Thursday, April 24, 2014

‘স্ত্রী-প্রহার দন্ডনীয় অপরাধ’- আইন প্রণয়ন করলো নবীর মাতৃভূমিও


সৌদি আরব আবার এক ধাপ পিছু হটলো শরিয়ত আইন থেকে ।  সৌদি আরবের শরিয়ত থেকে এক একটা ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার মানে একদিকে বিশ্বের গোঁড়া মুসলমান সমাজে একটা ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়া,  আর একদিকে সারা বিশ্বকে চমকে দেওয়া ।  কারণ, এই দেশটি বিশ্বের আর পাঁচটি মুসলিম দেশ বা ইসলামি রাষ্ট্র থেকে অনেক বেশী গুরুত্ব বহন করেতার প্রধান কারণ হলো, ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মদ এখানে (মক্কায়_) জন্ম গ্রহণ করেন ও এখান থেকেই শুরু করেন তাঁর ইসলাম ধর্মের  প্রচারের কাজ, এবং এখানেই  ৬৩০ খৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র যার রাজধানী ছিল মদিনা ।  সেই রাষ্ট্রের পরিচালিকা শক্তিই ছিল কোরান সেই রাষ্ট্রটি পরিচালনার সময় কোরানের বাইরেও কিছু বিধি-নিষেধ  তিনি তৈরী করেছিলেন  যেগুলি ইসলামের পরিভাষায় সুন্নাহ বা হাদিস নামে পরিচিত । এই কোরান ও হাদিসই হলো শরিয়িতি আইনের প্রধান ভিত্তি ।  তাই স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরবের রাজাদের কাছে  প্রধান কর্তব্য  হলো  কোরান-হাদিসের শাসন-ব্যবস্থাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করা । এই কর্তব্য অন্যান্য মুসলিম দেশের উপর সেভাবে বর্তায় না । তার জন্যে অন্যান্য  মুসলিম দেশগুলি বা ইসলামি রাষ্ট্রগুলি কোরানের আইনের সুরক্ষাকে সব কিছুর ঊর্ধে স্থাপন করাকে তাদের প্রধান কর্তব্য বলে মনে করে না তাই এই দেশগুলি ১৪০০ বছর আগেকার মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ  আইন-কানুনগুলি  আঁকড়ে ধরে থাকার  ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান নিয়ে বসে থাকে নি,বহু ক্ষেত্রেই শরিয়তি আইনে ব্যাপক সংশোধন করে অনেকটাই যুগোপযোগী করে নিয়েছে শরিয়তি আইনের এই সংস্কার আজো অব্যাহত রয়েছে তাই এই দেশগুলি এখন কোনো ক্ষেত্রে শরিয়ত থেকে সরে এসে নতুন কোন আইন প্রণয়ন করলে তা দেখে গোঁড়া মুসলমানরা খুব বেশি বিচলিত বোধ করে না,  এবং সেই খবরে বিশ্বের মানুষও আর চমকে ওঠে না । কিন্তু সৌদি আরবের কথা আলাদা । সৌদি আরব আবার যেই এক ধাপ পিছু হটেছে তেমনি একদিকে বিশ্বের গোঁড়া মুসলিম সমাজ যেমন আঁতকে উঠেছে, তেমনি অপরদিকে চমকে উঠেছে বিশ্বের তামাম মানুষও ।
সকল ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মই পুরুষতন্ত্রের হাত শক্তিশালী করেছে এবং তাকে আরো দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করেছে । এক্ষেত্রে ইসলামও ব্যতিক্রম নয় । অবশ্য মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা, এমনকি ইসলাম ধর্মের ধারক ও বাহকদের একাংশ তা মানতে রাজী নয় । তাঁরা দাবী করেন যে ইসলামই নারীকে পরাধীনতা ও দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে এবং পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছে । বলা বাহুল্য যে, এত হাস্যকর ও মিথ্যা দাবী আর হয় না । বরং নির্মম সত্য যেটা তা হলো, ইসলামও পুরুষকে   নারীর উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা প্রদান করেছে । নারীকে করেছে পুরুষের অধীনস্থ  দাসী । ইসলাম আল্লাহকে দিয়ে বলিয়েছে যে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের সেবা করার জন্যে, পুরুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে, তাই স্বামী যখনই তার স্ত্রীকে সঙ্গম করার মানসে ডাকবে তখনই তাকে সে যে অবস্থায়ই থাকুক অতি তৎপরতার সাথে সাড়া দিতে হবে । স্বামী যেভাবে তাকে ভোগ করতে চায়বে, স্ত্রীকে হাসি মুখে সেভাবেই তার ভোগের জন্যে প্রস্তুত করতে হবে, কোন প্রকার ওজর-আপত্তি করা চলবে না বা অখুশী হওয়া চলবে না ।  এক্ষেত্রে নারী অসম্মত হলে বা অবাধ্য হলে ইসলাম সেই স্ত্রীকে পেটানোর জন্যে স্বামীকে হুকুম করেছে । ইসলাম পুরুষকে এমনই অসভ্য রকমের কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব প্রদান করেছে  নারীর উপর । কোনো নারীর পক্ষেই এটা মানা সম্ভব নয়, মুসলিম নারীরাও মানে নি যুগে যুগে দেশে দেশে ঘরে বাইরে মুসলিম নারীরাও এই অসভ্য আইনের বিরুদ্ধে সরবে নীরবে প্রতিবাদ করেছে, করে আসছে ।  ফলে বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশই নারীর উপর থেকে পুরুষের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কিছুটা শিথিল করতে  শরিয়তি আইনে ব্যাপক সংস্কার করতে বাধ্য হয়েছে । এই সংস্কারগুলি শুধু নারীর জন্যেই হয়েছে তা নয়, হয়েছে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থেই ।  শরিয়তের দোহায় দিয়ে নারীর প্রতিবাদ ও অধিকারকে সম্পূর্ণ  দাবিয়ে রাখতে পেরেছে এমন মুসলিম দেশ খুবই কম আছে । যারা পেরেছে তাদের মধ্যে  একটি দেশ হলো  সৌদি আরব । সৌদি আরব  বরাবরই অনড় শরিয়ত আইনেই । অবশেষে সেই অনড় অবস্থান  থেকে তারাও এবার সরে দাঁড়ালো এবং শরিয়ত থেকে অন্ততঃ একটা বেশ বড়ো ধাপ পিছু হটে প্রণয়ন করলো এমন একটা আইন যার ফলে পুরুষের আধিপত্য , কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব অনেকটাই হ্রাস পাবে । আইনটি হলো - স্ত্রী-প্রহার দন্ডনীয় অপরাধ
আগেই উল্লেখ করেছি যে শরিয়ত আইনে স্ত্রীকে প্রহার করা বৈধ ।  পরিষ্কার ভাষায় বলা আছে যে স্বামী যদি মনে করে যে তার স্ত্রী অবাধ্যতা প্রদর্শন করছে তাহলে সে তার স্ত্রীকে প্রহার করতে পারবে ।  ফলে প্রহৃত হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ জানানোর বা বিচার চায়বার কোনো সুযোগ নেই শরিয়ত আইনেসৌদি আরব এতদিনে এই অসভ্য ও বর্বর আইনের সমাপ্তি ঘটাতে উক্ত আইনটি  প্রণয়ন করেছে    এই আইনে বলা হয়েছে যে স্ত্রীকে প্রহার করার  করার অপরাধে ৫ (পাঁচ) থেকে ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার রিয়াল আর্থিক জরিমানা দিতে হবে স্বামীকে । এবং আরো বলা হয়েছে যে, নির্যাতনের কারণে স্ত্রীর অঙ্গহানি কিংবা প্রাণহানি হলে শাস্তির মাত্রা বাড়বে ।  সে দেশের ‘প্রোটেকশন অ্যাট দ্য সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স’ মন্ত্রকের ডাইরেক্টর মোহাম্মদ আল হাবিব জানিয়েছেন যে, এই শাস্তি কেবল আর্থিক জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না । জরিমানার পাশাপাশি এক মাস থেকে এক বছর কারাদন্ডের বিধানও রাখা হয়েছে এই আইনে । তিনি আরো জানিয়েছেন যে, যদি কেউ একই অপরাধ বারংবার করে, তবে এই সাজা দ্বিগুণ হয়ে যাবে     আশা করা যায় যে সৌদি আরবের অত্যাচারী পুরুষদের শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার  থেকে নারীদের  সুরক্ষা দিতে এই আইনটি  কিছুটা হলেও সহায়ক  ভূমিকা পালন করতে পারবে ।  তার চেয়ে বড়ো কথা হলো এই আইনটি স্বামীও স্ত্রীর মধ্যে শরিয়ত আইনে প্রভু-ভৃত্যের যে সম্পর্ক রয়েছে সেই সম্পর্কের একেবারে মূলেই আঘাত করবে । কোনো সন্দেহ নেই  যে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে   যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রে স্ত্রীকে প্রহার করার আইনি অধিকার ভোগ করছে পুরুষরা সে দেশগুলিও এই অসভ্য আইনটির অবসান ঘটাতে বাধ্য হবে । ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজের রক্ষণশীল মন-মানসিকাতেও।
এই খবরে মুসলিমদের মধ্যে আরো দু ধরণের প্রতিক্রিয়া হবে । অনেক গোঁড়া মুসলমান আছে যাঁদের সৌদি আরবে এ রকম শরিয়ত-বিরোধী আইন হয়েছে  তা বিশ্বাস বে না ।  তাঁরা এটাকে মক্কা-মদিনার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র ও  গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চাইবেতাঁদের সন্দেহ নিরসনের উদ্দেশ্যে বলি যে, এই সংবাদটি আপনাদের মতো রক্ষণশীল মুসলমানদের কাগজ  ‘কলম’ও খবরটি বের করেছে ১৯.০৪.১৪ তারিখে, দেখে নেবেন ।   আর এক ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে আধুনিক শিক্ষায় তথাকথিত শিক্ষিত মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে । তাঁরা বলবেন, এটাই তো আসল ইসলাম আইন এই বুদ্ধিজীবীরা সর্বদায় সচেষ্ট থাকেন এটা বোঝানোর জন্যে ইসলাম যে বিধান প্রণয়ন করেছে তা সর্বোত্তম, ইমাম-মোল্লা- মুফতিরা কোরান-হাদিসের ভুল বাখ্যা বা  অপবাখ্যা করে বলে ইসলামের বিধি-বিধানগুলোকে অমানবিক ও পশ্চাদপদ বলে মনে হয় । এই অংশের লোকগুলো বরাবরই দাবী করে থাকেন যে অন্য কোনো ধর্ম নয়, একমাত্র ইসলাম ধর্মই নারীকে স্বাধীনতা, সম্মান ও অধিকার দিয়েছে এবং স্ত্রীকে প্রহার করার অধিকার স্বামীকে দেয় নি । এই প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে সাধারণভাবে অধিকাংশ মুসলমানের কারণ, তারা  ইসলাম সম্পর্কে কিছু না জেনেই অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্মটাই শ্রেষ্ঠ  ধর্ম । মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই প্রতিক্রিয়া প্রভাবিত করে অমুসলিম সমাজের মানুষদেরও এই বুদ্ধিজীবীরা যাই দাবী করুন না কেন, প্রকৃত ও  নির্মম সত্যিটা হলো ইসলাম সত্যি  সত্যিই স্বামীকে   হুকুম প্রদান করেছে প্রয়োজনে তার স্ত্রীকে প্রহার করার জন্যে এই বিষয়ে যাবতীয় বিভ্রান্তি ও সংশয় নিরসনের জন্যে বরং কোরান-হাদিস কী বলছে তা দেখা যাক ।
উল্লেখিত বিষয়ে কোরানের ভাষ্য অত্যন্ত স্পষ্টভাষ্যটী হলো “পুরুষগণ নারীদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত কর্তা । যেহেতু আল্লাহ্‌ তাদের মধ্যে একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেহেতু যে তারা স্বীয় ধন-সম্পদ থেকে ব্যয় করে থাকে; এইজন্য স্বাধ্বী স্ত্রীরা অনুগত হয়, আল্লাহ্‌র সংরক্ষিত প্রচ্ছন্ন বিষয় সংরক্ষণ করে, এবং যদি নারীগণের অবাধ্যতা  আশঙ্কা হয় তবে তাদের সৎ-উপদেশ দান করো, এবং তাদের শয্যা থেকে পৃথক করো,  এবং তাদের প্রহার করো, অনন্তর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়, তবে তাদের জন্য অন্য পথ অবলম্বন করো না ; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সমুন্নত মহীয়ান ” (সুরা নিসা, ৪/৩৪)  এই আয়াতের ভাষ্যে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তা হলো  ‘প্রহার করতে পারো’ নয়, বলা হয়েছে ‘প্রহার করো’, অর্থাৎ একেবারে হুকুম করা হয়েছে ।  কেন স্ত্রীগণ তাদের স্বামীদের অনুগত থাকবে, এবং আনুগত্য অস্বীকার করলে তাদের স্বামীরা কেনো তাদের প্রহার করবে তার যুক্তি বা উত্তরও ওই আয়াতেই রয়েছে ।  এতদসত্বেও পরে মুহাম্মদ সে কথাটা তাঁর শিষ্যদের মাঝে আরো স্পষ্ট করে বাখ্যা করে দিয়ে গেছেন । কীভাবে স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন যে তা জানা যায় তফসীরকারদের লেখা গ্রন্থ থেকে । তফসীরকার ইবনে কাথির এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) –কে জিজ্ঞাসা করা হয়, স্ত্রীর উপর কী হক আছে ? তিনি বলেনঃ ‘যখন তুমি খাবে তাকেও খাওয়াবে, যখন পরবে তাকেও পরাবে, তাকে মুখে মেরো না, গালি দিও না, ঘর  হতে পৃথক করো না, ক্রোধের সময় যদি শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কথা বন্ধ করো তথাপি তাকে ঘর থেকে বের করো না ’ অতঃপর বলেনঃ  ‘তাতেও যদি ঠিক না হয়, তবে তাকে শাসন-গর্জন করে এবং মেরে-পিটেও পথে সরল পথে আনয়ন করো’    (৪র্থ-৭ম খন্ড, পৃঃ ৩৮৭)  এখানে মুহাম্মদের বাখ্যা অত্যন্ত স্পষ্ট -  অবাধ্য স্ত্রীকে যেভাবেই হোক, প্রয়োজনে মেরে-পিটেও,  সরল পথে আনতে হবে ।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা স্ত্রীকে মারার হুকুম নেই বলে যা দাবী করেন তার সপক্ষে অবশ্য একটা হাদিস আছে যেটা তাঁরা উল্লেখ করে থাকেন   কিন্তু সেটা আংশিক ও  অসম্পূর্ণ হাদিস  হাদিসের বাকি অংশটা তাঁরা চেপে যান ।  ফলে হাদিসের মূল অর্থটাই পাল্টে যায়  অর্থাৎ হাদিস নিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা সচেতনভাবে মিথ্যাচার করে থাকেন । সম্পূর্ণ হাদিসটি এরূপ ।  ইবনে কাথির উপরি উক্ত      তফসীরে ওই ৩৮৭ পৃষ্ঠাতেই  লিখেছেন,   একট হাদিসে রয়েছে যে  রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ   ‘আল্লাহর দাসীদের প্রহার কর নাএর পর একদা হযরত উমার ফারুক (রাঃ)  এসে আরয করেনঃ ‘নারীরা আপনার এ নির্দেশ শুনে তাদের স্বামীদের উপর বীরত্বপনা দেখাতে আরম্ভ করেছে ।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে মারার অনুমতি দেন ।”    
প্রহার করা নিয়ে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে  অবশ্য কোনো মতভেদ নেই, মতভেদ যা আছে তা কেবল প্রহার করার মাত্রা নিয়ে ।  মতভেদের কারণ হলো মুহাম্মদ যা বলেছেন তাতে  কিছুটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছেকীরূপ প্রহার করতে হবে তা বলতে গিয়ে বিদায় হজ্বে তিনি কী বলেছেন সে প্রসঙ্গে ইবনে কাথির তাঁর উক্ত তফসীরে ঐ একই পৃষ্ঠাতেই  লিখেছেন, সহীহ মুসলিমে নবী (সঃ) – এর বিদায় হজ্বের ভাষণে রয়েছেঃ নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো । তারা তোমাদের সেবিকা ও অধীনস্থা । তাদের উপর তোমাদের হক এই যে, যাদের যাতায়াতের ব্যাপারে তোমরা অসন্তুষ্ট তাদেরকে তারা আসতে দেবে না । যদি তারা এরূপ না করে তবে তোমরা তাদেরকে যেন তেন প্রকারে সতর্ক করতে পারো । কিন্তু তাদেরকে তোমরা কঠিনভাবে প্রহার করতে পার না, যে প্রহারের চিহ্ন প্রকাশ পায় । তোমাদের উপর তাদের হক এই যে, তোমরা তাদেরকে খাওয়াবে ও পরাবে এবং এমন প্রহার করা উচিৎ নয়  যার  চিহ্ন  অবশিষ্ট থাকে, কোনো অঙ্গ ভেঙ্গে যায় বা কোনো অঙ্গ আহত হয় । ”     
 প্রহারের ‘কঠিন’ শব্দটি নিয়েই  প্রবল মতভেদ  দেখা যায়একটি মত  হলো,  মুহাম্মদ স্ত্রীদের হালকা প্রহার করার কথা বলেছেন  । ২য় মতটি হলো, প্রহার করার উদ্দেশ্য  যেহেতু অবাধ্য স্ত্রীকে সোজা পথে আনা , তাই হাল্কা নয়, কড়া প্রহার  করার কথাই বলেছেন মুহাম্মদ যাতে সে ভয় পায় এবং স্বামীর বাধ্য হয়   যাঁরা  হাল্কা প্রহারের মতের পক্ষে তাঁদের অভিমত হলো, হয় চড় বা থাপ্পড় মারবে,  অথবা কিল-ঘুষি মারবে ; তবে সে আঘাত যেন খুব জোরের সঙ্গে না হয় ।   যাঁরা কড়া প্রহারের পক্ষে তাঁরা প্রহার করার জন্যে লাঠি, রড ও চাবুক ব্যবহার করার বিধান প্রদান করেছেন । যাঁরা হাল্কাভাবে প্রহার করা সমীচীন বলেছেন তাঁরা কি ধরণের ‘হাল্কা প্রহার’ হবে সেটাও নির্দিষ্ট  করে দিয়েছেন । বলেছেন, ‘স্ত্রীকে যতখুশী, যতক্ষণ খুশি প্রহার করা যাবে, কিন্তু প্রহারের ফলে যেন শরীরে কোনো চিহ্ন ফুটে না উঠে’ ।  আরও বলা হয়েছে যে, প্রহারের ফলে স্ত্রীর শরীরে যদি চিহ্ন ফুটে ওঠে তবে তা সীমা লঙ্ঘন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে এবং সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ । আরব আমীর শাহী  সংবিধানে এই মতটিকে অনুসরণ করা হয়েছে । সম্প্রতি (২০১০ সালে) একজন প্রহৃত স্ত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত তার রায়ে বলে যে, স্ত্রীকে প্রহার করা স্বামীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার । তবে প্রহারের ফলে স্ত্রীর শরীরে চিহ্ন ফুটে উঠলে তা দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে । সেই রায়ে অভিযুক্ত স্বামীকে কারাদন্ড প্রদান করা হয়, কারণ তার  প্রহারে তার স্ত্রীর গায়ে প্রহারের চিহ্ন ফুটে উঠেছিলো ।
        এ প্রসঙ্গে আরো দুটি কথা না বললে এই আইনটি নিয়ে আলোচনার বৃত্তটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে    প্রথম কথাটি হলো স্ত্রীর অবাধ্যতা নিয়ে । স্ত্রী কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্মতি বা আপত্তি জানালে স্বামীর প্রতি অবাধ্যতা বলে বিবেচিত হবে ?  অসম্মতি ও আপত্তির ক্ষেত্রগুলি এত বিস্তৃত ও ব্যাপক যা আলোচনা করা একটা নিবন্ধে অসম্ভব ।   এখানে তাই  মাত্র একটি ক্ষেত্রই উল্লেখ করতে চাই যেটার  উপর মুহাম্মদ সম্ভবতঃ সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন । ক্ষেত্রটি হলো স্বামীর যৌন-সম্ভোগ । মুহাম্মদ বলেছেন স্বামী যখনই তার স্ত্রীকে সঙ্গম করার উদ্দেশ্যে ডাকবে তৎক্ষণাৎ স্ত্রীকে সেই ডাকে সাড়া দিতে হবে সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন ।  সেই হাদিসটি হযরত তলব ইবনে আলি (রাঃ) হতে বর্ণিত । “তিনি বলেন রাসূলে (সঃ)পাক ইরশাদ করেছেনঃ যে কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিজের প্রয়োজনে ডাকলে সে যেন সাথে সাথে তার নিকটে চলে আসে, এমনকি সে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও ।” ( তিরমযি শরিফ, হাদিস নং ১০৯৮) ।  মুহাম্মদ এ কথা বলেই চুপ থাকেন নি ।  স্বামীর যৌন কামনা তৎক্ষণাৎ পরিতৃপ্ত করতে কোনো কারণে স্ত্রী যদি অসম্মতি প্রকাশ করে তবে  তাকে(স্ত্রীকে) মুহাম্মদ আল্লাহর ফেরেস্তার ভয় দেখিয়েছেন আবু হোরায়রাহ(রাঃ) সূত্রে রাসূলে (সঃ) পাক হতে বর্ণিত হয়েছে। “তিনি বলেছেনঃ স্বামীর শয্যা পরিত্যাগ করে কোনো স্ত্রী রাত কাটালে ভোর পর্যন্ত ফিরিস্তাগণ তার উপর অভিসম্পাত করতে থাকে ।” (মুসলিম শরীফ, ১ম-৮ম খন্ড,  হা নং  ৩৪০৫) । 
স্ত্রীকে বাধ্য করার সমস্ত কদর্য ও বর্বর উপায়গুলি প্রয়োগ করার পরেও যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর বাধ্য না হয় তাহলে কী হবে ? এর উত্তর ৪/৩৪ নং আয়াতে নেই । সে উত্তরও  দিয়ে গেছেন   মুহাম্মদ ।  সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর শিষ্যদের চূড়ান্ত শাস্তি তথা তালাক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেনহযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে উদ্ধৃত করে ইবনে কাথির তাঁর ঐ তফসীরে ঐ পৃষ্ঠাতেই  সে কথা লিখেছেন -  এরপরেও যদি তারা বিরত না হয় তবে ক্ষতিপূরণ নিয়ে  তালাক দিয়ে দাও   এই  তফসীর যে নির্ভুল তা  পাকিস্তানের প্রখ্যাত  ধর্মগুরু মাওলানা মুহাম্মদ আলির বই থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় । তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে (The Religion of Islam: A  Comprehensive Discussion of the Sources, Principles and Practices of Islam - Lahore, 1938 , p-652-653 ) লিখেছেন, “It appears that confining (women) to the house is the first step, and it is when they repeat their evil deeds in the house, or do not submit to the authority of the husband and desert him, that permission is given to inflict corporal punishment, which is  the last resort, and even if this last step does not make them mend their ways, matrimonial relations may be ended.” ( Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat, p-216)   
পরিশেষে যে কথা বলে এই নিবন্ধে ইতি টানতে চাই তা হলো, সৌদি আরব  ‘স্ত্রীকে প্রহার করা নিষিদ্ধ ও দন্ডনীয় অপরাধ’ বলে যে আইনটি করেছে তাতে শরিয়িত আইনের যে স্পষ্ট উল্লঙ্ঘন হয়েছে তা সংশয়োর্দ্ধে ।  তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ সৌদি আরবের প্রাপ্য ।  কারণ, এই আইনটি  প্রণয়ন করা মানে এটা স্বীকার করে নেওয়া যে কোরানকে আঁকড়ে ধরে থাকার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে । মুহাম্মদের নিজের হাতে স্থাপন করা ইসলামি রাষ্ট্রে  এমন পদক্ষেপ নেওয়া যে অত্যন্ত  কঠিন কাজ  তা বলা বাহুল্য   
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এর আগেও সৌদি আরব কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল যেগুলিও ছিলো শরিয়তের পরিপন্থী । সে রকম কয়েকটি ঘটনা হলো - () মুহাম্মদ বলে গেছেন ইহুদিরা অভিশপ্ত জাতি ও ইসলামের শত্রু । সেই ইহুদি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে সৌদি আরব এবং এখনও ইস্রাইলের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক তাদের অব্যাহত রয়েছে । () সে কোন কালে গামেল নাসের মিশরকে ইসলামি শাসন থেকে মুক্ত করে সেখানে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র স্থাপন করে যান । পরে তারাও ইস্রাইলের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করে মুহাম্মদের নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে । সৌদি আরব তথাপি মিশরের সঙ্গেই মৈত্রী বন্ধন  স্থাপন করতে দ্বিধা করে নি । () গত বছর মুসলিম ব্রাদারহুডের মত কট্টরপন্থী সংগঠনের নেতৃত্বাধীন মুরসির সরকারকে মিশরের সেনা-শাসিত সরকার বরখাস্ত করলে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা মিশরের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে । সৌদি আরব কিন্তু তাদের দলে না গিয়ে মিশরের সরকারের পাশেই দাঁড়িয়েছে । () মুসলিম নারীদের গ্ররহের মধ্যেই পর্দানশীন থাকার কঠোর  নির্দেশ থাকায় সৌদি আরবে মুসলিম নারীদের ভোটাধিকার ছিলো না । সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে সম্প্রতি সৌদি আরব নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করেছে । () মুহাম্মদ নিজে হাতে মদিনা থেকে সমস্ত ইহুদীদের হয় হত্যা, না হয় নির্বাসিত, না হয় ধর্মান্তরিত করে মদিনাকে ইহুদিমুক্ত করেছিলেন । এবং মৃত্যুর সময় নির্দেশ দিয়ে যান আরব থেকে সমস্ত অমুসলিমদের তাড়িয়ে আরবের মাটিকে যেন  অপবিত্রতা থেকে অবিলম্বে মুক্ত করে তোলা হয় । সেই নির্দেশ কার্যকর করেছিলেন পরবর্তী খলিফারা এবং আরবের মাটিতে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীবীদের বসবাস ও ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করেছিলেন চিরদিনের জন্যে । সৌদি আরবে সেই আইন আজও বহাল আছে । অথচ কিছুদিন আগে সৌদি আরবের রাজা ভ্যাটকানে গিয়ে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন খৃস্টানদের গীর্জা স্থাপন ও প্রকাশ্যে ধর্মচর্চা করার অধিকার দেওয়া হবে ।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...