Sunday, January 26, 2014

২৬ শে জানুয়ারী দিনটিকে আমার প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না


আজ আমাদের দেশ ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করছে সাড়ম্বরে, মহাসমারোহে। কিন্তু ১২০ কোটি মানুষের ১০০ কোটিই জানে না এটা আবার কেমন দিবস। মানুষ নবি দিবস জানে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস জানে, রাম নবমী জানে, গুরু নানকের জন্ম দিবস জানে, গুরুর জন্ম দিবস জানে, একাদশী জানে, কবে কোন দিন কোন তিথিতে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে উপবাস থাকতে হয় জানে, কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবস কী তারা জানে না।  তবু সাড়ম্বরে, ধূমধাম করে বছর বছর দিবসটি উদযাপন করা হয়, জলের মত খরচ করা হয় দেদার টাকা। যারা উদযাপন করে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা সবাই ভালো করেই জানে যে দেশের অধিকাংশ মানুষ  প্রজাতন্ত্র  কী সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবু তারা মহা উৎসাহে ২৬ শে জানুয়ারীর দিন সকাল বেলা পতাকা তোলে, প্রজাতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করে, প্রজাতন্ত্রের অহঙ্কার করে, দেশ কত এগোলো তার  লম্বা লম্বা ফিরিস্তি দেয়, হাসপাতালে যারা সারা বছর অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে অবহেলায় তাদের কাছে গিয়ে দু-একটা ফল তুলে দেয়, আর ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়, অর্ধমৃত মানুষগুলো হঠাৎ এসব দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে এ ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাই, বাবুরা ঝড়ের বেগে আসে আর কিছু ফল বিতরণ করে আবার ঝড়ের বেগে চলে যায়। এভাবে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে শাসকশ্রেণী মানুষকে ঠকায়, বিশ্ববাসীকেও ঠকায়।
আসলে শাসক শ্রেণী চায় না যে দেশের মানুষ জানুক প্রজাতন্ত্র দিবস কী, কেন এই দিবস? মানুষ প্রজাতন্ত্রের মানে জানলে তাদের অনেক অসুবিধা - শ্রমিকের শ্রম সস্তা দরে কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো যাবে না, সহজ হবে না চাষির কাছে বেশী দামে সার, বীজ, বিষ ইত্যাদি বিক্রি করা ও তাদের ফসল সস্তায় ক্রয় করা, বনবাসীকে উচ্ছেদ করে বনের দখল নেওয়া সহজ হবে না, খাল-বিল-নদী-সমুদ্র থেকে মৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ করে সেগুলো কব্জায় রেখে অনায়াসে ভোগ করা সহজ হবে না, পাহাড়বাসীকে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ করে পাহাড়ের সম্পদ লুঠ করা সহজ হবে না, মানুষের রুজি-রোজগারের প্রতিদিনের সংগ্রামকে আইনশৃঙ্খলার দোহায় দিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে দমন করা সহজ হবে না, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে মারামারি-কাটাকাটি লাগিয়ে রাখা সহজ হবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে ধর্মের গাঁজা-চরস খাইয়ে মসজিদে-মন্দিরে-গীর্জায় বুঁদ করে রাখা সহজ হবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে-বেকারত্বে থাকা মানুষকে ভাগ্যের দোহায় দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা সহজ হবে না, দেশের তথা দেশের মানুষের  সকল সম্পদ যেমন  বন-জঙ্গল, পাহাড়, নদ-নদী, ইত্যাদি আত্মসাৎ করা সহজ হবে না, এ রকম হাজারো অসুবিধা রয়েছে শাসক শ্রেণির। 
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আর মর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা, জেনে নিন  তিরঙ্গার অজানা কাহিনী | Independence Day 2020 Interesting Facts About  Indian Tricolour Flag You Should ...

তাই প্রজাতন্ত্র দিবস কী তা মানুষ জানুক – এটা শাসক শ্রেণী একদমই চায় না। চায় না কারণ, জানলে তাদের সমস্ত অধিকার বুঝে নিতে চায়বে তারা, তাদের বেঁচে থাকার জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- স্বাস্থ্য ন্যূনতম এই পাঁচটি জিনিষ ন্যূনতম পরিমাণে সরকারের কাছে দাবী করবে, দাবী করবে এটা জেনে যে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবী করবে তাদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, আওয়াজ তুলবে জাতপাত ও বর্ণবিভেদের বিরুদ্ধে, দাবি করবে সমান অধিকার ও ক্ষমতা পাবার, দাবীতে দাবীতে পাগল করে দেবে রাষ্ট্রকে তথা শাসক দল ও শোষক শ্রেণীকে। প্রাজাতন্ত্রের মানে জানলে গতর খাটানো মানুষেরা বুঝে যাবে যে রাষ্ট্রের চোখে সব মানুষই সমান নয়, রাষ্ট্র সকলের সঙ্গে সুবিচার করে না, রাষ্ট্রটা মোটেই নিরপেক্ষ নয় এবং রাষ্ট্রটা আর যাদেরই হোক তাদের নয়। প্রজাতন্ত্র কী জিনিষ জানতে পারলে মানুষ তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে চাইবে, একা যেতে না পারলে অন্ততঃপক্ষে ক্ষমতার ভাগ নিতে চাইবে। যেদিন মানুষ এ সব বুঝবে সেদিন তাদেরকে ঠেকানো যাবে না কোনোভাবেই। হয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। শাসক শ্রেণী তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলির অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞ করে রাখতে। শাসক শ্রেণী তাই  মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে। এভাবেই ৬৪ বছর ধরে তারা ভারতবাসীকে ঠকিয়ে আসছে।
আজ ২৬ শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে, আকাশে কত যুদ্ধ বিমান উড়ছে, কত বাদ্যি বাজছে, এ সব বসে বসে দেখছি টিভির পর্দায়। পাশাপাশি শুনছি কত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, শুরু হয়ছে এই ফুলঝুরি ছোটানো গতকাল থেকে অথচ চারিদিকে রোজরোজ নারীরা ধর্ষিতা হয়, রাষ্ট্র কিছুই করে না তা প্রতিরোধ করার, তারপরেও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির ছোটে নেতাদের কন্ঠে, আজও ছুটছে সমানে, আর এদিকে ২০ বছরের সাঁওতাল সমাজের মেয়েটিকে তার সমাজেরই মোড়ল-মাতব্বর যারা গণধর্ষণ করতে উস্কানি দিল, শাসক দলের সেই নেতাকর্মীরা বহাল তবিয়তে জেলের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্লাবে ক্লাবে, অফিসে, স্কুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা তুলছে, আর ঐ ধর্ষিতা মেয়েটা হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শারিরীক ও মানসিক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটট করছে, সে জানে না কী অপরাধে তার সব শেষ হয়ে গেলো, সে এও জানে না হাসপাতাল থেকে ফিরে গিয়ে সে কোথায় ঊঠবে, কারণ তাকে নষ্ট মেয়ে বলে শুধু গণধর্ষণই করেনি, সমাজ থেকেও বহিষ্কার করেছে শুধু সাঁওতাল সমাজের ঐ একটি মেয়েরই নয়, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে নারীর অবস্থাও তদ্রূপ।   
আজ ২৬ শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে দিল্লীতে, রাজ্যে রাজ্যে সমস্ত রাজধানী শহরে, ভাষণ বিলানো হচ্ছে দেদার, বড়ো বড়ো ভাষণ যে ভাষণে বলা হচ্ছে – ভারত প্রজাতান্ত্রিক দেশ, এখানে বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্ব স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ধর্ম না পালনের স্বাধীনতা, সসম্মানে ও স্বমর্যাদায় বেঁচে থাকার স্বাধীনতা-সহ সমস্ত স্বাধীনতা সুরক্ষিত। রাষ্ট্র নেতাদের এ সব ভাষণ যে শুধুই ভাষণ এবং বিলকুল মিথ্যা ভাষণ সে কথা দুনিয়া শুদ্ধ লোক জানে। কোথায় আমাদের বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক তসলিমা নাসরিন আজ দিল্লীতে নির্বাসিত। ভারত সরকার তাঁকে এ দেশে থাকার অনুমতি দিয়েছে, সেই বৈধ অনুমতির জোরে ভারতের যে কোনো স্থানে থাকার স্বাধীনতা তাঁর আছেরাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো তাঁর এ অধিকার যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে তা দেখা ও সুনিশ্চিত করা। অথচ রাষ্ট্রই তাঁকে কলকাতায় আসতে দিচ্ছে না। গত বছর কলকাতা বই মেলায় তাঁর লেখা একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন আটকে দিল সরকার। ঐ একই সময়ে বিশ্বখ্যাত লেখক সলমান রুশদি কলকাতা বই মেলায় আসতে পারলেন না সরকার আসতে দিল না বলে। কেন তসলিমা ও সলমন রুশদির অধিকার হরণ করলো সরকার? কারণ, তাঁরা মুসলিম ধর্মাবেগে আঘাত করেছেন। কে বলেছে? মুসলিম ধর্মের নেতারা। তাই ওঁদের কলকাতায় পা ফেলার অধিকার নেই। এই হলো এ দেশে মানুষের বাক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত থাকার নমুনা। এ দেশে লেখকের বাক স্বাধীনতা নেই, কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের সে অধিকার আছে। তারা যা কিছু বলতে পারে, মুন্ডু কাটার ফতোয়া দিতে পারে, এ ফতোয়া বেআইনী তবুও তাদের অধিকার আছে তা দেওয়ার। একই ফতোয়া দিয়েছিলো দঃ চব্বিশ পরগণা আক্রা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোরসেলিন মোল্লার উপরে একটা নিরীহ প্রবন্ধ লেখার অপরাধেতাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা। মোরসালিনকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেয় নি, ঘুরিয়ে বলেছিলো ফতোয়াবাজ মোল্লাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে। মোরসালিন অগত্যা তাই করেছিলেন, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন এবং আর কোনোদিন ঐ রকম লেখা লিখবেন না বলে থানায় বসে মোল্লা ও পুলিশের কাছে মুচলেকাও লিখে দিয়েছিলেন। একই অবস্থা হয়েছিলো পত্রিকা সম্পাদকের যাঁর পত্রিকায় লেখাটা বেরিয়েছিলো। এ ঘটনা বাম সরকারর আমলের। প্রায় একই সময়ে ঐ একই কারণে আমারও মুন্ডুচ্ছেদ করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো। আমাকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, যারা আমাকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে আমার লিখিত অভিযোগও নেয় নি। এই হচ্ছে আমার দেশ, আমাদের প্রজাতন্ত্র, আমাদের যাবতীয় অধিকার সুরক্ষিত থাকার নমুনা! আসল কথা হলো, এ দেশে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা আছে শাসক শ্রেণীর, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের, শাসক দল আশ্রিত চোর-গুন্ডা-বদমায়েশদের, ধাপ্পাবাজ ও প্রতারক ধর্মীয় নেতাদের ও পুলিশের, স্বাধীনতা নেই সাধারণ মানুষের, লেখকের ও নারীদের।
তাই প্রজাতন্ত্র দিবসের আসল মানে যাই থাক, আমার কাছে এ দিনটি প্রতারণা দিবস ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এ দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না, বরং প্রজা-নিয়ন্ত্রণ, প্রজা-নিষ্পেষণ ও প্রজা-হরণ দিবস বলেই মনে হয়।
   
       

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...