঙ্গে সুবিচার করে না, রাষ্ট্রটা মোটেই নিরপেক্ষ নয়, এবং এই রাষ্ট্রটা তাদের নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে চাইবে, একা যেতে না পারলে ক্ষমতার ভাগ নিতে চাইবে। যেদিন মানুষ এ সব বুঝবে সেদিন তাদেরকে ঠেকানো যাবে না কোনোভাবেই, হয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। শাসক শ্রেণী তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলির অর্থ, তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞ করে রাখতে। শাসক শ্রেণী তাই মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে। এভাবেই ৬ বছর ধরে তারা ভারতবাসীকে ঠকিয়ে  আসছে।
আজ ২৬শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে, আকাশে কত যুদ্ধ বিমান উড়ছে, কত বাদ্যি বাজছে, এ সব বসে বসে দেখছি টিভির পর্দায়। পাশাপাশি শুনছি কত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, শুরু হয়ছে এই ফুলঝুরি ছোটানো  কয়েকদিন  থেকে অথচ চারিদিকে রোজরোজ নারীর শ্লীলতা হানি হয়, নারীরা ধর্ষিতা হয়, সে সব দেখে রাষ্ট্র কার্যতঃ নীরব থাকে, কিছুই করে না তা প্রতিরোধ করার, ঘুরিয়ে এ রাজ্যের নারী মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষিতা নারীকেই অপবাদ দেন নষ্ট মেয়ে বলে, তারপরেও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে একের পর এক প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির ছোটে  নেত্রী ও নেতাদের কন্ঠে, আজও সে ফুলঝুড়ি ছুটছে সমানেআর এদিকে গত বছর ২০ বছরের সাঁওতাল সমাজের মেয়েটিকে ঐ সমাজের মোড়ল-মাত্তবর যারা গণধর্ষণ  করার ফরমান দিয়েছিলো, যারা ধর্ষণ করেছিলে পার্ক স্ট্রীট, কাটোয়া প্রভৃতি অসংখ্য জায়গা অসংখ্য নারীকে এবং  গতকালই  একজন নারীকে বিবস্ত্র করে যারা গাছে বেঁধে মেরেছে শাসক দলের সেই পোষা গুণধর নেতাকর্মীরা আজ ক্লাবে ক্লাবে, অফিসে অফিসে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা  তুলছে, আর অন্যদিকে শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে সেই অসংখ্য ধর্ষিতা ও নিগৃহীতা  মেয়েরা ঘরের কোণে  মানসিক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটট করছে, এই মেয়েরা জানে না কী অপরাধে তাদে উপর এতো অত্যাচার ও নিগ্রহ হয়েছে ও হয়    
আজ ২৬শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে দিল্লীতে, রাজ্যে রাজ্যে সমস্ত রাজধানী শহরে,  ভাষণ বিলানো হচ্ছে দেদার, বড়ো বড়ো ভাষণ, যে ভাষণে বলা হচ্ছে, ভারত প্রজাতান্ত্রিক দেশ, এখানে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্ব স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ধর্ম না পালনের স্বাধীনতা, সসম্মানে ও স্বমর্যাদায় বেঁচে থাকার স্বাধীনতা সহ সমস্ত স্বাধীনতা সুরক্ষিত। রাষ্ট্র নেতাদের এ সব ভাষণ যে শুধুই ভাষণ, এবং  বিলকুল মিথ্যা ভাষণ সে কথা দুনিয়া শুদ্ধ লোক জানে। এ সব ভাষণ যে বিলকুল মিথ্যা তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বারাক ওবামা। ওবামা আজ দিল্লির অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, প্রধান অতিথি। প্রধান মন্ত্রী মোদি স্বয়ংই যে প্রজাতন্ত্রের পথে একটা মস্ত বড়ো কাঁটা তা বিশ্ববাসী জানে, কারণ তিনি নিজেকে আরএসএসের পোষ্টার বয় বলে গর্ব করেন। একে মোদি, তারপর ওবামা – এ যে সোনায় সোহাগা। মোদি চায় ভারতে হিন্দুতন্ত্র কায়েম করতে আর ওবামা চায় বিশ্বকে আমেরিকার নয়া উপনিবেশবাদ বানাতে। সেই লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালের ৬ই ও ৯ই আগষ্ট জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফাটিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করতে আমেরিকার বুক এতটুকুও কাঁপে নি। ভিয়েতনামে লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলে হত্যা করেছিল ভিয়েতনামের হাজার হাজার মানুষকে। অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান, যুদ্ধাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংসলীলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এই তো সেদিন আফগানিস্তান ও ইরাকেওউদ্দেশ্য ছিল দুটো রাষ্ট্রে তাবেদার সরকার বসিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করা, বিশেষ করে ইরাকের খনিজ তৈল ভাণ্ডারের দখল নেওয়া। প্রবল শক্তিধর আমেরিকা এ ভাবে একের পর এক দেশে হামলা চালিয়ে চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, ধন-সম্পদ ধ্বংস করেছে মানবাধিকারের নামে এবং রষ্ট্রসঙ্ঘ ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই। এদিকে মোদিজি প্রধান মন্ত্রীর গদিতে আসীন হওয়ার পর দেখছি ভাগবত, তোগাড়িয়া, সিংঘল, উমাভারতীরা গর্ত থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। বলছে ভারতবাসী মানেই হিন্দু, ভারতবাসী মানেই রামের সন্তান, এ কথা যে অস্বীকার করবে সে জারজ সন্তান। মোদিজী সব জেনে শুনেও নীরব থেকে তাদের সাহস জোগাচ্ছেন। অথচ সেই ওবামা ও মোদিই আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে  গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব, বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বড়ো বোড়ো ভাষণ দিচ্ছেন। একদিকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ, আর একদিকে আন্তর্জাতিক ইসলামি সন্ত্রাসবাদ, মাঝখানে ভারতে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের ভ্রুকূটি, সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় শান্তি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের পুরোহিত ওবামা ও হিন্দুত্ববাদের প্রতীক আরএসএসের পোষ্টার বয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজির কণ্ঠে আমাদের  শুনতে হচ্ছে  সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লম্বা-চওড়া ভাষণ। এই হচ্ছে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের বেহাল অবস্থা। হায়রে প্রজাতন্ত্র দিবসের মহিমা!
লাল কেল্লা থেকে আমাদের শোনানো হচ্ছে আমাদের বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শান্তি-সম্প্রীতির ভারী ভারী কথা। কিন্তু কোথায় আমাদের বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক তসলিমা নাসরিন আজ দিল্লীতে নির্বাসিত। ভারত সরকার অনেক আগেই তাঁকে এ দেশে থাকার  অনুমতি দিয়েছে, মোদিজি ক্ষমতায় এসে সেই অনুমতি আটকে দিতে বহু টালবাহানা করলেন। সেই বৈধ অনুমতির জোরে তসলিমা নাসরিনের ভারতের যে কোনো স্থানে যাওয়ার ও থাকার  অধিকার  আছেরাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাঁর এ অধিকার যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে তা দেখা ও সুনিশ্চিত করা। অথচ রাষ্ট্রই তাঁকে কলকাতায় আসতে দিচ্ছে না। বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতা ব্যানার্জিও বাম সরকারের মতো তাঁকে কলকাতায় আসতে দিচ্ছেন না। এমনকি  গত বছর  কলকাতা বই মেলায় তাঁর লেখা একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনআটকে দিয়েছিলো বইমেলা কত্তৃপক্ষ মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে। তাঁর লেখা একটা বাংলা সিরিয়ালের প্রচারও তিনি বন্ধ করে দেনবিশ্বখ্যাত লেখক সলমান রুশদিও গত বছর কলকাতা বই মেলায় আসতে পারেন নি মমতা সরকারের বাধায়। কেন তসলিমা ও সলমন রুশদির অধিকার হরণ করলো সরকার? কারণ তাঁরা মুসলিম ধর্মাবেগে আঘাত করেছেন। কে বলেছে? মুসলিম ধর্মের নেতারা। তাই ওঁদের কলকাতায় পা ফেলার অধিকার নেই। এই হলো এ দেশে মানুষের বাক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত রাখার ও  থাকার নমুনা। এ দেশে লেখকের বাক স্বাধীনতা নেই, কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। সে স্বাধীনতা লাগামহীন তারা যা কিছু বলতে পারে, মুন্ডু কাটার ফতোয়া দিতে পারে, এ ফতোয়া বেআইনী তবুও তাদের অধিকার আছে তা দেওয়ার, এমনকি মুণ্ডু কাটারও তাদের অবাধ অধিকার আছে তসলিমার উপর সেই ফতোয়া তারা দিয়েছে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে। একই ফতোয়া দিয়েছিলো দঃ চব্বিশ পরগণা জেলার আক্রা হাই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লার উপর একটা নিরীহ প্রবন্ধ লেখার অপরাধেতাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা। মোরসেলিনকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেয় নি, ঘুরিয়ে বলেছিলো ফতোয়াবাজ মোল্লাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে। মোরসেলিন অগত্যা তাই করেছিলেন, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন এবং আর কোনোদিন ঐ রকম লেখা লিখবেন না বলে থানায় বসে মোল্লা ও পুলিশের কাছে মুচলেকাও লিখে দিয়ে এসেছিলেন। একই অবস্থা হয়েছিলো ঐ পত্রিকার সম্পাদক মহাশয়েরও যাঁঁর পত্রিকায় লেখাটা বেরিয়েছিলো। এ ঘটনা বাম সরকারর আমলের। প্রায় একই সময়ে ঐ একই কারণে  আমারও  মুন্ডুচ্ছেদ করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো। আমাকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, যারা আমাকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে আমার লিখিত অভিযোগও নেয় নি। প্যারিসে গত ৭ই জানুয়ারী ব্যাঙ্গ পত্রিকা শার্লি এব্দুর ব্যাঙ্গ শিল্পী সহ ১২ জন সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সেই হত্যালীলাকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে হত্যাকারীদের আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএসপি নেতা জনৈক কুরেশি। কিন্তু সরকার ও পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় নি। এই হচ্ছে আমার দেশ, আমাদের প্রজাতন্ত্র, আমাদের যাবতীয় অধিকার সুরক্ষিত থাকার নমুনা। আসল কথা হলো এ দেশে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা আছে শাসক শ্রেণীর, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের, শাসক দল আশ্রিত চোর-গুন্ডা-বদমাশদের, ধাপ্পাবাজ ও প্রতারক ধর্মীয় নেতাদের ও পুলিশের, স্বাধীনতা নেই কেবল সাধারণ মানুষের, লেখকদের ও নারীদের।  
তাই প্রজাতন্ত্র দিবসের আসল মানে যাই থাক, আমার কাছে এ দিনটি প্রতারণা দিবস ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এ দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না শুধু তাই নয়, বরং দিনটিকে প্রজা-নিয়ন্ত্রণ, প্রজা-নিষ্পেষণ ও প্রজা-হরণ দিবস বলেই মনে হয়।
   
       

Saturday, January 17, 2015

হাফসার প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করতে মুহাম্মদ তাঁকে তালাক দিতেও দ্বিধা করেন নি


মুহাম্মদের যে কজন স্ত্রী ইতিহাসে বিশেষভাবে খ্যাত তাঁদের মধ্যে একজন হলেন হাফসা। তিনি  ছিলেন দ্বিতীয়  খলিফা এবং মুহাম্মদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সাহাবী ওমর বিন খাত্তাবের বিধবা কন্যা। হাফসার স্বামী, খানায়িস বদর যুদ্ধে মারা গেলে মুহাম্মদ তাঁকে বিয়ে করেন। হাফসা ছিলেন ব্যতিক্রমী নারীদের একজন তিনি  অসাধারণ  সাহস ও প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যা মুহাম্মদের অপছন্দ ছিলো ফলে  মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর মাঝে মাঝেই দ্বন্দ ও কলহ হতো, কখনো কখনো কলহ তো তীব্র সংঘাতের রূপ পরিগ্রহ করতোঅন্ততঃ একবার  সংঘাত এতো চরমে উঠেছিলো যে মুহাম্মদ মেজাজ হারিয়ে তাঁকে তালাক দিয়ে  ঘর থেকে বের করে  দেন।  অবশ্য হাফসাকে তালাক দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে  তিহাসে অনেক মতভেদ রয়েছেমতভেদ শুধু ঐতিহাসিকদের মধ্যেই নয়, মতভেদ রয়েছে মুসলিম সমাজের সর্বস্তরেও। একটা মত হলো, মুহাম্মদ সত্যিই হাফসাকে তালাক দিয়েছিলেন, আর একটা মত হলো,  তালাক দেওয়ার প্রচারটা নেহাতই একটা গুজব ছিলো দুটি প্রধান হাদিস বলছে যেমুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন বলে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছিলো একবার। তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক বিন খাত্তাব সরাসরি মুহাম্মদের কাছে গিয়ে জানতে চান আসল ঘটনাটা কী মুহাম্মদ নাকি তখন জানান যে তিনি তালাক দেন নি এই মতটির পক্ষে কয়েকটি হাদিস আছে। সে রকম একটি হাদিসের  বয়ানের অংশ বিশেষ  এ রকমঃ  “... যখন রাসূলে পাক [সাঃ] তাঁর স্ত্রীদের নিকট হতে সাময়িকভাবে পৃথক হয়ে গেলেনতখন আমি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম যে, লোকগণ হাতে কঙ্কর নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তারা পরষ্পর আলোচনা করতেছিল যে, রাসূলে পাক [সাঃ] তাঁর স্ত্রীগণকে তালাক প্রদান করেছেনঘটনাটি ছিল তাঁদের উপর পর্দার আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বেকার। ওমর [রাঃ] বললেন, প্রকৃত ঘটনাটা কি  তা আজই জেনে নিব; ...  আয়েশা বিনতে আবুবকর [রাঃ] এবং হাফছাহ বিনতে ওমর [রাঃ] এ দুজন হুযুর [সাঃ] – এর অন্যান্য পত্নীদের উপর তাদের প্রাধান্য বিস্তার করে আসতেছিল । আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ [সাঃ] ! আপনি কি তাদের তালাক দিয়েছেন ? তিনি বললেন, না(মুসলিম শরীফ, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাঃ নং – ৩৩৫৬, পৃঃ - ৫৫৪) তিরমিযী শরীফেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।  মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরিফ  প্রধান সহিহ হাদিসগুলোর অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু এই হাদিস দুটিতে উল্লেখ রয়েছে যে তালাক দেওয়ার প্রচারটা নেহাতই গুজব মাত্র,  তাই এই মতটিই [অর্থাৎ মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রী হাফসাকে তালাক দেন নি] সত্যি ভাবলে ভুল হবে। কারণ, অন্য কয়েকটি সহিহ হাদিস সাক্ষ্য দেয় যে হাফসাকে তালাক দেওয়ার ঘটনাটি মোটেই গুজব নয়, মুহাম্মদ  সত্যি সত্যিই  তাঁকে  তালাক দিয়েছিলেন। যে হাদিসগুলি সত্য ও সঠিক বলে মুসলিম সমাজে অনুমোদিত ও স্বীকৃত সেগুলিকে সহিহ হাদিস বলা হয়। মুহাম্মদ হাফসাকে সত্যিই তালাক দিয়েছিলেন এ কথা  যে সব হাদিসে ব্যক্ত করা হয়েছে তার তালিকা  দিয়েছেন প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাথিরকাথির লিখেছেন যে মুহাম্মদ হাফসাকে সত্যিই একবার তালাক দিয়েছিলেন, কিন্তুরে ওমরের অনুরোধে মুহাম্মদ সে তালা ফিরিয়েও নিয়েছিলেন। কোরানের ৩৩/৫২ নং আয়াতের তফসীরে এ প্রসঙ্গে তিনি  লিখেছেন  “আর হযরত হাফসা [রাঃ] সম্পর্কীয় ঘটনাটি সুনানে আবি দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ প্রভৃতি হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। হাফিজ আবূ ইয়ালা [র:] বর্ণনা করেছেন যে,  হযরত ইবনে উমার [রাঃ] বলেছেনঃ  হযরত উমার [রাঃ] হযরত হাফসা [রাঃ] – এর নিকট এমন অবস্থায় প্রবেশ করেন যে, তিনি কাঁদছিলেন। তখন তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ  তুমি কাঁদছো কেন? সম্ভবতঃ রাসুলুল্লাহ [সঃ] তোমাকে তালাক দিয়েছেন। নিশ্চয় তিনি তোমাকে একবার তালাক দিয়েছিলেন। অতঃপর আমারই কারণে তিনি তোমার ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যদি তিনি তোমাকে তালাক দিয়ে থাকেন তবে আমি কখনও তোমার সাথে কথা বলবো না।” (দ্রঃ- ইবনে কাথিরের তফসির, ১৫শ খন্ড, পৃ – ৮৩৮)  ইবনে কাথির ৬৫/১ নং আয়াতের তফসিরেও এই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কাথির এই তফসিরে বলেন যে মুহাম্মদ হাফসাকে তালাক দিয়ে তাঁর গৃহ থেকে তৎক্ষণাৎ বের করে দেন যেটা মস্তবড়ো ভুল ছিলো। ফলে আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ৬৫/১ নং আয়াতটি তথা প্রত্যাদেশটি পাঠিয়ে হাফসাকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন এবং মুহাম্মদ তখন হাফসাকে ফিরিয়ে নেন। এই আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, “হে নবী [সঃ] তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে ইচ্ছা কর তবে তাদেরকে তালাক দিয়ো  ইদ্দতের প্রতি লক্ষ রেখো, ইদ্দতের হিসেব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো; তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ হতে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয়।” উক্ত তফসিরে এই আয়াতের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কাথির বলেছেন মুহাম্মদ হাফসাকে তালাক দিয়েও তা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন আল্লাহর নির্দেশে, ওমরের অনুরোধে নয়। তিনি লিখেছেন – “হযরত আনাস [রাঃ] হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ [সঃ] হযরত হাফসা [রাঃ] – কে তালাক দেন। তখন তিনি পিতা-মাতার বাড়িতে চলে যান। ঐ সময় এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলুল্লাহ [সঃ] – কে বলা হয়ঃ তাঁকে [হযরত হাফসা (রাঃ) – কে] ফিরিয়ে নাও। সে খুব বেশী  রোযাব্রত পালনকারিণী এবং অধিক নামায আদায়কারিণী। সে দুনিয়াতেও তোমার স্ত্রী এবং জান্নাতেও তোমার স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অন্যান্য সনদেও এসেছে যে রাসূলুল্লাহ[সঃ] হযরত হাফসা[রাঃ] – কে তালাক দিয়েছিলেন, অতঃপর রুযূ করেছিলেন বা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।” (দ্রঃ- ইবনে কাথিরের তফসির, ১শ খন্ড, পৃ –  ৫৩২, ৫৩৩)   
এ কথা ঠিক যে মুসলিম সমাজে পরের তিনটি হাদিস গ্রন্থ অপেক্ষা প্রথম দুটি হাদিস বেশী সমাদৃত। তাই মনে হতে পারে যে  হাফসাকে তালাক দেওয়ার ঘটনাটি  গুজব  ছাড়া সত্যি হতে পারে না।  কিন্তু পরের তিনটি হাদিসকেও ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কারণ এই হাদিসগুলিও সহিহ হাদিস বলে মুসলিম সমাজে স্বীকৃত ও মান্যতাপ্রাপ্ত। তাছাড়া মুহাম্মদের হাফসাকে তালাক দেওয়ার ঘটনাকে অধিক বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে কোরানের ৬৫/১ নং আয়াতটি যে আয়াতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে পত্নীদের ইদ্দতের কথা খেয়ালে রেখে তালাক দিতে হবে। এ কথাটির অর্থ হলো পত্নীদের তাদের মাসিক ঋতুর সময় তালাক দেওয়া যাবে না। কিন্তু কোরানের তফসিরকারদের মতে মুহাম্মদ হাফসাকে ঋতুকালীন অবস্থাতাতেই তালাক দিয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ সেই তালাক বাতিল করতঃ উক্ত আয়াত (৬৫/১) পাঠিয়ে মুহাম্মদকে নির্দেশ দেয় হাফসাকে ফিরিয়ে নেওয়ার। মুহাম্মদ যে সত্যিই ঋতুবতী হাফসাকে তালাক দিয়েছিলেন  এবং সে কারণে তাঁকে হাফসাকে ফিরিয়ে নিতে আল্লাহর নির্দেশ এসেছিলো তার প্রমাণ রয়েছে মুহাম্মদ প্রদত্ত একটি বাখ্যা ও আদেশের মধ্যে। এই ঘটনাটির বর্ণনা রয়েছে ৬৫/১-এর তফসিরেই। তফসিরের সেই বিবরণটি এরূপঃ "হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার স্ত্রীকে মাসিক ঋতুর অবস্থায় তালাক দেন। হজরত উমার(রাঃ) ঘটনাটি রাসুলূল্লাহ(সঃ)-র নিকট বর্ণনা করেন। রাসুলূল্লাহ(সঃ) অসন্তুষ্ট হন এবং বলেনঃ 'সে যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় এবং ঋতু থেকে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীরূপেই রেখে দেয়। অতঃপর পুনরায় ঋতুবতী হওয়ার পর যখন পবিত্র হবে তখন ইচ্ছা হলে এই পবিত্র অবস্থায় সহবাস করার পূর্বেই তালাক দিবে। এটাই ঐ ইদ্দত যার হুকুম আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন।(দ্রঃ - ঐ) হাদিস ও কোরানের এই প্রমাণগুলি ছাড়াও মুহাম্মদের দাম্পত্য জীবন কীরূপ ছিলো, বিশেষ করে মুহাম্মদ ও হাফসার মধ্যেকার দাম্পত্যজীবন কীরূপ ছিলো তার পর্যালোচনা করলেও এটাই প্রতীয়মান হয় যে মুহাম্মদ কর্তৃক হাফসাকে তালাক দেওয়ার ঘটনাটা  মোটেই গুজব ছিলো না।   

ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে  অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সূর্যের মতোই সত্যি ঘটনা  যে, মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনে মোটেই শান্তি  সুখ  ছিলো না। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের মাঝে মাঝেই নানা প্রশ্নে কলহ-বিবাদ লেগেই থাকতো। কলহ  একবার  এতোই প্রকট হয় যে, তিনি  এক মাস ব্যাপী স্ত্রীদের সংস্রব থেকে দূরে সরে ছিলেন  আপাত দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঘটনাটি যে আজগুবি নয় তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে কোরান।কোরানের ৩৩/২৮ নং আয়াতটি সে সাক্ষ্য দিচ্ছে। কোন  প্রেক্ষাপটে আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো তার  তফসিরে  গিরিশচন্দ্র সেন  লিখেছেন – “মদীনা প্রস্থানের নবম বৎসরে হজরত স্বীয় পত্নীগণের হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন ও শপথ করিয়াছিলেন যে, একমাস কাল তাঁহাদের সঙ্গ করিবেন না, কারণ এই  যে, তাঁহারা তাঁহার সাধ্যাতীত বস্ত্রাদি প্রার্থনা করিতেছিলেন 
মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ করে আয়েষা ও হাফসার সঙ্গে  তাঁর ঝগড়া  যে একবার তাঁদের উভয় পক্ষের সহিষ্ণুতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল সে কথা অস্বীকার করা বা আড়াল করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ, কোরান ও হাদিসের মধ্যে সে তুমুল ঝগড়ার  প্রমাণ রয়েছে। এরূপ ঝগড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট  দুটি আয়াত ও কয়েকটি হাদিস উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো কিছু আয়াত ও হাদিস আছে যেখানে মুহাম্মদের দাম্পত্য জীবনে কলহ ও অশান্তির কয়েকটি ঘটনার  উল্লেখ রয়েছে। সেই সব অশান্তি বা ঝগড়া-বিবাদগুলি এখানে আলোচনা করার অবকাশ নেই, আবশ্যকতাও বিশেষ নেই। এখানে যেটা আলোচনা করা জরুরী সেটা হলো কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাফসা মুহাম্মদের মধ্যে  লাগাম ছাড়া ঝগড়া হয়েছিলো যার ফলে  মুহাম্মদ হাফসাকে  তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন সেই ঘটনাটি ঘটেছিলো হাফসার দাসী মারিয়াকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের কাছে এমন কোনো ঘটনা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু ঘটনাটি যে সত্যি ঘটেছিলো তা সংশয়াতীত। ঘটনাটি বর্ণনা করা যাক মিশরের শাসনকর্তা মুকাউকিস একবার হাম্মদকে উপহার হিসাবে কিছু সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন। সেই সামগ্রীর মধ্যে এই সুন্দরী খৃীষ্টান রমণী তথা মারিয়াও  ছিলেন। মুহাম্মদ তাঁকে তাঁর দাসী হিসেবে রেখে দে  এবং হাফসার সেবায় নিয়োগ করেন মুহাম্মদের অনেক উপপত্নী ছিলো। তাদের মধ্যে মারিয়া ছিলেন একজন যাঁকে তিনি পরে বিয়ে করেছিলেন বলে অধিকাংশ  ঐতিহাসিক জানিয়েছেন। মুহাম্মদ যে তাঁর হারেমে  অনেকগুলি পত্নী  একত্র করেছিলেন তাতো সর্বজন সুবিদিত। তিনি পত্নীদের মধ্যে কবে কার সঙ্গে  যাপন  করবেন তার পালা বন্টন করে দিয়েছিলে যে দিন মুহাম্মদ ও হাফসার মধ্যে তুমুল কলহ হয় সেদিন ছিলো হাফসার পালা। সন্ধ্যায় মুহাম্মদ হাফসার ঘরে গিয়ে দেখেন  হাফসা রে নেই  তিনি তখন তাঁর পিতৃগৃহে গিয়েছিলেনহাফসা কেনো পিতৃগৃহ গিয়েছিলেন তা নিয়েও বিতর্ক আছে। একটি মত হলো তিনি তাঁর নিজের প্রয়োজনে গিয়েছিলেন, আর একট মত হলো মুহাম্মদই হাফসাকে ছল করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেনসে যাই হোক, হাফসার অবর্তমানে মুহাম্মদ মারিয়াকে হাফসার ঘরে ডেকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে যান। ঠিক সে সময়েই হাফসা   পিতৃগৃহ থেকে ফিরে আসেন এবং মুহাম্মদ মারিয়াকে সঙ্গমরত অবস্থায় দেখে ফেলেন।এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা তাঁর কাছে ছিলো কল্পনাতীত মুহাম্মদও ভাবতে পারেন নি যে হাফসা এত শীঘ্র ফিরে আসতে পারেন। ফলে হাফসাকে দেখে তিনি ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন এবং তৎক্ষণাৎ মারিয়াকে ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান  হাফসা ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী, তারপর মুহাম্মদের অতি ঘনিষ্ঠ ও মক্কার কোরেশদের মধ্যেকার একজন প্রবল প্রভাবশালী ব্যক্তি ওমর বিন খাত্তাবের মেয়ে। স্বভাবতঃই তাঁর ব্যক্তিত্ব, মেজাজ, অহঙ্কার ও আত্মগৌরব  ছিলো মুহাম্মদের অন্যান্য স্ত্রীদের তুলনায় অনেক বেশী। তিনি তাই মুহাম্মদ ও মারিয়াকে তাঁরই দিনে তাঁরই বিছানায় সঙ্গমরত অবস্থায় দেখে নিজেকে স্থির ও সংযত রাখতে পারেন নি দৃশ্য দেখা মাত্রই তিনি  মুহাম্মদকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করতে শুরু করেন  মুহাম্মদকে হাত ধরে হ্যাচকা টানে টেনে বিছানায়  বসিয়ে দিয়ে  বলেন,  হে আল্লাহ্ নবী ! আমার ঘরে, আমার দিনে এবং আমার শয্যাতেই এটা করতে পারলেন? হাফসা তখন প্রবল মাথা গরম অবস্থা, মুহাম্মদকে ভর্ৎসনা  করার ভাষা যেমন ছিলো রূঢ়, তেমনি তাঁর গলার স্বরও ছিলো একেবারে সপ্তমেফলে মুহাম্মদ  আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এটা ভেবে যে,  তাঁর এই কেলেঙ্কারী সর্বসমক্ষে ফাঁস হয়ে যাবে হাফসাকে তিনি তাই করজোড়ে  অনুনয়-বিনয়  করতে শুরু করেন এবং আস্তে আস্তে কথা বলার জন্যে অথবা চুপ করার জন্যে  অনুরোধ করতে থাকেন  কিন্তু কিছুতেই হাফসাকে থামানো যাচ্ছিলো না দেখে তিনি হাফসার কাছে দ্রুতই  ভুল স্বীকার করে নেন। তাতেও হাফসা সন্তুষ্ট না হলে তখন তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে জীবনে আর কোনোদিন মারিয়াকে স্পর্শ করবেন না।  হাফসা তখন কিছুটা শান্ত হন সেই অবস্থায়  মুহাম্মদ  হাফসাকে বলেন যে তাঁকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে সে কোনো দিন কারো কাছে এ ঘটনাটা প্রকাশ করবেন না। হাফসা তখন শর্তসাপেক্ষে মুহাম্মদের কাছে  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তিনি বলেন যে মুহাম্মদ যদি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করেন তবেই এই ঘটনাটা তিনি কাউকে জানাবেন না হাফসা কিন্তু  তা প্রতিশ্রুতি  রক্ষা করতে পারেন নি মারিয়াকে মুহাম্মদের  স্ত্রীরা প্রায় সকলেই  ভীষণ  হিংসা করতেন, কারণ  মারিয়া ছিলেন অতি সুন্দরী এবং তাঁর প্রতি মুহাম্মদ তাঁকে সবচাইতে বেশী ভালবাসতেন তাই মারিয়াকে আর কোনো দিন মুহাম্মদ স্পর্শ করবে না এমন শপথটা তাঁর কাছে ছিল  বিরাট একটি যুদ্ধ জয়ের মতো  প্রবল আনন্দ দায়ক ঘটনা  সেই আনন্দে তিনি এতই উদ্বেল হয়ে পড়েন যে  মুহূর্তের মধ্যেই  মুহাম্মদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা বিস্মৃত হয়ে পড়েন তাই মুহাম্মদ তাঁর ঘর ছেড়ে যেতে না যেতেই ছুটে চলে যান আয়েশার কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনাটি সবিস্তারে তিনি আয়েশাকে জানিয়ে দেন সবটা শুনে আয়েশা শিশুর মতো আনন্দ নেচেউঠেছিলেন তারপর তাঁরা সবাই মিলে আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিতে অন্যান্য  স্ত্রীদেরও খবরটা  জানিয়ে দেন এতে মুহাম্মদ হাফসা আয়েশা প্রতি প্রচন্ড রুষ্ট হন   




হাফসার ঘরে হাফসার দিনে মারিয়ার সঙ্গে মুহাম্মদের সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার কুৎসিত ও নোংরা ঘটনাটা  কোনো কাল্পনিক ঘটনা নয়,  বা মুহাম্মদের চরিত্রকে মলিন করার উদ্দেশ্যে রচনা করা   কোনো বানানো  গল্পও নয়   এই ঘটনাটি যে সত্য তার  বহু প্রমাণ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া যায়   এমনকি কোরানের তফসিরকারগণও এই ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন ।  কোরানের তফসির থেকে ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার আগে মুসলিম বংশোদ্ভূত একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আনোয়ার হেকমতের দেওয়া তথ্যের উপর চোখ রাখা যাক ।   আনোয়ার  লিখেছেন   One day when Muhammad came to Hafsa’s house he found that the woman was out visiting her father. While still there, his Coptic concubine, Marya, arrived; she had been presented to Muhammad by the governor of Alexandria some time ago. The Prophet, evidently overcome with desire, could not resist the temptation of making love with the pretty-faced young woman right then and there. It is recorded that her “skin was white and tender.” In the middle of their love-making the door opened and in came his wife Hafsa. “He was caught by one of his wives, Hafsa, the proud daughter of his companion, ‘Umar, having intercourse with Mariya in Hafsa’s own room and her own day.”  [ Vide: Women and the Koran, page- 71,72]  উক্ত উদ্ধৃতিটি হেকমতের নিজের নয়, তিনি অন্য একটি গ্রন্থ থেকে এটা তুলে দিয়েছেন সেই সূত্রটি হলোঃ Al -Tirmidhi, Al – Shahih al – Tirmidhi, 2 vols. (Cairo, 1292 A.H.), p. 213  এবার কোরানের তফসিরে চোখ রাখা যাক ।
যে আয়াতগুলির  তফসিরে মুহাম্মদ ও মারিয়া বৃত্তান্তের উল্লেখ আছে সেগুলি হলো তাহরিম সুরার প্রথম চারটি আয়াত  অর্থাৎ ৬৬/১-৪ নং আয়াত । আয়াতগুলি মুহাম্মদ আবৃত্তি করেন মারিয়াকে স্পর্শ না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কিছুদিন পর ।  আয়াতগুলির ভাষ্য হলো – হে নবী ! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তোমাদের স্ত্রীদের খুশী করার জন্য তা অবৈধ করছো কেন ?  আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়  যখন নবী তার স্ত্রীদের একজনকে গোপনে কিছু বলেছিল, পরে তার সেই স্ত্রী তা অন্যকে বলে দিয়েছিল, এবং আল্লাহ্নবীকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন নবী এই বিষয়ে তার স্ত্রীকে কিছু বললো এবং কিছু বললো না, নবী যখন তা তাকে জানালো, তখন সে বললো কে আপনাকে  কথা জানিয়েছে ? নবী বললো আমাকে জানিয়েছেন তিনি যিনি সর্বজ্ঞানী, সবই অবগত   তোমাদের দু জনের হৃদয় অন্যায়-প্রবণ হয়েছে, এখন যদি তোমরা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্ দিকে প্রত্যাবর্তন করো আল্লাহ্তোমাদের ক্ষমা করবেন কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরের পোষকতা করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ জিব্রাইল এবং  সৎকর্মশীল বিশ্বাসীগণ তার সাহায্যকারী ; উপরন্তু ফেরেস্তাগণও তার সাহায্যকারী হবে    যদি নবী তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করে, তবে তার প্রতিপালক তোমাদের পরিবর্তে সম্ভবত তাকে তোমাদের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্ত্রী দেবে, যারা হবে আত্মসমর্পণকারী, বিশ্বাসী, তওবাকারী, ইবাদতকারী, রোজা পালনকারী এবং বিধবা কুমারী  ( সুরা তাহরিম, ৬৬/১-)     এই আয়াতগুলির  তফসিরে মুহাম্মদ-মারিয়া কান্ডের কথা যে সত্যি তা স্বীকার করা হয়েছে । কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ আয়াতগুলি আবৃত্তি করেছিলেন তা  প্রাঞ্জল ভাষায়  বর্ণনা করেছেন তফসিরকার   ইবনে কাথির    তিনি লিখেছেন তাফসীরে ইবনে জারীরে রয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করেনঃ দুজন স্ত্রী কে ছিলেন ?’ উত্তরে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃতাঁরা হলেন হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ) উম্মে ইব্রাহিম কিবতিয়্যাহ (রাঃ)-কে কেন্দ্র করেই ঘটনার সূত্রপাত হয় হযরত হাফসা (রাঃ)-এর ঘরে তার পালার দিনে হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মারিয়া কিবতিয়্যাহ (রাঃ)-এর সাথে মিলিত হন এতে হযরত হাফসা (রাঃ) দুঃখিতা হন যে, তাঁর পালার দিনে তাঁরই ঘরে তাঁরই বিছানায় তিনি মারিয়া (রাঃ)-এর সাথে মিলিত হলেন ! হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বলে ফেলেনঃআমি তাকে আমার কাছে হারাম করে নিলাম তুমি এই ঘটনা কারো কাছে বর্ণনা করো না এতদসত্বেও হযরত হাফসা (রাঃ) ঘটনাটি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে প্রকাশ করে দেন আল্লাহ তাআলা এই খবর স্বীয় নবী (রাঃ) কে জানিয়ে দেন এবং এই আয়াতগুলি নাযিল করেন নবী (রাঃ) কাফ্ফারা আদায় করে স্বীয় কসম ভেঙ্গে দেন এবং দাসীর সঙ্গে মিলিত হন ” [দ্রঃ ইবনে কাথিরের  তফসীর, ১৭শখন্ড, পৃ ৫৫৮]
হাফসাকে মিথ্যা অজুহাতে তাঁর পিতার বাড়ি পাঠিয়ে মারিয়ার সঙ্গে রতিক্রিয়ায় মত্ত হওয়ার ঘটনা যে খুবই আপত্তিকর ও নিন্দাজনক এবং বিশ্বাসভঙ্গের মতো অমার্জনোয় অপরাধ তা বলা বাহুল্য ।  যাঁরা মুহাম্মদের জীবনচরিত  এবং কোরানের তফসির লিখেছেন তাঁদের  সকলেই যে ঘটনাটি যেমন ঘটেছিলো ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করেছেন তা নয় । তাঁদের  একাংশ সম্ভবতঃ মুহাম্মদ এরূপ কুৎসিত কান্ড ঘটাতে পারেন তা হয় বিশ্বাস করতে পারেন নি, না হয় এমন  কুৎসিত ঘটনাটাটি উন্মোচন  করা অনুচিত বলে ভেবেছেন । তারা তাই এই আয়াতগুলির প্রেক্ষাপট কী তার বাখ্যা দিতে গিয়ে অন্য গল্প রচনা করেছেন । সে জন্যে  ইবনে কাথির বর্ণিত উক্ত তফসির ছাড়াও অন্য তফসিরও রয়েছে এবং মুহাম্মদের জীবন-চরিতে কেউ কেউ সেই সেই তফসিরকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন  মুহাম্মদ-মারিয়া কান্ডকে নস্যাত করার  অস্ত্র হিসেবে  । অন্য সেই তফসিরে বলা হয়েছে তা যে নেহাতই বানানো গল্প তা বলা নিষ্প্রয়োজন  । স গল্পটি এ রকমঃ   মুহাম্মদ মধু খাওয়ার জন্যে জয়নবের ঘরে অনেক বেশী সময় কাটাতেন যার ফলে তাঁর অন্যান্য স্ত্রীরা, বিশেষ করে আয়েষা ও হাফসা তাঁর উপর খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন । মুহাম্মদ তাই তাঁর স্ত্রীদের ক্ষোভ দূর করার জন্যে তাঁদের কাছে আর কোনোদিন মধু খাবেন না বলে শপথ করেন । মুহাম্মদের এই শপথ এবং আয়েষা ও হাফসার ব্যবহারে আল্লাহ তার অসন্তোষের কথা জানাতেই নাকি এই আয়াতগুলি অবতীর্ণ করেছিলো । দেখা যাক ৬৬/১ নং আয়াতের সেই তফসিরে ঠিক কী লেখা আছে  । তফসিরিটি এরূপঃ  হজরত মোহম্মদ মধুর শরবত ভালবাসিতেন । একদা তাঁর অন্যতম ভার্যা জয়নব কিঞ্চিত মধু সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, হজরত যখন তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইতেন তখন তিনি মধুপানা প্রস্তুত করিয়া দিতেন, তদনুরোধে তাঁহার আলয়ে হজরতকে কিছু অধিক বিলম্ব করিতে হইত ইহা তাঁহার কোন কোন পত্নীর পক্ষে কষ্টকর  হয় । তাঁহার সহধর্মিনী আয়শা ও হফসা পরষ্পর পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন যে, হজরত যখন জয়নবের গৃহে মধুর শরবত পান করিয়া আমাদের কাহার নিকটে আগমন করিবেন তখন বলিব যে, তোমার মুখ হইতে মগফুরের গন্ধ নির্গত হইতেছে । মগফুর অরকত নামক বৃক্ষ বিশেষের নির্যাস, তাহা অতিশয় দুর্গন্ধ । হজরত সুগন্ধ ভালবাসিতেন, দুর্গন্ধকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন । একদিন তিনি মধু পান করিয়া তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকট উপস্থিত হন । প্রত্যেকেই বলেন, “হজরত,  আপনার মুখ দিয়া মগফুরের গন্ধ আসিতেছে” তিনি উত্তর করেন, “আমি মগফুর খাই নাই, জয়নবের আলয়ে মধু শরবত পান করিয়াছি” । তাঁহারা বলিলেন, “হয় তো মধুমক্ষিকা অরকত কুসুম হইতে মধু আহরণ করিয়াছিল” । ইহা পুনঃ পুনঃ বলা হইলে হজরত কহিলেন, “ঈশ্বরের শপথ, আর কখনও উহা পান করিব না “ । তাহাতেই এই আয়াত অবতীর্ণ হয় । [সূত্রঃ গিরিশচন্দ্র সেনের কুরআন শারীফ]  গিরিশ অবশ্য মারিয়াকান্ডটির কথা নস্যাত করেন নি ।   তিনি  স্বীকার করেছেন যে মধু খাওয়ার ঘটনা নয়, আর একটি মত হলো সেই  মুহাম্মদ-মারিয়া কান্ডই ।  গিরিশ তাঁর ঐ তফসিরেই   ২য় অংশে লিখেছেন – পরন্তু এরূপ প্রসিদ্ধ যে, হজরত হফসার বারের দিন তাঁহার গৃহে যাইতেন, একদা তিনি হজরতের আজ্ঞাক্রমে পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন, হজরত কেবত কুলোদ্ভবা দাসিপত্নী মারিয়াকে ডাকাইয়া নিজ সেবায় নিযুক্ত করেন । হফসা তাহা অবগত হইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন । হজরত বলেন, “হে হফসা, যদি আমি তাহাকে নিজের সম্বন্ধে অবৈধ করি তাহাতে তুমি কি সম্মত নও” । তিনি বলিলেন, “হ্যাঁ সম্মত” । হজরত কহিলেন, “এ কথা   কাহারও নিকটে ব্যক্ত করিবে না, তোমার নিকটে গুপ্ত রহিল” । হফসা সম্মত হইলেন । কিন্তু যখন হজরত তাঁহার গৃহ হইতে চলিয়া গেলেন, তৎক্ষণাৎ হফসা আয়শাকে যাইয়া এই সুসংবাদ দান করিয়া বলিলেন, “আমরা কেবতনারীর হস্ত হইতে মুক্তি পাইয়াছি” । পরে হজরত আয়শার গৃহে আগমন করিলে তখন আয়শা ইঙ্গিতে এই বৃত্তান্ত বলেন । এতুদপলক্ষে এই সুরা অবতীর্ণ হয় । অর্থাৎ মারিয়াকে পরমেশ্বর তোমার প্রতি বৈধ করিয়াছেন, তাহাকে কেন আপনার সম্বন্ধে অবৈধ করিয়া তুলিলে ও শপথ করিলে ?

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...