Monday, March 31, 2014

মিশরে ৫২৯ জনের মৃত্যুদন্ড নিয়ে এখানে মুসলিম মৌলবাদীরা কুৎসিত রাজনীতি করছে


সম্প্রতি (২৪.০৩.২০১৪) মিশরের একটি আদালত ৫২৯ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে । দন্ডপ্রাপ্তগণ মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যতাদের বিরুদ্ধে একজন পুলিশ আধিকারিককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে । গত বছর ৩রা জুলাই মিশরের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মহম্মদ মুরসিকে সেনাবাহিনি ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে তাঁর দল ও সমর্থকরা গোটা দেশ জুড়ে সহিংস প্রতিবাদ শুরু করে ।  তারই ধারাবাহিকতায় আগষ্ট মাসে দক্ষিণাঞ্চলের মিনা শহরে বিক্ষোভকারীরা কায়রোর দুটি জায়গায় অবস্থান ধর্মঘট করছিলো । আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে ।  সেই সংঘর্ষে একজন  পুলিশ আধিকারিক নিহত হয় এবং আরো অনেক পুলিশ আধিকারিক ও কর্মী আহত হয় । সেই ঘটনায় ১২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে পুলিশ । তাদের মধ্যে একাংশের শুনানী  সম্পন্ন হয়েছেযাদের হয়েছে তাদের মধ্যে  ৫২৯ জনের মৃত্যুদন্ড হয়েছে । বিচারক কিন্তু মাত্র দুটি শুনানীর পরেই তাঁর রায় ঘোষণা করেছেন ।  পরের দিনই আবার সেই একই মামলাতে এবং একই বিচারকের আদালতেই বাকি আরো ৬৮৩ জনের শুনানী শুরু হয়েছে যাদের তাদের মধ্যে রয়েছেন মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মুহাম্মদ বাদায়ী এবং ফ্রিডাম ও জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান সাদ আল কাততানি ।
 এই রায়কে ঘিরে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক শুরু হয়েছে এটা প্রত্যাশিত, কারণ প্রথমতঃ একজনের হত্যার সঙ্গে ৫২৯ জন লোক জড়িত – এটা অবিশ্বাসযোগ্য দ্বিতীয়তঃ মাত্র দুটো শুনানীর শেষেনজিরবিহীনভাবে রায় প্রদান করা হয়েছে   তৃতীয়তঃ প্রথম রায় প্রদানের পরের দিনই বাকিদের বিরুদ্ধে শুনানী শুরু হয়ে গিয়েছে । এত মানুষকে একসঙ্গে মৃত্যুদন্ড প্রদান, এত দ্রুত রায় প্রদান ও  আদালতের এত অতিসক্রিয়তা – এসব নিয়ে স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠেছে বিচারের স্বচ্ছতা ও  অভিসন্ধি নিয়েপ্রশ্ন উঠছে,    বিচারের রায় কি পূর্বনির্ধারিতই ছিলো ?    
কিন্তু এটাও মানতে হবে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে খুব প্রবলভাবে হচ্ছে তা নয়রাষ্ট্রসঙ্ঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকা এ পর্যন্ত এই রায়ের সমালোচনা করেছে রায় ঘোষণার পরের দিনই রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের মুখপাত্র রূপার্ট কোলভিল জেনেভায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে এতজনকে মৃত্যদন্ডের আদেশ দেওয়া হয় নি । বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি কিন্তু এর বাইরে এই রায় নিয়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো নিন্দা বা সমালোচনা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না । এ ঘটনা মুসলিম মৌলবাদীদের খুবই হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে । সেই হতাশা ও ক্ষোভ ফুটে উঠেছে জনৈক মুদাসসির নিয়াজের কলমে । তিনি দৈনিক ‘কলমে’ আজ (৩১.০৩.১৪) একটি নিবন্ধ লিখেছেন যার শিরোনাম হলো- মিশরে বিচারের নামে গণহত্যার আয়জন/নীরব দর্শকের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক সমাজ । এই ‘নীরব দর্শক’ কথাটি আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও   সমান প্রযোজ্য । এখানে - হয়তো সারা বিশ্বেই - নিন্দা বা প্রতিবাদ যেটুকু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তা মূলতঃ মুসলিম সমাজ থেকে । মুসলিম সমাজ বলতে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় সংগঠনগুলি   বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেই নিন্দা ও প্রতিবাদে শোনা যাচ্ছে কেবল , বাকি  গোটা মুসলিম সমাজ একেবারেই নির্বিকার   
 যাঁরা প্রতিবাদে সরব তাঁদের কাছে এই ভূমিকা প্রত্যাশিতই ছিল ।  মিশর সহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলির প্রতিটি ঘটনাতেই তাঁরা দুই বাংলার মুসলিম সমাজের কাছে ধারাবাহিকভাবে  তাঁদের প্রতিক্রিয়া সোচ্চারে ব্যক্তরে থাকেন । তাহরির স্কোয়ারে  আরব বসন্তের যখন সূত্রপাত হয় তখন থেকেই মিশর নিয়ে তাঁরা তাঁদের পত্র-পত্রিকায় প্রতিদিনই সংবাদ, প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন কিছু না কিছু একটা প্রচার করে চলেছেন নিরলসভাবে ২০১১ সালে ২৫শে জানুয়ারী যেদিন মিশরের সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি মুবারক হোসেনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে  টানা তিন দশকের মোবারকের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলো সেদিন গোটা বিশ্বের সাথে মুসলিম সমাজের এই অংশটাও  স্বতঃস্ফূর্তভাবে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল এবং মিশরের জনগণের গণঅভ্যুত্থান তথা আরব বসন্তকে উদবাহু নৃত্য করে স্বাগতম জানিয়েছিল সেদিন তাঁরা আরব বসন্তের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে  সেনাবাহিনীর প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ আবার তাঁরাই আড়াই বছর পর ২০১৩ সালের ৩রা জুলাই যেদিন জনগণের গণঅভ্যুত্থানের ডাকে আর এক দফা সাড়া দিয়ে মিশরের সেনাবাহিনী  কট্টর মৌলবাদী মুহাম্মদ মুরসিকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে উৎখাত করে সেদিন থেকে তাঁদের চোখে সেই সেনাবাহিনীই হয়ে উঠেছে খলনায়ক সেদিন তাঁরা মিশরের গণঅভ্যুত্থানকে ইসলামবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন ।    
একজনকে হত্যার জন্যে ৫২৯ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান এবং যে অস্বাভাবিক দ্রুততা ও তৎপরতায় বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবাদযোগ্য । কিন্তু কোনো অন্যায়-অবিচারকে কখনোই কোনো দূরভিসন্ধি বা জনস্বার্থবনিরোধী কোনো হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার করাও প্রতিবাদযোগ্য অন্যায় উক্ত দন্ডাদেশকে হাতিয়ার করে মুসলিম মৌলবাদীরা বাংলার বুকে সে কাজই করার চেষ্টা করছেন । মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই দিয়ে আদালতের এই দন্ডাদেশের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁরা মিশরের সেনা-সরকারের বিরুদ্ধে যে  প্রচারণা চালাচ্ছেন তা ভীষণ রকমের একপেশে   এই দন্ডাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যে বিবৃতি প্রদান করেছে তা তুলে ধরা সংবাদপত্রের কর্তব্য, কিন্তু তা তাঁরা করছেন না ।  এবং এ  ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় নিয়ে যে প্রচারণা তাঁরা চালাচ্ছেন তাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অর্ধ সত্য, বিকৃত সত্য ও কুৎসিত মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ । আর এসব মিথ্যাচারই শুধু করছেন না, তাঁরা আড়াল করছেন সচেতনভাবে অনেক সত্য ঘটনা ও তথ্য তাঁদের নিজেদের এবং মুসলিম ব্রাদারহুড ও মুরসি সরকারের প্রকৃত স্বরূপ আড়াল করার জন্যে ।
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু মুরসি যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিশরের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করে তার পরিবর্তে  ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের ভয়ঙ্কর অপপ্রয়াসে মত্ত ও মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন সে কথা সজ্ঞানে গোপন করছেন  ঘুরিয়ে তার সেই অপপ্রয়াসকে আড়াল করতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন মুরসি মিসরের মাটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার আন্তরিক প্রয়াস চালাচ্ছিলেন বলে ক্ষমতালোভী গণতন্ত্রবিরোধী সেনাবাহিনী  তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে ।  তাঁরা এই রায়ের নিন্দা ও প্রতিবাদ করছেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে । তাহলো,  মুসলিম মানসে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব ও বিরুদ্ধ মনোভাব গড়ে তোলা এবং তার বিকল্প হিসেবে একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তুলে ধরা ।   
তাঁরা দাবী করছেন যে মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকার তথা  মুরসির সরকার মিশরে ‘ইসলামি-গণতন্ত্র’  প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিলেন সেটা সেনাবাহিনী মেনে নিতে পারে নি ।  ‘ইসলামি-গণতন্ত্র’ – এই শব্দবন্ধটি আমি শুধু হাস্যকরই নয়, চরম বিভ্রান্তিকরওতাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে এটা সোনার পাথরবাটির মতো অবাস্তব, তথাপি এ প্রচারণা চালাচ্ছেন দুটি হীন উদ্দেশ্যে । ওঁরা এটা উপলব্ধি করেছেন যে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে তা আধুনিক যুগে আর উপেক্ষা করা যাবে না । তাই তাঁরা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক শরিয়তি আইনকে ‘ইসলামি-গণতন্ত্রে’র মোড়কে আড়াল করে মুসলমানদের ধোঁকা দিতে চায় । দ্বিতীয় কারণ হলো, মুসলিম ব্রাদাহুড ও মুরসির আসল পরিচয় ও যে লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা মিশরে সরকার পরিচালনা করছিলেন তা গোপন করা । মুসলিম ব্রাদাহুড কী রকম  সংগঠন আর মুরসি  কোন লক্ষ্যে কাজ করছিলেন সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক ।
‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ একটি আন্তর্জাতিক মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন । মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলিতে সর্বত্র এই সংগঠনটির শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে । গণতন্ত্র ও হিংসা – দুটি ধারাতেই এই সংগঠনটি কাজ করে  । সম্প্রতি সৌদি আরব সরকার  এই সংগঠনটিকে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা এবং নিষিদ্ধ করেছে । মিশরে ১৯২৮ সালে এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ লাভ করেছিল মিশরে শরিয়তি শাসনব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে । মিশরের ‘ফ্রিডাম ও জাস্টিস পার্টি’ হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক সংগঠন । মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মুহাম্মদ মুরসি ফ্রিডাম ও জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে ভোটে লড়াই করে রাষ্ট্রপতি হয়ে মিশরের ক্ষমতা দখল করেছিলেন ২০১২ সালের মাঝামাঝি   সেদিন ওরা ভেবেছিলো, এবার পূরণ হলো দীর্ঘ ৮৪ বছর ধরে দেখে আসা মিশরের বুকে শরিয়তি রাজ প্রতিষ্ঠার অলীক স্বপ্ন । তাই মুরসি রাষ্ট্রপতি হয়েই দ্রুত গতিতে শুরু করে দিয়েছিলেন সেক্যুলার মিশরের ইসলামিকরণের (Islamisation of Egypt) কাজ । সে কাজের দু-একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক । মুরসির শাসনেও অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছিলো যার বিরুদ্ধে মিশরবাসী প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন । এর পরিপ্রেক্ষিতে মুরসি সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী আবদেল আজেজ বলেছিলেন,  My concern is providing cultural services throughout Egypt, not financial benefit for a new intellectuals.  মুরসি ও আজেজ কোন সংস্কৃতি মিশরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন  ছিলেন ? তাঁদের সরকার ঘোষণা করেছিল, প্রকাশ্যে ব্যালেট বা ব্যালে নৃত্য প্রদর্শন করার অনুমতি তুলে নেওয়া হবে, চলচিত্রের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে এবং প্রেমের গল্প নিয়ে বানানো চিত্তাকর্ষক চলচিত্রের প্রদর্শনির মত অপসংস্কৃতি  বন্ধ করে সুস্থ সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা হবে । কী সে সুস্থ সংস্কৃতি ?  ব্যালেট বা ব্যালে নৃত্য ও আমেরিকার চলচিত্র সহ আধুনিক ও পাশ্চাত্য শিল্প-সংস্কৃতি মিশরবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় যা মুরসি সরকারের  কাছে  অপসংস্কৃতি , কারণ ইসলামে এগুলি নিষিদ্ধ তাদের কাছে একমাত্র শরিয়তি সংস্কৃতিই সুস্থ সংস্কৃতি । মুরসি সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে এভাবে প্রথম থেকেই মিশরের মানুষের উপর শরিয়তি সংস্কৃতি চাপানোর অপতৎপরতা শুরু করেছিল যা ছিল মিশরের মানুষের পছন্দ ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী ।  এত অপতৎপরতার যাতে মিশরের জনগণ  সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে না পারে তার জন্যে মুরসি একটি ডিক্রি জারি করে নিজেকে আইনের ঊর্দ্ধে স্থাপন করেছিলেন । সেই ডিক্রিতে বলা হয়েছিলো, মুরসি যা বলবেন ও করবেন তাই-ই  আইন, তাঁকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না । এই হচ্ছে মুরসি ও ব্রাদারহুডের ‘ইসলামি-গণতন্ত্রে’র নমুনা ! মিশরের মানুষ  মুবারককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন সামরিক শাসনব্যবস্থার স্থলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, তাঁরা সামরিক শাসনব্যবস্থার চেয়েও নিকৃষ্ট কোনো শাসনব্যবস্থা  মানবেন কী করে ? তাই দেরী করেন নি, আবার তাহরির স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন  মুরসির পদত্যাগের দাবীতে । কত মানুষ জড়ো হয়েছিলো । মুবারকের বিরুদ্ধে যত মানুষ জড় হয়েছিলো তার চেয়েও বেশী । মুরসিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যতো মানুষ ভোট দিয়েছিলো তার চেয়েও বেশী । সেই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব করা একট সংগঠন তামরূদ তখন বলেছিলো , মুরসির পদত্যাগের দাবীতে তাহরির স্কয়ারে পাঁচ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভ-অবস্থানে অংশ নিয়েছিলেন, এত বিপুল সংখ্যক মানুষ কিন্তু হোসনি মুবারকের পদত্যাগের দাবীতে তাহরির স্কয়ারে জমায়েত হয় নি । তামরূদ আর বলেছিলো, দু কোটি কুড়ি লক্ষ মানুষ মু্রসির পদত্যাগের দাবীপত্রে স্বাক্ষর করেছে যা পার্লামেন্ট নির্বাচনে মুরসির প্রাপ্ত ভোটের দ্বিগুণমুরসি এক কোটি ত্রিশ লক্ষ ভোট পেয়ে প্রেসিডেণ্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন । মুরসির সরকারকে সেনাবাহিনী কেন ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো এই হলো তার প্রেক্ষাপট যা সচেতনভাবে গোপন করছেন মুসলিম মৌলবাদীরা  । এটা মুসলিম ব্রাদারহুড এবং মুরসির সরকারের আসল স্বরূপকে আড়াল করার ওঁদের হীন কৌশল বৈ নয় ।
‘ইসলামি-গণতন্ত্রে’র  কথা থাক, এবার আসা যাক ইসলামি মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের কথায় । তাঁরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আধুনিক যুগের মানবাধিকারের সমস্ত তাগুত (মানুষের তৈরী)  নীতিকে ঠেস দিয়ে, বিদ্রূপ করে, আক্রমণ করে বারবার একটা দাবীকে সোচ্চারে ঘোষণা করছেন যে,  একমাত্র ইসলামই মানুষের সকল প্রকার মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং সকল মানুষকে ন্যায়বিচার দিতে সক্ষম । আর সেই দাবীকে বিশ্বাসযোগ্য করার প্রয়াসে তাঁরা একদিকে অনেক সত্যকে যেমন আড়াল করছেন তেমনি অপরদিকে অনেক মিথ্যা প্রচারণার জালও অবিরাম বুনে চলেছেন । এক্ষেত্রে ওঁরা কোন সত্যটা গোপন করছেন ? গোপন করছেন ওই মৃত্যুদন্ডাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মিশর সরকারের দেওয়া বিবৃতিটা সেই বিবৃতিতে সরকার বলেছে যে, এই রায়ই শেষ কথা নয় । মিশরের গ্রান্ড মুফতি আছেন তিনি পুরোটা খতিয়ে দেখবেন, তারপর চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে ২৮ শে এপ্রিল । এর মধ্যে অভিযুক্তরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করতে পারবেন, সে সুযোগ তাঁদের আছে । এই বিবৃতির পর  আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন যে, ৫২৯ জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, এই  রায় লঘু হওয়ার পুরো সম্ভাবনা রয়েছেতাঁরা বলছেন,  এমনকি সরকার নতুনভাবে আবার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আদেশ দিতে পারে  । এ সব সংবাদ যথাসম্ভব আড়াল করতে চাইছেন এ দেশের মুসলিম মৌলবাদীরা উদ্দেশ্য হলো মিশরের সেনাবাহিনীকে সাক্ষাৎ দৈত্য-দানব রূপে চিত্রিত করে মুসলিম ব্রাদারহুড ও মুরসিকে গণতন্ত্র ও  মানবাধিকারের বিশ্বস্ত ফেরিওয়ালা রূপে তুলে ধরা
ইসলাম যেমন সকলের মানবাধিকার সুরক্ষিত করেছে, তেমনি কেউ যাতে  ন্যায়বিচার  থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যবস্থাও সুনিশ্চিত করেছে –  মুসলিম মৌলবাদী ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীদের এই দাবী সম্পর্কে অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে মুসলিম সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এখনও প্রবল বিশ্বাস ও মোহ রয়েছে ।  এরূপ দাবীর কি সত্যি সত্যিই কোন ভিত্তি আছে ?
ঈশ্বরকেন্দ্রিক কোনো ধর্মেই প্রকৃত মানবাধিকারের স্থান নেই ।  ইসলাম তার ব্যতিক্রম তো নয়ই, বরং ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে ইসলামি আইনে যে সব শাস্তির বিধান রয়েছে তাতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপাদান রয়েছে যতটা অন্যান্য ধর্মে ততটা নেই । ইসলামি আইনে চুরির শাস্তি হলো হাত কেটে নেওয়া এবং ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে মেরে অভিযুক্তকে হত্যা করা ইসলামি আইনে কারো কোনো স্বাধীনতা নেই । একজন মুসলমান যদি তার ধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারায় তবে তারও শাস্তি মৃত্যুদন্ড ।   ইসলামি আইনের এই বিধানগুলি থেকে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে  একমাত্র ইসলামেই মানবাধিকার সুরক্ষিত বলে ঢাক পেটানো হয় তা কত বড়ো নগ্ন মিথ্যাচার ।  একই রকম নগ্ন মিথ্যাচার করা হয়  এরূপ দাবী করে যে ইসলামই কেবল সকলকে ন্যায়বিচার দিতে পারে । আসল কথা হল, ইসলামি আইনে অমুসলিমদের কোনো সুবিচার পাওয়ার স্থানই নেই । সৌদি আরব  সহ কয়েকটি ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব লাভের, আপন ধর্ম পালনের, ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপনের, রমযান মাসে দিনের বেলায় অন্নজল গ্রহণের অধিকার নেই । এই আইনগুলি সম্পূর্ণই ইসলাম সম্মত । মুহাম্মদ মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন আরব থেকে সমস্ত অমুসলিমদের তাড়িয়ে দিয়ে আরবের মাটিকে পবিত্র করতে ও পবিত্র রাখতে ।
মিশরের একটি আদালতের উক্ত রায়কে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি জঘন্য ও নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত বলে যে দাবী তাঁরা করছেন সেটাও তাঁরা করতে পারেন না । প্রথমত তাঁদের এমন দাবী করার  নৈতিক অধিকার নেই, দ্বিতীয়ত দাবিটি অসত্য । একটু আগেই উল্লেখ করেছি যে, ইসলামি আইনে কীভাবে লঘু অপরাধেও চরম শাস্তির (মৃত্যুদন্ড) ব্যবস্থা রয়েছে, আর মৃত্যদন্ডতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের  ঘটনার মধ্যেই পড়ে । ইসলামের ইতিহাস ও মুহাম্মদের জীবনী থেকেও জানা যায় অতি তুচ্ছ কারণে অসংখ্য অমুসলিমদের প্রাণদন্ড দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সে রায় পুনর্বিবেচনার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয় নি । সে রকম একটি ঘটনা এরূপঃ- ৬২৭-২৮ খৃষ্টাব্দে মদিনার প্রায় ৭০০/৮০০ ইহুদীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিলো । তাদের বিরুদ্ধে  হত্যা, বা   চুরি  বা  ধর্ষণের  কোনো অভিযোগ ছিলো না । অভিযোগ ছিল শুধু বিশ্বাসভঙ্গের, খন্দক যুদ্ধে তারা নাকি গোপনে কোরাইশদের সাহায্য করেছিলো ।  সেই তথাকথিত লঘু অপরাধের জন্যে তাদেরকে মুহাম্মদ ১৫দিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন । অবশেষে তারা  প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যে,  তাদেরকে ছেড়ে দিলে বনি-কানুইকা ও বনি-নাজির গোষ্ঠীর মতো তারাও সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর  সম্পত্তি ফেলে রেখে  অন্যত্র চলে যাবে ।  কিন্তু মুহাম্মদ সে প্রস্তাব  প্রত্যাখান করে তাদের বিরুদ্ধে বিচারের আয়োজন করেছিলেন । আর সে বিচারটাই ছিলো সম্ভবতঃ পৃথিবীর সবচাইতে প্রথম  প্রহসন । ‘মানবাধিকার সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রদানের’ সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ইসলাম ধর্মের প্রবক্তা মুহাম্মদের তত্ত্বাবধানে যে বিচার নামক প্রহসনটি হয়েছিল তার রায় ছিল এরূপঃ- ‘ইহুদী পুরুষদিগের প্রাণদন্ড হইবে, স্ত্রীলোক এবং বালক-বালিকাগণ দাস-দাসীরূপে পরিগণিত হইবে এবং ইহুদীদিগের সমস্ত সম্পত্তি মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করিয়ায়া দেওয়া হইবে ।’ (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা, পৃ-২০৬) যাদের প্রাণদন্ড হয়েছিলো তাদের সংখ্যা ছিলো ৫২৯ জনের চেয়েও অনেক বেশী । সেই সংখ্যাটা কত এবং কী নৃশংসভাবে স্বয়ং মুহাম্মদের তত্ত্বাবধানে সেই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো তার কিছুটা বর্ণনা পাওয়া Sir W. Muir – এর লেখা থেকে । তিনই লিখেছেন, The butchery began in the morning, lasted all day,and continued by torch light till evening. Having dusk drenched the market place with blood of seven to eight victims and having given command for te earth to be smoothed over their remains. 
 উপরের আলোচনার পর এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে,  ইসলামে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার সুরক্ষিত আছে – এমন দাবীর কোনো ভিত্তি নেই, এবং এর চেয়ে বড়ো মিথ্যা হয় না । পরিশেষে যেটা বলতে চাই – ৫২৯ জনের মৃত্যুদন্ডের যে রায় দিয়েছে মিশরের আদালতটি তা নিশ্চয় নিন্দাযোগ্য ও প্রতিবাদযোগ্য । কিন্তু সেই রায়কে কেন্দ্র করে  এখানে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা যে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তাও নিন্দনীয় ও প্রতিবাদযোগ্য ।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...